#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৯
_____________
লিভিং রুমে সবার মুখে ছড়িয়ে পড়েছে ঈষৎ লজ্জার আলোকচ্ছ। সবচেয়ে বেশি লজ্জা বোধ করলেন বোধহয় কবির সাহেব। অতিথিদের সামনে ছেলে তার এ কেমন কথা বললো?
“তোমার বিয়ে তো কাল অথবা পরশু নয় আষাঢ়। সিনথিয়া ইন্ডিয়া চলে যাবার পর আবার আসলে তখন তোমাদের বিয়ে হবে। তুমি কি ভুলে গেছো?” ছেলেকে শুধালেন কবির সাহেব।
আষাঢ়ের মুখখানি প্রাঞ্জল। মুচকি হেসে বললো,
“সিনথিয়ার ইন্ডিয়া চলে যাওয়া, আবার বাংলাদেশ আসা এর সাথে তো আমার বিয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তো সিনথিয়াকে বিয়ে করবো না। আমি তো…”
আষাঢ়ের দৃষ্টি আড় চোখে চলে যায় নোয়ানার দিকে। স্তব্ধ মেয়েটার স্তব্ধ চাহনি খারাপ লাগে না। একটু আধটু স্তব্ধ না হলে আবার চনমনে হয়ে উঠবে কীভাবে? স্তব্ধ চোখ জোড়া যেন এখনও সাবধান করছে। চুপ করে যেতে নির্দেশ দিচ্ছে। কিন্তু তার নির্দেশ যে আজ বড়ো অকেজো। আষাঢ়ের বলতে ইচ্ছা হচ্ছে,
‘তুমিই তো পাগলামি দেখতে চেয়েছো। পুরো পাগলামি না দেখে থেমে যাওয়া কোনো হার্টলেস মেয়ের সাথে শোভা পায় না।’
আষাঢ় চোখ সরিয়ে এনে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“আমি নোয়ানাকে বিয়ে করবো।”
লিভিং রুম থমকে যায়। উপস্থিত সকল চোখে ঠিকরে ওঠে অপ্রতিভ বিস্ময়। ক্ষণকাল নীরব, স্থির কেটে যায়।
নোয়ানার বক্ষস্থলে বিকট শব্দ হয়ে হৃদস্পন্দন এখন রুদ্ধ। হাত দিয়ে জামার অধিকাংশ মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। চোখে জল ছলছল করে ওঠে।
কবির সাহেবের দুই কানে তালা লেগে গেছে। দুই কান অবিশ্বাস্য। সহসা দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন,
“কী বললে তুমি?”
আষাঢ় স্বাভাবিক। তার চোখে-মুখে কোনো বিচলিত, অস্বাভাবিকতার লেশমাত্র নেই। সরল কণ্ঠে বললো,
“যা বলেছি তা তো শুনেছো আব্বু। আশা করি এখানে উপস্থিত সকলেই আমার কথা শুনেছে।”
আষাঢ় নোয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আশা করি তুমিও শুনতে পেয়েছো।”
এক মুহূর্তের জন্য সকলের দৃষ্টি নোয়ানার উপরে এসে স্থির হলো। কবির সাহেবের মস্তিষ্ক ওলটপালট ঠেকছে। কী শুনছে এটা ছেলের মুখে? শেষ পর্যন্ত তার দুই ছেলের মাথাতেই কি না গন্ডগোল দেখা দিলো!
শ্রাবণের মাথার গন্ডগোল মানা যায়, কিন্তু আষাঢ়ের? সে আষাঢ়কে বিচক্ষণ একটা ছেলে ভাবতো, যতই আষাঢ়ের মেয়ে গঠিত সমস্যা থাকুক না কেন। কিন্তু আজ? কবির সাহেবের চোখ সিনথিয়ার দিকে চলে গেল। মেয়েটার সামনে আষাঢ় কী শুরু করেছে? সে গলার স্বর এক ধাপ কঠিন করে গুরুগম্ভীর ভাবে বললেন,
“কী বলছো কী তুমি? ভাইয়ের মাথার গন্ডগোল থামতে না থামতেই তোমার মাথায় গন্ডগোল শুরু হয়ে গেছে?”
