#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৪
#মিদহাদ_আহমদ
পুরো মহল একেবারে চুপ হয়ে গেলো। ননাস নীরবে দাঁড়িয়ে আছে৷ বদরুল দুলাভাই বললো,
‘কী? কোনকিছু বলছো না যে?’
তারপর বদরুল দুলাভাই আসিফের সামনে এসে বললো,
‘ও না তোমার বোন হয়? জানো সে কি করেছিলো? জানো? তোমাকে যে আমি এক লাখ টাকা দিয়েছিলাম, সেই এক লাখ টাকা কেন দিয়েছিলাম জানো? তোমার বোনের কথায়। আর সে কেন দিয়েছিলো তোমাকে জানো? দিয়েছিলো এই ভেবে যে তুমি আবার নেশা করবে। নেশায় বুঁদ হয়ে যাবে। আর সম্পত্তি এই বাসা এই পরিবার সবকিছু সে একা একাই ভোগ করবে।’
আসিফ তেড়ে আসলো। দুলাভাই বললো,
‘না না না। রাগ দেখানো চলবে না। তোমার বোনকে জিজ্ঞেস করো। আমি মিথ্যা বলছি কিনা সত্য বলছি।’
ননাস হাউমাউ করে কান্না করে উঠে বললো,
‘আমি এসব করেছি। আমি এসব করেছি। আমি তোমার মোহে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে আমি কোনকিছু বাছবিছার করিনি। আমি শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম সব শেষে। আর যাই করেছি সব তোমার জন্য।’
শাশুড়ি মা ধীরপায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ননাসের দিকে। আমি তাঁকে হাত ধরে আটকালাম। আমি বুঝতে পারলাম এই মুহূর্তে কোন কথা বলা ঠিক হবে না। বদরুল দুলাভাইকে বললাম,
‘আপনি প্লিজ এখন এখান থেকে যান। প্লিজ।’
‘কেন? এসেছি যখন বলেই যাই। বলতে দোষ কোথায়।’
‘প্লিজ আপনি যান। প্লিজ’
‘দেখুন৷ এই মেয়েকে দেখুন। এই মেয়েকে আপনারা সবাই মিলে টর্চার করছিলেন না, এই মেয়েটাই এখন আপনাদের বাঁচাতে চাচ্ছে। আমি যেনো আর কিছু না বলি এজন্যই সে আমাকে চলে যেতে বলছে। আমি যাবো না। জানো আসিফ, তোমার সিগারেটে গাঁজা ছিলো গাঁজা। তোমার বোন জানতো সব। সব জেনেও সে আমাকে নিষেধ করেনি। আর তাকে আমি বিশ্বাস করবো? কোন যুক্তিতে আমি বিশ্বাস করবো? কোন কারণে? একে তো আমি বাবা হতে পারব না কোনদিন তোমার বোনকে নিয়ে থাকলে। তার উপর এসব? আমি কোন মীর জাফরের সাথে সংসার করতে পারবো না।’
আসিফ একেবারে থ বনে গেলো। আমি আসিফকে উপরে যেতে বললাম। আসিফ ননাসের সামনে এসে বললো,
‘আপা তুমি এমন করতে পারলা? তুমি? আমি না তোমার ভাই হই? আরে আমাকে বলতা যে তুমি সব চাও। আমার কোন লোভ নেই এসবে। কোন লোভ নেই। কিন্তু তুমি? এসব কেন করলা আপা? কেন?’
আসিফকে আমি উপরে যেতে বললাম। আসিফ আর কথা না বলে চলে গেলো উপরে। বদরুল দুলাভাই আমার সামনে এসে বললো এবার,
‘দেখেছিলা না মেয়ের সাথে কারে? ওইটা আমিই ছিলাম৷ আর মেয়েটা আমার মামাতো বোন। এসেছে লন্ডন থেকে। তাকে এই উইকেই বিয়ে করছি আমি৷ আর এই বিয়ের আগে তোমার ননাসকে ডিভোর্স দিচ্ছি৷’
কথাটা বলেই বদরুল দুলাভাই চলে গেলো।
পনেরো দিন কেটে গেলো। এর মাঝে বদরুল দুলাভাই আর তানিয়া আপার ডিভোর্স হয়ে গেলো৷ একদম নীরবে, নিভৃতে যেনো এই ডিভোর্স হলো৷ কেউ কোন আপত্তি করলো না৷ আমি শুধু খেয়াল করছিলাম, ডিভোর্স পেপারে সাক্ষার করার সময়ও তানিয়া আপার চোখ দিয়ে কোন জল এলো না। মানুষ অল্প শোকে কাতর হয়, অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়। আসিফ সেদিনের পর থেকে আর কথা বলেনি আপার সাথে। মা শুধু একবার বলেছিলেন তাকে, বোন হয়ে সে ভাইয়ের সাথে এমন ব্যবহার কেমন করে করলো। ফ্ল্যাটটা বদরুলের নামে রেজিস্ট্রি হওয়ায় ফ্ল্যাটের দাবি আর কেউ করতে পারিনি আমরা। শ্বশুর বলে দিয়েছেন, দাবিও যেনো না করি। ডিভোর্স শেষে উকিল মারফতে ননাসের বিয়ের কাবিনের পনেরো লাখ টাকা বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলো বদরুল। ননাস সেদিকে চেয়েও দেখেনি। আমার সাজানো গুছানো সংসারে একেবারে নিমজ্জিত জলপুষ্প এসে গেলো যেনো। আসিফ কাজে যায় না আর আগের মতোন নিয়ম করে। শাশুড়ি রান্নাঘরে এসে রান্না করেন না নানা পদের ভর্তা ভাজি। মা অসুস্থ বাড়িতে। তামান্না কল করে বললো গতকাল, তার স্বামী নাকি কাল রাতে তার উপর হাত তুলেছে। তামান্না কান্না করতে করতে আমাকে বললো,
