বিবর্ণ জলধর পর্ব: ৪৩

0
1431

#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৩
____________

কাল রাতে মিহিক বিছানায় শোয়ার অনেকক্ষণ পর নিজ থেকেই বলেছিল,
“একটা কথা কি জানেন শ্রাবণ?”

শ্রাবণ মিহিকের কণ্ঠ শুনতে পেয়ে পাশ ফিরে তাকায়।
“কী কথা?”

“নোয়ানা আমার আপন বোন নয়।”

কথাটা শুনে শ্রাবণের পিলে চমকে ওঠে। অবিশ্বাসের ঘোর নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ‘আপন বোন নয়’ মানে কী?
এরপর মিহিকের কাছ থেকে শ্রাবণ এও জানতে পারে যে তার মা-বাবা বিষয়টা সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিল। অথচ সে এত বড়ো বিষয়টা সম্পর্কে একদমই জানতো না। মিহিকের কাছে প্রশ্ন করে করে সে সবই শুনেছে রাতে। ও রাতে তার আর ঘুম হয়নি। এমনকি এখনও সে বিষয়টা নিয়ে আকাশ পাতাল চিন্তায় ডুবে আছে।
আজ বিয়ের দিন। বিয়ে হবে রাতে। আয়োজন চলছে সবকিছুর। যেমন ধুমধাম করে বিয়ে হওয়ার কথা, ততটা ধুমধাম আরকি হচ্ছে না। বিয়েতে থাকতে পারছেন না আষাঢ়ের আমেরিকান পরিবার। মানে ওর ফুফুরা। এমন করে বিয়ে হবে আষাঢ়ের তা তো আগে থেকে নির্ধারণ করা ছিল না। সব কিছু ম্যানেজ করে তাই বাংলাদেশ আসা হয়ে উঠলো না তাদের। এ নিয়ে আমেরিকান বোন ঝুম অনেক দুঃখ প্রকাশ করেছে। আষাঢ় বিয়ের ফুল ভিডিও পাঠাবে বলে শান্ত করেছে তাকে। বিয়েতে সবচেয়ে আনন্দে আছে বোধহয় আষাঢ়ই। সকাল থেকেই তার ওষ্ঠ্য হতে হাসি সরছে না। ভিডিও কল দিয়েছিল নোয়ানাকে। নোয়ানা রিসিভ না করে কল কেটে দিয়েছে। হয়তো কখনও আষাঢ়ের সাথে ভিডিও কলে কথা হয়নি তাই কথা বলতে অস্বস্তি হবে বলে এমনটা করেছে। কিন্তু এটা কি তার অডিও কলের মাধ্যমে জানানো উচিত ছিল না? আষাঢ় এ নিয়ে রাগান্বিত ছিল কিছু সময়। তবে সে রাগ আবার এমনি এমনিই কেটে গিয়েছে।

মিহিকের উদ্বিগ্ন দুই দিকে। বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি দুই দিকেরই খেয়াল রাখছে সে। এতক্ষণ বাবার বাড়িতে ছিল। নোয়ানাকে মেহেন্দি পরিয়ে দিয়ে এসেছে। শুধু নোয়ানাকে না, সাথে আরও কয়েকজনকে মেহেন্দি পরিয়ে দিতে হয়েছে। অথচ নিজে দেওয়ার সময় পায়নি। মিহিকের মনে পড়ে, তার বিয়ের সময় হাতে মেহেন্দি পর্যন্ত লাগানো হয়নি। নতুন বউয়ের মতো সেজেছিল ঠিক, কিন্তু এত কিছুর ভিড়ে মেহেন্দি রাঙা হাতটা উহ্য ছিল। আজ সে মেহেন্দি পরবে হাতে।

রুমের ভিতর বসে মিহিক নিশ্চিন্তে মেহেন্দি দিচ্ছে এমন সময় শ্রাবণ এলো হঠাৎ। শ্রাবণ এসেছে বুঝতে পেরেও মিহিক তাকালো না। যেটা শ্রাবণের আত্মসম্মানে আঘাত হানলো। মিহিক কি এখনও তাকে এড়িয়ে চলছে? সে জানালার এদিকটায় সরে এসে দাঁড়ালো। একটু শব্দ করলো না, চুপচাপ মিহিকের হাতে মেহেন্দি পরা দেখতে লাগলো। মিহিক সেটা টের পেয়ে বললো,
“এত মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকবেন না আমার দিকে। লজ্জা লাগে আমার।”
কথাটা মিহিক মেহেন্দি দিতে দিতে শ্রাবণের দিকে না তাকিয়েই বললো।

