বিন্নি ধানের খই পর্ব-৫০

0
3539

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫০
#মিদহাদ_আহমদ

দুরদুর বুকে আমি মেসেজটা ওপেন করলাম। একবার চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে যেনো ভেসে উঠলো আমার বাবার শাদা কাফন পরানো দেহের ছবি। বাবা উঠে বলছেন, ‘আমার স্বপ্ন তোকে পূরণ করতেই হবে’

আমি এক দীর্ঘশ্বাস নিলাম। চোখ খুললাম। পৃথিবী সমান আশা আমার সামনে ভেসে উঠলো। এই মুহূর্তের আগে আমি কল্পনাও করিনি আমার জন্য এতোটা আবেগমাখা স্বপ্নের দিন কখনো আসবে৷ ওপেন করলাম মেসেজ৷ খোদার হাতে সপে দিলাম আমার স্বপ্ন। মেসেজটা দেখার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। মেসেজটায় লেখা,

MBBS Admission
Result Info:
Roll: 2102591
Status: Not eligible

আমি বুঝে উঠতে পারলাম না কী করবো। আমার সামনে অন্ধকার ছেয়ে আসলো। আসিফ বললো,

‘কী হলো? কী মেসেজ?’

আমি মোবাইলটা আসিফের দিকে তাক করালাম। আসিফ মেসেজ দেখে সহাস্যে বলে উঠলো,

‘আরে চিল। কোন বিষয় ই না। তুমি যে এত বড় একটা এক্সামে বিয়ে, সংসার সামলে অংশ নিয়েছো এটাই অনেক।’

শাশুড়ি সামনেই ছিলেন৷ শাশুড়ি আমার কাধে হাত রেখে বললেন,

‘এই মেয়ে, এতো মন খারাপ করলে হয়? জীবন তো একটাই৷ উপরওয়ালা আমার এত সুন্দর লক্ষ্মীমন্ত বউকে কষ্ট দিতে চাননি। মেডিকেলে পড়লে হয়তো কম কষ্ট করতে হতো না তোমায়। দেখি আমি রান্নাঘরে যাই। কিছু রান্না করে আসি।’

আমি মনে মনে অবাক হলাম। আমার শাশুড়ি আজ দুই মাস হলো রান্নাঘরে যান না। আজ শুধু আমার জন্য রান্না করতে রান্নাঘরে যাবেন? শুধু আমাকে খুশি করতে?

আমি নিজেকে সামলে নিলাম। একজন সাধারণ পরীক্ষার্থীর আগে আমি একজনের স্ত্রী, একজনের পুত্রবধূ, কারোর ভাইয়ের বউ, কারোর ভাবি। আমাকে আমার সংসারধর্ম পালন করতে হবে৷ শাশুড়িকে বললাম,

‘না না মা। আপনি কেন রান্না করতে যাবেন? কোন কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি ‘

‘না না। আমি যাই। আমি যাই। তোর কচু চিংড়ি দিয়ে লতা পছন্দ না? আজ আমি রান্না করবো দাঁড়া।’

শাশুড়ি চলে গেলেন হেলেদুলে। আমি রুমে এলাম। বিছানায় বসলাম। আসিফ মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আমার গালে হাত দিয়ে ধরে টেনে বললো,

‘এই মেয়ে? কী হলো? হয়নি আবার হবে৷ এমন মন খারাপের দরকার আছে বলো? আমার মিষ্টি বউয়ের মুখে এমন গুমট ভাব মানায়?’

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আসিফ আমার মাথায় হাত দিয়ে ধরে বললো,

‘আরে না না৷ বাচ্চা নাকি। কিছুই হয়নাই তো।’

আমি আসিফকে জড়িয়ে ধরলাম। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। হাউমাউ করে কান্না করলাম। আসিফও আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর আসিফকে ছাড়লাম। সে টিস্যু এনে আমার চোখ মুছিয়ে দিলো। পানি এক গ্লাস সামনে এনে বললো,

‘খাও।’