“আমি পাগল, আমার মাথায় গন্ডগোল এমনটাই সকলে ভাবো কেন বলো তো? আমি সুস্থ মস্তিষ্কেই সবটা বলেছি।”
আষাঢ় নোয়ানার দিকে চেয়ে বললো,
“কি ভীতু, হার্টলেস টিউলিপ, আমাকে বিয়ে করতে আপত্তি তোমার?”
রাগে নোয়ানার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে। আষাঢ়ের এমন পাগলামি শিরা উপশিরা বিক্ষিপ্ত করে তুলছে। হাফিজা নোয়ানাকে কিছু বলার জন্য কেবল মুখ খুলতে নিয়েছিলেন, এর মাঝেই নোয়ানা বসা থেকে উঠে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
আষাঢ়ের পাশ অতিক্রম করে যাওয়ার সময় আষাঢ় সামনে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে আটকে বললো,
“কিছু বলে যাও।”
নোয়ানা তাকালো। দু চোখ জলে চিকচিক করছে। মুখে অভিমানের গাঢ় প্রলেপ। মুখ ফুঁটিয়ে বহু কষ্টে দুটো শব্দই শুধু উচ্চারণ করলো,
“আপনি অসহ্যকর!”
“উহু, তুমি।”
নোয়ানা আষাঢ়ের হাতটা সামনে থেকে ছিটকিয়ে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত পদে বেরিয়ে গেল কবির সাহেবের বাড়ি থেকে। হাফিজাকে সবটা খতিয়ে দেখতে হবে। নোয়ানা এমন জঘন্য কাজ করলো কী করে? সেও দ্রুত পায়ে নোয়ানার পিছন পিছন বেরিয়ে গেল।
লিভিং রুমের কারো মুখেই কোনো রা নেই। সিনথিয়া অবাক নয়। এমন কিছু হবে সেটা আগেই জানতো সে। তবুও হৃদয়ে সূক্ষ্ম ব্যথার আঁচ অনুভব হচ্ছে!
ইদ্রিস সাহেব ঘটনার প্রতিকূল থেকে একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। কী বলবে, বা কী করবে কিছু বোধগম্য নয় তার।
কারিব, শ্রাবণ, মিহিকের অবস্থাও একই। সবথেকে বেশি ক্ষ্যাপা কবির সাহেব। সে লায়লা খানমকে হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,
“লায়লা, তোমার ছেলেকে এসব কাণ্ড থামাতে বলো, যদি না সে তেজ্যপুত্র হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে মনে।”
আষাঢ় বাবার কথার প্রত্যুত্তর করলো,
“আমি তেজ্যপুত্রও হবো না আর নোয়ানাকে বিয়ে না করেও থাকবো না। তোমরা সকলে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করো। আমি উল্টাপাল্টা কিছু করতে চাইছি না। সকলের অনুমতি নিয়েই বিয়ে করতে চাইছি। না হলে কাজী অফিসে গিয়ে নোয়ানাকে বিয়ে করার কার্যটা অনেক আগেই সেরে ফেলতাম।”
কবির সাহেব গর্জন করে উঠলেন,
“তোমার স্পর্ধা দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি। তুমি এমনভাবে কথা বলছো আমার সাথে?”
