বিন্নি ধানের খই পর্ব-০৮

0
3216

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_০৮
#মিদহাদ_আহমদ

আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমার ননদ ফোনে কার সাথে বলছে যে আজ রাতে সে সেখানে থাকবে। হোটেলের রুম সেইফ থাকা চাই। বাসায় বলবে যে সে তার বান্ধবীর বাসায় আছে।

কথাগুলো শুনেই যেনো আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেলো। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। পেছন থেকে আমার ননাস আমাকে ডাক দিয়ে বললো,

‘কী? এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন নুপুর? ভেতরে যাও। রান্নাঘরে গিয়ে দেখো কী করছে কাজের লোকেরা। দেখতে শুনতে হবে না নাকি? বাড়ি ভর্তি মেহমান!’

ননাসের কথা শুনে আমি আমার ননদের রুম অতিক্রম করে রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলাম। আমার ননাসের ননাস এমন সময় সামনের দিক থেকে আসতে লাগলো। এইটা দেখেই আমার ননাস আমাকে ডাক দিয়ে বললো,

‘আরে নুপুর! রান্নাঘরের দিকে কেন যাচ্ছো? ওখানে কাজের মেয়েরা তো আছেই। তুমি রুমে গিয়ে বিশ্রাম করো। যা গরম পড়েছে আজ! আর নাহলে আসো আমার রুমে। আমরা গল্প করি।’

তারপর আমার ননাস আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে তার ননাসের সামনে গিয়ে বলল,

‘আপা দেখো না! আমার ভাইয়ের বউটা কত সুন্দর না! কী লক্ষ্মী দেখতে!’

ননাসের ননাস আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। আমার হাত ধরে সে আমার ননাসকে বললো,

‘তানিয়া, তোমার ভাইয়ের বউয়ের আঙুলের এই আংটিটা কোথা থেকে করেছো? কী সুন্দর ডিজাইন!’

ননাস বললো,

‘আপা! ওই মান্তাসা আংটিটা! দেখো আপা পুরো আঙুল জুড়ে বসে থাকে। আমি এই ধাচের আংটি এর আগে কখনো দেখিনি। মা নিজে এই ডিজাইন দিয়ে বানিয়েছেন আংটিটা নিজের একমাত্র পুত্রবধূর জন্য। যতোই হোক আদরের বউ তো! ওজনও আছে। পাক্কা দেড় ভরি!’

‘দেড় ভরি!’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’

আমার ননাস আর তার ননাসের এসব আলাপ আলোচনা চলতেই লাগলো। আমি অবাক হলাম, যে গহনাগুলো আমি মাত্র পরার অধিকার পেয়েছি, সেই গহনাগুলো কী সুন্দর করে তিনি তার ননাসের সামনে প্রেজেন্ট করে চলছেন! যে মানুষটা মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে বলেছে যে আমাকে রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে, সেই মানুষটা মুহূর্তেই আবার বলে বসলো রান্নাঘরে না গিয়ে এসি চালিয়ে রুমে যেতে!

আমি তাদেরকে কাটিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। শুনতে পেলাম ননাসের ননাস তাকে বলছে,

‘শুনো তানিয়া, এসব ভাইর বউদের টাইট দিয়ে রাখতে হয় শুরু থেকেই। নাহলে একবার ছাড়া পেয়ে গেলে মাথায় উঠে নাচে। তাদেরকে এইটা বুঝিয়ে দিও যে এইটা তাদের স্বামীর বাড়ি, আর তোমার বাপের বাড়ি। এই বাড়িতে সে আসার আগে তুমি এসেছো। এখানে তার কোন অধিকার নেই। সে শুধু তোমার ভাইয়ের বিয়ে করে আনা স্ত্রী। আর কিচ্ছু না। এখানে সব রাজত্ব, সব আয়ত্ব, সবকিছু শুধু তোমার চলবে। যেমনটা আমাদের ঘরে শুধু আমার কথা চলে, ঠিক তেমন’

