বিয়েকথন শেখ জারা তাহমিদ তৃতীয় পর্ব

0
199

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

তৃতীয় পর্ব

“কী হয়েছে, অপরা? তোমার হাতে ব্যাগ কেনো?”, অবাক কন্ঠে করা তামিম ভাইয়ার প্রশ্ন শুনে অপরাজিতা মৃদু হাসলো। গলা চড়িয়ে আম্মুকে ডাকলো। তিনি কিচেনে ছিলেন। সকলের জন্য চায়ের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। মেয়ের জোরগলায় ডাক শুনে ছুটে এলেন। অপরাজিতার হাতে ব্যাগ দেখে, তামিমের করা সেইম প্রশ্নটাই আবার করলেন। ড্রয়ইংরুমে ততক্ষণে সবাই হাজির হয়ে গেছে। সকলকে দেখে অপরাজিতার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো।

কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠলো, “আমি কী তোমাদের অবাধ্য মেয়ে, আম্মু? নাকি আমার অনেক বেশি চাহিদা? এই নাটকীয়তার পিছনে রিজন কী? সবাই মিলে কিচ্ছু না জানার অভিনয় কী দারুনভাবে করলে! আজকের গেস্ট আমাকে দেখতে আসছে, সেটা বললে আমি কী বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতাম? নাকি ওদের আসতে নিষেধ করতাম? তোমাদের থেকে আমি এটা এক্সপ্যাক্ট করি নাই।” মামী এগিয়ে এলেন। বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন, “তুই ভুল ভাবছিস, অপরা। ব্যাপারটা অফিশিয়াল না বলে তোকে জানানো হয়নি। শুধু শুধু তোকে কেউ প্রেশার দিতে চাচ্ছিলো না।” অপরাজিতা মামীর দিকে প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। এরা এখনো বলছে অফিশিয়াল ছিলো না! প্রেশার দিতে চায়নি! অথচ বুঝতেই পারছে না কতটুকু প্রেশার ওকে দিয়ে ফেলেছে! ওর কান্না পেয়ে গেলো। এরা ওর ফ্যামিলি? আসলেই?

কান্নাজড়ানো গলায় ও থেমে থেমে বললো, “বাবা, তুমি আমার হিরো। তুমি যেটা যখন বলো সেটা আমার জন্য মাস্ট করতে হবে টাইপ। তুমি যদি বলতে ওরা আসবে, আমাকে পটের বিবি হয়ে ওদের সামনে গিয়ে বসতে হবে, আমি তাও করতাম। কিন্তু তুমি সবকিছু লুকিয়ে করেছো। আমি রাজি কি না, জিজ্ঞেস করেছো। কিন্তু সবকিছু রেডি করে আমাকে জিজ্ঞেস করার মানেটা কী? ছেলেটার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছো। তোমার ঠিক মনে হয়েছে, তারমানে ঠিকই হবে। কিন্তু আমি কী তার সাথে একবার কথা বলতে পারতাম না? এতোবড় একটা ডিসিশন নেয়ার জন্য পাঁচ-দশ মিনিট কী এনাফ, বাবা?” এ পর্যায়ে অপরাজিতা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। “আমি বিয়েতে হ্যাঁ বললাম। তুমি জানতে চাইলে রাগ করে বলছি কি না। রাগ কবে করেছি আমি তোমার সাথে? আমার মত জানতে চেয়ে তুমি ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করলে। যদি আমি না করে বসি! তুমি আসলে আমাকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করো না, বাবা।” অপরাজিতার বাবা কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু মেয়ের অভিযোগের পিঠে পেরে উঠলেন না। দাঁড়িয়ে থেকে কেবল দেখে গেলেন। বড়ফুপি ওকে শান্ত করতে চাইলেন। হলো হিতে বিপরীত। অপরাজিতা আরো ক্ষেপে গেলো। ফোপাঁতে ফোঁপাতে বলে উঠলো, “ধরবে না ফুপি। তোমাদের সবার মনে এক, মুখে আরেক। পুরোটা সময় আমি ভেবেছি, সুযোগ থাকলে তোমরা বোধহয় আমাকে ওদের সঙ্গে পাঠিয়েই ছাড়তে! তোমাদের সাথে আমি থাকবো না! এত কাহিনী করেও, তোমরা একটুও স্যরি না। উল্টো নিজেদের পয়েন্ট অ্যাট এনি কস্ট জাস্টিফাই করতে উঠেপরে লেগেছো।”