“বলতে চাইনি আব্বু। কিন্তু আমাকে বাধ্য করা হয়েছে।”
“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে আষাঢ়। তুমি পাগল হয়ে গেছো।”
“পাগল এখনও হইনি, কিন্তু নোয়ানার সাথে বিয়ে না হলে পাগল হয়ে যাব।”
এটুকু বলে আষাঢ় সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।
কবির সাহেব স্তব্ধ। তার ছেলে জীবনে কখনও এরকম দুঃসাহস দেখায়নি তার সামনে। কিন্তু আজ মুখের উপর চটাং চটাং করে সব কথা বললো। কতটা অবনতি হলে এরকম করতে পারে? রাগে সর্বাঙ্গ কাঁপছে তার। লায়লা খানমের উদ্দেশ্যে বললেন,
“তোমার ছেলে এগুলো কী বলে গেল? কী হয়েছে তোমার ছেলেদের? একজন বিয়ের মজলিসে গিয়ে গন্ডগোল করে, আরেকজন নিজ বাড়িতে! তোমার ছেলেরা তো পাগল করে দেবে আমায়। ওর কাছ থেকে কি এটা আশা যোগ্য ছিল? শ্রাবণ আর জুনের থেকেও ও বেশি আদরে বড়ো হয়েছে। দূরে থাকলেও ওর প্রতিই বেশি ভালোবাসা অনুভব করি। ও বাংলাদেশ এলে কারিবকে আমি ছুটি দিয়ে দিই ওর ভালোর জন্য। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায় কারিবকে নিয়ে। মেয়েদের প্রতি ওর খানিক ঝোঁক আছে, এটা জানার পরও আমি ওকে সরাসরি কিছু বলিনি। এটা উপশম করার জন্য বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেছি। নয়তো এত তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করতাম না। আমি কি পারতাম না এটা এভাবে সমাধান করার চিন্তা না করে ওর সাথে এই নিয়ে রাগারাগি করতে? করিনি তো তা। নোয়ানাকে বিয়ে করবে সেটা আগে বলেনি কেন? মধ্য থেকে এখন এটা কী শুরু করেছে? পাগলই হয়ে গেছে ও।”
কবির সাহেব রাগে গমগম করতে করতে রুমের দিকে অগ্রসর হলেন।
লিভিং রুমে থমথমে অবস্থা। সবাই নির্বাক। শ্রাবণ আর কারিব সিঁড়ির কাছেই দণ্ডায়মান। ইদ্রিস সাহেব এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন একেবারে। একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি মুখ দিয়ে। মিহিকের দিকে তাকিয়ে রাশভারী কণ্ঠে বললেন,
“এসব কী?”
বাবার কথার কোনো প্রত্যুত্তর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না মিহিক। নিজেই তো ব্যাপারটা সমন্ধে অজ্ঞ ছিল। মস্তক নত হয়ে এলো তার।
লায়লা খানমের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তার মনে বরংচ কেমন ভালো লাগার একটা রেশ অনুভব হচ্ছে। তিনি ভেবে দেখলেন, নোয়ানা তার পুত্র বধূ হলে মন্দ হয় না। বেশ ভালোই তো হয়। কিন্তু সিনথিয়ার কথা মনে পড়তে মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। তার থেকে খানিক দূরে বসা সিনথিয়ার দিকে তাকায় সে। মেয়েটার মুখ পাথুরে দেখাচ্ছে। কী বলে মেয়েটাকে মানাবে এখন? লায়লা খানম একটু নিকটে এগিয়ে এসে বসে বললেন,
“আসলে মা…মানে আমি…আসলে আষাঢ়…”
লায়লা ইতস্তত করছে দেখে সিনথিয়া বললো,
“ইট’স ও কে আন্টি। আমি আগে থেকেই জানতাম সবটা। আষাঢ় আগে থেকেই সবটা জানিয়ে রেখেছিল আমায়।”
বলে বসা থেকে উঠে রুমের অভ্যন্তরে চলে গেল গম্ভীর পাথুরে মুখ নিয়ে। হৃদয়ে চিনচিনে একটা ব্যথা হচ্ছে না? হুম হচ্ছে। এ সবটার জন্যই আষাঢ় দায়ী। কেন আষাঢ়ের জন্য তার হৃদয় দুর্বল হয়ে পড়ছে এভাবে?
ইদ্রিস খান ও তিন্নি চলে গেলে বাড়িতে রইল শুধু বাড়ির মানুষ। কারিব আষাঢ়ের রুমে গিয়েছে। রুপালি এত ফটফটে মানুষ অথচ এই মুহূর্তে তাকে একটা কথাও বলতে শোনা গেল না। শ্রাবণ সিঁড়ির কাছ থেকে মিহিকের দিকে এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বললো,
“আষাঢ় আর নোয়ানার মাঝে কখন কী হলো? কীভাবে হলো? আমি তো কিছু টের পেলাম না। আপনি পেয়েছেন টের?”
