#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৫
_____________
আমেরিকার শরৎকাল। গাছে গাছে এখন হলুদ, লাল, কমলা রঙের পাতার সমারোহ। কালো পিচের রাস্তার দু ধারে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন গাছের ঝাঁক। রাস্তায় কিছু মানুষের চলাচল আছে। তবে খুব বেশি না। কেউ কেউ আবার সাইক্লিং করছে। পনেরো বছর বয়সী দুরন্ত কিশোর আষাঢ়ের সাইকেলও দ্রুত বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। সাইকেলটা নতুন পেয়েছে সে। কাল বিকেলে তার ফুফু গিফট দিয়েছে সাইকেলটা। সাইকেল পেয়ে কাল বিকেলে একবার চক্কর দেওয়া হয়নি। তাই সকাল হতেই বেরিয়ে পড়েছে। আমেরিকায় এসে এই প্রথম সাইকেল চালাচ্ছে। প্রথম হলেও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়াই ইতোমধ্যে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে। কিন্তু প্রথম অঘটনটা ঘটলো রাস্তার ডানে বাঁক নেওয়ার পর। তার সাইকেলের গতি দ্রুত ছিল। আর রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা মেয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। রাস্তাটা কেবল ওয়াকিং এবং সাইক্লিং এর জন্য। এমন একটা ঘটনায় আষাঢ় বুদ্ধিহীন হয়ে পড়লো। সাইকেলে ব্রেক কষার পরিবর্তে সে মেয়েটাকে চেঁচিয়ে সামনে থেকে সরে যেতে বললো। মেয়েটা তার চ্যাঁচানো গলা শুনে চোখ তুলে তাকালো। চোখ দুটো মুহূর্তে ভরে ওঠে আতঙ্কে। মেয়েটাও এমন পরিস্থিতিতে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েলো। সে দৌঁড়ে রাস্তা থেকে সরে না গিয়ে আতঙ্ক আঁখি জোড়া নিয়ে তাকিয়ে রইল।
আষাঢ় ব্রেক কষে। কিন্তু ব্রেক কষে লাভ হলো না। যতক্ষণে ব্রেক করলো ততক্ষণে সাইকেলটা মেয়েটার গায়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে!
মেয়েটা পড়ে যায়, সেই সাথে ছিটকে পড়ে মেয়েটার হাতে থাকা টিউলিপ ফুলগুলো। এদিকে আষাঢ়ও পড়লো সাইকেল নিয়ে। এমন এক্সিডেন্টে রাস্তায় থাকা দুই তিনজন পথচারীর মনোযোগ তাদের উপর এসে পড়ে। আষাঢ়ের মুখ থেকে ব্যথাতুর শব্দ শোনা যায়। সে খানিক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করে রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটার দিকে দৃষ্টিপাত করলো না। মেয়েটা ওদিকে পড়েছে। সে ব্যস্ত হলো নিজের সাইকেল নিয়ে। সাইকেলটা উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে উৎকণ্ঠা হয়ে বলতে লাগলো,
“ওহ মাই সাইকেল….মাই সাইকেল…”
এবার মেয়েটার দিকে তাকালো সে। আক্রোশপূর্ণ চাহনি। মেয়েটার দিকে এগিয়ে এসে রাগী তারস্বরে বললো,
“হেই ইউ, পৃথিবীতে কি সাইকেলের অভাব পড়েছে? এত সাইকেল থাকতে তুমি আমার সাইকেলের সামনে এসে কেন পড়লে? আর কোনো সাইকেল পাওনি? তুমি আমার সাইকেলকে আঘাত করেছো। ওর চিকিৎসার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তোমার।”
মেয়েটা তখনও রাস্তায় পড়েছিল। সে উঠে বসলো। হাতের তালু আহত হয়েছে। আষাঢ় তা দেখতে পেলেও, মায়া হলো না তার।
