বিন্নি ধানের খই পর্ব-৫২

0
7877

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫২
#মিদহাদ_আহমদ

Coleman A. Young International Airport এ গিয়ে যখন আমরা ল্যান্ড করি, তখন আমার ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো৷ আমি কোথাও যেনো নিজের অস্তিত্ব ছেড়ে এসেছি। আমার গল্প যেনো আমাকে টানছে। মায়ের মন সব সময় সন্তানের জন্য আনচান করে উঠে। আসিফ আমার হাত শক্ত করে ধরলো৷ আমাকে ভরসা দিয়ে বললো,

‘টেনশনের কোনকিছু নেই নুপুর। দেখো আমাদের সামনে বিশাল পৃথিবী। আমরা আমাদের সেই পৃথিবীর খোঁজে এসেছি। আমাদের এখন এগিয়ে যেতে হবে আপন খোঁজার উদ্দেশ্যে। আমাদের ড্রিম পূরণের উদ্দেশ্যে।’

আমি আসিফের দিকে তাকিয়া চোখের পাতা ফেলে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম। সামনেই রাজীব আর তামান্না কার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তামান্নার হাত ধরে আছে সেই পুচকে রাফসান। রাফসানের বয়স দেখতে দেখতে চার হয়ে গিয়েছে। রাফসান বয়সের তুলনায় কিছুটা লম্বা। ঠিক তার বাবার মতোন হয়েছে যেনো। তামান্না আমাকে দেখিয়ে রাফসানকে বললো,

‘সি ইজ ইউর আন্টি। সে হেলো।’

‘হেলো আন্টি।’

আমি একটা চুমু খেলাম রাফসানের কপালে। রাফসানের শরীর থেকে বের হওয়া বাচ্চা সুলভ গন্ধ আমাকে মাতৃত্বের টানে অবস করে ফেললো। অজান্তেই ভিজে এলো চোখ দুইটা। আসিফ হয়তো বুঝতে পেরেছিলো। রাফসানকে আমার থেকে ছাড়িয়ে সে হ্যান্ড শেইক করলো রাফসানের সাথে। আমরা গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। রাজীব আমাদের নিয়ে একটা পিৎজা কোর্টে ঢুকলো। রাফসান বলে উঠলো,

‘চিকেন পিৎজা…নট স্পাইসি, নট স্পাইসি।’

তামান্না হেসে উঠলো৷ আসিফের দিকে চেয়ে বললো,

‘ভাগিনা তার মামার মতোই হয়েছে। সেও ঝাল খেতে পারে না। আর পিৎজাই ওর পছন্দ৷ এছাড়া ফার্স্টফুড সে কোনকিছু খায় না তেমন।’

আমার আবার মনে পড়ে গেলো আমার গল্পের কথা। আমার বানানো আলুর চিপস আর ম্যাকারোনি নুডুলস মেয়েটা সস দিয়ে খেতে দারুণ পছন্দ করতো! দুধদাঁত দিয়ে যখন কুটুস কুটুস করে আলুর চিপস কেটে খেতো, তখন তাকে কী দারুণ লাগতো! সস আঙুলে নিয়ে কাপড়ে লাগিয়ে একদম যা তা অবস্থা করে ফেলতো মেয়েটা! আমি বকাঝকা করলেও মেয়েটা ফিক ফিক করে হাসতো৷ কী জানি মায়ের বকাকে তার কাছে হাসি খেলা মনে হতো হয়তো!

এদিকে তানিয়াকে গল্পের সাথে একা একা কথা বলতে দেখলেন তানিয়ার মা। তানিয়া গল্পকে নিজের কোলে নিয়ে বলছে

‘এইতো মা। তোমার মা তোমার কাছে চলে এসেছে। আমার ছোট্ট মেয়েটা। আমার একমাত্র মেয়ে। ‘

কথাগুলো বলছে আর গল্পকে জড়িয়ে ধরছে সে। তানিয়ার মা দরজা খুলে রুমে ঢুকলে তানিয়া উঠে এসে এগ্রেসিভভাবে বলে বসে,

‘আরে দেখছো না আমার মেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তুমি এখন চলে এলা। তাও দরজা শব্দ করে খুললা। আমার সোনামনির ডিস্টার্ব হচ্ছে৷ বুঝো না কেন তোমরা। আমার বাবুটার কষ্ট হচ্ছে এখন।’

