বিভাবতীর জীবন পর্বঃ৯

0
2419

#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃ৯

সময় ফুরিয়ে যায়, এক এক ধাপ মানুষকে জীবনের নতুনত্ব আর জীবনের মানে শেখায় কিভাবে একজন মানুষ নিজের জীবনে সফলতার উচ্চ স্তরে পারি জমায়।
জীবনে আঘাত জিনিসটা খুব প্রয়োজন! দেয়ালে যখন একটা মানুষের পিঠ ঠেকে যায় তখন সেই মানুষ আর মুখ বুজে সহ‍্য করতে পারে না। তখন সেই মানুষ উঠে দাড়ায় আর লড়তে শুরু করে নিজের উল্টো পিঠে থাকা মানুষ গুলোর দিকে।

বিভার ও সেই সময় এসেগেছে, সাজানো স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে যাওয়ার পর বিভার সেই লড়াইয়ে সে আবার তার বাবাকে পেয়েছিল। এই তো বছর দুয়েক আগে শশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে আসা মেয়েটির এখন একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়েছে। কথায় কথায় নাক-মুখ কুচকে থাকা পাড়া-প্রতিবেশিদের মুখ সে একাই বন্ধ করতে পারে।
হয়তো অতসব প্রতিবাদ করতে গিয়ে শুনতে হয় নানাধরনের মন্তব‍্য। তবুও বিভা আর চুপ করে থাকতে পারেনা।
_________________________________

ব‍্যাংকের দু নাম্বার কাউন্টারে এসেছে মনিকা। ভিড় ঠেলে দাড়াতে পারছেনা তবুও সবাইকে পিছনে চেপে সামনে এগুতে লাগল। এক নাম্বার কাউন্টারের লোকজন যেন নিজেদের মধ‍্যে হট্টগোল লাগিয়ে দিয়েছে। মনিকার খুব বিরক্ত লাগছে। একেতো প্র‍েগন‍্যান্সির প্রায় সাত মাস চলছে প্রায়। ক্লান্ত মনিকা দাড়াতে পারছেনা কিছুক্ষণ দাড়িয়ে সামনের লোকটিকে বলল –

–” আঙ্কেল আমাকে একটু তাড়াতাড়ি যেতে দিবেন? আমি আর দাড়াতে পারছিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আঙ্কেল।”

–” আপনাকে যদি আমি আগে সিরিয়াল দিয়ে দেই তাহলে তো আমি সময় পাবো না, আমার অফিস আছে, ছেলের বেতন দিতে এসেছি সময় মত না গেলে বস রেগে যাবে।”

–” আঙ্কেল যদি পাচঁটা মিনিট সময় দিতেন তাহলে আমি একটু দাড়াতে পারতাম। আমি দাড়াতে পারছিনা আঙ্কেল।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”

–” এই অবস্থায় কেন আসেন? ঘরে জামাই নেই? কেউ নেই?”

হুটকরে কেদেঁ উঠলো মনিকা, এতগুলো লোকের সামনেও তার বাধ মানছে না চিৎকার করে কাদতেঁ কাদঁতে বলল –

–” আমাকে একটু বিষ দিন খেয়ে চিরজীবনের মত সবাইকে মুক্ত করে যাই! আমি আর পারছিনা! স্বামীর বাড়িতে আজ শশুর শাশুড়ি ভালো হওয়ার পর ও শুধু আমার স্বামীর জন‍্য ভালো থাকতে পারছিনা। দিনদিন তার অত‍্যাচার এখান থেকে ওখান থেকে টাকা নেওয়া। ঋণ করতে করতে আমার জমানো টাকা ও সে শেষ করে দিয়েছে। বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনেছি বলে ভাবি আর বড় ভাই আমাকে ঐ বাড়িতে যেতে দেয় না। এই অবস্থায় আমাকে ঘুরতে হয় অথচ আমি আমার স্বামীকে কাছে পাইনি।” বিভা এসেছিল ভিতর থেকে এপ্লিকেশন ঠিক করে সিল নিতে, কিন্তু ক্লান্ত মনিকাকে চিৎকার করতে দেখে বিভা কাউন্টারে আর দাড়াতে পারল না কারন মনিকা ততক্ষণে পরে যাচ্ছিল প্রায়। বিভা মনিকাকে এভাবে রেগে যেতে দেখে অনেকটা নিজেকেই যেন দেখতে পেল। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে সে একেবারে।
মনিকাকে সেই ভীড় থেকে টেনে নিয়ে এসে চেম্বারে বসিয়ে দিল। পানির বোতল টা এগিয়ে দিয়ে বলল –

–” আপনার এই সময়ে এত হাইপার হওয়া উচিৎ নয়।
কয়মাস হয়েছে প্রেগন‍্যান্সির?”

