#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১৭
#মিদহাদ_আহমদ
বাসায় গিয়ে শাশুড়ি সব জানালেন আমার ননাস কে। বললেন,
‘তোর বাচ্চা হচ্ছে না তাই তারা চায় তোকে যেনো তাদের ছেলে ডিভোর্স দিয়ে দেয়!’
আমি খেয়াল করলাম আমার ননাস একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। কথা বলার অবস্থায় আর সে রইলো না। হেলাম দিয়ে পিলারে মাটিতে বসে পড়লো৷ আসিফ সম্ভবত আমার হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার বোনকে। আমি আসিফকে আটকালাম। ফিসফিস করে বললাম,
‘এখন সময় না এসবের। এখন একজোট হয়ে এর সমাধান কী হয় এইটাই খুঁজে বের করার সময়।’
সেদিন রাত আমাদের এভাবেই নিরানন্দে কেটে গেলো। আসিফ বারান্দায় বসে বসে সিগারেট টানছে আর বলছে,
‘আপার জীবনে কী হবে এখন? যদি দুলাভাই সত্যি সত্যি আপাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়?’
আমি বললাম,
‘ডিভোর্স এতো সহজ নাকি? বললেই হয়ে গেলো? চিন্তা করো না তুমি। দেখবে সব সহজ হয়ে গিয়েছে। একবার জানো, আমাদের কী হয়েছিলো? আমাদের বাড়িতে চাল নেই। চাল নেই মানে বাবা যে ধান বিক্রি করেছেন সেই ধানের টাকা গতকাল পাওয়ার কথা কিন্তু পাননাই। হাত একেবারে খালি। দুপুরে খেয়ে রাতে কী খাবো এর জোগাড় কিছুই হয়নি। মা রেগেমেগে অস্থির একদম। কেন বাকিতে ধান বিক্রি করলা,কেন চাল ভাঙ্গালা না, এখন এই রাত বিরাতে কার ঘর থেকে চাল খুঁজতে যাবো? এইসেই নানাকিছু। আমার বাবা একদম নিশ্চুপ৷ শুধু বললেন, রিজিকের মালিক আল্লাহ৷ তিনি কোন না কোন ভাবে রিজিকের ব্যবস্থা করে ফেলবেন৷ দেখে নিও। মাও সেদিন বাবাকে শুনিয়ে বলেছিলেন, সব সময় আল্লাহর ভরসায় থাকলে কীভাবে হয়? বাবা কোন জবাব দেননি।’
আসিফ বললো,
‘তারপর কী হয়েছিলো?’
সেই রাতেই ধান যার কাছে বিক্রি করেছিলেন, সে ধানের টাকা ও এক বস্তা ভাঙ্গানো চাল উপরি এনে দিয়েছিলো! রাত বাজে নয়টা। এমন সময়ে গ্রামে গঞ্জে কেউ চাল আর টাকা নিয়ে আসার কথাও নয়। লোকটা যাওয়ার পর আমার বাবা সেদিন আমাকে আর আমার মাকে বলেছিলেন,
‘যখন সব পথ বন্ধ হয়ে যায় তখন একমাত্র আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবা। দেখবা সব ঠিক হয়ে যাবে৷ কোন সিদ্ধান্তে যেতে পারছো না? ব্যস। আল্লাহকে বলো। আল্লাহ সব সিদ্ধান্তের উপর বসা আছেন। তিনি যা করবেন, তাই আমাদের জন্য মঙ্গল।’
আসিফ এবার নড়েচড়ে বসলো। বললো,
‘এবার কি তাহলে উপর থেকে কোন সিদ্ধান্ত আসার পালা?’