‘ভাবি আমি আর সহ্য করতে পারছি না এখানে৷ আমার দিনটা ভালো কাটছে না। এখানের সব কয়টা মানুষ যেনো একেবারে আমার উপর উঠেপড়ে লেগেছে। আর কীভাবে কীভাবে যেনো জেনেছে যে আপার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে৷ এ নিয়েও তারা আমাকে কম কথা শুনাচ্ছে না।’
আমি তামান্নাকে বুঝালাম। এও বললাম, মাকে যেনো সে এসব না বলে। মায়ের অবস্থা দেখে আমার ভয় হয়। একজন মানুষ ভেতর থেকে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন যেনো। শ্বশুর এখন নীরবে ইজি চেয়ারে বসে পেপার পড়েন শুধু৷ আর দুই একবার আমাকে ডেকে চা দিতে বলেন। বরাবরের মতো আমি রান্নাঘরে ছিলাম। শ্বশুর ডাক দিলেন,
‘নুপুর, মা এদিকে আসো তো।’
‘হ্যাঁ বাবা বলেন।’
‘এক কাপ চা হবে? আর অল্প চিনি দিয়ে দিও কেমন?’
‘আচ্ছা বাবা।’
শ্বশুরের ডায়াবেটিস। তবুও আমাকে আবদারের সুরে বলেন যে সামান্য চিনি দিয়ে দিতে। আমিও না করি না। অল্প একটু দিয়ে দেই। জানি এতে ওনার জন্যই খারাপ। তবুও দেই। আমার যে বাবা নেই। বাবা থাকলে এমন আবদার আমাকে আমার বাবাও করতেন নিশ্চয়ই!
চা নিয়ে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যে। শ্বশুর পত্রিকার নিচ থেকে একটা কারেন্ট এফেয়ার্স বের করে দিয়ে বললেন,
‘এটা পড়ো।’
‘কেন বাবা?’
‘সাম্প্রতিক প্রশ্ন সব আছে এইটায়। এই মাসের শেষে ফার্স্ট ভিউ আর সামনের মাসের শুরুতে লাস্ট ভিউ বাজারে আসবে পত্রিকায় দেখলাম। আর কিছু বই অর্ডার দিয়েছি আমি পত্রিকা দেখে দেখে। তোমার কাজে লাগবে। মেডিকেলে তো সাধারণ জ্ঞান আসে। আর ইংরেজি নিয়ে আমার কাছে বসবা। আমি রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ইংরেজির গ্রেজুয়েট করা স্টুডেন্ট। বুঝলা? এত বছর কাওকে পড়াইনি৷ পড়ানোর দরকার হয়নি অবশ্য৷ এখন বাসায় আছি, তোমাকে পড়াবো। কেমন?’
শ্বশুরের কথায় আমার চোখ দিয়ে জল চলে এলো। আমি কী বলবো বলে বুঝাতে পারছিলাম না তখন। আমি নিশ্চুপে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে রুম থেকে বের হয়ে আসছিলাম। শাশুড়ি আমাকে পেছন থেকে ডাক দিলেন৷ আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। শাশুড়ি ডাক দিয়ে এসে আমাকে ধরে বসিয়ে সে কী কান্না! একেবারে নাস্তেনাবুদ অবস্থা যাকে বলে। শাশুড়ি আমাকে ধরে কান্না করতে করতে বলতে লাগলেন,
‘মারে, আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি জানি তোকে যে কষ্ট দিয়েছিলাম সেই কষ্ট আমার মেয়েদের উপর এসে লেগেছে। তুই বলেছিলি আমার মেয়েরা সংসার করতে পারবে না সুখে। আর কারো অন্তর থেকে আসা বদদোয়া লাগলে জীবন একেবারে ছাড়খাড় হয়ে যায়। মারে তুই আমার মেয়ের মতো। তোর দোহাই লাগে তোর মনের কষ্ট তুই আমার উপর নিয়ে আয়৷ আমার দিল ডাকছে, আমার তামান্নাও শ্বশুর বাড়িতে শান্তিতে নাই।’
আমার মুহূর্তেই মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথাটা। সেদিন কথায় কথায় ননাস আর ননদকে বলেছিলাম তারা দুজনে শান্তিতে ঘর সংসার করতে পারবে না। আমি শাশুড়ির চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললাম,
‘কী বলছেন মা এসব? আমি আপনার মেয়ে। তানিয়া আপা, তামান্না এরা আমার বোন। আর বোন হয়ে বোনের অভিশাপ লাগে বলেন? আমার ভুল হয়েছে মা আমি এমন কথা মুখ দিয়ে এনেছি। আমার নিজের লজ্জা হচ্ছে এখন।’
শাশুড়ি মায়ের চোখ নাক দিয়ে যেনো জলের বারিষা শুরু হয়েছে। হেলে পড়লেন আমার বুকে। কান্না জর্জরিত গলায় বললেন,
‘মারে, আমার মেয়ে দুইটার সাথে কেন এমন হচ্ছে! কেন!’