দশ বছর বয়সী ছোট মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। সাথে নিজের টিউলিপ ফুলগুলো তুলতে ভুললো না। দুইহাত দিয়ে টিউলিপগুলো আঁকড়ে ধরে মাথা নিচু করে আষাঢ়ের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। ভয়ে তার ভিতর মিইয়ে গেছে। এমন এক ভাব যেন আর একটু হলে কেঁদে দেবে সে।
আষাঢ় থেমে নেই, সে একাধারে বকে চলেছে,
“কখনো হাঁটোনি আর রাস্তা দিয়ে? জানো না কীভাবে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়? তুমি কি ভিনগ্রহ থেকে এসেছো? হেই গার্ল, চুপ করে আছো কেন? ভেবেছো চুপ করে থাকলে পার পেয়ে যাবে? নো, নেভার। আমার সাইকেলের ট্রিটমেন্টের খরচ দাও।”
মেয়েটার হেলদোল হলো না। আষাঢ় খানিক নীরব দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু আর ধৈর্যতে সইলো না। বলে উঠলো,
“কী হলো? তুমি চুপ কেন? ক্ষতিপূরণ দেবে না? ও কে, আমি পুলিশে ইনফর্ম করবো।”
আষাঢ় পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল করা দিলে মেয়েটা কেঁদে উঠলো। আষাঢ় থেমে গেল, ঘাবড়ে গেল। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল মেয়েটার নত করে রাখা চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু ধারা নামছে। আষাঢ় সত্যিই অনেক ঘাবড়ালো। আশেপাশে তাকালো একবার। এখনও কয়েকজন মানুষ দূরে থেকে তাদের দেখছে। আষাঢ়ের মনে হলো সে সত্যি সত্যি ঝামেলায় পড়েছে। সে মেয়েটার দিকে তাকালো। কণ্ঠ আগের থেকে একটু নরম হলো।
“হেই, তুমি কাঁদছো কেন? আমি কি তোমাকে মেরেছি? দেখো, কান্না বন্ধ করো। তুমি আমাকে ঝামেলায় ফেলে দেবে। ও কে, তোমাকে ছাড় দেবো আমি। করবো না পুলিশে ইনফর্ম। কান্না থামাও প্লিজ!”
আষাঢ়ের কণ্ঠে অনুরোধ।
মেয়েটার কান্না থামলো না। কান্নারত অবস্থায় একটা অবাক কাজ করলো। দুই হাতে টিউলিপগুলো আঁকড়ে ধরে এক দৌঁড় দিলো।
আকস্মিক এমন ঘটনায় আষাঢ় চমকে উঠলো। যখন বুঝলো মেয়েটা পালিয়ে যাচ্ছে, তখন পিছন থেকে দৌঁড়ে গিয়ে মেয়েটার পথ আটকে দাঁড়ালো। মেয়েটার থেমে যেতে হলো। মেয়েটার দু চোখ থেকে এখনও অশ্রু ঝরছে। তবে নীরব।
এই প্রথম মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো আষাঢ়ের দিকে। তাও হয়তো তাকাতো না। এমন ঘটনায় চোখ বোধহয় নিজ থেকে আষাঢ়ের দিকে চলে গেল। মেয়েটার চোখে চোখ পড়তে আষাঢ় থমকে গেল। মেয়েটার দু চোখে ভয় ঠিকরে বেরিয়ে আসছে যেন। আষাঢ় বুঝতে পারলো না ব্যাপারটা। সে কি এতটাই রুড ছিল, যে মেয়েটা এতটা ভয় পেয়েছে? আষাঢ়ের হঠাৎ মায়া হলো ওই চোখ দুটো দেখে। ভেবেছিল পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার অপরাধে মেয়েটাকে কঠিন কঠিন কথা শোনাবে, কিন্তু ওই চোখ দুটো এবং মেয়েটার বাচ্চা মুখ দেখে সে হঠাৎ নরম থেকে অতি নরম হয়ে গেল। যা তার কঠিন করে বলার কথা তা বললো অতি নরম কণ্ঠে,
“পালিয়ে যেতে চাও তুমি? এত সাহস তোমার?”
মেয়েটা তাকিয়ে রইল। দু চোখে কী ভীতিছায়া! আষাঢ় আরও নরম হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“নাম কী তোমার?”
মেয়েটা কথা বললো না। আষাঢ়ের মনে হলো মেয়েটা বোবা। তাই জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি কথা বলতে পারো না?”