শ্রাবণ উত্তর দিলো,
“আমি আপনাকে দেখছিলাম না। আপনার মেহেন্দি দেওয়া দেখছিলাম।”

“সেটাই বা কেন দেখবেন? দেখবেন না।”

“চোখ আমার, আমি কি দেখবো না দেখবো সেটা তো আমার ব্যাপার।”

মিহিক কঠিন চোখ তুলে শ্রাবণের দিকে তাকালো,
“আপনি কি আমার সাথে ঝগড়া করতে চাইছেন?”

“ঝগড়া করা তো আমার কাজ নয়, ঝগড়া তো আপনি করেন সব সময়।”

শ্রাবণের এ কথা শুনে মিহিকের বেশ রাগ হলো। সে টুল ছেড়ে লম্বা পা ফেলে শ্রাবণের কাছে এগিয়ে এলো।

“কী করি আমি? ঝগড়া করি সব সময়?”

শ্রাবণ একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মেয়েটা যে ক্রমশ রেগে যাচ্ছে বুঝতে পারছে। বললো,
“এখন করেন না, আগে তো করতেন।”

“বিয়ের দিন আমি মুড খারাপ করতে চাই না।”

“আমিও চাই না। যাচ্ছি তাহলে।”
ঢিমে গলায় উত্তর দিয়ে শ্রাবণ চলে গেল। যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন করেছিল,
“নোয়ানা কি আসলেই আপনার আপন বোন নয়?”

“আপন বোন না হলে কী করবেন? বিয়ে দেবেন না আপনার আপন ভাইয়ের সাথে?”

“আপনি এত রুড বিহেভ করছেন কেন? বউ মানুষের এত রুড বিহেভ করতে আছে?”

মিহিক কটমট করে তাকালেই শ্রাবণ রুম থেকে চলে যায়।

___________________

বিয়ে কার্য সম্পন্ন হওয়ার পরও হাফিজা মনে মনে এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। বোনের অপমানের কথাটা বার বার মনে পড়ে তার। নোয়ানার মনেও চাচির এমন মুখ দেখে বার বার বিষাদের আঁচড় পড়েছে। সে যাওয়ার সময় চাচিকে বলে গিয়েছে,
“দীর্ঘ এতগুলো বছর তো আমাকে তোমাদের কাছে রেখেছো, বড়ো করেছো। এতগুলো বছরের ভিতরও কখনো মুখ ভার হয়নি তোমার, তাহলে এই ঘটনাটার জন্য এত কেন মুখ ভার তোমার এখন? এটা কি এতটাই গুরতর যে এমনভাবে মুখ ভার করে রাখতে হবে?”

হাফিজা কিছু বলেনি। নোয়ানা তারপর হাফিজাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
“আমিও তোমার একটা মেয়ে। মুখ ভার করে রেখো না। কষ্ট হয় আমার।”