আমি কথা বলার জন্য উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পেলাম না। দুই চোখ আমারও আর বাধ মানলো না। অজান্তেই নোনাজলে ভিজে উঠলো চোখের চারপাশ। রুমে এসে খুব কান্না করলাম। আল্লাহর কাছে মনে মনে বললাম, আমার রাগের মাথায় বলা ফরিয়াদ যদি তিনি কবুল করে ফেলেন, তাহলে যেনো তা আবার ফিরিয়ে নেন। আমি এমন ক্ষতি চাইনি মালিক।
রাতে খাবার নিয়ে ননাসের রুমে গেলাম। ননাস একেবারে ঝিম ধরে বসে রয়েছে। আয়নার দিকে তাকাচ্ছে। তাকে আমার দিকে ফিরিয়ে মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বললাম,
‘জানেন আপা, আমাদের স্কুলের সবচাইতে কড়া কিন্তু মমতাময়ী যে টিচার, রাশিদা আপা, উনার বিয়ের চার বছরের মাথায় বর মারা যায়। আপার কোন বাচ্চা ছিলো না। আপা তারপর বাকি জীবন স্কুলে শিক্ষকতা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। আপা কী বলে জানেন, আপা বলে যে, লাইফে যখন ফুল স্টপ বসে যাবে, ঠিক তখনি আমরা সেই ফুল স্টপের শেষে আরও দুইটা বিন্দু যোগ করে দিবো৷ তখন আর ফুল স্টপ, ফুল স্টপ থাকবে না। টু বি কন্টিনিউড হয়ে যাবে…। তাইনা?’
তানিয়া আপা তার কান্নায় ভাঙ্গা কন্ঠে আমাকে বললো,
‘জানিস নুপুর, জীবনের কত স্বপ্ন, কত আশা, কত ভরসা আমি দেখেছিলাম ওই মানুষটাকে নিয়ে! আর আজ কী হচ্ছে জানিস…’
এমন সময় ননাসের হোয়াটসঅ্যাপে ডাক দিয়ে একটা মেসেজ এলো৷ দেখলাম বদরুলের প্রোফাইল দেয়া ছবির আইডি থেকে মেসেজ এসেছে। তানিয়া আপা আমাকে দেখিয়ে বললো,
‘আজ সেই মানুষটা নতুন বিয়ে করে সংসার পাতছে। এই দেখ নুপুর।’
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম এর আগেও কয়েকটা ছবি দিয়েছে লোকটা। আর এবার তার বিয়ে করা বউয়ের সাথে ছবি আর নিচে লিখে দিয়েছে,
‘কেমন বোধ করছো এবার? আমি আমার সংসার নতুন করে সাজালাম৷ নিজের মাথার ভেতরে থাকা কুবুদ্ধি নিয়ে নিজে বাঁচো’
আমি মেসেজটা দেখে আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। সাথেসাথে তাকে কল দিলাম। কল দিয়ে সাবধান করে দিলাম, এরপর যদি এমন কিছু আসে তাহলে তার নামে সাইবার ক্রাইমে হ্যারেজ করার মামলা আমি নিজে দিবো।
ননাসখে খাইয়ে রুমে চলে এলাম। আসিফ সিগারেট খাচ্ছিলো নীরবে। হুট করে তার কাশি উঠলো। ঝুড়িতে কাশি ফেলার সময়ে খেয়াল করলাম, আসিফের কাশির সাথে মুখ ভর্তি রক্ত বের হচ্ছে। আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। মাথার উপরের আকাশ বিলীন হয়ে যেতে লাগলো। মনের কোটর থেকে স্নাত হতে লাগলো বিষের বর্ষণ। চোখমুখ মলিন হতে শুরু করলো। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। কী দেখছি আমি এসব!
(চলবে)