#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১০
#মিদহাদ_আহমদ
*গ্রুপে যুক্ত না হয়ে যারা গল্প পড়ছেন এবং আমার গ্রুপে পোস্ট করার সাথে সাথেই কপি করে অন্য গ্রুপে গল্প দিচ্ছেন, আপনাদের খুঁজে বের করে গ্রুপ শীঘ্রই প্রাইভেট করে ফেলা হবে। এজন্য গল্প পড়ার আগে গ্রুপে জয়েন হয়ে নিন।
আসিফ বাসা থেকে বের হবার সময় যখন বলে গেলো যে, আজ যদি সে তামান্নাকে ঠিকঠাক দেখে তাহলে এই বাড়িতে এটাই হবে আমার শেষ রাত। আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো তখন।
ঘন্টাখানেকের মাথায় আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটে গেলো যেনো! আসিফ বাসায় এলো। আসিফের সাথে তামান্নাও এলো। বাসায় ঢুকেই আমার শাশুড়ি অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুরু করলেন। তার সাথেসাথে বলতে লাগলেন,
‘এই ছোটলোকের বাচ্চা শুরু থেকেই আমার মেয়ের পেছনে লেগেছিলো। কই? আমরা কি তামান্নাকে গিয়ে কোন ছেলের সাথে পেয়েছি? সবকিছুর মূলে ওই মেয়েটা।’
আমার ননদ তামান্না নাকি সুরে কান্না করতে করতে বললো,
‘ভাবি তুমি আমাকে এত অবিশ্বাস করো? এতো হিংসা ভেতরে পুষে রাখো আমাকে নিয়ে? আমাকে বলেই দিতে সবকিছু। আমি নাহয় তোমার কথায় কথায় চলতাম। তোমার মন জুগিয়ে চলতাম। তবুও অন্তত আমার চরিত্রে এমন দাগ বসতো না। তুমি কিনা আজ আমার চরিত্র নিয়ে! চিহ! আমার বান্ধবীর বাসায় আমার কতটুকু অপমান হলো তার আন্দাজ করতে পারবা তুমি? পারবা না। আর আমি কখনো তাদের সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবো? পারবো না।’
ননাস বললো,
‘কী? এখন কই বড় বড় কথা? খুব তো এসে বলেছিলা আমার বোনের নামে এই সেই। এখন গেলো কই এসব? নাকি সব ভংচং করে আমার ভাইকে নিজের বশে আনার চেষ্টা জারি রেখেছিলা এতদিন?’
‘ব্যাস! সবাই কথা বন্ধ করো। প্লিজ! নুপুর, তোমার যা যা নেয়ার ব্যাগে করে নিয়ে নাও। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে দেরি করতে পারবো না। তোমাকে একেবারে তোমার বাড়িতে রেখে আসবো ‘
আসিফের মুখ থেকে এই কথাটা শোনার পর আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো যেনো! আসিফ তার রুমে চলে গেলো। শাশুড়ি তার বড় মেয়েকে বললেন,
‘কী হচ্ছে এসব তানিয়া? এই মেয়েকে তো এনেছিলাম আমার ছেলের জন্য৷ এখন যে আসিফ পাগলামি শুরু করেছে…’
‘করুক। এই মেয়েটাকে এই ঘরে রাখার জন্য তুমি এখন পক্ষপাত করো না মা। আজ যে মেয়েটা তার ননদের উপর এমন মিথ্যা আরোপ দিতে পারলো, আগামীকাল সেই মেয়েটা তার বড় ননাসের উপর আঙুল তুলতে এক মুহূর্ত ভাববে না। এই মেয়েকে এই ঘরে রাখা মানে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনা৷ একে তার বাপের বাড়িতে বিদায় করে দিলেই মন্দের ভালো ‘
ননদও তার বোনের সাথে যুক্ত হলো। আমার সামনে এসে ফিসফিস করে বললো,
‘সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। কী মনে করেছিলা? আজ আমার বয় ফ্রেন্ডের বাসায় যাবো আমি? যাইনাই। আমিও দেখতে চেয়েছি যে তুমি কতটুকু যেতে পারো।’
ফিসফিস করে বলা শেষ করে ননদ আবার কান্না জর্জরিত হয়ে বললো,
‘তুমি না আমার ভাবি? তুমি এমন করতে পারলা? এমন বলতে পারলা? এক বারও তোমার মুখে বাধা দিলো না এসব বলার আগে? তুমিও না একজন মেয়ে? একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়ের নামে এমন নোংরামো কথা বলার আগে একটাবার ভাবার প্রয়োজন মনে হলো না?’