এরপর আম্মুর কান্নাকাটি উপেক্ষা করেই ও একপ্রকার বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো৷ আশ্চর্যের বিষয় হলো বাবা একবারও ওকে আটকায়নি। এতেই ওর অভিমান আরো গভীর হয়েছে। অভিমান না হলে আর কী? রাগ? নেভার। বাবার সাথে কখনই ও রাগ করতে পারে না।

আদরে-আহ্লাদে বড় হওয়া অপরাজিতার এই ছিলো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার গল্প। ডিড শী মেইক অ্যা মিসটেক? ওয়াজ শী অ্যান ইমোশনাল ফুল? মেইবি। কিন্তু কাছের মানুষগুলোর ভালোবাসার ছলে করা ভুলগুলো ভুলই। এক্সকিউজ দিয়ে জাস্টিফাই করতে চাইলেই হবে না।

***

আম্মু অনেকবার ফোন দিলেও, অপরাজিতা রিসিভ করে নি। ভালো আছে বলে টেক্সট পাঠিয়েছে। অবশ্য ও না জানালেও বাবা-আম্মু ঠিকই ওর খবর জানে৷ বাসা ছেড়ে বেরোনোর পর থেকেই যে ওর আপডেট বাবার কাছে কোনো না কোনোভাবে ঠিক পৌঁছে যাচ্ছে, সেটায় কোনো সন্দেহ নেই।

হলে আসার তিনদিন পার হয়েছে। সহজেই মানিয়ে নিয়েছে ও। এতোজন একসাথে থাকা ব্যাপারটা ওর জন্য নতুন হলেও এনজয় করছে। রাতজেগে ওদের সঙ্গে মুভিও দেখেছে গতকাল। নয়জন মিলে এক ল্যাপটপে মুভি দেখাটাও ওর কাছে চমকপ্রদ এক্সপেরিয়েন্স। হলের খাবারে মন ভরেনি। হাকিম চত্বরের খিচুড়ি-চিকেন চাপ, কলাভবন ক্যাফেটেরিয়ায় ভাত-আলুভর্তা-মুরগী! এই দিয়ে চলছে। ক্লাসেও গিয়েছে সেদিনের পর। টিউশনও বাদ দেয়নি।

আজকেও ক্লাস শেষে, বারোটা নাগাদ লাইব্রেরিতে চলে গেলো অপরাজিতা। মিডটার্মের পড়া সব বাকী কি না। ম্যাথিউ আর্নল্ডের “দ্যা স্কলার জিপসি” পড়ে, কেনো একজন স্কলার একাডেমিক লাইফ ছেড়ে জিপসিদের জয়েন করলো, সেটারই সামারাইজেশন করছিলো ও। সোশ্যাল চেইঞ্জ, ক্লাস কনফ্লিক্ট নিয়ে ভেবে ভেবে যখন ওর মাথা খারাপ দশা, আননোন নাম্বার থেকে কলটা এলো তখনই। কল ধরার জন্য সিট ছেড়ে উঠতে হবে। ফিরে এসে এই সিট কোনোভাবেই আর পাওয়া যাবে না। মিডটার্ম বলেই এতো ভীড়। নাহ। থাক। পরে কলব্যাক করা যাবে। পড়ায় মন দেয়া যাক এখন।

কিন্তু কলদাতা সেটা বুঝলে তো। মিনিট পনেরো পরে আবার ওর কল বেজে উঠলো। মেজাজ খারাপ করে সব গুছিয়ে অপরাজিতা দ্রুত বেরিয়ে এলো৷ বটতলার দিকে যেতে যেতে কল রিসিভ করলো। ওর মৃদুস্বরে বলা হ্যালোর বিপরীতে বলিষ্ঠ গলার হ্যালো শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পরলো। জানতে চাইলো, “কে বলছেন? স্যরি, চিনতে পারছি না।” পুরুষ কন্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো, “অপরাজিতা! ওয়াহিদ বলছি। কেমন আছেন?”

অপরাজিতা ভ্রূ কুঁচকায়। গলার স্বর তীক্ষ্ণ হয়, “ওয়াহিদ? কোন ওয়াহিদ? এই নামে কাউকে চিনি বলে মনে পরছে না।” ওপাশ থেকে বিস্মিত গলা শোনা গেলো ওয়াহিদের, “কোন ওয়াহিদ! ওয়াহিদ জামান। আট তারিখে বিয়ে করলেন যাকে, সেই ওয়াহিদ।”