এটাই বাড়ি থেকে চলে আসার সময় নোয়ানার শেষ কথা ছিল হাফিজার সাথে।
নোয়ানা এখন যে রুমে আছে সে রুমটা ফুলের ঘ্রাণে মোহিত। বিভিন্ন ফুলের ঘ্রাণের সংমিশ্রণ ঘটে মোহনীয় এক সুবাসের উৎপত্তি করেছে। রুমটা সাজিয়েছে শ্রাবণ, মিহিক। তৃতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি আর রাখেনি। শুধু দুজন মিলেই সাজিয়েছে। খুব সুন্দর করেই সাজিয়েছে বলে ধারণা নোয়ানার। সৌন্দর্যটা ঠিকভাবে দেখতে পাচ্ছে না। রুমে জ্বলছে শুধু দুটো ড্রিম লাইট। সব ঝাপসা ঝাপসা দেখাচ্ছে। আসল সৌন্দর্য ফুঁটে উঠছে না দর্শনেন্দ্রিয়তে। শুধু দুটো ড্রিম লাইট জ্বালানোর কাজটা আষাঢ়ের। নোয়ানার এমন পরিবেশ ভালো লাগছে না। সে আনমনে ভাবছে, আজ এ বাড়িতে যখন প্রথম পা রেখেছিল, অন্তর আড়ষ্ট হয়ে ছিল সে সময়। ভেবেছিল কবির সাহেব এবং লায়লা খানম হয়তো ছেলের পাগলামিতে বাধ্য হয়ে এ বিয়েতে সায় দিয়েছে, মন থেকে মেনে নিতে পারেনি তারা। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। লায়লা খানম, কবির সাহেব, জুন, রুপালি সবাই-ই তার সাথে আন্তরিক। এমনকি বিয়ে উপলক্ষ্যে আমন্ত্রিত অতিথিরাও তার সাথে বেশ সৌজন্যশীল ছিল। নোয়ানার কাছে সব ব্যাপারই যেন কেমন ঠেকছে। সিনথিয়ার সৌন্দর্যের কাছে তার সৌন্দর্য কিছুই না। আষাঢ়ের মা-বাবা সিনথিয়ার মতো মেয়ের সাথে তার ছেলের বিয়ে ক্যানসেল করে তার সাথে দিলো কী করে? আর এখন এতটা আন্তরিক আচরণই বা করছে কীভাবে? নোয়ানার মনে হলো সে সব কিছুর ব্যাপারেই খুঁতখুঁতে ছিল। সব কিছু নিয়ে অধিক চিন্তা করতো সে। এ পর্যায়ে আষাঢ়ের কথা সত্যি মনে হলো, সে আসলে সবকিছুকে যতটা জটিল মনে করে, আসলে সব কিছু এত জটিল নয়।
নোয়ানার হঠাৎ রুপালির বলা কথাটা মনে পড়লো। যখন লিভিং রুমে ছিল তখন রুপালি বলেছিল,
“হুনো ছুডু বউ, আমাদের এই বেশর্মা পোলাটারে কিছু লজ্জা শরমের বালাই শিখাইয়ো।”
কথাটা বলে রুপালি নিজেই হেসে দিয়েছিল। হেসেছিল উপস্থিত সবাই। নোয়ানাও কেন যেন নিজের হাসি সংযত করতে পারেনি কথাটা শুনে। সেও হেসেছিল। কথাটা মনে পড়তে এখনও হাসলো নোয়ানা। সম্মুখে চাইলো। ড্রিম লাইটের ঝাপসা আলোয় স্বামীকে দেখতে দেখতে পাচ্ছে। যে স্বামী এখন ব্যস্ত তার কান্নারত গার্লফ্রেন্ডের সাথে ফোনালাপে। তার গায়ে একটা ব্ল্যাক শার্ট। পরনে ডার্ক ব্লু প্যান্ট। শত বলেও বিয়েতে কেউ আষাঢ়কে শেরওয়ানি পরাতে পারেনি। বিয়ে কার্য সেরেছে সে ডার্ক ব্লু স্যুট-প্যান্টে। এমনকি নোয়ানাকেও বিয়েতে শাড়ি পরতে দেয়নি। লেহেঙ্গা পরতে বলেছে। লায়লা খানমের ইচ্ছা ছিল নোয়ানাকে লাল টুকটুকে শাড়ি পরিয়ে ঘরে তুলবেন। কিন্তু আষাঢ়ের জন্য সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। দুই বউয়ের এক বউকেও শাড়ি পরাতে পারেনি সে। তবে মেয়ের বিয়েতে মেয়েকে লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরাবে এটা তার দৃঢ় পণ।

আষাঢ় এই মুহূর্তে কথা বলছে ভেরোনিকার সাথে। বাকি চার গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা সম্পন্ন হয়েছে। আষাঢ় ভেবে রেখেছিল বাসর রাতেই সে সব কিছু বলবে তার গার্লফ্রেন্ডদের সাথে। চার গার্লফ্রেন্ড বিয়ের কথা শুনে তেমন কিছু বলেনি। শুধু একটুখানি দুঃখ প্রকাশ করেছে। তারা আসলেই প্রমাণ করলো তারা আষাঢ়কে মন থেকে কখনও চায়নি। কিন্তু ভেরোনিকা সবার উল্টো কাজ করলো। সে বিয়ের কথা শুনে কান্নাকাটি শুরু করেছে। আষাঢ় কোনো গার্লফ্রেন্ডের কাছে নিজের গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারটাও গোপন রাখেনি। বিয়ের পাশাপাশি সবাইকে নিজের গার্লফ্রেন্ড সম্পর্কেও জানিয়েছে। আষাঢ় ভেরোনিকাকে মানাতে সদা ব্যস্ত। ভেরোনিকা কান্না ভেজা কণ্ঠে বললো,
“নো হিম, নো। আমি এসব বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি কিছুতেই বিয়ে করোনি অন্য কাউকে, তুমি মিথ্যা বলছো। রাইট? তুমি মিথ্যা বলছো। এটা করোনি তুমি। তুমি আমেরিকা আসলে আমরা বিয়ে করবো। তুমি বেঙ্গলি কাউকে বিয়ে করতেই পারো না, তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। তাই না? বলো হিম। তুমি তো…”