আমার ননাস বললো,

‘না আপা। আমরা আমাদের ভাইয়ের বউটাকে এই ঘরের একজন মানি। আর কেন বাপের বাড়ি এসে কর্তৃত্ব দেখাবো আমি বলেন? এখানে মেয়ের কর্তৃত্ব ফলানোর কিছু নেই। আসলে কিছুকিছু জিনিস না আপা, ছেড়ে দিতে হয়। সব সময় এভাবে হাতের কাছে আর নিজের আয়ত্বে রাখলে, লেবু এমন বেশি চিপলে তিতা হয়ে যায়, মানুষও তেমন। তখন আর মুখের স্বাদও থাকে না, ভালোবাসাও না। আমার এই বাড়ির সবকিছুই তো আসিফের বউয়ের। এই বাড়ির পুত্রবধূর। আর আমরা আসলে কি সে করবে না বলেন? আমাদের তো কোন খাতির যত্নে কমতি হচ্ছে না কখনো। বেশ ভালোই তো চলে যাচ্ছে আপা সবকিছু। ‘

এভাবে তাদের পেছনে আলাপ চললো। আমার বুঝতে বাকি রইলো না আমার ননাসেরও তার স্বমীর ঘরে তার কথা চলে না। সেখানে তার ননাসের সব কথা চলে। অথচ শেষে আমার ননাস কী মিথ্যাই না বললো আমার সম্পর্কে! আর আমার ননাসের ননাস তো আরও ভয়াবহ!

আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোজা চলে আসলাম আমার শাশুড়ির রুমে। শাশুড়ির রুমে ঢুকতেই শাশুড়ি প্রথমে শুরু করলেন,

‘পোলাও দেখেছো? হাত নিয়ে দেখলাম তেল কম। এখনও ইফতার করার সময় হয়নি। জানি না ইফতারে বসলে কী দেখবো খেতে কেমন হয়েছে। তা তোমার বাপ কি তেলের লিটার দুইশো টাকা দেখে দুই লিটার তেল কম দিয়েছে পোলাওয়ে? বলে দিতা আমি দুই লিটার তেলের দাম দিয়ে দিতাম তোমাকে দিয়ে।’

শাশুড়ির এহেন কথার কোন জবাব আমি কোনদিন দেইনি। এবারও আমি জবাব দিলাম না। শাশুড়িকে নিচু স্মরে বললাম,

‘মা একটা কথা বলার ছিলো আপনাকে।’

‘কী কথা? ঈদে কাপড় দিতে পারবে না তোমার বাপ এই কথা নাকি? শুনো মেয়ে বলে দিলাম, কাপড় দেয়া লাগবেই। আর এখানে আমার মান সম্মানের বিষয় জড়িত। আমাকে না দিক, তোমার বাপকে বলে দিও আমার বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে সে যেনো শরম না পায়। আড়ং থেকে কাজ করা শাড়ি একটা আমার মেয়ের শাশুড়িকে, একটা আমার মেয়েকে, একটা আমার মেয়ের শ্বশুরকে তাতের পাঞ্জাবি, তসরের পাঞ্জাবি আমার মেয়ে জামাইকে যেনো ভালো দেখে দেয়। এগুলায় যদি কোন হেরফের হয় তাহলে আমার মেয়ের আর মাথা থাকবে না। বলে দিও তোমার বাবাকে এগুলো আমাদের এখানের নিয়ম। এগুলো রক্ষা করেই তবে চলা লাগবে।’

শাশুড়ির এবারের এই ভয়াবহ লিস্ট শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আমি এবারও কোন কথার জবাব দিলাম না। শাশুড়িকে আবার বললাম,

‘একটা জরুরী কথা বলার ছিলো মা।’

শাশুড়ি মা ইশারায় আমাকে তার পা টিপে দিতে বললেন। আমি বসলাম খাটের এক কোনে। তারপর ইশারা করে বললেন,

‘বল’

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। জানি না তার মেয়ের কথা বললে তিনি কী রিয়েক্ট দেখাবেন এখন। তার পরও মনে সাহস নিয়ে বললাম,

‘মা, কিছুক্ষণ আগে আমি আমার রুম থেকে বের হয়ে আসছিলাম রান্নাঘরের দিকে। এমন সময় আমি তামান্নাকে তার রুমে কার সাথে কলে কথা বলতে দেখতে পাই।’

শাশুড়ি এবার হাক ছেড়ে বসলেন। বললেন,

‘অহ! তার মানে এখন কানাঘুষা শুরু করেছো? কে কী করছে তারও জিম্মাদার হয়ে উঠেছো? ছোট ঘরের মেয়েদের এসব স্বভাব থাকে তাও প্রমাণ করতে বসেছো নাকি এখন? এসব স্বভাব কে শিখিয়েছে?’