মেয়েটা নিশ্চুপ। একটু শব্দও করলো না। শুধু নিজের ওই ভীতগ্রস্ত আঁখি জোড়া দিয়ে আষাঢ়কে নম্র করে দিতে লাগলো।
আষাঢ় বললো,
“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে, তুমি কথা বলতে পারো না। বলো, নাম কী তোমার?”
মেয়েটা মুখ খুললো না। কিন্তু কান্না থামলো। কান্না থেমে জল শুকিয়ে যেতে লাগলো চোখ থেকে। কিন্তু দু চোখের ভীতি কাটলো না। মেয়েটার চোখ দেখে আষাঢ়ের খুব মায়া হচ্ছে। মেয়েটার দু চোখে কী যেন একটা মিশ্রিত। জিনিসটা কী? কেমন অসহায় দুটি আঁখি। অসহায়ত্বটাই মিশ্রিত না কি চোখ দুটি তে?
“তোমার কি নাম নেই?”
আষাঢ়ের প্রশ্ন এবারও মেয়েটার মুখে উত্তরের বুলি ফোঁটাতে পারলো না। মেয়েটা আগের ন্যায় তাকিয়ে থাকলো।
আষাঢ় অধৈর্য হয়ে উঠলো,
“কাম অন, টেল মি ইওর নেম। হোয়াট ইওর নেম? যদি আমাকে নাম না বলো, তাহলে আমি কিন্তু একটা উটকো নাম দিয়ে দেবো তোমাকে। সেটা কি ভালো হবে?”
মেয়েটা নিশ্চুপ। একটা মানুষ এভাবে চুপ থাকতে পারে জানতো না আষাঢ়। সে বললো,
“ও কে, যখন তুমি বলবে না তখন নিজেই একটা নাম দিচ্ছি তোমাকে।”
আষাঢ় মেয়েটার হাতের টিউলিপ ফুলগুলো একনজর দেখে মেয়েটার মুখে তাকালো আবার। বললো,
“টিউলিপ! আজ থেকে তোমার নাম হবে টিউলিপ।”
“বাট আই হ্যাভ অ্যা নেম।” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে মেয়েটি বললো।
আষাঢ় চমকে উঠলো। সে একদম আশা করেনি মেয়েটা কথা বলবে। ধরে নিয়েছিল মেয়েটা আসলেই বোবা। কিন্তু মেয়েটা তাকে অবাক করে দিলো। সে টানা সুরে বললো,
“ও―তাহলে কথা বলতে পারো তুমি! কিন্তু এখন কথা বলেও যে কোনো লাভ নেই টিউলিপ ফুল। তোমার নাম আছে সেটা দিয়ে এখন আমি কী করবো? আগে বলে দিলে তো এটা হতো না। তোমাকে নাম দেওয়া হয়ে গেছে, ওটা আর ফেরত আনা যাবে না।”
মেয়েটা চুপসে গেল। বিষণ্ন একটা রূপ ফুঁটে উঠলো চেহারায়। চোখ ঢেকে গেল অসহায়ত্বে। ক্ষণিকের জন্য যেন অসহায়ত্ব ভাবটা উবে গিয়েছিল। আষাঢ় জিজ্ঞেস করলো,
“হোয়াট’স ইওর রিয়েল নেম?”
মেয়েটা আষাঢ়কে তাৎক্ষণিক আবার অবাক করলো। আষাঢ়ের পাশ কাটিয়ে এক ছুট লাগালো। অকস্মাৎ কাণ্ডে আষাঢ় বিস্ময়ে জমে গেল। পিছন থেকে তাকিয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে। এই মেয়েটা এমন কেন? এমন অস্বাভাবিক আচরণ! নতুন এসেছে এ দেশে? আষাঢ় চোখ ফিরিয়ে আনলো। রাস্তায় চোখ পড়তে দেখতে পেল একটা টিউলিপ পড়ে আছে। এমন মেয়ে, ফুলও ফেলে গেছে! আষাঢ় তুলে নিলো ফুলটা। হঠাৎই তার ওষ্ঠ্যতে হাসি ফুঁটে উঠলো, ফুলটার দিকে তাকিয়ে থেকে হাস্যমুখে উচ্চারণ করলো,
“টিউলিপ ফুল!”
