#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৯
_____________
বাড়িতে এসে আষাঢ় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। হিতাহিত কোনো জ্ঞান ছিল না তার কিছুক্ষণের জন্য। আসার পর থেকে শুধু কারিব কারিব করছে। কারিব দেখেছে আষাঢ়ের মাঝে উত্তেজিত ভাব, মানুষটা যেন একটুও শান্ত হতে পারছে না। এই উত্তেজনা যে এক বিরক্তিকর উত্তেজনা এটা সে সহজেই বুঝলো। আষাঢ় খানিক ধাতস্থ হয়ে বললো,
“সে খুব ডেঞ্জারাস, খুব ডেঞ্জারাস মেয়ে! আমি তাকে বোকা ভেবে ভুল করেছি। এ মেয়ে আমাকে যেন টেক্কা দিতে চাইছে। ভেবেছিলাম আমার হিস্ট্রি শুনে সে আজই ইন্ডিয়া ব্যাক করবে, কিন্তু সে বললো, আমি তার হৃদয় কেড়ে নিয়েছি! আমার গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারটাও না কি স্বাভাবিক। আচ্ছা তুমিই বলো, আমার এত এত গার্লফ্রেন্ড এটা কি স্বাভাবিক ব্যাপার?”
“একদম স্বাভাবিক নয়। এটা খুব অস্বাভাবিক।” সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় কারিব।
“তাহলে এই মেয়ে কী বললো? আমার মনে হচ্ছে মেয়েটার মাঝে কোনো সমস্যা আছে। আমি শিওর এ মেয়ে একটা সাইকো!”
কারিবের বুক মৃদু দমকায় কেঁপে উঠলো। ভয়ার্ত ভাবে উচ্চারণ করলো,
“সাইকো?”
“হ্যাঁ, সাইকো। সে অন্য লেভেলের কোনো এক সাইকো।”
কারিবের ভয়ার্ত চাহনি অটল। সে তাকিয়ে রইল। উপস্থিত দুটো মানুষ চুপ হয়ে যাওয়ার কারণে রুমে নামলো পিনপতন নীরবতা। আষাঢ় সিনথিয়াকে ভাবছে। মেয়েটার কথাগুলো কানে বাজছে। একটা কথা বলতেই হচ্ছে, মেয়েটা খুব বিরক্তিকর হলেও, তার কথাবার্তা আষাঢ়কে মুগ্ধ করেছে। মেয়েটা অন্যরকম। এই প্রথম সাক্ষাৎ পেল এমন মেয়ের। এ মেয়ে তাকে রূপের পাশাপাশি কথাতেও মুগ্ধ করেছে। আষাঢ়ের ঠোঁটের কোণ চওড়া হলো। তা দেখে কারিব বলে উঠলো,
“আপনি হাসছেন?”
আষাঢ়ের ঠোঁট থেকে হাসি মুছে না। কারিব লক্ষ্য করলো আষাঢ়ের মাঝে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। সব সময়ের চির চেনা ভাবটা। আষাঢ় বসা থেকে গা এলিয়ে দিলো নরম বিছানায়। অধরে হাসি স্থায়ী রেখে ছাড়া গলায় বললো,
“আমি হাসছি না কারিব, মেয়েটা আমাকে হাসাচ্ছে। মেয়েটা আরও মুগ্ধ করলো আমায়। আমি মুগ্ধ! হিমেল ইসলামের হবু বউ বলে কথা, একটু আনকমন না হলে চলবে? তবে আমিও দেখে ছাড়বো সুন্দরী এমন কতদিন থাকে। হিমেল ইসলামের সাথে টেক্কা? দেখে ছাড়বো আমি।”
কারিবের মাঝেও শান্তি বিরাজ করলো। বহিঃপ্রকাশ হিসেবে হেসে বললো,
“মেয়েটাকে তাড়িয়েই ছাড়বেন?”