“আমি তোমাকে কোনোদিন একবারের জন্যও বলিনি ভেরোনিকা―’আই লাভ ইউ’। আমি তোমার প্রতি অনেক মায়া অনুভব করি, তুমি খুব প্রিয়, তোমাকে খুব পছন্দ এরকম আরও অনেক কিছু বললেও ভালোবাসি এটা কখনোই বলিনি। তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে এটা?”

“হ্যাঁ, তুমি কখনও আমাকে ভালোবাসো এটা বলোনি। ভালোবাসলেই সেটা মুখে বলে বলে জানান দিতে হয় না। আমি তোমার মাঝে আমার জন্য ভালোবাসা দেখতাম। তুমি আমার সাথে অভিনয় করছো এমনটা কখনও মনে হয়নি। হিম…হিম…তুমি…তুমি…”
ভেরোনিকা কান্নার জন্য নিজের কথা শেষ করতে পারলো না।

আষাঢ়ের খুব কষ্ট হচ্ছে ভেরোনিকার জন্য। মেয়েটা কষ্ট পাবে জানতো, কিন্তু এতটা কষ্ট পাবে কখনো আশা করেনি। জীবনে কখনও ভাবেইনি সে বিয়ে নিয়ে। বিয়ে করলে গার্লফ্রেন্ডদের কী হবে এসব চিন্তা কখনও মাথায় আসেনি। সে আন্তরিকতার সাথে বললো,
“আমি স্যরি ভেরোনিকা। সত্যিই অনেক স্যরি। আমি ভাবিনি এতটা কষ্ট পাবে তুমি। অন্য গার্লফ্রেন্ডদের কেউ তোমার মতো এমন করেনি, তুমি এতটা কষ্ট অনুভব করবে সত্যি বুঝতে পারিনি আমি। স্যরি!”

ভেরোনিকা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমি তোমাকে সত্যিই খুব ভালবাসি হিম, সত্যি সত্যি।”

“আই নো। আমি দুঃখিত সেজন্য।”

“না, স্যরি বলবে না তুমি। তোমার মুখে স্যরি শুনলে খারাপ লাগে।”

আষাঢ়ের মনে হলো ভেরোনিকা সত্যিই তাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে। মেয়েটার এমন কান্নাকাটি অন্তরে নিদারুণ ক্লেশের জন্ম দিচ্ছে। সে ভেরোনিকাকে মানাতে বললো,
“কান্না করো না ভেরোনিকা। তুমি তো বেঙ্গলি মানুষ পছন্দ করো। তোমার জন্য আমি বাংলাদেশ থেকে বেঙ্গলি বয় নিয়ে যাব।”

“বেঙ্গলি বয়?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো ভেরোনিকা।

“হুম বেঙ্গলি বয়। আমি একজন বেঙ্গলি বয়কে চিনি। সে খুব সহজ সরল। দেখতেও বেশ হ্যান্ডসাম। গায়ের রংও আমার মতো নয়, আমার থেকে অনেক উজ্জ্বল। তোমার সাথে খুব ভালো মানাবে। তুমি আমার খুব প্রিয় বলেই আমি চাইছি তার সাথে তোমার বিয়ে হোক।”

“কার কথা বলছো তুমি?”

“কারিব!”

ভেরোনিকা চেনে কারিবকে। কারিবের কথা অনেক শুনেছে আষাঢ়ের মুখে। ভেরোনিকার কান্না থেমে এসেছিল, কিন্তু আবারও এটি বৃদ্ধি পেল। কাঁদতে কাঁদতে কোমল গলায় ডাকলো,
“হিম…”

“কারিবের কথা ভেবে দেখো। সে কিন্তু খুবই ভালো ছেলে।”

আষাঢ়ের কথা যেন ভেরোনিকার শ্রবণ হলো না। সে নিজের মতো করে বললো,
“খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। খুব কষ্ট পাচ্ছি আমি।”

আষাঢ়ের ভিতরটা আবারও অপরাধী বনে গেল। সে তটস্থ কণ্ঠে বললো,
“আই অ্যাম স্যরি ভেরোনিকা!”