আমি এবার মুখ খুললাম। জমাট বাধা রক্ত শক্ত হতে গিয়ে যখন ব্লাস্ট করে, তখন যেমন স্ট্রোক হয়ে যায়, আমিও তেমন। নিজের ভেতরের চাপা কথাগুলো এতদিন ধরে যেই ঘরে চাপা দিয়ে আসছিলাম, আজ সেই কথাগুলো আর চাপিয়ে রাখতে পারলাম না। শাশুড়িকে বললাম,
‘মা! আপনিও তো একজন মা তাইনা? একজন মেয়ে তাইনা? আমি মিথ্যা বলে কী লাভ করবো বলেন?’
আর তামান্না, তুমি যে মিথ্যা বলছো এখন, আর এই মিথ্যার ফলে যে আমার সংসার ভাঙ্গছে, আমি এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত নই। শুধু আজ আমি এক নারী হয়ে আরেক নারীর সংসার ভাঙ্গার অপরাধে তোমাকে অভিশাপ দিলাম,
‘সংসার নামের শান্তি জীবনে তুমি স্পর্শ করতে পারবা না।’
শাশুড়ি এবার তেড়ে এলেন যেনো। বললেন,
‘কী? কী? ছোটলোকের মেয়ে এসব কী বলছিস তুই…’
‘ছোটলোকের মেয়ে ছিলাম মা। এখন আমি ছোটলোকের মেয়ে নই। আপনার মতো বড়োলোক মানুষের একমাত্র ছেলের বউ আমি।’
ননাস বললো,
‘মা দেখেছো! কী মুখের বাড় বেড়েছে মেয়েটার! এই মেয়ে, শুনেছো তোমাকে কী বলে গিয়েছে আসিফ? একেবারের জন্য তোমার বাড়িতে রেখে আসবে সে তোমাকে। আজই তোমার সবকিছু শেষ এখানে।’
‘শেষ এখনও হয়নি আপা। আমি এখনও আইন এবং ধর্মমতে আপনার ভাইয়ের বিয়ে করা স্ত্রী। আমাদের এখনও ডিভোর্স হয়নি।’
ননদ তার মাকে আর বোনকে বললো,
‘এই মেয়েকে বিদায় করো এখান থেকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করো৷ এখানে এই মেয়েটা দেখছো কত ছোটলোক হয়ে উঠেছে৷ লোভী হয়ে উঠেছে!’
আমি তামান্নার সামনে গেলাম। তামান্নাকে বললাম,
‘বয়সে তুমি আমার চেয়ে দুই বছরের বড় হলেও, সম্পর্কে আমি তোমার চেয়ে বড়, তুমি আমার চেয়ে ছোট। সম্পর্কের তামিজ মেনে অন্তত ভালোভাবে কথা বলবা তামান্না। অনেক সহ্য করেছি আর না। আর না ‘
আমি আমার কান থেকে কানের দুল, হাত থেকে চুড়ি, আঙুল থেকে আংটি আর গলা থেকে চেইন খুলে দিয়ে শাশুড়ির হাতে দিয়ে বললাম,
‘এই রাখুন আপনার সবকিছু। আমি চললাম।’
এক কাপড়ে যখন আমি সদর দরজার দিকে যাচ্ছি, পেছন থেযে আমাকে ডাক দিলো আসিফ। ডাক দিয়ে বললো,
‘দাঁড়াও।’
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। ওপরের তলায় সে দাঁড়িয়ে আছে। আসিফ বললো,
‘কোথাও যাওয়া চলবে না তোমার। আর মা, ও আমার বিয়ে করে আনা স্ত্রী৷ সে এখানেই থাকবে। সে কোথাও যাবে না। আর কে কতটুকু সত্য না মিথ্যা বলছে আমি সব জানি, সব বুঝি।’
শাশুড়ি মা আর ননাস, ননদ যেনো চুপটি মেরে মুহূর্তেই। আসিফ আবার বললো,
‘কী হলো? আমার কথা শোনা যাচ্ছে না নাকি? এই ঘর ছেড়ে কোথাও তুমি যেতে পারবে না।’
আমি ভেতরে ঢুকলাম। আসিফকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘আজ তিন মাস হলো এই ঘরে বউ হয়ে এসেছি৷ তারপর থেকে প্রতিটা দিন আমি কী পেয়েছি? কী পাচ্ছি? এসব লাঞ্চনা? অপমান? ঘৃণা? কথায় কথায় ছোটলোকের মেয়ে, গরীব ঘরের মেয়ে, গরীবের বাচ্চারা চাল চলন জানে না এই কথাগুলো? নাকি অন্যকিছু? দুইবেলা দুই মুঠো ভাতের জন্য আমি কি এই বাড়িতে এসেছি? নাকি শুধু শুধু কথা শোনার জন্য?