“তাকে না তাড়ালে আমার টিউলিপের হৃদয় পুড়বে। যে হৃদয় আমি ছিনিয়ে আনবো, সে হৃদয়ের এত দগ্ধতা কেমনে সইবো? পুরোটা পুড়ে যাওয়ার আগে, সিনথিয়াকে জ্বালিয়ে মারতে হবে। সিনথিয়ার দগ্ধ হৃদয় নিয়ে সিনথিয়া ফিরে যাবে ভারত। সুন্দরীর হৃদয় কেড়ে নিয়েছে আমি, তাই না? এবার বুঝবে আষাঢ়ের হৃদয় কেড়ে নেওয়ার থাবা কত ব্যথাতুর!”
আষাঢ় উঠে পড়লো। সেন্টার টেবিল থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে পাশের বাড়ির উপর দৃষ্টি ফেললো। কদিন ধরেই নোয়ানাকে দেখতে পাচ্ছে না সে। মেয়েটা বারান্দায় এসে বসছে না, কল দিলে কল রিসিভ করছে না। এত জেদ কীসের? এমন জেদ ভালো লাগছে না আষাঢ়ের। খুব শিঘ্র সে এই জেদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে। নোয়ানার ব্যাপারে সবকিছু জানতে বেশি দেরি নেই।
___________________
“আর কতদিন?”
শ্রাবণ সফট ড্রিংকসে চুমুক দিয়েছিল, সম্মুখে বসে থাকা রুমকির প্রশ্নে চুমুক শেষ করে বললো,
“কী কতদিন?”
“তুই আর কতদিন ওই ডাইনিটার সাথে থাকবি? এখনও ডিভোর্স দিচ্ছিস না কেন ওকে?”
‘তুই’ শুনতে শ্রাবণের সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। মনে হলো তার জ্বলন্ত শরীরে আবার হাজার গোলাপ কাঁটা এসে সুঁচ ফুঁটিয়েছে। তুই সম্মোধন শুনতে তার প্রচন্ড রাগ হয়। ইগোতে লাগে। বেশি রাগ হতো মিহিক যখন তুই করে বলতো। মিহিকের তুই বলা তো থেমেছে, কিন্তু রুমকির তুই করে বলা অনড়। রুমকি প্রায় সময় তাকে তুই করে বলে। রুমকির সাথে আগের মতো খুব বেশি একটা কথা, দেখা সাক্ষাৎ হয় না তার। কিন্তু যখন কথা হয় রুমকি তখন তুই করে বলবেই। তুই-তুমি সংমিশ্রণ ছাড়া কথা ফোঁটে না রুমকির মুখে। শ্রাবণ এ নিয়ে কিছু বলে না রুমকিকে। রুমকির রাগ হওয়া স্বাভাবিক। রাগ থেকে তুই করে বলতেই পারে। নিজের রাগ দমিয়ে রেখে শ্রাবণ বললো,
“ডিভোর্স দেওয়া কি সহজ কাজ? ডিভোর্স দেওয়ার কথা উঠলে আব্বু আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে।”
শ্রাবণ মুখে সহজভাবে কথাটা বলে দিলেও, তার অন্তঃস্তলে ‘ডিভোর্স’ শব্দটা উচ্চারণ করার সময় বার কয়েক কাঁপন হয়েছে। হৃদপিণ্ড যেন কেউ পাথরের সাথে ঠেসে দিয়েছে এমন এক অনুভূতিও উপলব্ধি করেছে সে। তার মন এই ‘ডিভোর্স’ শব্দটা থেকে পালিয়ে বেড়ায়। এটার সম্মুখীন হতে চায় না। কিন্তু এভাবে কতদিন? তার আর মিহিকের সম্পর্ক তো এরকম চলতে পারে না। মিহিক তাকে পছন্দ করে না, আর সেও তো তার পুরোনো ভালোবাসাকে এভাবে শূন্যে ভাসতে দিতে পারে না।
“ও–তুই মরে যাবি এটা নিয়ে তোর চিন্তা? আর আমি যে এদিকে শেষ হয়ে যাচ্ছি সেটা কে দেখবে? আমার বয়ফ্রেন্ড অন্য একটা মেয়ের সাথে এক রুমে থাকে এটা আমি গার্লফ্রেন্ড হয়ে কিছুতেই মেনে নেবো না। মিহিককে খুব শীঘ্রই ডিভোর্স দে তুই। আমি আর মোটেই সহ্য করবো না। হয় তুই ওকে ডিভোর্স দিবি, নয়তো আমি আজই আমার জিনিসপত্র নিয়ে তোর বাড়িতে উঠে যাব।”
“বলছো কী তুমি? আমার বাড়িতে উঠে যাবে মানে?”