ভেরোনিকা একটু ধাতস্থ হয়ে বললো,
“থাক, যা ঘটার তা ঘটে গেছে। যাকে বিয়ে করেছো তাকে তুমি অনেক আগে থেকে ভালোবাসতে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো তুমি কখনও আমাকে ভালোবাসো বলিনি। শুধু আমাকে না কোনো গার্লফ্রেন্ডকেই বলোনি। আর এটাও সত্যি যে আমার সাথে তুমি নিজ থেকে কোনোদিন ভাব জমাতে আসোনি। আমি নিজেই তোমার প্রতি ইন্টারেস্ট ফিল করেছিলাম। এবং নিজ থেকে তোমার সাথে ভাব জমিয়েছিলাম। যদিও আমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে, তবুও এটা আমার মেনে নিতে হবে। ভালো থাকো তুমি তোমার বেঙ্গলি ওয়াইফের সাথে। তবে হ্যাঁ, অন্য কাউকে বিয়ে করেছো বলে যে আমার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেবে এমনটা ভেবো না। আমাদের মাঝে অবশ্যই ফ্রেন্ডলি একটা রিলেশনশিপ থাকবে। ঠিক আছে?”

আষাঢ় মাথা দুলিয়ে বললো,
“হুহ, ঠিক আছে।”

“তোমার ওয়াইফের কাছে ফোনটা দাও, তার সাথে একটু কথা বলি।”

আষাঢ় সঙ্গে সঙ্গে বিরোধ জানালো,
“নো নো, ওর সাথে কথা বলতে পারবে না তুমি। আমার ওয়াইফ কারো সাথে কথা বলতে পারে না।”

“মানে? তুমি কি বোবা মেয়েকে বিয়ে করেছো?”

“হ্যাঁ, এক ধরণের বোবাই সে।”

“ঠিক আছে…আমি…”
ভেরোনিকার কণ্ঠে কান্নাটা আবার উদ্বেল হয়ে উঠতে চাইছে। কণ্ঠটা আগের থেকে কিছুটা বসে এলো। কান্না কান্না নরম গলায় বললো,
“আই লাভ ইউ হিম! আই উইল মিস ইউ!”

“আই মিস ইউ টূ!”

ভেরোনিকার সাথে কথা বলা শেষ হলে আষাঢ় আর্মচেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে রইল কিছুক্ষণ। ভেরোনিকা তাকে এত ভালোবাসে সেটা তার সত্যিই জানা ছিল না। কিছুক্ষণ দীর্ঘশ্বাস-টাস ফেলে নোয়ানাকে বললো,
“ভেরোনিকার জন্য আমার খারাপ লাগছে নোয়ানা। নিজের বিয়ে নিয়ে কখনও কিছু ভাবীইনি। বিয়ে করলে যে ভেরোনিকা মনে খুব কষ্ট পাবে এটা একদম মাথায় ছিল না। ওর জন্য অনুতাপ হচ্ছে আমার!”

“তাহলে কি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করার চিন্তা ভাবনা করছেন আপনি?”

আষাঢ় বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল।
“সেটা কি বলেছি আমি? এত যুদ্ধ করে তোমায় বিয়ে করেছি কি ডিভোর্স দেওয়ার জন্য?”

নোয়ানা কিছু বললো না। চোখ নামিয়ে ফেলে আবারও তাকিয়ে বললো,
“আপনার গার্লফ্রেন্ড আমার সাথে কথা বলতে চাইছিল?”

“হ্যাঁ।”

“দিলেন না কেন কথা বলতে? বোবা বললেন কেন আমায়?”

“কারণ আমি চাই না আমার ওয়াইফ আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলুক।”

“কথা বললে কি আপনার গোপন কিছু ফাঁস হয়ে যেত?”

আষাঢ় চমকালো,
“তুমি আমায় সন্দেহ করছো?”