‘হ্যাঁ। এখন সব সিদ্ধান্ত উপর থেকে আসবে।’
সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি রান্নাঘরে গেলাম। ঈদ চলে আসছে। কাজ কর্ম অনেক বাকি। আমি ইফতারের আয়োজন করতে লাগলাম৷ খেয়াল করলাম শাশুড়ির মন ভার ভার। কথা বলছেন না। আমার ননদের রুমে গেলে সে চিৎকার করে বলে উঠে,
‘এখানে কেন এসেছো? আমাদের দুই বোনের কষ্ট দেখে দেখে মজা নিতে? এখন অনেক মজা নিচ্ছো তাইনা? অনেক ফুর্তি হচ্ছে আমাদের অবস্থা দেখে তাইনা? আর হবেই বা না কেন। ভালোর সাজে মন্দ তো তুমিই৷ তোমার আসার পরেই এসব হচ্ছে।’
আমি আমার ননদ আর ননাসের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে কথা আর বাড়ালাম না। আসিফ কোথা থেকে এসে তার বোনকে বললো,
‘এভাবে ভাবির সাথে কথা বলে তামান্না? সে তো এমনি এসেছিলো। আমি তো দেখছি সব। সে কোন কথাও বলেনি তার পরও?’
‘অহ! এখন তুমি সব কথায় কথায় এসে ভাবির পক্ষে আমাকে কথা শুনাবা?’
‘বন্ধ করো এসব। বন্ধ করো। আমি আর নিতে পারছি না এগুলো। প্লিজ!’
কানে হাত দিয়ে আমার ননাস বললো কথাগুলো৷ আমি আসিফকে রুমে যেতে বললাম। এমন সময়ে কলিংবেল বেজে উঠলো বাসার। আমি দরজা খুললাম। দরজা খুলতেই আমার ননাসের স্বামীকে দেখতে পেলাম। আমার শাশুড়ি এসে তাকে ভেতরে এনে বসাতে না বসাতেই কান্নায় ভেঙ্গে বললেন,
‘বাবা তুমি বলো এসব আমি তুমি জানি? এর মাঝে আমাদের হাত আছে কি? নাকি এগুলো সব আল্লাহর ইচ্ছাতেই হচ্ছে? এর মাঝে তো বাবা আমাদের কোন হাত নেই’
আমার ননাসের স্বামী চুপ থাকলো। ননাস এসে বললো,
‘আমাকে ডিভোর্স দিবা? আমি বন্ধ্যা? আমার বাচ্চা নেই? এজন্য? চিহ! তোমাকে দেখতেই আমার লজ্জা করছে। তুমি? তুমি আমাকে ডিভোর্স দিবা যে আমার বাচ্চা হচ্ছে না এজন্য?’
আমি আমার ননাসকে সামলালাম। এমন অবস্থায় অহেতুক কথাবার্তা আর উত্তেজনা ভালো না। তাকে নিয়ে বসালাম সোফায়। ননদও চলে এলো ড্রইংরুমে। সে কিছু বলতে যাবে এর আগেই আমি তাকে ধরে বললাম,
‘কোন কথা না তামান্না। এখন একদম চুপ। আমরা আগে দুলাভাইর কথা শুনি। তারপর যা বলার বলবো।’
আমি আমার ননাসের স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আপনার সিদ্ধান্ত কী? আমাদের কি আপনার সিদ্ধান্ত জানানো যাবে এখন?’
