#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_০৪
#মিদহাদ_আহমদ
মাস দুয়েক যেতে না যেতেই শাশুড়ি সবার সামনে প্রকাশ্যে বলে বেড়াতে লাগলেন, আমার মামাকে চার লাখ আর আমার মাকে তিন লাখ টাকা দিয়ে আমাকে এনেছেন তিনি এই ঘরে। আত্মীয়-স্বজন সবার সামনেই যেনো আমি এক লোভী, অপরাধী হয়ে উঠলাম। আমার আত্মসম্মান বলে কোনকিছুই এই বাড়িতে নেই যেনো। বাড়িতে গিয়ে গতমাসে মামাকে এনে সামনাসামনি আমি জিজ্ঞেস ও করেছিলাম, কেন তিনি আমার সাথে এমন করলেন! কেন তিনি আমাকে জেনেশুনে এই নরক যন্ত্রনার মাঝে ঢাললেন! যে ছেলের রাত কাটে মদের বার আর নারীতে মত্ত হয়ে, যে ছেলে আমাকে বিয়ে করতে অসম্মতি জানিয়েছিলো, যে ছেলের সাথে আরও কত মেয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, জেনেশুনে কেন সেই ছেলের ঘরে আমাকে পাঠালেন!
মামা সেদিন আমাকে জবাব দিয়েছিলো,
‘আমার বোনকে তোর বাবার ঘরে বিয়ে দিয়ে আমি কী পেয়েছি? আমার একমাত্র বোন বাসন মাজতে মাজতে, সংসারে বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে, মাটির বেড়া দেওয়া ঘর আর ধান মাড়াতে মাড়াতে জীবন পার করে দিলো। আমি মামা হয়ে এই একই জীবন তোকেও দেখতে দিতে পারতাম?’
মাও এসে মামার সাথে এক হয়ে গেলো যেনো! মা আমাকে বসিয়ে বুঝালো
‘দেখ মা, তোর এত বড় বাড়ি আছে, আলিশান আছে৷ শ্বশুর, শাশুড়ি পরিবার আছে। দুবেলা দুই মুঠো খেতে পারছিস। আর কী চাই?’
আমার ফ্যালফ্যাল করা চোখে তখন আর আটকাতে পারলো না৷ কান্না আসা চোখ নিয়ে মাকে বললাম,
‘আমি কি আমার বাবার ঘরে অভুক্ত থেকেছি মা? তুমি কি একদিনও অভুক্ত থেকেছো? বাবা কি তোমাকে এক দিনের জন্যও মানসিক কষ্টে রেখেছিলো?’
মা বললো,
‘দেখ মা, মানসিক কষ্টের চেয়েও বড় কষ্ট কী জানিস? না পাওয়া। আমার না পাওয়া আমাকে আজীবন শেষ করে দিয়েছে। আমি চাই না আমার এই না পাওয়া আমার মেয়েকে ভর করুক।’
তারপর মা আমার সামনে তার হাত দুইটা তুলে ধরে দেখিয়ে আমাকে বললো,
‘এই দেখ! এই দেখ আমার হাত দুটো। কী দেখছিস? রঙ উঠা দুই গাছা সিটি গোল্ডের চুড়ি তাইনা? এই হাতে কখনো স্বর্ণ কী জিনিস আমার চেখে দেখা হয়নি। দেখ তোর হাত দু খানা। দুই দুই করে চারগাছা স্বর্ণের চুড়ি। কে পরেছে এমন? আমাদের আশেপাশের কোন ঘরের মেয়ে এমন স্বর্ণের চুড়ি পরে আছে? হাতের দশ আঙুলের মাঝে পাঁচ পাঁচটা স্বর্ণের আংটি, নাকে হীরার নাকফুল, গলায় ভারি চেইন, এসব কার আছে? কাদের আছে রে মা? এই মা কি কখনো তার মেয়েকে এমন দেখতে চায় না? এমন দেখাও কি পাপের?’
আমার ভেতরতা আরও নিশ্বেষ হয়ে যেতে লাগলো। আমার হাতের স্বর্ণের চুড়ি যে আমাকে চিরতরে বেধে রেখেছে! আমাকে কুন্ঠিত করে রেখেছে নিজের স্বপ্নের কাছে, নিজের ইচ্ছার কাছে, নিজের সবকিছুর কাছে। বাবা এমন সময় ঘরে এসে ঢুকলেন৷ আমি বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন কেমন আছি৷ সবাই কেমন শ্বশুরবাড়িতে। আমি অবলীলায় মুখে হাসি এনে মিথ্যা বলেছিলাম বাবাকে,
‘আমি খুব ভালো আছি।’
বিকালেই গাড়ি চলে আসে আমার বাবার মাটির বেড়া আর টিনের চালা দেয়া বাড়ির সামনে। টয়োটা প্রভোক্স নাম। কালো রঙের গাড়ি। যেনো চকচক করছে! আমার ছোট ভাই বোনেরা গাড়ির সামনে পিছে থেকে সরছেই না যেন! আমাকে এসে জিজ্ঞেস করছে,
‘আপু এই গাড়িটা দুলাভাইয়ের গাড়ি? সত্যিই নাকি?’