নোয়ানা প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললো,
“শুধু ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে রেখেছেন কেন? অন্য লাইটও অন করেন।”

“নো, অন্য লাইট অন করা হবে না। কেন? তোমার কি ড্রিম লাইটের আলো ভালো লাগছে না? আমার তো খুব ভালো লাগছে। এই মুহূর্তে কেমন রোমান্টিক রোমান্টিক ফিল হচ্ছে ড্রিম লাইটের আলোয়।”

“আমার ভূতুড়ে ভূতুড়ে ফিল হচ্ছে। লাইট অন করুন।”

“না।”

আষাঢ় এসে বিছানায় বসলো। ঝাপসা আলোতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল স্ত্রীর মুখপানে। এক সময় বললো,
“তোমাকে কি বউ বউ লাগছে টিউলিপ?”

“সেটা তো আপনি ভালো জানেন। কারণ, আপনি দেখছেন আমায়। আমি নিজেকে নিজে দেখছি না।”

“বউ বউই লাগছে। আচ্ছা, আমাকে কি বর বর লাগছে?”

“পাগল পাগল লাগছে আপনাকে।” বলে নোয়ানা হাসলো।

“আজকের দিনেও এটা বলতে পারলে?”

“পারলাম তো।”

আষাঢ় ক্ষুদ্রতম শ্বাস ছেড়ে বললো,
“থাক এসব কথা। এখন ঝটপট আমার পাওনা মিটিয়ে দাও।”

নোয়ানা ভ্রু কুঞ্চিত করে অবাক সুরে বললো,
“কীসের পাওনা?”

“ভুলে গেছো? উঁহু, ভুলে গেলে তো হবে না। অবশ্যই এটা মনে রেখে পাওনাদারের পাওনা মিটাতে হবে তোমার।”
আষাঢ় নোয়ানার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“একটি চুমু!”

নোয়ানা ভীষণ লজ্জা পেল। এমন লজ্জা শেষ কবে পেয়েছিল মনে নেই। দ্রুত সে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করে বললো,
“কীসব আজেবাজে কথা বলছেন!”

“আজেবাজে কথা তো নয়, এটা ন্যায্য কথা। তাড়াতাড়ি আমার পাওনা মিটিয়ে দাও, কোনো ভণিতা চাই না আমি।”

নোয়ানা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আষাঢ় এমন কেন? রুপালির কথা তো ঠিক। আসলেই তো একে লজ্জা শরমের বালাই শিখাতে হবে। নোয়ানা কথাটা না বলে পারলো না,
“আপনার মাঝে লজ্জার খুব অভাব হিমেল।”
কথাটা বলতে নিজেরই কেমন লাগলো, আষাঢ়ের শুনতে কেমন লেগেছে কে জানে!

“লজ্জার অভাব আমার মাঝে?”

“হুম।”

আষাঢ় হেসে ফেললো। নোয়ানাকে এক হাত ধরে কাছে টেনে আনলো। নোয়ানার চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বললো,
“তোমার বিষণ্ন, বিষাদ ঘেরা আঁখি জোড়া আমার শুরু থেকে প্রিয়, এটা কি তুমি জানো টিউলিপ?”

নোয়ানা বিমোহিত অবস্থায় উত্তর দিলো,
“আজ জানলাম।”

আষাঢ় নোয়ানাকে ছেড়ে দিয়ে জানালার ধারে এলো। পূর্ণিমা নয় আজ। তাও কিন্তু জোৎস্না কম নয়। সে এখান থেকে নোয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার বিবর্ণ জলধরে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারা হবো।
জলধর খসে লুটিয়ে পড়বো পৃথ্বীতে।
তুমি হাত বাড়িয়ে কুড়িয়ে নাও,
রাখো যত্ন করে।
তোমার জীবন হতে বিবর্ণ অপসারণে আমিই সবচেয়ে বর্ণিল উৎস এই ধরণীতে।”

নোয়ানা সবিস্ময়ে শুনলো আষাঢ়ের প্রতিটা কথা। কিছু বোধগম্য হলো না তার। বললো,
“বুঝলাম না কিছু। খুব কঠিন লাগলো।”

আষাঢ় উত্তর দিলো,
“তোমার ফ্যাকাশে জীবন উজ্জ্বলতায় ভরে তুলবো আমি!”

নোয়ানা অপলক তাকিয়ে রইল। চোখের দৃষ্টি স্থির রইল অনেকক্ষণ। আষাঢ় আবার ফেরত এলো নোয়ানার কাছে। নোয়ানার দিকে একটু ঝুঁকে বললো,
“পাওনা কি পরিশোধ করবে না টিউলিপ? এই পাওনাদার কিন্তু রেগে যাবে তাহলে।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here