কিছুক্ষণ তিনি মৌনতা অবলম্বন করলেন। তারপর৷ বললেন,
‘আমি বাসায় কথা বলেছি। আমি এই বিয়েতে রাজি নই। তারা যেভাবে আমাকে আমার মামাতো বোনের সাথে বিয়ে করাতে চায়, আমি তাদেরকে অসম্মতি জানিয়েছি। আর এই সিদ্ধান্তও আমার ছিলো না। তানিয়া তুমি এক্ষুণি রেডি হও। আমার সাথে বাসায় চলো।’
ননাস বলল,
‘না। আমি যাবো না৷ এখন আর আমি যাবো না। যেই ঘরের লোকজন এভাবে আমাকে ঘরছাড়া করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেই ঘরে আমি আর দ্বিতীয়বার গিয়ে ঢুকবো না৷ কখনোই না ‘
আমি ননাসকে নিয়ে ভেতরে গেলাম। শাশুড়িও এলেন। শাশুড়ি ননাসের কাধে হাত রেখে বললেন,
‘দেখ তানিয়া, মেয়েদের জীবনে স্বামীর ঘর ছাড়া আর কোন কিছুই দ্বিতীয় ঘর হতে পারে না৷ আর কোথাও সুখ মিলতে পারে না৷ সবকিছু বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে হয়৷ আজ যখন জামাই নিজে এসেছে তখন আমাদের আর দ্বিমত করা খাটে না। এখন যা সিদ্ধান্ত আমরা নিবো, তাই যেনো মঙ্গলের হয়৷ কোন ভুল সিদ্ধান্তে একটা জীবন এভাবে শেষ করে দেয়া যায় না ‘
আমার ননাস কয়েকবার আমার শাশুড়ির কথা উপেক্ষা করলো। সে সাফ জানালো যে সে যাবে না। শেষে দেখলাম আসিফ রুমে আসলো। তার বোনকে সে বললো,
‘দেখ আপা, দুলাভাই তোকে নিতে এসেছেন। একটা মেয়ে বিয়ে করে কার সাথে? একটা ছেলের সাথে তাইনা? নাকি একটা মেয়ে একটা পরিবার, একটা আলিশান বাড়ি, টাকা এসবের সাথে বিয়ে করে বল? একটা বিয়ে তো ঠিকেই থাকে স্বামী স্ত্রীর বুঝাপড়া, মতের মিল, ভালোবাসা, একে অন্যকে কেয়ার করার মাঝেই। এর মাঝে তো কোন দ্বিমত নেই তোর তাইনা? তাহলে দেখ, যে মানুষটা তোর জীবনে আসল প্রাধান্য রাখে, যে মানুষটা তোর জীবনের সব, সেই মানুষটাই তোকে নিতে এসেছে। সে কি একবারও বলেছে যে সে তোকে ডিভোর্স দিবে? আমি রাতেই নুপুরের কাছে সব শুনেছি৷ সে জিজ্ঞেস করেছিলো দুলাভাইকে এই কথা সরাসরি।দুলাভাই বলেছে যে সে ডিভোর্স দিতে চায়না, যা হচ্ছে বা হবে সব তার মায়ের ইচ্ছাতেই। আর আজ দেখ, দুলাভাই নিতে এসেছে তোকে। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে যে তোকে এভাবে কষ্ট দেয়া, অবহেলা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাইতো এসেছে ফিরে তাইনা? এখন কি তোর এমন করা চলে?’
আমার ননাস আসিফকে জড়িয়ে ধরলো। আসিফও কেমন জানি স্থির হয়ে রইলো কিছুক্ষণ! আসিফের মুখে স্বামী স্ত্রীর এই সম্পর্ক, একে অন্যের প্রতি কেয়ার, ভালোবাসা, ভিত্তির কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে অনুভব করতে লাগলাম, মানবজন্ম স্বার্থক হয়ে যায় এই ভালোবাসার কথাগুলো শুনলে। স্বার্থক হয়ে উঠে নিজের জীবনের লালিত স্বপ্নগুলো। এক পরশেই যেনো মুগ্ধতা এসে জড়িয়ে নেয় মানুষের সব ভালোবাসার আবেগ, অনুভূতি, অনুভব। বর্ষায় যখন জলেরা খেলে রাস্তায়, ঘাটে, মাটে, মানুষ যখন হাহাকার করে উঠে ফসলি জমি রক্ষার জন্য, তখন যে কৃষক পত্নী আর পতি একে অন্যের ভরসা হয়ে উঠে, এর চেয়ে মাটিমাখা ভালোবাসা আর কি হয়? আর কি খুঁজে পাওয়া যায়?
ননাস বললো,
‘আমার কিছু কথা আছে ওর সাথে। তোমরা আমাকে একটু ওর সাথে একা কথা বলতে দাও’
আমি ড্রইংরুমে গিয়ে দুলাভাইকে ডেকে রুমে নিয়ে এলাম। দুজনকে এক রুমে একা ছেড়ে দিলাম। শাশুড়ি মা বাইরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তানিয়া মানবে তো?’