____________________________________________
আষাঢ়ের মুখে ‘টিউলিপ’ ডাক শুনে নোয়ানা কিছু সময় স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অন্তঃকরণে অস্বাভাবিক ঝড় চললেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,
“আমি নোয়ানা।”
“আমি জানি তুমি নোয়ানা। আমার নোনা, আমার প্রিয়তমা, আমার টিউলিপ ফুল! আমি চিনি তোমাকে। কিন্তু আমাকে কি তুমি চেনো? কে আমি?”
“আপনি আষাঢ়, এ বাড়ির ছেলে, আমার আপুর দেবর, কবির আঙ্কল-লায়লা আন্টির ছেলে, বিদেশে থাকেন এসবই জানি আপনার সম্পর্কে।”
“তাহলে এখনও একটা জিনিস জানা বাকি তোমার।” আষাঢ় নোয়ানার দিকে খানিক ঝুঁকে পড়লো। ফিসফিসানির সুরে বললো,
“আমি হলাম―প্রেমিক পুরুষ!”
নোয়ানার ভ্রুযুগল কুঁচকে ওঠে। আষাঢ় সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মুচকি হাসি লেগে রয়েছে এক নাগাড়ে ঠোঁটে।
“কোনো কিছু আড়াল রাখবো না তোমার থেকে। নিজের খারাপ দিকটাই আগে প্রকাশ করবো। এ যাবৎ আমার গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা অগণিত। আমার কাছে গার্লফ্রেন্ড বিষয়টাতে দুটো ভাগ রয়েছে। এক হলো স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ড। দুই হলো স্থায়ী গার্লফ্রেন্ড। তোমাকে এ দুটোর কোনোটাতেই ঢুকাবো না, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকো। কারণ, তুমি বিশেষ!”
আষাঢ় একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো,
“আমার অনেক স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ড রয়েছে। স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ডরা হলো ক্ষণস্থায়ী। এদের তেমন কোনো গুরুত্ব আমার কাছে নেই। আর স্থায়ী গার্লফ্রেন্ডরা হলো একেবারে স্থায়ী। আমার মোট পাঁচজন স্থায়ী গার্লফ্রেন্ড। ক্যারি, ভেরোনিকা, সুরাইয়া, লিন্ডা এবং জেনি। এদের ভিতর একজন হলো ইরানি, এবং একজন রাশিয়ান। বাকি সবাই আমেরিকান। এরা প্রত্যেকেই আমার পছন্দের, আমার প্রিয়। এদের প্রতি আমার মায়া আছে, দায়িত্ববোধ আছে, শুধু এদের প্রতি যেটা নেই সেটা হলো ভালোবাসা। আজ পযর্ন্ত এদের প্রতি আমার ভালোবাসা নামক ব্যাপারটা কাজ করেনি। আর আমি চাইওনি কাজ করুক।”
আষাঢ় একটু বিরতি নিয়ে আবার বললো,
“আমার এত এত গার্লফ্রেন্ড, আমি খুব খারাপ ছেলে এমনটাই ভাবছো তুমি…আমি জানি এমনটাই ভাবছো। হুম আমি খারাপ। তবে একটা বিষয় গর্বের সাথে বলতে পারি। আমি আমার কোনো গার্লফ্রেন্ডের সাথে কখনও খারাপ কিছু করিনি। না স্থায়ী গার্লফ্রেন্ডদের সাথে, না স্বল্প সাময়িক। আই হোপ তুমি বুঝতে পেরেছো কী বলেছি আমি।”
নোয়ানা স্তব্ধ চাহনিতে তাকিয়ে আছে। আষাঢ় কী বললো এ সমস্ত? সে বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলে উঠলো,
“সত্যি আপনার এত গার্লফ্রেন্ড আছে?”