“হ্যাঁ, তোর বাড়িতে গিয়ে হাঙ্গামা করবো আমি।
কী ভেবেছিস? তোকে এভাবে ছেড়ে দেবো? গাছেরও খাবি, আবার তলারও কুড়াবি?”
“গাছেরও খাবি, আবার তলারও কুড়াবি এটা কেমন ধরণের কথা?” রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো শ্রাবণ।
“হয়েছে…অনেক হয়েছে, আমার সাথে আর সাধুগিরি দেখাতে আসিস না। তুই মিহিককে ডিভোর্স দিবি এটাই জানি আমি। খুব শীঘ্রই ডিভোর্স দিবি ওকে। মাত্র পাঁচদিন সময় দিলাম, এর মাঝে যদি ওকে ডিভোর্স না দিয়েছিস, তাহলে আমি তোর বাড়িতে গিয়ে উঠবো।”
“এটা বেশি বেশি রুমকি। পাঁচদিনের সময় বেঁধে দিতে পারো না তুমি।” শ্রাবণের মেজাজ আর সংযত হলো না। সে তিরিক্ষি গলায় বলে উঠলো।
রুমকিও সাফ জানিয়ে দিলো,
“কিছু শুনতে চাই না আমি। পাঁচদিনের মাঝে ডাইনিটাকে বাড়ি থেকে তাড়াবি, নয়তো সত্যিই পাঁচদিন পর আমি তোর বাড়িতে গিয়ে উঠবো।”
শ্রাবণ ক্ষুব্ধ। চোখ জোড়া রক্তলাল হয়ে উঠলো। সফট ড্রিংকের বোতলটা রাগে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলো সে।
ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরলো। রাগ এখনও জড়িয়ে রেখেছে তাকে। হালকা করার চেষ্টার্থে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। গেট পেরিয়ে ঢোকার সময় দেখতে পেল মিহিক ঘরে প্রবেশ করছে। শ্রাবণ থেমে গেল। মিহিককে সে বিকেলে বাড়ি ফিরতে বলেছিল, মিহিক তার কথা রেখে ঠিক বিকেলেই বাড়ি ফিরেছে।
____________________
আজকে টিউশনিতে যাওয়ার কথা ছিল না, তারপরও নোয়ানা আজকে টিউশনি করাতে গিয়েছিল। টিউশনি থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়েছে। আসার আগে ছাত্রীদের মা আবার অনেক কিছু খাইয়েছে আজ। গলির মোড় পর্যন্ত রিকশায় এসেছিল। এখন পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। ঝাপসা অন্ধকার পথে। সন্ধ্যাকালীন সময় তাই পথে কাউকে দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। একটু আগেও কয়েক জনকে দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু এখন যেন পথ একেবারে মানব শূন্য। নোয়ানার ভয় করছিল না, এর আগেও সন্ধ্যার সময় অনেক আসা যাওয়া করেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ অন্যরকম এক অনুভূতি হলো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে তার পিছন পিছন কেউ একজন আসছে, তাকে ফলো করছে। ভয়ের এক শীতল স্রোত নেমে গেল নোয়ানার শিরদাঁড়া বেয়ে। হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। বুকের ভিতর ভয় ডিগবাজি খেতে লাগলো। নোয়ানা পিছনে না তাকিয়েই হেঁটে চললো। কিন্তু পিছন পিছন কেউ একজন আসছে এই অনুমান থামলো না। মানুষটা যেন এখনও তাকে ফলো করছে। কে করছে? নোয়ানার পা আর সামনে এগোলো না, থেমে গেল। ভয়ে বুক ধুকধুক করছে। পিছন ফিরে একবার দেখবে ভাবলো। যখন পিছন ফিরতে চাইলো ঠিক সে সময় কেউ একজন পিছন থেকে তার হাত টেনে নিজের কাছে এনে ফেললো।
ভয়ে নোয়ানার হৃদপিণ্ড গলার কাছে উঠে এলো যেন। হাত পা’ও জমে যাওয়ার উপক্রম। পিছনের ব্যক্তি মুখে শব্দ করলো,
“শসস…শব্দ করবে না।”
নোয়ানার কণ্ঠ রুদ্ধ হলো। এই কণ্ঠস্বর পরিচিত তার। পরিচিত হলেও তার ভয় কমলো না। পিছনের ব্যক্তি কিছু একটা গুঁজে দিলো কানে। একটি ফুল! লোকটা নোয়ানার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
“টিউলিপের জন্য টিউলিপ ফুল উপহার। কী ভাবছো? এটা পছন্দ হয়েছে তোমার?”
নোয়ানা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলো,
“আপনি?”
লোকটা বললো,
“হুম আমি, হিমেল ইসলাম ওরফে আষাঢ়।”
“আমাকে ফলো করছেন কেন?”
“ফলো করছি না, তুমিই আমার সামনে এসে যাচ্ছ।”
“ভয় পেয়েছি আমি।”
“ভয় এখনও পাচ্ছ। এটাই চাইছিলাম আমি। তিন দিন কল রিসিভ করোনি আমার। শাস্তি স্বরূপ এটুকু ভয় তো পেতেই পারো।”
নোয়ানার ভালো লাগলো না আষাঢ়ের কথা। সে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে আষাঢ় আবারও হাতে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। নোয়ানার পিঠ ঠেকলো এসে আষাঢ়ের সাথে।
আষাঢ় বললো,
“এত পালানোর স্বভাব তোমার, দেখে বোর হচ্ছি জানো?”
“আপনার বাড়াবাড়ি ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আমার।”
“সীমার মাঝেই থাকতে চাই আমি, তুমিই থাকতে দাও না। একটু বাড়াবাড়ি তো করতেই হয় তাই। …আমার হবু বউ এসেছে খবরটা নিশ্চয়ই পেয়েছো?”
নোয়ানা মৃদু অথচ ক্ষিপ্র কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“হুম, পেয়েছি।”
“কষ্ট হচ্ছে?”
“কীসের কষ্ট?”
“আমার হবু বউ এসেছে বলে।”
“আপনার হবু বউ এসেছে তাতে আমি কেন কষ্ট পাবো?”
“কষ্ট হচ্ছে না তোমার?”