তানিয়াকে কিছু বললেন না তানিয়ার মা৷ চলে এলেন রুম থেকে। সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা৷ নুপুর কল করেছে আমেরিকা থেকে। প্রতিদিন ই কয়েকবার করে। ভিডিও কলে দেখে মেয়েকে৷ কথা বলে সবার সাথে। ঠিক তেমনি কল করেছিলো। কিন্তু বাধ সাধলো তানিয়া। সে গল্পকে ভিডিও কলে দেখাবে না। তানিয়াকে তানিয়ার মা বুঝানোর চেষ্টা করলেও তানিয়া বলে বসলো,

‘না। আমার মেয়েকে সে দেখবে কেন৷ আমার মেয়েকে কেন তাকে দেখতে দিবো? সে কেন দেখবে? শুধু শুধু আমি অন্যজনকে আমার মেয়ে দেখতে দিবো না। নজর লেগে যাবে। নজর লেগে যাবে। তোমরা আমাকে জোর করো না৷ সরো এখান থেকে।’

তানিয়া গল্পকে নিয়ে রুমের ভেতর থেকে লক করে দিলো। নুপুর আর জোর করলো না। নুপুরকে নুপুরের শাশুড়ি বললেন যে তানিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে গল্পকে নিয়ে দরজা লাগিয়ে৷

একদিন তামান্নার মা খেয়াল করলেন তানিয়া গল্পকে মোবাইলে নুপুরের ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে বলছে,

‘আম্মু ওই দেখো তোমার ফুপি। ফুপি।’

তারপর সে নিজের দিকে ইশারা করে বলতে লাগলো,

‘আয়ায়াম্মু। বলো মা আম্মু’

গল্পও আম্মু বলতে বলতে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো তানিয়ার উপর। হঠাৎ তানিয়া তার মাকে দরজায় দাঁড়ানো দেখলে সে ডেকে বলতে লাগলো,

‘মা দেখেছো আমার মেয়ে আমাকে মা বলে ডেকেছে? দেখেছো মা?’

তানিয়ার মা রুমে ঢুকলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। উপরের দিকে তাকিয়ে মনের ভেতরে জাগ্রত হওয়া শঙ্কাকে হাতছানি দিলেন আনমনে। মুখে কিছুই বললেন না।

আসিফ মাস্টার্স শেষে পিএইচডির জন্য আবেদন করলো। আসিফের পিএইচডি থিসিস শেষের দিকে চলে আসলো আর এদিকে আমার ডিগ্রিও কমপ্লিট হয়ে যায়। আমি যেনো এক প্রশান্তির রেশ অনুভব করতে লাগলাম। আমি দেশে ফিরে আসতে চাইলেও আসিফ বাধা দেয়। আসিফ বলে,

‘শুনো, এখন মাস্টার্স কমপ্লিট করে পিএইচডি। এইটাই তোমার আসল গোল হওয়া উচিত। এছাড়া আর কোনকিছু না৷ আর দেশে আমাদের গল্প তো আছেই। মা আছেন, আপা আছেন। তাদের কাছে সুস্থ মতেই আছে আমাদের গল্প। কোন চিন্তা করার কিছু নেই। তুমি শুধুশুধু টেনশন নিচ্ছো কেন?’

শত বুঝানোর পরও আসিফ তার কথায় অটুট রইলো। সে জানিয়ে দিলো, আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করে পিএইচডি শেষে তবেই দেশে ফিরতে পারবো। এর আগে না। শেষমেশ আসিফের কথার জেরে আমাকে মানতেই হলো। শাশুড়ি কল করে বারবার বলতেন, আমি যেনো দেশে চলে আসি। সবকিছু যেনো নিজের হাতে আগলে নেই আবার। আসিফকে বললাম, ভ্যাকেশনে দেশে যেতে। আসিফও রাজি হয়ে গেলো।

আজ সেই দিন। আজ আমি বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। মাত্র দুই সপ্তাহের জন্যই হোক, আমি আমার গল্পকে আমার কাছে পাবো। নিজের কাছে পাবো। আমার নাড়িছেঁড়া ধন আমার কাছে আসবে। প্লেইনে বসে বসে আসিফকে জিজ্ঞেস করছিলাম বারবার,

‘আমার গল্প অনেক বড় হয়ে যাবে তাইনা? এখন সে বলতেও শিখে গিয়েছে পুরোপুরি। ক্লাস ওয়ানে পড়ে৷ অনেক পটু হয়ে গিয়েছে না আমার গল্প? আমাকে চিনতে পারবে তো?’