নোয়ানার প্রশ্নে হাসলো আষাঢ়।
“বিশ্বাস করা কষ্টকর, তাই না? তবে এটাই সত্যি। আসলে এই রোগটা আমার মাঝে উদয় হয়েছিল উনিশ বছর বয়স থেকে। বুঝতে পারছি খুব খারাপ একটা রোগ এটা। বিচ্ছিরি খুব। তবে এই বিচ্ছিরি রোগ তোমার আশেপাশে ঘেঁষতে দেবো না। চিন্তামুক্ত থাকো। হিমেল ইসলামের কাছে তুমি বিশেষ। বাকি সবার সাথে গুলিয়ে ফেলবে না সে তোমায়।”
নোয়ানার বিস্ময়ভাব কেটে গেছে। রাগ হচ্ছে তার। এটাকে সত্যি মানতে পারছে না। সে রাশভারী কণ্ঠে বললো,
“আপনার বায়োডাটা বলা হয়ে গেলে, এবার যাব আমি?”
“সব সময় নিজের কাছে রাখতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু পাখি কি আর পোষ মানে? তার যে ওড়ার স্বভাব। যাও, বোন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর একসাথে দুজনের এত সময় এভাবে থাকা উচিত নয়। কেউ দেখলে সন্দেহ করবে। সন্দেহ’র আভাস এত তাড়াতাড়ি না ছড়ানোই ভালো।”
নোয়ানার রাগের পালা ভারি হলো। আষাঢ় নোয়ানার চোখ দুটোতে দৃষ্টি রেখেছিল। সেই চোখে কী পরিমাণ রাগ-বিরক্তি! মেয়েটা যেন চোখ দিয়ে আষাঢ়কে শাসিয়ে চলে গেল। ইদানিং কেন যেন সে গার্লফ্রেন্ডদের প্রতি খুব একটা মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না। এই ভীতু মেয়েটা কি তার রোগের প্রতিষেধক হয়ে এলো না কি? আষাঢ়ের ঠোঁটে মিটি হাসির রেখা, মুখে বিড়বিড় করে বললো,
“তুমি প্রতিষেধক হও গো মেয়ে! বিনাশ করো এই বিচ্ছিরি রোগের। তারপর নিজে এক মারাত্মক রোগ হয়ে এসে বিরাজ করো হৃদয়ে। সেই রোগেতে মরণ হলেও কখনও দাবি তুলবো না তোমার নামে!”
__________________
অফিস থেকে ফিরে শ্রাবণ একটা বড়ো আকারের বক্স ধরিয়ে দিলো মিহিকের হাতে। মিহিক অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
“কী এটা?”
শ্রাবণ বক্সের ঢাকনা সরিয়ে বললো,
“বিছানার চাদর আর বালিশের কভার।”
“কী?” দ্বিগুণ বিস্ময় ঝরে পড়লো মিহিকের কণ্ঠে।
“হ্যাঁ। আমি এতকাল বিছানায় ঘুমিয়েছি বলে আপনার আমার বিছানাতে ঘুমাতে অসুবিধা, তাই তো? এই জন্য আমি এই ব্যবস্থা নিয়েছি। বিছানার চাদর আপনার সামনে বসে পাল্টে দিলে নিশ্চয়ই আপনার আর বিছানায় ঘুমাতে অসুবিধা হবে না? অমত থাকবে না আর? মোট চারটা চাদর এনেছি আমি। কিছুদিন পর পর একেকটা চেঞ্জ করে করে শোবেন। দরকার হলে এই চারটা একসাথেও বিছাতে পারেন।”
শ্রাবণের সব কথা শুনে মিহিকের প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো।
“আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?”