আমি পানি খেলাম। মায়ের নাম্বার থেকে সেই মুহূর্তে কল এলো৷ আসিফ মোবাইল নিয়ে চলে গেলো রুমের বাইরে। আমার চোখের সামনে আমার বাবার স্বপ্ন ভেসে এলো৷ আমার মায়ের দোয়া উঠে এলো৷ আমার অসহায় বিধবা মা আর আমার এতিম দুই ভাইয়ের জন্য কিছু করার যে বাসনা ছিলো আমার সেই বাসনা যেনো উবে গেলো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা থাকলেও সূর্যের তীব্র কিরণ আমাকে ঘিরে ধরলো। আমার স্বপ্ন, আমার ইচ্ছা, আমার ভালোলাগা সবকিছু যেনো উপর ওয়ালার ইচ্ছায় আমার থেকে যোজন যোজন দূরে চলে গেলো৷ শ্বশুর রুমের দরজায় এসে কাশি দিলেন এমন সময়ে৷ আমি উঠে দাঁড়ালাম। শ্বশুর ভেতরে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

‘মারে, জানিস মেয়েদের ভাঙ্গতে নেই। এই এক জাতিই তো পুরো দুনিয়া ঠিকিয়ে রেখেছে। আজ যদি একটা নুপুর ভেঙ্গে যায় তাহলে আগামীকাল হাজারটা আসিফ ভেঙ্গে যাবে। জানিস ই তো এটাই সৃষ্টির নিয়ম যে যুগে যুগে আমাদের মায়েরা, আমাদের মেয়েরা শক্ত হাতে সবকিছু সামাল দিয়েছে। পরীক্ষাই তো এইটা তাইনা?’

আমি শ্বশুরের কথার কোন জবাব দিলাম না। শ্বশুর আমাকে বিছানায় বসালেন। চেয়ার টেনে এনে নিজে বসলেন। বললেন,

‘তোকে একটা গল্প শুনাই মা। একবার এক রাজার একজন মন্ত্রী ছিলো। মন্ত্রী খুবই খোদাভীরু একজন মানুষ। সব কিছুতে মন্ত্রী বলতো, যা হয়েছে সব আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে এবং মঙ্গলের জন্যই হয়েছে। একবার হলো কি, রাজা গিয়েছেন জঙ্গলে শিকার করতে। সাথে রাজার ওই খোদাভীরু মন্ত্রীও ছিলো। রাজা হরিণ শিকার করার সময় ভুলে ভুলে তার নিজের বর্ষা নিজের পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে গেথে যায়। প্রাসাদে আসার পর রাজবৈদ্য সেই বর্ষাটা বের করে আনেন এবং রাজার সেই বুড়ো আঙুল ও কেটে ফেলেন। রাজা চিরতরে আঙুল হারালেন। মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতেও কি মঙ্গল?’

মন্ত্রী বললো,

‘জি জাহাপনা। এতেই আপনার মঙ্গল। এবং এটা ভালোর জন্যই হয়েছে৷ আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।’

রাজা রেগেমেগে একেবারে আগুন হয়ে গেলেন। মন্ত্রীর এত বড় সাহস সে রাজার এই পায়ের আঙুল চিরতরে কেটে ফেলাকে মঙ্গল বলছে? রাজা মন্ত্রীকে জেলে বন্দি করে ফেললেন। এভাবে কেটে গেলো বছর আটেক।

একদিন রাজা আবার জঙ্গলে গেলেন শিকার করার জন্য। এবার ভুলক্রমে তিনি বন মানুষদের কবলে পড়লেন। তারা দলবেধে রাজাকে নিয়ে গেলো তাদের সর্দারের কাছে। তাদের কোন এক পূজা ছিলো সেদিন৷ পূজোর নিয়ম একজন জীবন্ত নিঁখুত মানুষকে দেবতার উৎসর্গে বলি দিতে হবে। রাজার অবস্থা একদম নাজেহাল। তারা সবাই রাজাকে ধরেবেধে নিয়ে গেলো বলি দেয়ার জন্য। রাজার জীবন যায় যায় অবস্থা। যখনই রাজাকে তারা বলি দিবে, তারা দেখতে পেলো রাজার পায়ের বুড়ো আঙুল নেই। তাদের সর্দার বলি আটকে দিলেন। একজন খুত ওয়ালা মানুষকে তাদের দেবতার উৎসর্গে বলি দেওয়া যাবে না৷ তারা রাজাকে ছেড়ে দিলো। রাজা চলে এলেন তার প্রাসাদে। এসে তিনি মনে মনে ভাবলেন, তিনি যারপরনাই বেঁচে গেলেন এইবার। পরেরদিন রাজা জেলখানায় গেলেন৷ দেখলেন মন্ত্রীকে। মন্ত্রী এক সময় তার শিকারের সঙ্গী ছিলো তাই তাকে তিনি সব খুলে বললেন কী কী হয়েছিলো। মন্ত্রী বললো, দেখেন রাজা মশাই আপনার পায়ের আঙ্গুল কাটায় আমি বলেছিলাম না এতেই আপনার মঙ্গল? দেখলেন তো? আপনার মঙ্গল এতেই? আজ আপনার মাঝে খুঁত থাকায় আপনি বেঁচে গেলেন। নাহলে আপনাকে বলি হতে হলো। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।