আমি নীরবে শুনে গেলাম শাশুড়িমার কথাগুলো। তিনি চুপ করার পর আমি শুরু করলাম

‘মা, তামান্না কার সাথে কলে বলছে যে আজ রাতে সে বাইরে যাবে তার ফ্রেন্ডের বাসায় যাবে এমন বলে। আর হোটেলের কথা, হোটেল সেইফ কিনা এসব…’

শাশুড়ি মা সাথে সাথে আমার বুকে একটা লাত্তি দিলেন। আমি হাত ছেড়ে দিলাম তার পা থেকে। কেশে উঠলাম সাথে সাথে। বিছানায় উঠে বসে শাশুড়ি ডাক দিলেন তার মেয়ে দুজনকে। সাথে সাথে মুখ ছেড়ে বলতে লাগলেন,

‘ইচ্ছা হচ্ছে গালিগালাজ করে একদম শেষ করে দেই ছোটলোকের বাচ্চাটাকে। ছোটলোকের বাচ্চার মুখে যা আসছে, সে তাই বলে বেড়াচ্ছে যেনো!

শাশুড়ি মায়ের ডাকার সাথে সাথে দুজনে এসে হাজির মুহূর্তেই! আমার ননদ এসেই তার মাকে বললো,

‘কী হয়েছে মা?’

ননাস আমার দিকে চেয়ে বললো,

‘কী? এই মেয়ে কিছু করেছে নাকি?’

ননদ বললো,

‘দেখো কোন কান্ড ঘটাচ্ছে মনে হয় মনে মনে ‘

শাশুড়ি বললেন এবার,

‘এই নুপুর এখন আমার মেয়েদের নামে বদনাম তুলছে। এই তামান্না, দেখেছিস তোর নামে কী বলছে? শুনেছিস? তুই আমাকে কাল বলে রেখেছিলি না যে আজ রাতে অবন্তীর বাসায় যাবি তুই? বলেছিলি না? ভাগ্যিস আগে বলে রেখেছিলি আমাকে। এখন এই মেয়ে কী বলছে দেখছিস? তোকে বুঝি কোন ছেলের সাথে কথা বলতে শুনেছে তুই নাকি হোটেলে….

চিহ! আমার মুখে আনতেও লজ্জা করছে এসব।’

‘কী? তুমি এসব বলেছো মাকে? চিহ! গার্বেজ! নোংড়া মহিলা? তোমার সাহস কীভাবে হয় এসব বলার? চিহ! ছোট ঘরের মেয়েরা যে এত নোংড়া হয় তোমাকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। কোন মাটিতে গড়া তুমি? চিহ চিহ!’

শাশুড়িও বললেন,

‘আমার মেয়ের সম্পর্কে এমন কথা তোর মুখে আটকালো না? আরে সম্পর্ক বলেও তো একটা কথা আছে তাইনা? সেই সম্পর্কের খাতিরেও তো তুই এতো জঘন্য কথা না বললেও পারতি! আমার নিজের কানের কাছে নিজের ঘৃণা হচ্ছে এসব শুনে। চিহ চিহ চিহ!

ননদের সাথে সাথে ননাস তেড়ে এলো। ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো সে আমার গালে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘটে গেলো এই ঘটনাটা। আমি এবার আর নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারলাম না৷ বললাম,

‘আমি কি নিজের জন্য বলছি কিছু? আর আমি যা শুনেছি তাই বলেছি৷ তাই বলে তানিয়া আপা আমাকে এভাবে চড় মারতে পারেন? আমি ভুল বলেছি কিছু? আর তামান্না, তুমি নিজে বলো বুকে হাত দিয়ে যে আমি মিথ্যা? আমি এই ঘরে আসার পর থেকে কী না সহ্য করে আসছি? এই ঘরে যেনো আমার কোন দামই নেই! আমিও একটা মানুষ তাইনা? আমিও তো এই ঘরের একজন সদস্য। আমার যে বাবা মা আমাকে বড় করেছেন, সেই বাবা মাও আমাকে জীবনে চড় মারেননি। আর আপা আপনি? আপনিও তো কারোর মেয়ে। নিজের মায়ের ঘর ছেড়ে থাকতে কেমন লাগে এইটা তো আপনিও ভালোকরে বুঝেন। এসব অন্যায় করে কি জীবনে খুব বেশিকিছু পাওয়া যায়?’