“না, মোটেই না। একটা মেয়ে আমার রুমে ফ্লোরে ঘুমায়, এটা দেখতে ভালো লাগে না আমার। তাই আপনি এই নতুন চাদর বিছিয়ে আজ থেকে খাটে ঘুমাবেন, আর আমি নিচে শোবো।”
মিহিকের হঠাৎ মনে হলো শ্রাবণ তার কেয়ার করছে। তার ব্যাপারটা ভাবতে একটু ভালো লাগলো। কিন্তু বাইরে তার কঠোর আচরণ ছাড়া আর কিছু প্রকাশ পেল না। সে হাতের বক্সটা বিছানায় ফেলে দিয়ে বললো,
“ফারদার আমার সাথে আর এমন মজা করবেন না। বিছানার চাদর কেন? ম্যাট্রেস চেঞ্জ করলেও আমি আপনার বিছানায় ঘুমাবো না।”
বলে মিহিক রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
শ্রাবণ অপমানিত মুখ নিয়ে চেয়ে রইল দরজার দিকে। সে নিজ হাতে মেয়েটাকে নতুন বেডশিট এনে দিলো, আর মেয়েটা এমন করে কথা শুনিয়ে চলে গেল? শ্রাবণ বিছানায় বক্সটার দিকে তাকালো। রাগে বক্সটা ছোঁ মেরে হাতে নিয়ে ক্লোজেটের দিকে যেতে যেতে বললো,
“ভুল হয়েছে, ভুল হয়েছে আমার। আপনার ভালো করতে চাওয়া উচিত হয়নি আমার।”
শ্রাবণ ক্লোজেটের ভিতর ঢুকিয়ে রাখলো বক্সটা। আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। আয়নায় যখনই নিজের মুখটা দেখে তখনই নিজেকে পাপী মনে হয়! শ্রাবণ আয়না থেকে চোখ নামিয়ে ফেললো। ঘড়ি খুলে রাখলো। শার্টের বোতাম খোলা দিলে মোবাইল টিং টিং করে বার্তা আসার খবর জানালো। শ্রাবণ বার্তা ওপেন করে দেখলো। রুমকি লিখেছে,
‘বিকেল পাঁচটায় আমাকে বাড়ি থেকে ড্রপ করে নেবে। রাত পর্যন্ত ঘুরবো আমরা।’
ম্যাসেজটা দেখে শ্রাবণ বিরক্তবোধ করলো একটু। রুমকির সাথে দেখা করতে তার কেমন অনিচ্ছা হয় এখন। ফোনে কথা বলতেও শান্তি লাগে না। মিহিক সেদিন রুমের ভিতর বসে রুমকির সাথে কথা বলতে নিষেধ করে দেওয়ার পর, সে সত্যি সত্যি আর রুমে বসে কথা বলেনি। রুমকি ফোন দিলে ছাদে চলে আসতো। মিহিকের ওই কথা কেন সে মেনে নিলো বুঝতে পারছে না। আর রুমকির সাথে দেখা, কথা বলাতে অনিচ্ছা হওয়ার ব্যাপারও ধরতে পারছে না। কেন হচ্ছে তার সাথে এমন? প্রশ্নটা প্রায়শই জেগে ওঠে তার মাঝে। তবে এর কোনো উত্তর খুঁজে পায় না সে। কিন্তু আজ হুট করে একটা উত্তর ধরা পড়লো তার নিকট। উত্তরটা ভেবে নিজের গালে নিজের চড় মারতে ইচ্ছা করলো শ্রাবণের। সে উত্তরের দিকটা আর ভাবতে চাইলো না। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে তার চোখ গেল জানালার ধারের টুলের উপর। এই টুলটা তার ছিল। সে ওই টুলে বসে একাকী আনমনে সময় কাটাতো। কিন্তু মিহিকের সাথে তার বিয়ে হওয়ার পর টুলটা মিহিকের দখলে চলে গেছে। এখন মিহিক ওখানে বসে বেশির ভাগ সময় কাটায়। শ্রাবণের মনে প্রশ্ন জাগলো, আসলেই কি তার সাথে যেটা হচ্ছে এর পিছনে মিহিক দায়ী?
_________________
রাতে নোয়ানার হাড় কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। খবরটা সকাল বেলা পেতেই মিহিক বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। মিহিক ভালো করে জানে নোয়ানার এমন হুট করে জ্বর কখন আসে। মেয়েটাকে বার বার বলে দেওয়া হয়েছে ওসব পুরোনো বিষয় নিয়ে আর না ভাবার জন্য। তারপরও মেয়েটা কথা শোনে না। কেন কষ্টের কথা মনে করে, এরকম চিন্তা করে শরীর খারাপ করতে হবে? বাড়ি থেকে বের হওয়া দিলে শ্রাবণের সাথে গেটের কাছে দেখা হয়ে গেল মিহিকের। শ্রাবণ সবে জগিং করে ফিরেছে। এত সকালে কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইলে মিহিক বললো,
“নোয়ানার খুব জ্বর। ওকে দেখতে যাচ্ছি।”
শ্রাবণ উৎকণ্ঠা হয়ে বললো,
“জ্বর! জ্বর এলো কেন? বৃষ্টিতে ভিজেছে না কি?”