মিহিক রাগী চক্ষুতে তাকালো। ওই দৃষ্টিতে একটু ভড়কে গেল শ্রাবণ। মিহিক শ্রাবণের থেকে চোখ সরিয়ে সদর দরজার দিকে ধাবিত হতে লাগলো। টের তো সে পেয়েছিল বোধহয়, কিন্তু বুঝে উঠতে পারেনি। আষাঢ় নিজেই তো তাকে কয়েক বার ইঙ্গিত দিয়েছিল এ ব্যাপারে। তার বুঝতে ব্যর্থতা ছিল। একটু বুদ্ধি খাটিয়ে ভাবলেই সবটা বুঝে যেত।
কারিব আষাঢ়ের রুমে প্রবেশ করে দরজা হালকা চেপে রাখলো। আষাঢ় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কারিব এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“আজ আপনি এত বড়ো একটা কাজ করবেন আমি ধারণাও করতে পারিনি আষাঢ় ভাই।”
আষাঢ় ম্লান হেসে বললো,
“কাজটা কি ঠিক করিনি?”
কারিব উত্তর দিতে পারলো না। আষাঢ় কাজটা ঠিক করেছে কি বেঠিক বুঝতে পারছে না। সে ক্ষণিকের জন্য নীরব থেকে বললো,
“মামা মনে কষ্ট পেয়েছে।”
আষাঢ় বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলে পরিস্কার গলায় বললো,
“মাঝে মাঝে কিছু ঝড় আসা প্রয়োজন। এই ঝড়ে এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেলেও, বাকি মুহূর্তগুলো তোমাকে শান্ত-সুখে থাকতে সাহায্য করবে। কিন্তু এই ঝড় যদি না আসে তাহলে তোমার সকল মুহূর্তগুলোই ওলট-পালট। মানুষের জীবনে এই ওলট-পালট জিনিসটা সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক। যেটা আমি আমার জীবনের সাথে চাইছি না।”
কারিবের বুঝতে একটু অসুবিধা হলো, কিন্তু সে অনুধাবন করতে সক্ষম হলো আষাঢ়ের কথাটা। যুক্তি খুঁজে পেল। আজ যদি এই ঘটনাটা না ঘটতো তাহলে সত্যিই সব ওলট-পালটই হতো। এটা ঘটা জরুরি ছিল। আজ অথবা কাল এটা ঘটারই ছিল। সে বললো,
“মামা-মামি কি মানবে সবটা?”
“মানা ছাড়া আর উপায় কী? জোর করে তো আর ছেলের বিয়ে দিতে পারবে না।”
“কিন্তু শ্রাবণ ভাইয়ের বিয়ে তো জোর করেই হয়েছিল।”
“ব্রোর কথা আর আমার কথা ভিন্ন।”
কারিব এটাতেও যুক্তি খুঁজে পেল। খানিক বাদে চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
“টিউলিপ ভাবির অবস্থাটা কী হবে? ওনার ফ্যামিলি নিশ্চয়ই অনেক বকা-ঝকা করবেন ওনাকে।”
“করুক। শুধু বকা-ঝকা নয়, তাদের ইচ্ছা হলে মেরে রক্তাক্ত করুক! কিন্তু সবশেষে টিউলিপ যে আমারই হবে সেটা সুনিশ্চিত।”
“আপনি নির্দয়ের মতো কথা বলছেন আষাঢ় ভাই।”
আষাঢ় হাসে,
“যার জন্য সম্পূর্ণ হৃদয় তোলা, তার সম্পর্কে কী করে নির্দয় হতে পারি?”