অপরাজিতা রীতিমতো জমে গেলো এবার। লোকটা, মানে ছেলেটা তার হাসব্যান্ড। আমতা আমতা করে বললো, “স্যরি। নাম্বার সেইভ ছিলো না। বুঝতে পারিনি।” ওয়াহিদ কৌতুকপূর্ণ কন্ঠে বললো, “না, না। ইট’স ওকে। নাম্বার সেইভ থাক না থাক, হাসব্যান্ডের নাম ভুলে যেতেই পারেন! এটা আপনার বউগত অধিকার, ম্যাডাম!” শেষ কথায় অপরাজিতার হাসি পেয়ে গেলো। ঠোঁট কামড়ে ও হাসি আটকালো। সেটা বুঝতে পেরে ওয়াহিদ বললো, “শব্দ করে হাসতে কিন্তু মানা নেই, অপরাজিতা। বরং এতে আপনাকে আরো চমৎকার দেখায়।”

চমৎকার দেখায়! কী অবলীলায় বলে দিলো! লোকটা এতকিছু কখন নোটিস করলো! কথা ঘোরাতে অপরাজিতা জিজ্ঞেস করলো, “আপনি ভালো আছেন? বাসার সবাই?” হেসে জবাব দিলো ওয়াহিদ, “ভালো আছি অপরাজিতা। বাসার সবাইও ভালো আছে। আমরা অধীর আগ্রহে আপনার অপেক্ষা করছি।”

অপরাজিতার একটু সময় লাগলো কথার পিঠে ডাবল মিনিং বুঝতে। যখন বুঝলো, না চাইতেও লজ্জা পেয়ে গেলো। লোকটা ভীষণ ঠোঁটকাটা। নিজের কথা বাসার নামে চালিয়ে দিচ্ছে! ও ধরা না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার মাছ ব্যবসা কেমন চলছে?” ওয়াহিদ আবারও অবাক হওয়া কন্ঠে বললো, “আমার সিজনাল ব্যবসার কথা আপনি জানেন!?” অপরাজিতা দ্বিধান্বিত হলো, “সিজনাল ব্যবসা! আমি যে শুনলাম আপনি মাছ ব্যবসায়ী।” ওয়াহিদ এবার শব্দ করে হাসতে থাকলো। মন খুলে হাসি যাকে বলে। খানিক পরে হাসতে হাসতেই বললো, “মাছের ব্যবসা করি বলেই কী নামটা ভুলে গিয়েছিলেন? আমি তো তাও বেঁচে গেলাম, ম্যাডাম। জগতে এতো মাছ ব্যবসায়ীদের কী হবে? তারা কী বউ পাবে না?” লোকটা মাছ ব্যবসায়ী না! তবে ও যে মাছ মাছ স্মেল পেলো! সেটা কী ছিলো? ওর অবচেতন মনের ভ্রম? অপরাজিতার লজ্জায় হাসফাস অবস্থা হলো। “বাই” বলে কোনোরকমে ফোন রেখে দিলো। এই ঠোঁটকাটা লোকের মুখে কোনো ফিল্টার নেই! কিচ্ছু আটকায়না!

বটতলায় গিয়ে বসতেই অপরাজিতার ফোন আবার ভাইব্রেট করলো। ওয়াহিদের টেক্সট। দু’লাইনের ছোট্ট মেসেজ। “আপনার ক্যাম্পাসের কাছেই আছি। ইফ ইউ ওয়ান্ট, মেইবি উই ক্যান মিট ফর লাঞ্চ।” অপরাজিতা দোনোমোনো করে রাজি হয়ে গেলো। ফিরতি টেক্সট পাঠালো, “বটতলায় আছি আমি। কোথায় আসবো?” কয়েক সেকেন্ডের মাঝে রিপ্লাই এলো ওয়াহিদের, “বাংলা একাডেমি থেকে বটতলায় আসতে ৭/৮ মিনিট লাগবে। ততক্ষণ একটু অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।”

সশব্দে চেপে রেখা শ্বাস ছাড়ে অপরাজিতা। দেখা করতে রাজি হওয়াটা ঠিক হলো কি না বুঝতে পারলো না। হঠাৎ খেয়াল হয় ওয়াহিদ দেখতে কেমন ও জানে না! সেদিন দেখেছিলো ঠিক। কিন্তু এতোজনের মাঝে প্রোপারলি খেয়াল করেনি! শিট! ফ্লেয়ারড জিনস, গলায় পেচানো নীল স্কার্ফ, সাদা নী লেংথ কুর্তিতে নিজেকে ভীষন আন্ডারড্রেসড মনে হলো। হুট করে বিয়ে করা বরের সাথে প্রথম দেখায় এই ড্রেস-আপ অবশ্যই ঠিক নেই। ডাবল শিট!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here