‘আরে বাবা পারবে। আর কিছুক্ষণ মাত্র। কয়েক ঘন্টা। তার পরেই আমাদের গল্প আমাদের কাছে চলে আসবে। তাইনা? দুই সপ্তাহের জন্য মেয়েকে মন খুলে দেখো। কেমন?’

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেইস ল্যান্ড করলো দুপুর তিনটায়। আধা ঘন্টা থেমে আবার যাত্রা শুরু করলো সিলেটের উদ্দেশ্যে। সিলেট এয়ারপোর্ট থেকে সবকিছু শেষ করে বের হতে হতে পাঁচটা বেজে গেলো। শ্বশুর এয়ারপোর্টে চলে এসেছেন আমাদের নিতে। শ্বশুরের সবকটা দাড়িতে যেনো পাক ধরে গিয়েছে৷ আমি সালাম করলাম তাঁকে পায়ে ধরে। শ্বশুর আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,

‘জীবনে বহুত তারাক্কি করো মা। অনেক দোয়া করি৷ আল্লাহ তোমার সব স্বপ্ন পূর্ণ করুন’

বাসায় ঢুকতেই মায়ের হাতের মোরগ ভূণার গন্ধ পেলাম। আমার মায়ের হাতের। সেই মোরগের গন্ধ, আমাদের টিনচালা ঘরের মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করা ভূণার গন্ধ! শাশুড়ি মা আর আমার মা বাইরে চলে এলেন। শাশুড়িকে সালাম করলাম পায়ে ধরে। শাশুড়ি আসিফকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলেন৷ তারপর বলতে লাগলেন,

‘বাবা কতদিন হয় তোকে দেখিনা। কতদিন!’

আমার মন শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছিলো গল্পকে। গল্প কোথায়। আমি বলার আগেই শাশুড়ি বললেন,

‘গল্প তার আর্ট টিচারের কাছে গিয়েছে নুপুর। তানিয়ার সাথে। আগামী পর্শুদিন তাদের একটা এক্সিবিশন আছে আর্টের। চলে আসবে কিছুক্ষণের মাঝে। আসো ভেতরে।’

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আসিফ আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো একবার। তার এই হাসির মুখে থাকা কথাটা ছিলো এমন, ‘আসবে তো গল্প। এতো উতলা হয়ো না তো তুমি’ আমি এই কথাটা মনে মনে বুঝে নিলাম। বসলাম সোফায়। শাশুড়ি কাজের মেয়েকে ডেকে সব লাগেজ আমাদের রুমে নিয়ে রাখতে বললেন। আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। এই সেই সিঁড়ি, এই সেই বাড়ি যেখানে আজ থেকে আট বছর আগে আমি বউ হয়ে এসেছিলাম। রুমের দরজা খুলতেই দেখলাম সবকিছু সেই আগের মতোই গোছানো। সব ঠিকঠাক। পরিবর্তন শুধু রঙে। আগে চার দেয়ালের এক দেয়ালে ছিলো ক্রিম কালার, মাথার পেছনে বেগুণি আর ঠিক সামনে সাদা আর গোল্ডেনের ছোপ ছোপ। অন্য দেয়াল জুড়ে কেভিনেট। এখন পুরো তিন দেয়ালেই সাদা। মাথার উপরে শুধু গাঢ় বেগুণি আভা। দেয়ালে সেটে রয়েছে শিল্পী হাসেম খানের বানানো আমাদের দুজনের সেই পোর্টেট! কী মায়া মাখা ছবিটা! জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ বেলের আওয়াজ। আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আসিফও আমার সাথে এলো। শাশুড়ি মা দরজা খুলে দিলেন। একটা ফুটফুটে সুন্দর পরির মতো বাচ্চা মেয়ে তার মোলায়েম দুই হাত দিয়ে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মায়ের হাতে ব্যাগ দিতে দিতে বাচ্চা মেয়েটা বললো,

‘জানো নানুভাই, আজ কী হয়েছে? আজ আমাদের ফাইনাল সিলেকশন ছিলো। আর আমি সিলেক্টেড হয়েছি। আজ আমি ভীষণ খুশি।’

‘আই লাভ ইউ আম্মু’ কথাটা বলেই সেই ছোট্ট মেয়েটা জড়িয়ে ধরলো তার পাশে থাকা সাদা শাড়ি পরিহিতা মহিলাকে। আমি মহিলার দিকে তাকালাম। লম্বা ইষৎ চুল আর সাদা শাড়িতে সবুজ পাড়ে শাড়ি পরা মহিলাটাই আমার ননাস তানিয়া।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here