সহাস্যমুখ এনে ভাইদের বলেছিলাম,
‘হ্যাঁ এইটা তোদের দুলাভাইয়ের গাড়ি।’
ভেতরে ভেতরে আমি আবার নিষ্পেষিত হচ্ছিলাম কাকে আমার ভাইদের পরিচয় দিচ্ছি দুলাভাই হিসাবে! সেই পাষণ্ড অমানুষকে?
আমি বের হওয়ার সময়ে সেদিন মায়ের ঠিক আগের কান্ডই চলতে লাগলো। সবাইকে ডেকে এনে আমাকে বিদায় দেয়া। আমার বুঝতে বাকি রইলো না, এই বিদায়ের মাঝে ছিলো লোক দেখানোর বিদায়। মা আমাকে না, বরং আশেপাশের বাড়ির লোকদের ডেকে এনেছিলো আমার গাড়ি দেখানোর জন্য! মানুষের স্বপ্ন এমনও হতে পারে! অথচ আমার যে কখনো এসবে টানতো না। আমার যে এসবে আকৃষ্ঠ করতো না।
এদিকে শাশুড়ি আর ননদ ননাস মিলে আমার জীবনটাকে নরকে পরিণত করে দিতে লাগলো। রাতে ইয়াশ দেরি করে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরতো রোজ রোজ৷ ননাস কল করে আর নাহলে সকালে বাসায় এসে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে সে কী কথা শুনাতো আমাকে!
অশালীন ভাষার বহর আর সাথে সাথে বলতো,
‘নারী হয়ে জন্মেছো, জামাই ধরে রাখতে পারো না? নাকি জামাই ধরে রাখার কোন মতলব নাই? কোনটা?’
আমি শুধু নীরবে সয়ে যেতাম এসব। কোন কথা বলতাম না। কোন প্রতিবাদও না৷ আমার ভেতরের আমিটা যেনো কোথায় মারা গিয়েছিলো, সেইটা হয়তো আমিও জানি না।
প্রথম রমজানের ইফতারে আমার শ্বশুরবাড়ির সবার মন ভরেনি। আগামীকাল রমজানের বড় ইফতারি আসবে আমার বাড়ি থেকে। শাশুড়ি শুনলাম সকাল থেকেই একে ওকে দাওয়াত দিচ্ছেন আর বলছেন, ‘আগামীকাল আমার ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে বড় ইফতারী আসবে৷ আপনারা সবাই চলে আসবেন।’
শ্বশুর এদিকে প্যান্ডেল বাধাতে লাগলেন ছাদে। শাশুড়ি এসে বললেন,
‘শুনো, বেশি কাওকে বলিনাই। একান্ত কাছের লোকজন, আত্নীয়-স্বজন সব মিলিয়ে দাওয়াত দিয়েছি দেড়শো জনের মতো। তোমার বাবাকে আগেই কল করে জানিও দিও যে কমপক্ষে দুইশো লোকের ইফতারি যেনো পাঠায়। আর ঈদের কাপড় এখন দিতে সমস্যা হলে, এখন দেওয়ার প্রয়োজন নেই৷ ঈদের বাকি আছে সপ্তাহ দুয়েক। কয়েকদিন পর ঈদের কাপড় দিলে চলবে।’
শাশুড়ির বলা কথাগুলো আমি নীরবে শুনলাম শুধু। নিরুপায় একদিনে আর অন্যদিকে ক্ষোভে, রাগে মাকে কল করে বললাম,
‘শুনো মা, তোমার বড়লোক মেয়ের সম্মান তো তোমাকে দেখতে হবে তাইনা? এসব ফকিন্নি ঘরের ইফতারি তো আমার বাড়িতে দিলে চলবে না। আর প্রথম রমজানে যা দিয়েছো, তাতে আমার মান থেকে অপমান বেশি হয়েছে। আগামীদিনের ইফতারিতে কি কি দেয়ার পরিকল্পনা চলছে জানতে পারি কি?’
মা আমাকে বললেন,
‘আরে আমি বুঝেছি মা। আসলে তোর বাবার হাতে টাকা ছিলো না তো। এখন দেখ, তোর বাবা ধান বিক্রি করেছে গত সপ্তাহে তোর বাসায় ইফতারি দিবে বলে। খুব ঘটা করেই দিবে। তুই কোন চিন্তা করিস না। আমরা সবকিছু দিয়েই দিবো যাতে তোর কোন শরম না হয়। তোর বাবা বলেছে আগামীকাল সব মিলিয়ে চল্লিশ জনের ইফতার আমরা পাঠাতে পারবো। টাকা বারো হাজার লোকটা আলাদা করেই রেখেছে তোর বাড়িতে ইফতারি দিবে বলে। সবকিছু কিনেই পাঠাবো৷ আর হ্যাঁ, খেজুর, দই, ফলফ্রুট সব যাবে মা। কোন চিন্তার কারণ নেই। তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না।’
মায়ের মুখে জন চল্লিশের ইফতারি দেয়ার খবর শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেনো! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম আমি সেই মুহূর্তে।
(চলবে)