বিন্নি ধানের খই পর্ব-১৬

0
2667

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১৬
#মিদহাদ_আহমদ

রাত বাজে দুইটা। সেহরির সময় হয়ে গিয়েছে। সেন্টার থেকে লোকজন চলে যাচ্ছে, যাবে এমন। আমার ননদ আর ননাস দুজনেই ফটোগ্রাফিতে ব্যস্ত। এদিকে একটার পর একটা কল করতে করতে শেষমেশ আমার ননাসের স্বামীকে নিয়ে আসতে সক্ষম হলাম। তিনি চায়নিজের পাশের কফিশপে আসবেন৷ আমি সবার চক্ষু গোপন করে তার সাথে দেখা করতে চলে গেলাম। আমি যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেই তিনি চলে এসেছেন। তার মুখোমুখি চেয়ারে বসলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

‘এভাবে ডাকার কারণ?’

‘আপনি নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন দুলাভাই আমি কেন ডেকে এনেছি?’

কিছুক্ষণ মানুষটা চুপ থাকলো। আমি মৌনতা ভেঙ্গে বললাম,

‘আপনি বলুন, বাচ্চা কি মহান আল্লাহর দান নয়? এর মাঝে কি আপনার আমার হাত আছে? আজ আল্লাহ দিচ্ছেন না, কাল আল্লাহ দিবেন। আর না দিলেও কি জীবন মুশকিল হয়ে যায়? আমরা তো কতকিছুই জীবনে পাই না। সব পেতে হবে এর নাম কি জীবন দুলাভাই? জীবন মানুষকে শেখায়, মানুষকে এক্সপ্লোর করার সুযোগ দেয়। মানুষও শিখে। এখানে কারোর ইচ্ছা অনিচ্ছায় আসলেই কি কিছু আসে যায়? এরকম এহেন সিদ্ধান্ত আপনার থেকে কি আশা করা যায় দুলাভাই?’

লোকটা এবারও শুধু কথাগুলো শুনলো। কোন উত্তর দিলো না। আমি আবার বললাম,

‘আপনি আমি দেখেন দুনিয়ার নিয়মে আবদ্ধ৷ এই যে দেখছেন, আমাকেই দেখেন৷ কত স্বপ্ন ছিলো আমার! আমি কিছু করবো, নিজের পায়ে দাঁড়াবো। মা বাবার ভরসা হবো। কিন্তু কই? আমার ইচ্ছা বা স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে? আদতে কি হবে? হবে না। সব ইচ্ছা আসলে পূর্ণ হয় না। আর তার উপর দেখেন একটা মেয়ে সর্বক্ষণ নিজের সব বিসর্জন দিয়ে যার রক্ষা করে চলে, যাকে নিজের বলে দাবী করে, সেই নিজের মানুষ ছাড়া নারী জীবন অসম্ভব। এই জীবনের স্বাদ এবং অন্বেষণেই যে আমরা আমাদের জীবন কাটিয়ে দেই দুলাভাই।’

এতক্ষণে আমার ননাসের স্বামীর মুখ খুললো৷ তিনি বললেন,

‘দেখো নুপুর, তুমি আমার শালার বউ বলে কিছু কথা বলছি সরাসরি। হয়তো অন্য কারো সামনে আমি বলতেও পারতাম না। আমি তানিয়াকে অনেক ভালোবাসি। তানিয়া ছাড়া আমি আমার এক মুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না।’

‘তাহলে সেই ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে দিবেন? এইটা ধর্মের সইবে? আপনি সহ্য করতে পারবেন? মনকোটরে সুখস্মৃতি সবসময় পীড়া দিয়ে যাবে না আপনাকে?’

খেয়াল করলাম তানিয়া আপার স্বামীর চোখের কোণে জল এসে জড়ো হচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ভাষার চোখে যখন মন গলা জল দেখা যায়, তখন সেই জল সাক্ষী হয়ে রয় ভালোবাসার। নিরেট ভালোবাসা ছাড়া পুরুষের চোখে জল আসে না।

আমি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম দুলাভাইর দিকে। তার হাত ধরে বললাম,

‘দুলাভাই, একবার দেখেন চিন্তা করে, জীবন মানুষের একটাই। মানুষ এই জীবনে যা সিদ্ধান্ত নেয়, পুরো জীবনে তাই বয়ে বেড়ায়। এরচেয়ে বড় কোন সত্য হতে পারে না।’

‘কিন্তু আমি যে অসহায়, নিরুপায় নুপুর।’

‘কেন? কেন নিরুপায়?’

‘আমি আমার মায়ের কথা ফেলতে পারবো না।’

‘যদি সেই কথা আপনার মনে সায় না দেয় তার পরও?’

‘হুম। তার পরও’

আমি আর কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না এরপর কিছু বলার। মানুষ যখন কিছু নির্ধারণ করে ফেলে নিজের মাঝে, তখন সেই নির্ধারণ বদলানো যায় না, সিদ্ধান্ত বদলানো যায়। আমি বুঝালাম আরও কিছুক্ষণ আমার ননাসের স্বামীকে। বললাম যে মানুষের জীবনে অনেক বাক আসে। অনেক খারাপ সময় আসে, অনেক প্রতিকূলতা আসে। সবশেষে একসাথে যদি দুজন মানুষ এই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন প্রতিকূলও অনুকূলে এসে দাঁড়িয়ে যায়। মানুষের সাথে সাথে এইটা শাপে বর হয়ে ধরা দেয়। মানুষ তখন লাভ করে এক অসীম প্রশান্তির আবেশ।

‘আপনার স্ত্রী কি আপনার জীবনে কোন অংশীদার রাখে না? কোন প্রভাব রাখে না?’

