#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১৯
#মিদহাদ_আহমদ
‘আপনার স্ত্রী আর কখনো মা হতে পারবে না।’
ডাক্তার কথাটা বললেন তানিয়া আর তানিয়ার স্বামীকে। তানিয়া তার স্বামীর হাত শক্ত করে ধরলো। ডাক্তারকে সে জিজ্ঞেস করলো,
‘আর কি কোন চান্স নেই?’
ডাক্তার এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন তানিয়ার দিকে। বললেন
‘জানি এই পরিস্থিতি এক নারী জীবনে সংকটময় অবস্থার সৃষ্টি করে। একজন নারী মা হয়েই পূর্ণতা লাভ করে এটা আমাদের ধারণা। আর যদি ডাক্তারের ফিলোসোফি থেকে বেরিয়ে এসে আমি বলি, তাহলে এটা আমারও ধারণা। তবে ডাক্তারের অবস্থান থেকে বলবো, এটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিন। আপনি মা হতে পারবেন না এটা আপনার দোষের কিচ্ছু না৷ উপরওয়ালা যা নির্ধারণ করেছেন আমাদের জন্য, তাই তো হবে।’
তানিয়ার স্বামী ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
‘সমস্যাটা কোন জায়গায় তাহলে?’
‘mixed Turner syndrome। এগুলোর fertility এর treatment আমাদের দেশে নাই। অন্য দেশেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফেইলর হয়। তবুও আশা থাকে। আশায় মানুষ বাঁচে। এরচেয়ে বড় বাঁচা আর হতে পারে না জীবনে৷ তারপর এই বাঁচাকেই অবলম্বন করে মানুষ গড়ে তুলে তার স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্খা সবকিছু। এছাড়া থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে বা Prolectine হরমোন বেড়ে গেলে ডিম্বাণু পরিস্ফুটন নাও হতে পারে বা বড় নাও হতে পারে। আপনাদের ক্ষেত্রে এই শেষের সমস্যাই প্রকট হয়ে উঠেছে৷ এই সমস্যার কারণেই আপনার মিসেস আর কখনো মা হতে পারবেন না। আই এম সরি।’
তানিয়া তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরলো।
ননাস আর ননাসের স্বামী বাসায় আসতেই আমার শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী বলেছে ডাক্তার? কী বলেছে?’
আমি দেখলাম আমার ননাস জমে শক্ত হয়ে আছে। কোন ফিল তার মাঝে নাই যেনো। সে আর কথা বলছে না।
ননাসের স্বামী আমার শাশুড়িকে বললেন,
‘তানিয়া আর মা হতে পারবে না কখনো’
শাশুড়ি মাটিতে বসে শুরু করে দিলেন মরাকান্না। মাটিতে বসা অবস্থাতেই চেয়ার পা দিয়ে ঠেলে আমার দিকে ফেলে দিলেন৷ আমি চেয়ার ধরলাম। আমার উপর পরলো না। শাশুড়ি বললেন,
‘এই অলক্ষ্মী অপয়া মেয়ের জন্য সব হচ্ছে। সবকিছু এই মেয়েটার জন্য। আমি ঘরে এক ডায়নি এনেছি৷ কাল নাগিনী এনেছি৷ এই মেয়েটা আসার পর থেকে এক এক করে এসব অনাচার হচ্ছে।’
ননাস চোখের সামনে তার রুমে চলে গেলো। ননদ এসে মায়ের সাথে আমাকে যা তা বলতে শুরু করলো। আমি নাকি একটা কালো গ্রহের ছাপ নিয়ে এসেছি, আমার ভাগ্যে নাকি তাদের ফ্যামিলির সাথে এত বিড়ম্বনা হচ্ছে। তারা কষ্টে পড়ছে, তাদের সম্মানহানি হচ্ছে। ননদ বললো,
‘মাতাল ভাইকে ঠিক করার জন্য এনেছিলো মা তোমার মতো গরীব ঘরের মেয়ে। আর তুমি কী করছো? এসব?’
ভেতর থেকে আসিফ উঠে এলো। আমি আসিফকে কথা বলতে আটকালাম। আমার মনেমনে ভাবনা, তারা যা ইচ্ছা বলুক৷ এই অবস্থায় তাদের মনের ঘরটা ভালো নেই, একজন মা কখনো নিজের সন্তানের খারাপ দেখে ভালো থাকতে পারে না।
আসিফ আমার হাত তার বাহু থেকে ছাড়িয়ে নিলো। তেড়ে গিয়ে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তামান্নাকে। উঠে দাঁড়ালেন আমার শাশুড়ি। গড়গড় করে বললেন,
‘বাহ বাহ! আজ এই দিন আমার দেখতে হলো? এই মেয়েটা তোকে এতোই জাদু করেছে যে আজ তোর নিজের বোন, আপন বোন, ছোট বোনের গায়ে হাত তুলতে বাধলো না তোর?’
তামান্না বললো,
‘বাহ ভাইয়া! ক্লেপ ক্লেপ! দারুণ! আজ আমাকে তুমি মারতে পারলা? এই মেয়েটার জন্য আজ এতকিছু? ‘
আসিফ বললো
‘তোমরা সবাই কখন থেকে শুধু নুপুর নুপুর নুপুর করে চলছো। কোনকিছু হলে, কোন অঘটন হলে সব নুপুর করছে? আরে সেদিনও আপা যখন নুপুরের উপর দুলাভাই নিয়ে আঙুল তুললো, সেদিনও তো সে আমাদের সবার অগোচরে কার জন্য করলো? কার জন্য? আপার জন্যই তো তাইনা? বিনিময়ে কী শুনতে হলো? আপার কথাবার্তা, গঞ্জনা, অপমান? একটা মেয়ে আর কত সহ্য করবে এসব?’