রাজা অবাক হলেন৷ সত্যিই তো। আজ তার পায়ের এই খুঁত না থাকলে তিনি হয়তো বেঁচেই থাকতেন না। তারপর রাজা আবার মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এইযে তোমার জীবন থেকে আট বছর চলে গেলো, এতেও কি তোমার প্রভুর ইচ্ছা এবং ভালোর জন্যই?’

মন্ত্রী এবার কায়মনোবাক্যে জবাব দিলো,

‘হ্যাঁ জাহাপনা। আমার মঙ্গলের জন্যই।’

‘যেমন?’

‘যদি আপনি আমাকে বন্দি না করতেন তাহলে এবার আপনার শিকারের যাত্রায় আমিও থাকতাম। বন মানুষেরা আমাকেও আপনার সাথে বন্দি করে নিয়ে যেতো। তারপর যখন আপনার পায়ে খুঁত দেখতো আর আমি একজন নিঁখুত মানুষ সাথে থাকতাম তখন তারা আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলি দিয়ে দিতো। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন৷ এজন্যই আপনি আমাকে বন্দি করেছেন।’

‘কী? কী বুঝলা বউমা? মন খারাপ কি আছে এখনও?’

শ্বশুরের বলা গল্পটা শুনে আমার ভেতরটা কেমন প্রশান্ত হয়ে উঠলো৷ আমি খুশি হয়ে গেলাম। শ্বশুরকে বললাম,

‘না বাবা। আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন৷ এতেও হয়তো আমার ভালো আছে।’

রাতে আসিফ আমাকে বুঝালো যে এসব কিছু না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আবার যেনো চেষ্টা করি। পরেরদিন দুপুরে শাশুড়ি আমাকে ডেকে নিয়ে ওনার মাথায় হাত ছুইয়ে কসম কাটালেন, আমি যেনো আর পড়াশোনা না করি। শাশুড়ি অনুনয় করে বললেন,

‘মা রে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না এতো জ্বালা যন্ত্রনা। এখন আমি চাই তুই আমার সংসার সামাল দে। আমার ঘরটা আলোকিত করে রাখ৷ আমাকে মুক্তি দে।’

আমি শাশুড়ি মায়ের কথা আর ফেলতে পারলাম না। মনে মনে শপথ করলাম, আমি আর পড়াশোনা আগাবো না।

আসিফ এরপর অনেকবার চেষ্টা করেছে আমাকে মুভ অন করানোর। আসিফকে বুঝতে দেইনি আমার ভেতরে চেপে থাকা ইচ্ছাগুলো। তাকে বলেছি শুধু যে আমার পক্ষে আর পড়ালেখা কন্টিনিউ করা সম্ভব হবে না। আমার আর ইচ্ছা নেই পড়ালেখা আগানোর। আসিফ বেশ কয়েকবার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলো। এও বলেছিলো যে আমি যেনো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকি কমপক্ষে। কিন্তু আমার সিদ্ধান্তের কাছে বরাবর শাশুড়ির অনুরোধ ভেসে উঠেছিলো। তাই বারবার তাকে না করে দিয়েছিলাম। আমি চেপে রেখেছিলাম আমার স্বপ্নের আধারকে।