আমার এই প্রশ্নেও আমার ননাসের স্বামী নীরব ছিলো। তার কোন উত্তর ছিলো না।

কিছুক্ষণ বুঝালাম আমার ননাসের স্বামীকে। জানি না সে বুঝতে পারলো কিনা না। তাকে বলে এলাম, কাল দুপুরে আমি তাকে কল করবো। আশা রাখবো যেনো পজেটিভ কোন সিদ্ধান্ত আমাকে জানান৷ মনের মধ্যে এক অজানা শঙ্কা নিয়ে আমি বের হলাম কফিশপ থেকে। রাত তখন দুইটা বেজে বিশ মিনিট। চায়নিজে এখনও বাসার সবাই আছে। সেহরি সেখানেই করবে সবাই। আমি চুপিচুপি গিয়ে ঢুকলাম। শাশুড়ি কাছ ঘেষে গিয়ে বসলাম। তাৎক্ষণিক আমার ননাস তেড়ে আমার দিকে এলো। তারপর বললো,

‘আজ কেন আমার স্বামী আসেনি অনুষ্ঠানে? আর কেন লুকিয়ে চুপিচুপি তার সাথে তুমি দেখা করতে গিয়েছিলা? নতুন কী ফন্দি আটছো তুমি?’

শাশুড়ি বললেন,

‘থাম তানিয়া। এখন এখানে কথা বাড়াস না।’

‘কেন? কেন থামবো আমি? এতরাতে আমার অগোচরে আমার স্বামীর সাথে কী এমন কথা ওর? আর দেখবে? দেখবে সে কী করেছে?’

আসিফ এগিয়ে এলো। সে বললো,

‘কী করেছে? কী করেছে নুপুর?’

আসিফের সামনে তখন আমার ননাস তার মোবাইল স্ক্রিন তুলে ধরলো। আসিফ কিছুক্ষণ দেখে আমার সামনে এসে বললো,

‘কী এসব?’

আমি আসিফকে বললাম,

‘তুমি আমার উপর বিশ্বাস করো তো?’

আসিফ নিশ্চুপ হয়ে রইলো। আমি আবার তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,

‘আমার উপর তোমার বিশ্বাস আছে তো?’

আমার ননাস এসে বললো,

‘বিশ্বাস অবিশ্বাস কী আবার? আমাকে জবাব দাও কী এসব? তুমি আমার স্বামীর হাতে ধরে কফিশপে বসে আছো? কী এসব? এই বয়সী মেয়েরা এমন হয় জানতাম কিন্তু স্বামী সংসার রেখে? কোন লাজ লজ্জা নেই নাকি? নাকি গ্রামের গরীব ঘরের মেয়ে বলে এমন যা ইচ্ছা তাই করতে হবে বলতে হবে?’

শাশুড়ি এসে বললেন,

‘তানিয়া এখন বন্ধ কর। এখন আর কোন কথা বলিস না তুই। এখানে আর নতুন করে সিন ক্রিয়েট করিস না।”

‘সিন ক্রিয়েট? আর আমি? মা শুনো, পুরুষ মানুষ সব সময় নরম, কোমল মনের। তাদের যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে পরিচালনা করা যায়। সমস্যা হলো এই নুপুরের মতো মেয়েরা। এরা অন্যের ঘর ভাঙ্গতে উঠেপড়ে লাগে।’

আসিফ সামনে এসে বললো,

‘কী বলছো এসব আপু? ভুলে যেও না ও আমার বিয়ে করা বউ’

‘বিয়ে করা বউ? পর নারীর স্বামীর সাথে যে মেয়ে রাত বিরাতে গিয়ে একা একা দেখা করে আসে সেই মেয়েকে বউ বলছিস তুই?’

‘হ্যাঁ। আমি জানি এর পেছনে কোন কারণ আছে। এমনি এমনি সে দেখা করতে যায়নি।’

শাশুড়ি এসে আমার ননাসকে থামতে বললেন৷ সে থামছে না দেখে শাশুড়ি ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললেন,

‘নিজের খেয়ে পরের করতে যাচ্ছে যে, তাকে না জেনে কথা শুনাচ্ছো তুমি? আমি বারবার না করছি তবুও?’

এদিকে আমি অবাক হলাম যে মানুষটাকে আমি আপন করে নিতে পারিনি এখনও, সেই মানুষটাই আমাকে কেমন জানি বিশ্বাস করে নিজের ভাবতে শুরু করেছে! আজ যদি আসিফ আমার উপরে ইশারা ইঙ্গিতে হাত তুলতো তাহলে এই অবিশ্বাস নিয়ে আমি আর বাঁচতে পারতাম না। আমি বাঁচতে বাঁচতে যেনো পৃথিবীর সব ভয়ংকর নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতাম। সেহরি আর আমাদের হলো না। গাড়িতে করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে আসিফ আমার কাছে জিজ্ঞেস করলো,

‘আপার সাথে কি দুলাভাইয়ের কিছু হয়েছে?’

‘হুম! দুলাভাই আপাকে ডিভোর্স দিতে চায়’

‘কী?’

[গতকালকের পোস্টে ঠিকই ২ হাজার+ লাইক ও ৫০০+ কমেন্ট এসেছে। মানে আপনারা পড়েন ঠিকই কিন্তু অনেকেই ইগনোর করে চলে যান🙂।
আজকে দাওয়াতে এসেছি একটা। সময় একদম পাইনাই। পর্ব কিছুটা ছোট হয়েছে এজন্য৷ লাইক কমেন্ট করে যাবেন সবাই। ভালো থাকবেন]

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here