মিহিক রাগতে চায় না শ্রাবণের সাথে, কিন্তু শ্রাবণের কথাবার্তা তাকে রাগিয়ে দেয়। এ কদিনে কোনো বৃষ্টি হয়নি। শেষ বৃষ্টি হয়েছিল তাদের বিয়ের দিন। সে বিরক্তির সুরে বলে উঠলো,
“বৃষ্টিতে ভিজবে কোত্থেকে? আজকালকার ভিতর কি বৃষ্টি হয়েছে?”
শ্রাবণ বুঝতে পারলো তার বলার মাঝে একটু বোকামি হয়েছে, কিন্তু তাই বলে মিহিক তার সাথে এরকম করে কথা না বললেও তো পারতো।
“আপনি কবে একটু সুন্দর করে কথা বলবেন আমার সাথে?”
শ্রাবণের প্রশ্ন অপ্রত্যাশিত ছিল মিহিকের কাছে। সে অপ্রস্তুত হলেও, দ্রুত উত্তর দিলো,
“যেদিন আপনি সুন্দর হতে পারবেন, সেদিনই আপনার সাথে সুন্দর করে কথা বলবো।”
মিহিক দাঁড়ালো না, পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। শ্রাবণ মিহিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। মিহিক পাশের বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে পড়ে, চোখের অদৃশ্য হলে সে চিন্তার রাজ্যে ভেসে উঠলো। সেই সাথে একটা অপমান ব্যাপার লক্ষ্য করলো। এই প্রথম কেউ একজন তাকে অসুন্দর বললো। সে কি দেখতে অসুন্দর? ছোট বেলা থেকেই তাকে সবাই সুন্দর বলে এসেছে। কিন্তু আজ এই মেয়েটা তার সৌন্দর্যে আঘাত হেনে কথা বলেছে!
___________________
“আষাঢ়কে নিয়ে সেদিন কোথায় গিয়েছিলে?”
কারিব সত্যি কথা বললো,
“ময়মনসিংহ।”
যদিও তার সত্যি কথা বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না।
“কেন গিয়েছিলে? ময়মনসিংহে কী কাজ তোমাদের?”
“কাজ আমার ছিল মামা। আমার স্কুল ফ্রেন্ড সাজ্জাদের হাজার পাঁচেক টাকার দরকার ছিল। ও আমাকে টাকাটা দিতে অনুরোধ করেছিল। ময়মনসিংহে ওর বাড়ি। ওকে টাকাটা দেওয়ার জন্য ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম।”
“পাঁচ হাজার টাকা সশরীরে ময়মনসিংহ গিয়ে দিয়ে আসতে হয় এই আধুনিক যুগে? তোমাকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না কারিব। ইদানিং তোমাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আমার।”
কবির সাহেব কথাটা খুব কষ্টে বললেন। কারিব তাকে মিথ্যা বলতে পারে না এ তার দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু কারিবের যুক্তি নড়বড়ে।
“আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন মামা?”
“অবিশ্বাস করতে চাই না তোমায়। আমার বিশ্বাসের মান রেখো। আজকে আবার এত রেডি-সেডি… কোথায় যাচ্ছ আজকে আবার দুজন মিলে?”
কারিব জড়তা নিয়ে বললো,
“ময়মনসিংহ।”
“ময়মনসিংহ? টাকা দেওয়ার জন্য ময়মনসিংহ না গিয়ে এলে পরশু। আবার কেন যাচ্ছ?”
“টাকা দিতে গিয়েছিলাম তো মামা, কিন্তু দিতে পারিনি একটা কারণে। দেখলেন না সেদিন তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম?”
কবির সাহেব রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন। তার বিশ্বাসযোগ্য কারিব কি আসলেই সত্যি বলছে?
(চলবে)