“না।”
“বিশ্বাস করি না। হৃদয় খুলে দেখাও আমায়।”
“আমার দ্রুত বাড়ি ফেরা প্রয়োজন।”
“হ্যাঁ তা তো ফিরবেই, আমি কি আটকাচ্ছি? এই সন্ধ্যাকালীন এভাবে একা বাইরে হাঁটাহাঁটি করা উচিত নয় তোমার। আমি থাকতে একা একা ফিরবে কেন? আমি তোমাকে সাথে নিয়ে যাব।”
আষাঢ় পিছন থেকে সামনে এসে দাঁড়ালো। নোয়ানার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“চলো।”
নোয়ানা বিরক্তি নিয়ে আষাঢ়ের বাড়িয়ে দেওয়া হাতে তাকালো।
আষাঢ় বুঝতে পারলো নোয়ানা তার হাত ধরবে না, তাই সে নিজেই আগ বাড়িয়ে ধরলো। অমনি নোয়ানা তার হাত ছিটকিয়ে সরিয়ে দিলো। এক মুহূর্ত আর না দাঁড়িয়ে হনহন করে চলতে শুরু করলো।
আষাঢ় পিছন থেকে বললো,
“বাব্বাহ! তোমার দেখছি গায়ে শক্তি কম না। আর একটু হলেই তো আমার হাতটা ভেঙে যেত।”
বলে দৌঁড়ে এসে নোয়ানার সঙ্গ নিলো।
_________________
বৃষ্টি যেন আজকাল শ্রাবণের মনের পরিস্থিতি অনুসারে ঝরছে। শ্রাবণের মনে পড়ে তার বাসর রাতে বৃষ্টি হয়েছিল, যে সময় তার মন খুব খারাপ ছিল। এছাড়াও মনে পড়ে এ মাসের এর আগের দিনগুলোর বৃষ্টিতেও তার মন খারাপ ছিল। আজকেও তার মন বড্ড খারাপ, আর আজকেও বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুপঝাপ শব্দ হচ্ছে বৃষ্টি পড়ার। সে দাঁড়িয়ে আছে লাইব্রেরি রুমের কাঁচের জানালার পিছনে। যেখান থেকে দেখছে বাইরে উন্মাদিনীর মতো বৃষ্টির ঝরে পড়ার পাগলামো। রাতের বৃষ্টি মানেই যেন কষ্টবহনকারী এক বার্তা। এমনটা শ্রাবণের অনেক আগে থেকেই মনে হতো। আজ কথাটাকে সত্যি বলে মনে হচ্ছে। তার ভিতরও কষ্ট পাগলা হাওয়ার মতো ছুটছে। চিন্তারা তো ঝেঁকে বসেছে বিকেল থেকেই। এত কষ্ট অনুভব হচ্ছে কেন জানে না। তবে কষ্ট হচ্ছে তার। বিকেলে একবার শুধু মিহিকের সাথে কথা হয়েছিল। মিহিক জিজ্ঞেস করেছিল,
“বিকেলে আসতে বলেছেন, বিকেলে চলে এসেছি। কিন্তু আমি আসাতে আপনি খুশি কি বেজার, সেটা তো বুঝতে পারছি না। আমি আসাতে আপনি কি বেজার?”
প্রশ্নটা শুনে শ্রাবণ কীয়ৎক্ষণ ঘোরের ভিতর থেকেই যেন তাকিয়েছিল মিহিকের দিকে। তারপর এক সময় বলেছিল,
“আজকেও আপনি আপনার বাবার বাড়িতে থেকে এলেই বোধহয় ভালো হতো।”
কথাটা কেন বলেছিল জানে না শ্রাবণ। সে তো চেয়েছিল মিহিক আজ বাড়ি ফিরুক। তারপরও এমন একটা কথা বলেছে সে। না, সে বলেনি, তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বা কথাটা বলেছে। আর সেই সত্ত্বা কেবল কষ্টে জর্জরিত। কথাটা শুনে মিহিকের কেমন লেগেছিল? খারাপ লাগেনি নিশ্চয়ই। মেয়েটার যে রাগ, হলে রাগ হতে পারে।