সপ্তাহ খানেকের মাথায় ননাসকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। আল্লাহর অপার মহিমা, ননাস সুস্থ হয়ে গেলো পুরোপুরি। সব ধরণের জটিলতা যেনো কেটে গেলো একসাথে। এরই মাঝে মাস নয়েক কেটে গেলো। ননাস আবার আগের মতো হয়ে উঠেছেন। তার বেকিং বিজনেস এখন রমরমা। শহরে নামকরা বেকিং পেইজ তার। বাসায় তিনজন হেল্পিং হেন্ড ও রেখেছেন ননাস। প্রতিদিন অর্ডার আসে কমপক্ষে পঞ্চাশ ষাট টা কেক। এই কেক নিয়ে যখন ননাস মেতে থাকেন সর্বক্ষণ, তখন এক অপার আনন্দ অনুভব হয়৷ এদিকে বদরুলকে লন্ডন নিয়ে গিয়েছে তার মামাতো বোন। ফ্ল্যাট আর তাদের দুই তলা বাসা বিক্রি করে দেড় কোটি টাকা দেয়ার বিনিময়ে সে লন্ডন গিয়েছে।
মাস নয়েক পর তামান্নার একটা টুকটুকে ছেলে হলো৷ শ্বশুর শাশুড়ি আনন্দে আত্মহারা। ননাস, আমি, শ্বশুর, শাশুড়ি, আসিফ সহ সবাই গেলাম তামান্নার ছেলেকে দেখতে৷ বাড়িতেই হয়েছে নরমাল ডেলিভারি। যদিও শুনেছিলাম অবস্থা বেগতিক তার পরও তারা তামান্নাকে ডাক্তারে নেয়নি। ধাত্রী এনে বাড়িতেই ডেলিভারি করিয়েছে। তামান্নার শাশুড়ি আমার শাশুড়িকে বললেন,

‘এখন নাতির নানা বাড়ি থেকে নুয়াই নিয়ে আসছেন কবে? আমরা কিন্তু এক হাজার দাওয়াত দিবো। আগে বলে দিলাম। বড়লোক নানার প্রথম নাতি বলে কথা।’

‘কোন সমস্যা নেই। আপনি চিন্তা করবেন না। গরু দুইটা দিয়েই আমার নাতির নুয়াই হবে। নানাবাড়ি থেকে নিয়ে আসার কোন কমতি হবে না।’

খাওয়ার পর শাশুড়ি আর তামান্না রুমে বসে গল্প করছিলেন৷ আমি মায়ের সাথে কথা বলায় ছিলাম। কথা বলার এক পর্যায়ে জানালার পাশে থেকে শুনতে পাই শাশুড়ি তামান্নাকে বলছেন,

‘আল্লাহ যা করেছেন ভালোর জন্যই করেছেন৷ যদি নুপুর মেডিকেলে চান্স পেয়ে যেতো তাহলে আমার সংসার কর্ম দেখা সব উচ্ছন্নে যেতো। আমি এখন শান্তি। নুপুর আমার লক্ষ্মীমন্ত বউ। সে কেন ডাক্তার হবে? যেমন আছে তেমন ঘরকন্নার দায়িত্ব পালন করবে ‘

কথাটা শুনে আমার চোখ দিয়ে জল গড়ালো। আমার স্বপ্ন ভঙ্গের চেয়েও বেশি কষ্ট অনুভূত তখন তখন, যখন জানতে পারলাম আমার চান্স না হওয়াতে আমার শাশুড়ি খুশি হয়েছে। আর আমি তো তাঁর কথায় ই সেকেন্ড টাইমের প্রিপারেশন নেইনি। আসিফ আমাকে ঠিক ই বলেছিলো আমার চেষ্টা করার। কিন্তু সেই চেষ্টা আমিই যে না করে দিয়েছিলাম। আর আজ? আমার স্বপ্নের কাছে তাদের সংসারধর্ম বড় হয়ে উঠলো? আমার স্বপ্ন নয়?’

পুরো পৃথিবীকে আমার চোখের সামনে ছোট মনে হলো। আর্তনাদ ছেয়ে বসলো আমার শব্দহীন মন জুড়ে। একটা স্বপ্ন ভঙ্গের চেয়েও বেশি দুঃখ ভর করে যখন স্বপ্ন ভঙ্গে কারো আনন্দ উৎযাপন দেখা যায়৷ অদেখা অনেককিছু মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। ভাঙ্গা স্বপ্ন মানুষকে শেষ করে দেয় ভেতর থেকে। এই স্বপ্নেরা আকাশে উড়ে বেড়ানোর আগেই উবে যায়।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here