শাশুড়ি অগ্নিশর্মা হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। শেষে বললেন,

‘মুখের খই ফুটেছে? আতপ চালের খই থেকে এখন বড় ঘরের বউ হয়ে এসেছো বলে বিন্নি ধানের খই হয়ে উঠবা? মেয়ে তোমার ওকাতে থাকো। সীমা লঙ্ঘন করার চেষ্টাও করবা না।’

‘কী হয়েছে বেয়ান? মা মেয়ে বউ মিলে কী করছেন? এদিকে আজানের সময় হয়ে এলো যে ‘

কথাগুলো রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন আমার ননাস তানিয়ার শাশুড়ি। আমার শাশুড়ি তার বেয়ানকে বললেন,

‘আরে না না। এই কথা বলছিলাম আরকি যে ইফতারের পর ডেজার্ট আইটেম কোথায় সার্ভ করবো এই নিয়ে। বউমা, ও বউমা আমার ওয়ারড্রব এর উপরে এসির রিমোট রাখা আছে। তুমি একটু অন করে দাও এসিটা। আজকের গরম কেন জানি একটু বেশিই পড়ে গিয়েছে। যা দিনকাল আসছে, একেবারে সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। আমি ভাবছি কখন না আমাদের দেশ আরবের মরুভূমির মতো হয়ে যায়। মানুষ তখন এসি ছাড়া তো বাঁচতে পারবেই না বরং গরমে মারা যাবে। তাইনা বেয়ান?’

আমি তাজ্জব বনে গেলাম আমার শাশুড়ির ব্যবহারে! এক মুহূর্তে যেনো তিনি বদলে গেলেন! আমাকে বউমা বউমা করে ডাকতে লাগলেন!

আমি এসি অন করে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। মানুষের এই বদলানো আমার ভয় করে প্রচন্ড। একবার আমার গ্রামে, আমাদের রহিম মেম্বারও ঠিক এমন করেই পালটে গিয়েছিলো৷ যে মেয়ের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো, যে মেয়েকে সে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ভোগ করেছিলো শরীর মন, সেই মেয়েকেই সে যখন তার প্রাপ্য চাইতে এলো, সে বানিয়ে দিলো তাকে আগন্তুক! সে যেনো সেই মেয়েকে চিনেই না! আমার সামনেই ঘটা ঘটনাগুলো। অথচ আমার বান্ধবির কাছ থেকে মেম্বারের কতোই না তারিফ শুনতাম আমি! মানুষ বদলে যায়। আসলেই বদলে যায়। মানুষ মাঝেমধ্যে হয়ে উঠে আরও ভয়ংকর। খুব ভয়ংকর। রাস্তায় আটকালো আমার ননদ তামান্না। আটকিয়ে আমার হাত চিপকে বললো,

‘বড়ো বাড়ন্ত হয়েছো দেখছি? সবকিছু বন্ধ করে দিবো একেবারে? যা শুনেছো সব সত্যি শুনেছো৷ সন্ধ্যার পর আমি যাবো আর রাতে আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে থাকবো। কী করবে তুমি? তোমার মতো দুই টাকার মেয়েকে আমাদের বড় ঘরের কেউ কখনো বিশ্বাস ই করে না। এখানে তো ভাইয়াকে অন্যকোন মেয়ে বিয়ে করবে না বিধায় তোমাকে বউ করে আনা হয়েছে। যার জন্য আনা হয়েছে, তার জন্য আর তার মতোই থাকো। কোন বেশিকিছু করতে যেও না। করার সাহস ও করো না। খারাপ হতে থাকলে খারাপ কোথায় গিয়ে মোড় নিবে ধারণাও করতে পারবা না বলে দিলাম। তাই যে কাজ করতে লেগেছে, সেই কাজ করো। নিজের ঘর সংসার করো৷ ঘর আর সংসার এর কোনটা করতেও পারবা বলে মনে হয় না৷ যা মাতাল তোমার স্বামী, দেখো কতদিন এই ঝামেলা নিয়ে চলতে পারো।

এক কোণায় দাঁড়িয়ে নিজের বোনের কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেলো আসিফ।

আপনাদের অনুরোধে আজকের পর্ব বড় করে লেখলাম। দুইদিনের পর্ব একদিনে দিলাম। গ্রুপে সবাই ইনভাইট দিয়েন নিজেদের পরিচিতদের। লাইক, কমেন্ট করে যাবেন অবশ্যই। ভালোবাসা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here