শ্রাবণ বুঝতে পারছে না সে এতসব কেন ভাবছে। তার তো এসব ভাবার কথা না। যেটা নিয়ে ভাবার কথা সেটা হলো ডিভোর্স। ডিভোর্স শব্দটা মনে উঠতে শ্রাবণের হৃদয় কেমন করলো। মিহিকের মুখখানি ভেসে উঠলো মানসপটে। ডিভোর্স হয়ে গেলে তার সাথে মিহিকের সম্পর্কের নামটা মুছে যাবে, তাই না? শ্রাবণের হৃদয় থরথর করে কাঁপছে। ভাবনার সূত্রপাত শুধু এখন নয়, বিকেল থেকেই ভেবেছে সে। ডিভোর্স হওয়া ছাড়া তো কোনো উপায় নেই। মিহিকের সাথে এভাবে তো থাকতে পারবে না সে। মিহিক তাকে অপছন্দ করে। এতটাই অপছন্দ করে যে, তার বিছানায় ঘুমাতেও অসুবিধা ওর। ওদিকে রুমকিও আছে। রুমকি বহু পুরোনো প্রেম তার। রুমকিকে তো সে কষ্ট দিতে পারবে না। রুমকি তার ভালোবাসা। ঠিকই তো, এখনও কেন মিহিককে ডিভোর্স দিচ্ছে না সে? শ্রাবণের মনে পড়লো, সে বিয়ের আগে থেকে ভেবে রেখেছিল যে, তার পরিবার ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে মিহিক একটা দজ্জাল মেয়ে। আর এটা যখন তারা বুঝতে পারবে তখন পরিবারই মিহিকের সাথে তার ডিভোর্সের কথা ভাববে। কিন্তু তার ভাবনার সাথে কোনো কিছুই বাস্তবায়িত হচ্ছে না। মিহিক তো তার পরিবারের সামনে খুব ভদ্র বউয়ের পরিচয় দেয়। দজ্জাল মেয়ের পরিচয় যা দেওয়ার তা তো দেয় তার সামনে। তাহলে তার ফ্যামিলি জানলো কী? তারা তো আরও ডিভোর্সের বদলে মিহিককে মাথায় করে রাখে। এই তো সেদিনও আম্মু মিহিককে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিল। না এরকম করে চলতে পারে না আর। এ সম্পর্কটা একেবারে গতিহীন। ফ্যামিলির মানুষজন যখন ডিভোর্সের কথা না ভাবছে, তখন তাকেই ভাবতে হবে। মিহিকের সাথে কথা বলতে হবে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যখন ডিভোর্সের কথা বলবে তখন তো ডিভোর্স হতেই হবে। হ্যাঁ, এখনই কথা বলতে হবে মিহিকের সাথে। কিন্তু এটাতেই তো তার সমস্যা। বার বার মন থেকে বাধা আসছে। মন বলছে মিহিককে এ নিয়ে কিছু বলা একেবারে অনুচিত। আর এই ডিভোর্স হওয়াটাও ঠিক হবে না। কিন্তু ডিভোর্স ছাড়া তো আর কোনো গতি নেই। এরকম ভাবে আর কতদিন?
শ্রাবণ প্রস্তুতি নিয়ে নিলো। লাইব্রেরি রুম থেকে হয়ে রুমে চলে এলো।
আশা করেছিল মিহিক রুমে থাকবে। আছে। জানালার ধারের টুল এখন মিহিকের দখলে। শ্রাবণ পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছে মিহিকের পরনে লাল রঙের থ্রি পিস। লাল রঙে মেয়েটাকে যেন একটু বেশিই সুন্দর লাগে। আজ আর সে মেয়েটার সৌন্দর্য নিয়ে ভাবতে চায় না। শ্রাবণ ডোর লক করলো। মিহিক বোধহয় টের পায়নি সে এসেছে। শ্রাবণ বললো,
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
মিহিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো শ্রাবণের দিকে। নির্জীব কণ্ঠে বললো,
“বলুন।”
“খুব ইম্পরট্যান্ট কথা।”
মিহিক কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে উঠে এলো। শ্রাবণের সামনে দাঁড়িয়ে আবার বললো,
“বলুন।”
শ্রাবণ বিছানার দিকে ইশারা করে বললো,
“ওখানে বসুন।”
মিহিক আরেকটু বিরক্ত হয়ে বললো,
“এত ভণিতা করেন কেন?”