–” সাত মাস,”

–” এভাবে ঘুরে বেরানোর কোন মানে হয় ? মাথায় পানি দিয়ে দিব?”
মনিকা চোখের পানিগুলোকে মুছতেও পারছেনা ঝরঝরিয়ে পরছে, মাথা নাড়িয়ে বহুকষ্টে বলল –

–” আমার মত জীবন যেন আর কারো হয় না গো আপু!”

–” এমন ভাবে বলবেন না আপু, জীবনে সুখ দুঃখ থাকবেই। নিজেকে শক্ত করুন, চেক কেন নিচ্ছেন? নিজের স্বামীর ঋণ শোধ করতে?”
মনিকা ডুকরে কেদেঁ উঠে মাথা নাড়ালো, বিভা তা দেখে বলে উঠলো –

–” কতদিন আপনি আপনার স্বামীর ঋণ শোধ করবেন?
আমি যতটুকু জানি যারা ঋণ করে তারা সারাজীবনে ও নিজের স্বভাব পাল্টাতে পারেনা। তো এভাবে কতদিন ঋণ শোধ করবেন? আপনার ব‍্যাংক একাউন্টে কত আছে এখন বর্তমানে?”

–” পনেরো লাখ, বাবা আমার নামে ব‍্যাংকে রেখেগেছেন।
আর একটা প্লট রেখেছেন।”

–” চাকুরীজীবি আপনি?”

–” না,”

–” তাহলে তো এগুলো আপনার ভবিষ্যৎ সম্বল, কেউ এভাবে নিজের সম্বলটুকু শেষ করে?”

–” আপু আমার স্বামী যদি ঋণমুক্ত না থাকতে পেরে মানুষের সাথে মাথা উচু করে বাচঁতে না পারে তাহলে আমার এই টাকা দিয়ে কি হবে?”

–” বোকার মত কথা বললেন আপনি, এত আত্মবিশ্বাস এত ভালোবাসেন আপনার স্বামীকে। আপনার স্বামী কি এমন ভাবে আপনাকে ভালোবাসে? এই যে এমন একটা মুহুর্ত সে পারতো নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে?
এত আবেগী হয়ে থাকবেন না আপু, কিছু বুঝতে চেষ্টা করুন, যে টাকা আপনার বাবা দিয়ে গেছেন তা শেষ না করে কিছু করার চেষ্টা করুন। আপনার সেই অর্জিত অর্থগুলো আপনার স্বামীর পিছনে ব‍্যায় করুন। এতগুলো টাকা শেষ করবেন কেন আপনি? পনেরো লাখ আপনি শেষ না করে ছোটখাটো চাকরি করুন টাকার সংকট হলে। তবুও নিজের শেষ সম্বলটুকু শেষ করবেন না।

মনিকার সামনে আরেক গ্লাস পানি দিয়ে বলল –

–” পানিটা শেষ করুন, তো যেটা বলতে চাইছিলাম।
আপনি সংসার করবেন, স্বামীর ঋণ শোধ করবেন ঠিক আছে তাই বলে এমনটা করবেন না। আরেকটা কথা সংসার করলে কখনই মনের দুঃখ হোক বা যেকোন কষ্ট থেকেই হোক বাইরের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করবেন না। এই যে আজ আপনি চিৎকার করে এত গুলো লোকের সামনে নিজের কষ্ট টাকে জাহির করেছেন একজন ও এগিয়ে আসেনি। আসবে ও না, আপনাকেই শক্ত হতে হবে।
আপনার স্বামীকে বলুন তার মধ‍্যাকার যত কথা সব আপনাকে বলতে। দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিন কিভাবে এই অর্থাভাব দূর করা যায় আর কিভাবে ওনার এই ঋণের স্বভাব বন্ধ করা যায়। এমন অন্ধের মত বিশ্বাসটা অন্তত করা বন্ধই করুন। এক সময়ে আমি ও আপনার মত বিশ্বাস করেছিল‍াম কাউকে। ঠকে ও ছিলাম আজ তার জন‍্য দেখুন সহ‍্য ও করে যাচ্ছি। তবে একদিক দিয়ে বেশ ভালো আছি আমি। নিজের মত বাচঁতে পারছি নিজের মত চলতে পারছি।”

বিভা মনিকার হাতে চেক বই ধরিয়ে দিল, মনিকা বিভার দিকে তাকিয়ে বলল –

–” আপনার কি সমস‍্যা ছিল?”