মানুষ বিয়ে করে কত স্বপ্ন নিয়ে৷ মানুষ বিয়ে করে একটা নতুন বাড়ি পায়। শ্বশুর পায়, শাশুড়ি পায়, ননদ, ননাস, জা পায়। আর সবচেয়ে বড় পাওয়া একটা স্বামী, সেই স্বামী পায়। আমি কী পেলাম? শুধু বড়লোক জামাই? তার অনেক টাকা? রুমে এসি? ডিপ্লেক্স বাড়ি? শহরের নামকরা ফ্যামিলি? দামি দামি গাড়ি? আর উৎসব আয়োজন হলে লোক দেখানো সোনার গহনা পরার সামান্য অধিকার? এটুকুই? এজন্য আমি বিয়ে করে এই বাড়িতে এসেছি? না আসিফ না। তুমি এসব ভেবে থাকলো ভুল ভাবছো৷ আমি হতে পারি গরীব ঘরের মেয়ে। হতে পারে কখনো এসির বাতাস খাইনি, ডুপ্লেক্স বাড়িতে থাকিনি, দামি গাড়িতে চড়িনি, তা বলে এই তো নয় যে আমি আমার আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বসবো?’
শাশুড়ি বললেন,
‘তাহলে এত যখন আত্মসম্মান তাহলে সব জেনেশুনে এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলে কেন?’
‘রাজি? আমি রাজি? আমার কোন মত নেয়া হয়েছিলো? আমার লোভী মা তার জীবন স্বাদ আস্বাদন করতে যে আমাকে এই নরকে ঠেলে দিয়েছে, এই পাপের বোঝা আমি এখন আজন্ম নিজের একটা অংশ হিসেবে বয়ে বেড়াচ্ছি। এটাই তো আমার নিয়তি৷ এটাই আমার ভাগ্য।’
কিছুক্ষণ পুরো মহল একেবারে চুপ করে গেলো।
আসিফ এবার নিচে নেমে এলো। আমার হাত ধরলো। হাত ধরে আমাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর আসিফ একটা সিগারেট ধরালো বারান্দায় গিয়ে। আমিও বারান্দায় গেলাম। আসিফকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আমাকে আটকিয়ে রেখেছো কেন? আমি যেতে চাচ্ছি। আমাকে যেতে দাও।’
আসিফ এবারও কোন জবাব দিলো না। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম। এবারও সে নিশ্চুপ। আবার জিজ্ঞেস করায় আসিফ তার পাশে থাকা সিগারেটের স্ট্রে টা ছুড়ে মারলো নিচে। এইটাও যেনো তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে৷ সিগারেট ও ফেলে দিলো। তারপর চিৎকার করে বললো,
‘তুমি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছো নুপুর। তুমি আমার অভ্যাস। আমি অভ্যাস ছাড়তে পারবো না।’
ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো এমন সময়ে। আকাশ থেকে যেনো সুখের ঝর্ণাধারা বইতে লাগলো পৃথিবী জুড়ে। অন্যদিকে তানিয়ার স্বামীর মামাতো বোন এসেছে লন্ডন থেকে। বিয়ের তিন বছর হয়ে যাওয়ার পরও তানিয়ার কোন সন্তান না হওয়ায় তানিয়ার শাশুড়ি চিন্তা করছেন, ছেলের আরেক বিয়ে দেওয়াবেন৷
(চলবে)