বেশি কিছু না বলে গিয়ে বসলো। শ্রাবণও এসে মিহিকের সম্মুখে বসলো। জড়তা ঝাপটে ধরে আছে তাকে, সেই সাথে ভয়। শ্রাবণ থমথমে কণ্ঠে বললো,
“আমাদের সম্পর্কটা ঠিক কেমন এটা অন্য কেউ না জানলেও আপনি আর আমি খুব ভালো করে জানি। আমাদের সম্পর্কটা অন্য দশটা বৈবাহিক সম্পর্কের মতো না। আমরা কেউই নিজ ইচ্ছাতে এই বিয়েটা করিনি। আপনি আমাকে অপছন্দ করেন, আর আমিও রুমকিকে ভালোবাসি। গতকালকে তো আপনিই বলেছিলেন, আমাদের সম্পর্কটার ঠিক কী গতি হবে? আমিও আসলে কোনো গতি দেখতে পাচ্ছি না শুধু একটা গতি ছাড়া। আর আমি যে গতিটা দেখতে পাচ্ছি সেটা হলো…”
শ্রাবণ একটু থেমে বললো,
“সেটা হলো ডিভোর্স!”
শ্রাবণের ‘ডিভোর্স’ শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথে মিহিকের হৃদয় আত্মসাৎ করে নিলো রাগ, দুঃখ, কষ্ট, ঘৃণা, অভিমানে। তার বুক ভেঙে যেতে লাগলো। পৃথিবী মনে হলো লন্ডভন্ড। এই মুহূর্তে সামনে বসে থাকা মানুষটির জন্য দুচোখে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না। বহু কষ্টে বললো,
“আপনি আমাকে ডিভোর্স দিতে চান?”
“আমি একা তো ডিভোর্স দেবো না, আপনিও দেবেন।”
মিহিকের হৃদয় কেঁদে ওঠে। মন বার বার এই লোকটার প্রতি একটা অনুভূতিই প্রকাশ করে, সেটা হলো, ‘ঘৃণা’! ঘৃণা, ঘৃণা আর ঘৃণা।
মিহিক তীব্র অভিমানে জড়িয়ে পড়লো, রাগে ফুঁসে উঠলো। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে দুঃখে-কষ্টে উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে বললো,
“হ্যাঁ ডিভোর্স। ডিভোর্সই দেবো আপনাকে। আপনার মতো একটা কাপুরুষের সাথে আমিও থাকতে চাই না। এখনই নিচে গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে বলবো, আপনাদের ছেলে আমাকে ডিভোর্সের কথা বলেছে। সে আমাকে ডিভোর্স দিতে চায়, আমিও চাই তাকে ডিভোর্স দিতে। আপনাদের এই কুলাঙ্গার ছেলের সাথে আর থাকা সম্ভব নয়। হুম, বলবো আমি। এখনই ডিভোর্স দেবো আমি আপনাকে।”
মিহিক রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। শ্রাবণ দ্রুত এসে হাত টেনে ধরলো তার। অনুরোধের সুরে বললো,
“এমনটা করবেন না প্লিজ! আই অ্যাম স্যরি!”
মিহিক কথা শুনলো না। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টায় রত হয়ে বললো,
“অবশ্যই করবো আমি। এক মুহূর্ত আর থাকতে চাই না আপনার স্ত্রী পরিচয়ে। আপনার প্রতি শুধুই ঘৃণা রইল আমার। এখনই আপনার আব্বু-আম্মুর কাছে গিয়ে সবটা জানিয়ে বাড়ি চলে যাব আমি। আপনার সাথে আর এক মুহূর্ত নয়।”
হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলে মিহিক দরজার দিকে ছুটলো।
শ্রাবণ ব্যস্ত পায়ে এসে পিছন থেকে ঝাপটে ধরলো মিহিককে। বললো,
“না প্লিজ! করবেন না এটা। আব্বু যদি জানতে পারে আমি আপনাকে ডিভোর্সের কথা বলেছি তাহলে আমাকে তো তেজ্যপুত্র নয়, একদম মেরে ফেলবে। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আই অ্যাম স্যরি…আই অ্যাম স্যরি!”