কারিব ঢিমে গলায় বললো,
“সেটা অবশ্য ঠিক।”
আষাঢ় উদাসী কণ্ঠে বললো,
“ঝড়টা আমি শুরু করেছি, কিন্তু এটা শেষ হবে নিজে নিজে। তবে আমার চাওয়াটা সফল করেই এটা শেষ হবে, তার আগে নয়।”
___________________
রাগ, দুঃখ, কষ্টে নোয়ানার ইচ্ছা হচ্ছে মরে যায়। এই অপার্থিব জগতে কষ্ট এত গভীর ভাবে কীভাবে গেড়ে বসে মানুষের জীবনে? আজ আষাঢ় নিজের পাগলামি দিয়ে তাকে সকলের সামনে নীচ করেছে। জীবনে আরও একটা বড়ো আঘাত এটা। সব কিছু ঠিক রাখতে চাইলেও, আষাঢ় শেষমেশ সেই সব কিছু বেঠিক করে দিলো! এরকম পরিস্থিতিতে তার সবচেয়ে ভয় ছিল, আর আজ সে এরকম একটা পরিস্থিতিতেই দাঁড়িয়ে আছে।
ইদ্রিস সাহেবের বাড়িতে থমথমে পরিবেশ। থমথমে পরিবেশে থেকে থেকে ক্রোধের কণ্ঠ গর্জে উঠছে। নোয়ানার উপর প্রচণ্ড রাগান্বিত হাফিজা। নোয়ানার থেকে এটা ভুলেও আশা যোগ্য ছিল না তাদের।
“নাঈম যে তোকে পছন্দ করে, ওর পরিবারও যে ওর পছন্দে সায় দেওয়া এটা তুই আগে থেকে জানতি না? সবাই জানতো, তুই জানতি না? এটা কি আজ অথবা গত কালকের কথা, অনেক আগে থেকেই সবাই এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। সব জেনেশুনেও যেই আষাঢ় এলো আর অমনি ওর সাথে জড়িয়ে পড়লি? তোকে কি আমরা অবহেলায় রেখেছি? যে থেকে বাংলাদেশ এসেছিস সেই থেকে নিজেদের কাছে আগলে রেখেছি তোকে। তার এই প্রতিদান দিলি?”
হাফিজার মুখে ‘প্রতিদান’ কথাটা শুনে নোয়ানার বুক কান্নায় ভেসে গেল। এরকম কথাগুলোকেই যে সে খুব ভয় পেত। এই মানুষগুলোর থেকে এই রকম কথা শোনা কতটা কষ্টকর সেটা কেউ বুঝবে না। সে যে এখানে মিহিক আর তিন্নির মতো আদরে ছিল সেটা নয়। কিন্তু জীবনে কখনও প্রতিদান কথাটার সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু আজ? আষাঢ় তাকে এই মর্মান্তিক কথাটা শুনিয়ে ছাড়লো। কী করে বোঝাবে সবাইকে যে সে সব কিছু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টাই করেছে? কে বুঝবে এই কথা? নোয়ানা কাঁদতে কাঁদতে কম্পিত কণ্ঠে বললো,
“ও…ওনার সাথে…তেমন কোনো সম্পর্ক নেই আমার। বি…বিশ্বাস করো…”
“তাহলে কি আষাঢ় মিছে মিছেই তোকে বিয়ে করার কথা বলেছে?” হাফিজার কণ্ঠ ক্ষিপ্র।
“এখন আমি আপাদের কী বলবো? নাঈম এটা শুনলে কী ভাববে? যেখানে আর কিছুদিন পর বিয়ে এমন একটা সময়ে… ছি, মানসম্মান আঘাতপ্রাপ্ত করলি তুই। কী বলে বোঝাবো আমরা ওদের?”
ইদ্রিস খান আর তিন্নি চুপচাপ সবটা শুনছে। মিহিক মাঝখানে ফোড়ন কাটলো,
“তুমি এরকম করে বলছো কেন মা? বিয়ে তো আর হয়ে যায়নি। আর নোয়ানারই বা দোষ কী? দোষ যা আমি তো সব আষাঢ়ের দেখছি। দোষ যারই হোক, বিষয় তো সেটা না। হুট করে যখন একটা ঘটনা ঘটেই গেছে তখন আষাঢ়ের সাথেই না হয় বিয়ের ব্যবস্থা করা হোক। আষাঢ় কি খারাপ ছেলে? ও আমার দেবর। মোটেই খারাপ নয়। আর নাঈম ভাইয়াকে সবটা বললে উনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। উনি শৃঙ্খলপূর্ণ মানুষ, সবটা শান্ত মস্তিষ্কে মেনে নেবে। খালামণিরা তো আর এমন মানুষ নয় যে সবটা শুনে যুদ্ধ করার জন্য নামবে।”
“কী বলছিস মিহিক? তোর মাথায় কিছু আছে?”
“যা আছে তা দিয়েই বললাম।”
তর্ক-বিতর্ক চললো প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যার পর পরিবেশ হয়ে গেছে একেবারে সুনশান। হাফিজা আছে তার বোনের পরিবারের অপমান নিয়ে। যে মেয়েকে এত বছর যাবৎ তারা দেখভাল করে এসেছে, সেই মেয়ের কারণে তার বোনের পরিবার অপমানিত হবে এটা মেনে নেওয়ার মতো না।
ইদ্রিস সাহেবের কাছে মানসম্মানই সব। আজ কত বড়ো সম্মানহানি হলো! কবির সাহেবদের মুখ দেখাতেও যে লজ্জা করবে এখন। দুই পরিবারের মাঝে এমন বিদঘুটে একটা ব্যাপার সৃষ্টি হবে কে ভেবেছিল!