আমি বললাম,
‘অবশ্যই মানবে। আপনি চিন্তা করবেন না মা।’
এদিকে রুমের ভেতরে দুজন কী কথা বলছিলো এর বিন্দুমাত্র আন্দাজ আমার ছিলো না। কিছুক্ষণ পর তারা বের হলো। ননাস জানালো, আগামীকাল সে তার শ্বশুর বাড়িতে যাবে। দুলাভাই চলে গেলো। আমি জিজ্ঞেস করার কোন সাহস পেলাম না যে কী কথা বললো তারা দুজনে!
রুমে এলাম। আসিফ সিগারেট টানছে। আয়নায় চুল আচড়াতে আচড়াতে তাকে বললাম
‘তুমি অনেক ভালো বুঝো সম্পর্ক সম্পর্কে তাইনা?’
‘কেন? হঠাৎ এমন বিচক্ষণ কথাবার্তা কেন হচ্ছে?’
‘না আপাকে বুঝিয়েছো দেখলাম। তাই আরকি!’
‘হুম! হয়তো। অথবা না ও। কেন? কোন প্রবলেম?’
‘না। প্রবলেম হবে কেন? ভালো লাগলো তাই বললাম।’
‘আপার সিদ্ধান্ত কী?’
‘আগামীকাল চলে যাবে সে শ্বশুর বাড়িতে।’
‘কিছু বলেছে আর?’
‘না। কিছু বলেনি।’
এদিকে ইফতার শেষ হতে না হতেই আমার শাশুড়ি শ্বশুরকে বললেন, আমার ননদ তামান্নার হবু শ্বশুর বাড়িতে আগামীকাল যেনো ইফতারি নিয়ে চলে যান। আর শাশুড়ি কল দিয়ে তাদের বলে দিলেন যে আগামীকাল আমার শ্বশুর ইফতারী নিয়ে আসছেন তাদের বাসায়।
আমি বারান্দায় কাপড় দিয়ে আসার সময় খেয়াল করলাম কাল যে ছেলেদের চায়নিজে দেখেছিলাম কথা বলতে যে তামান্না আমার না হলে আর কারো হবে না, সেই ছেলেটা বাসার নিচে মোটর সাইকেলে বসে আছে। ছেলেটা এক দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চোখের সাথে তার চোখ, চোখাচোখি হলো। আমি ভেতরে চলে এলাম। গ্লাস লাগিয়ে দিলাম৷ রান্নাঘরে গিয়ে শুনতে পারলাম, আমার ননাস আমার শাশুড়িকে বলছে,
‘ডাক্তার দেখাতে যাবো সন্ধ্যায়৷ সব টেস্ট করাবো ফাইনাল। যদি আমি মা হওয়ার ক্ষমতা না রাখি আর, তাহলে আমি আমার হাতেই আমার স্বামীকে নতুন বিয়ে দিবো। নতুন বউ ঘরে আনবো৷ আমার জন্য মানুষটাকে বাবা হওয়ার সাধ থেকে আমি বঞ্চিত রাখতে পারবো না। আমার এই সিদ্ধান্তের উপর আর কারো সিদ্ধান্ত হতে পারবে না। আমি এটাই ফাইনাল করেছি এবং তার সাথে এই শর্তেই যেতে রাজি হয়েছি। জানি না তোমরা কী রিয়েক্ট দেখাবে তবে আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়’
কিছুক্ষণ পর ননাসের শাশুড়ি আমার শাশুড়িকে কল করে যা তা ভাষায় কিছু কথা শুনালেন। সারকথা এই যে,
‘অলক্ষ্মী অপয়া মেয়েকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়েছেন এখন আমার ছেলেটাকেও তাবিজ করেছেন? আল্লাহ আপনার ঘর রাখবে না। আপনার সংসারও ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে বলে দিলাম। ধ্বংস হয়ে যাবে। ‘
[প্রিয় মানুষ, গ্রুপে সবাইকে ইনভাইট করবেন৷ মন্তব্য জানাবেন। ভালোবাসা]
(চলবে)