মিহিককে মানানো গেল না। সে ছাড়া পেতে মরিয়া হয়ে উঠলো। তার এতদিনের সকল ধৈর্য আজ শ্রাবণ নিজের কথা দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সে কষ্টে বেপরোয়া হয়ে বলতে লাগলো,
“ছাড়ুন, ছাড়ুন আমায়। আমি বলবোই। আপনার সাথে আজকেই সবকিছু শেষ আমার। না থাকবে এই সম্পর্ক, আর না থাকবো আমি। ছাড়ুন আমায়। ছাড়ুন…”
মিহিকের হৃদয় খাঁ খাঁ করছে। চোখ তার অশ্রুপূর্ণ। সে দরজার দিকে এগোনোর চেষ্টা করলেই শ্রাবণ তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। মিহিকের মাথা গভীর ভাবে গুঁজে গেল শ্রাবণের বুকে। মিহিকের শ্বাস পড়ছে অশান্ত গতিতে। অশান্ত সে। শ্রাবণ মিহিকের মাথা নিজের বুকের সাথে ধরে রেখে মিহিককে শান্ত করার চেষ্টার্থে বললো,
“স্যরি…আই অ্যাম স্যরি মিহিক! আমি বুঝতে পারছি আপনাকে ডিভোর্সের কথা বলা একেবারেই উচিত হয়নি আমার। আই অ্যাম রিয়েলি স্যরি! আপনি শান্ত হন। আমার ভুল হয়েছে। আপনাকে ডিভোর্সের কথা বলা অন্যায় হয়েছে আমার। আমি স্যরি!”
শ্রাবণের প্রত্যেকটা কথা ছিল আকুলপূর্ণ। আগের বার বাবার ভয়ে কথাগুলো বললেও, এবার যেন ডিভোর্সের কথা বলার জন্য মন থেকে ক্ষমা চাইলো।
মিহিক ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। শীতল স্বরে বললো,
“ছাড়ুন আমায়।”
শ্রাবণের খেয়াল ছিল না সে মিহিককে জড়িয়ে ধরে আছে। খেয়াল হতেই বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়লো, ছেড়ে দিলো মিহিককে।
মিহিকের মুখ ঘামে একাকার। ঘামে ভিজে চুল মুখে লেগে রয়েছে। মিহিকের চেহারা দেখে শ্রাবণ মায়া অনুভব করলো। ইচ্ছা হলো মুখে লেগে থাকা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। কিন্তু ইচ্ছা নিজের কাছে গুটিয়ে রাখতে হলো তার।
মিহিক ঘৃণিত দৃষ্টি জোড়া শ্রাবণের উপর রেখে বললো,
“আমাকে আর কখনো স্পর্শ করবেন না।”
বলে শ্রাবণের পাশ কাটিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে এলো। টুলের উপর বসলো।
বাইরে বৃষ্টি ঝরছে এক ধারায়। মিহিক শান্ত হলেও তার ভিতরের ঝড় অশান্ত ভাবে উপচে পড়ছে। হৃদয় ভাঙার নির্মম শব্দধ্বনি শুনতে পাচ্ছে সে। চোখের কোল ডিঙিয়ে জল গড়াতে লাগলো মিহিকের। উষ্ণ গরম অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে অবাধ নিয়মে।
কীয়ৎক্ষণ নীরবতার পর দুঃসহ কষ্ট অভিমানে বলে উঠলো,
“আপনাকে বিয়ে করা আমার বড্ড ভুল হয়ে গেল শ্রাবণ!”
মিহিকের কথাটাতে তীব্র আফসোসের রেশ অনুভব হলো।
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রাবণ মিহিকের আফসোসপূর্ণ কথা শুনে অপরাধ বোধ থেকে আরও গভীর অপরাধ বোধে হারিয়ে গেল। কী যেন একটা ছিল মিহিকের কথায়! যা তার অন্তঃকরণে অন্য রকমের হাওয়া বইয়ে দিলো।
(চলবে)