–” ঐ একই সমস‍্যা, ”

মনিকার সঙ্গে কথা বলেই বিভা তাকে তার পিয়ন দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়ার ব‍্যবস্থা করেদিল। মনিকার সঙ্গে কথা বলে নিজেকে খুব হালকা লাগছে তার। বেশ ভার ভার লাগছিল তার কারোর সঙ্গে কথা বলেই যেন তার ভালো লাগে না। একই দুঃখের সই না হলে নাকি দুঃখের গল্প বলে মজা পাওয়া যায় না বিভার ও ঠিক একই দশা।

বিকেল বেলায় কিছুটা ভীড় কম থাকে। বিভা কাজ শেষ করে হাত ঘড়ি দেখল সময় হয়েগেছে প্রায় এরপর বেড়িয়ে গেল সে। আজ উর্মির সঙ্গে দেখা করতে হবে তার কবে দেখা হয়েছিল তাদের। বিভা গাড়ি নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে আসল উর্মির ভাই বোন সবাই একসাথে। বিভা উর্মির সঙ্গে দেখা করতেই উর্মি তাকে জড়িয়ে ধরল। কথার মাঝে দুজনই কেদেঁ দিল স্কুল -কলেজ লাইফে তো দুজন একসঙ্গে থেকেছে। শেষকালে এসে এমন ঘটনা ঘটেছে যে দুজনই আলাদা হয়েগেছে। কিছুক্ষণ কথা বলার পরই উর্মিকে বিদায় নিয়ে এসে পরল।

ঘড়ির কাটায় ছয়টা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট, বিভা গাড়ি থেকে নেমে বাসায় আসা মাত্রই দেখল ডাঃফাইয়াজ বসে আছেন, সঙ্গে একজন মহিলা । বিভা ওনাকে দেখে কিছুটা চমকে গেল, এই লোকটা এখানে কেন?
বিভা সৌজন্য মূলক ভাবে সালাম দিয়ে নিজের রুমে চলেগেল। কিছুক্ষণ পর বিভা রুম থেকে বের হয়ে দেখল ড্রয়িংরুমে এখনও কথা শুনা যাচ্ছে শব্দের উৎসের কারনে বুঝতে পারল ফাইয়াজ এখনও চলে যাননি।
বিভা কিছুটা অবাক হলো, সে অফিস করে এমনিতেই ক্লান্ত তাই আর কিছু ভাবলো না ফাইয়াজ সাহেব বিভার মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন। কিছুক্ষণ কথা বলেই ফাইয়াজ সাহেব চলেগেলেন সেখান থেকে।

বিভা তখন রুমেই ছিল, বাবা আসার পর তার মা তাকে ডেকে বললেন বাবা তাকে ডাকছে সে যেন চলে আসে।
বিভা বাবার রুমে আসলে তিনি বসিয়ে দিলেন সামনে।

–” কিছু বলবে বাবা?”

–” হুম, একটা কথা বলতে চাই, ”

–” বল,”

–” তুমি ডাঃ ফাইয়াজ কে তো চেনো?”

–” হ‍্যা,”

–” ফাইয়াজকে তোমার কেমন মনে হয়?”

–” ভালোই তো, খুব ভালো মানুষ!”

–” অনেক কাজ করেছ, আমাকে এসে বলেছো,”

–” হ‍্যা বলেছি তো, আজ আবার জানতে চাইছো কেন?”

–” সে আজ তোমার জন‍্য বিয়ের প্রপজাল নিয়ে এসেছিল। সে তোমাকে বিয়ে করতে চায়, তোমার মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে। আমি ও দেখেছি বাইরে।”

–‘হুম,”

–” তোমার কি মনে হয়, এখন এই মুহূর্তে তোমার একটা ভালো জায়গায় বিয়ে হওয়া প্রয়োজন নয় কি?
না দেখো অনেক তো হলো এভাবে থাকা, তোমার জীবনের দাগটা তো মুছে দিতে পারিনি। কিন্তু জীবনটাকে তো একটা ভালো মুহূর্তে নিয়ে যেতে পারি।”
বিভা বাবার মুগের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বলল – এতটা খুশি হয়ে লাভ নেই বাবা। ফাইয়াজ সাহেব তো জানেনা আমার পুরো কথা তাই হয়তো বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। জানলে এমন প্রস্তাব করতো না।

–” তুমি কি বিয়ে করতে প্রস্তুত নও?”

–” বাবা সময় নিয়ে বলছি তোমাকে।”
____________________________________

ঘড়িতে রাত দশটা বেজে গেছে প্রায়। বিভা মনে থাকা হাজারো দিধা কাটিয়ে ডাঃফাইয়াজকে ফোন করল।
কিছুক্ষণ পরই ব‍্যাক করলেন ফাইয়াজ। বিভা সালাম দিয়ে কি কথা বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা।
বিভার নিরবতায় ফাইয়াজ বলে উঠলো –

–” বিভা আপনি কি কিছু বলতে চান?”

–” জ্বী, আপনি আজ কেন এসেছিলেন? ”

–” আপনাকে বলা হয়নি?”

–” হুম,”

–” তাহলে প্রশ্ন করছেন যে, কিছু জানতে চাইছেন নাকি?”

–” আমার সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?”

–” কি?”

–” আমার অতিত?”

–” অতিত ধুয়ে কি পানি খাবো আমি? বিয়ে করতে অতিত লাগে?”
বিভা চমকে গেল এই লোক কি কথা সব সময়ে এমন ভাবেই বলেন?

চলবে।

ইনশাআল্লাহ কাল থেকে নিয়মিত গল্প পেয়ে যাবেন সবাই!🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here