আমি আসিফকে বললাম,
‘তুমি রুমে এসো প্লিজ। কথা বাড়িও না আর।’
আসিফ আমার দিকে তেড়ে এলো এবার৷ বললো,
‘কেন বলবো না? কেন? সব সময় এসব সহ্য করা? অন্যায়ের সাথে চলে এসব সহ্য করবো আমিও? না নুপুর এমন হবে না৷ এমন হবে না।’
শাশুড়ি নাকি গলায় বললেন,
‘ছেলেকে তাবিজ করে ফেললি তুই৷ তাবিজ করে ফেললি। আমার আর কিছু রইলো না। আমার আর কিছু রইলো না।’
আসিফ তার মাকে বললো,
‘তোমাদের সমস্যা কোথায়? এই মেয়েটা তোমাদের কী ক্ষতি করেছে? আমার জীবনের সাথে জুড়ে দিয়ে প্রথমেই তোমরা তার জীবন শেষ করে দিয়েছো৷ শেষ করে দিয়েছো সব।’
‘এত বড় বড় কথা? খাচ্ছিস তো আমাদের ঘাড়ে। ঘর ভর্তি মদ আর সিগারেট এর টাকা রুজি করার মুরোদ আছে তোর? বউ সোহাগী হওয়ার আগে নিজে কিছু করে দেখা আহাম্মক। নালায়েক। তারপর অধিকার দেখাতে আসবি।’
শাশুড়ির এই কথাটা কেমন জানি গভীর হয়ে লাগলো আসিফের এমন মনে হলো। আসির আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না সেখানে। রুমে চলে এলো। বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো৷ কয়েক টান দেয়ার পর সিগারেট ফেলে দিলো। কেমন মুচড়ে ফেলে দিলো সে। তারপর আমাকে বললো,
‘চলো।’
‘চলো মানে?’
‘এই ঘর থেকে চলো। এই ঘরে আর এক মুহূর্তও না।’
আমি আসিফের গরম মাথা বুঝতে পারলাম। তার হাত ধরে বললাম,
‘মাথা ঠান্ডা করো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘না। কোন ঠিক হওয়ার কিছু নাই এখানে। চলো।’
আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না। এমন উদ্ভূত পরিস্থিতি আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়৷ ভেতরের সাহস একেবারে শেষ করে দেয়। কম্পিত করে রাখে নিজের মন প্রাণ সব।
মিনিট পাঁচেকের মাথায় ব্যাগে কিছু ব্যবহার করা কাপড় নিয়ে আসিফ আমার হাত ধরে নিচে নেমে এলো। শাশুড়ি সামনেই বসা ছিলেন৷ পাশে আমার ননদ। শাশুড়ি আসিফকে বললেন,
‘অহ! বউয়ের হাত ধরে বাড়ি ছাড়বা এখন? দুইদিন পরে তো আবার এই ঘরে আসবি। এই ঘর ছাড়া তোর মদের পয়সা আসবে কোথা থেকে?’
আসিফ তার মায়ের কথার জবাব দিলো না। আমার হাত ধরে শাশুড়িকে অতিক্রম করার সময় শাশুড়ি আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন,
‘যে মেয়ে ঘর ভাঙ্গিয়েছে আমার, সেই মেয়ের ঘর আল্লাহ কখনো করতে দিবেন না। ছোটলোকের ঘরের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এসে আমি নিজেই নিজের ঘর ভাঙ্গলাম।’
আমরা দুজন বাড়ির সদর দরজা ক্রস করার সময়ে পেছন থেকে আমার ননাস আসিফকে ডাক দিয়ে বললেন,
‘দাঁড়া আসিফ! এইটা তোর ঘর৷ তুই কেন যাবি এখান থেকে?’
শাশুড়ি উঠে গিয়ে ননাসকে বললেন
‘কেন? এখন তুই ও নতুন হয়ে আসলি নাকি এখানে?’
‘মা! আমি মা হতে পারবো না। আমার শাশুড়ি সব কথা বলে দিয়েছে তামান্নাত হবু শ্বশুরবাড়ি। এখানে আমার দোষ, আমাদের দোষ। আল্লাহ আমাকে মা হওয়ার ক্ষমতা দেন নাই। এই দোষ এখন কেন আরেকটা মেয়ের ঘাড়ে পড়বে? সে কী অপরাধ করেছে?’
আমার ননদ আমার ননাসকে বললো এবার,
‘অহ! তারমানে এখন তোমাকেও সে হাত করে নিয়েছে? নিজে মা হতে পারবে না দেখে এখন ভাইর বউয়ের চামচামি করে জীবন কাটানোর পায়তারা করতে বসেছো?’
‘বল। তোর যা ইচ্ছা বল। আমি আর কোন কথা বলবো না। কোন কথাই না।’
ননাস আমার হাত ধরে বললো
‘তুমি অন্তত বুঝার চেষ্টা করো নুপুর। একটা ঘর মানুষ শূন্য হওয়া আর কবর হওয়ার মাঝে কোন তফাত নেই। আসিফ আমার একমাত্র ভাই। আমাদের পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য৷ আমাদের মাথার উপরে ছাতা। এই ভাইকে আমাদের থেকে দূরে নিয়ে যেও না। তুমি বুঝাও আসিফকে।’
আসিফ আমার ননাসের থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিলো। কোন কথা না বাড়িয়ে পা আগালো বাইরের দিকে। পেছন থেকে আমার শাশুড়ি বলতে লাগলেন,
‘আর কোনদিন যেনো এই মেয়েকে নিয়ে আমার ঘরের চৌকাট পার করতে না আসতে হয়।’
(চলবে)