ওদিকে নাঈমের সাথে যদি নোয়ানার বিয়ে না হয় তাহলে নাঈমের পরিবারের সাথেও একটা বিদঘুটে ব্যাপার সৃষ্টি হবে। সব মিলিয়ে ইদ্রিস সাহেব মহা দুশ্চিন্তায় আছেন।
নোয়ানা এক ধারায় কেঁদে চলেছে। প্রকৃতি ডুবে চলেছে অন্ধকারে। আজ এত কিছু ঘটবে কে জানতো! যা ঘটেছে, সব কিছু ছিল খুব খারাপ। হৃদয়কে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। তার জীবন বরাবর এত কষ্টের কেন? রুমে নোয়ানা একা। একটা মানুষ যখন কাঁদে তখন তাকে প্রাণ খুলেই কাঁদতে দেওয়া উচিত। লোকালয়ে এটা হয় না। কাঁদতে হলে চাই একাকী, সুনশান একটা পরিবেশের। সেই পরিবেশটাই যেন দেওয়া হয়েছে নোয়ানাকে। না চাইতেও চাচা-চাচির হৃদয়ে আঘাত করে বসেছে সে। আষাঢ়ের প্রতি এখন ঘৃণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আষাঢ় যেটা করেছে আজ, এর চেয়ে খারাপ আর কিছু নেই। মুহূর্ত গড়াচ্ছিল অবচেতনার মতো। এর মাঝেই এক সময় ফোনে কল বেজে উঠলো। নোয়ানা ঘোলাটে চোখে আষাঢ়ের নামটা দেখতে পেল। হৃদয় যেন আরও জোরে আর্তনাদ করে উঠলো। অশ্রু যেন আরও বেশি করে ঝরে পড়ছে। কল রিসিভ করে কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে আষাঢ় বললো,
“তুমি কাঁদছো টিউলিপ?”
নোয়ানা কাঁদতে কাঁদতে প্রত্যুত্তর করলো,
“সকলের কাছে আমায় এরকম ভাবে কেন নীচ করলেন আষাঢ়? কেন করলেন এটা?”
আষাঢ় নোয়ানার কান্না জড়ানো কণ্ঠ ধরতে পারলো। ব্যাপারটা মোটেও খারাপ লাগলো না তার। বরং শান্তি অনুভব হলো। বললো,
“কার কাছে নীচ হয়েছো তুমি? কে বলেছে তুমি নীচ হয়েছো? কারো কাছেই নীচ হওনি তুমি। আর যদি নীচ হয়েও থাকো, তাহলেও সেটা পরোয়া করা উচিত নয় তোমার। কারণ, এই হৃদয়ে তুমি সবচেয়ে মহিমান্বিত স্থানে আছো। আমি মনে করি, এটুকুই যথেষ্ট তোমার জন্য।”
“ঘৃণা করি আপনাকে!”
“উহু, ভালোবাসো আমাকে।”
“আপনি ভালোবাসার যোগ্য নন।”
“আমি ঠিক তাই-ই।”
“ভুল।”
“তুমি এখন বেঘোরে এসব বলছো, পরে যখন তোমার সম্বিৎ ফিরবে তখন নিজেকেই ভুল হিসেবে পাবে। বাই দ্য ওয়ে, বিয়ের জন্য অভিনন্দন! হিমেল ইসলামের সাথে একটা সুখী-সুন্দর জীবন কাটুক আপনার, ছয়-সাতটা বাচ্চার মা হন সেই দোয়া করি।”
“আপনি আপনার জীবন নিয়ে কখনও সিরিয়াস নন, কিন্তু আমি…”
“সমস্যা নেই, আমার মতো মানুষের সাথে থাকতে পারবে তুমি। থাকতে না পারলেও আমার সাথেই থাকতে হবে। সেটা স্বেচ্ছায়ই হোক বা বাধ্য হয়ে!”
(চলবে)