বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ২৫

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ২৫
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

অফিসে আমরা দুজন প্রবেশ করতেই আমাদের সালাম দিলেন গার্ডরা। অফিসের সবাই পূর্ণকে দেখে দাঁড়িয়ে “গুড মর্নিং স্যার” বললো। উনিও জবাব দিলেন। যেহেতু সময় বেশি নেই তাই পূর্ণ তখনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে।

—হ্যালো এভরিওয়ান। মিট মাই ওয়াইফ, তুরফা।

সবাই আমাকে সালাম দিয়ে আমায় আর পূর্ণকে কংগ্রেটস জানালো। এরপর পূর্ণ সবাইকে কাজ করতে নির্দেশ দিয়ে আমায় হাত ধরে নিয়ে এগিয়ে চললেন উনার কেবিনের দিকে। সবাই আবার নিজের মতো কাজ করতে লাগলো। এখানে সবাই যে উনাকে অনেক শ্রদ্ধা-সম্মান করে ও মেনে চলে, বিষয়টা বুঝতে পারলাম। আশেপাশে দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। একটি কেবিনের সামনে গিয়ে দরজা খুলে পূর্ণ ভেতরে প্রবেশ করলেন। এরপর আমার দিকে ঘুরে বললেন,

—এসো।

আমিও চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো প্রবেশ করলাম সে রুমে। পূর্ণ হাতঘড়িতে সময় দেখলেন এরপর কোন একজনকে ফোন দিয়ে বললেন,

—হ্যালো, আমি ওকে আমার কেবিনে রেখে যাচ্ছি। তুমি একটু এসে চেক করবে ওর কিছু লাগবে নাকি। আর একটু টাইম দিবে ওকে। গট ইট??

ওপাশ থেকে কি জবাব এলো শুনতে পেলাম না তবে পূর্ণ আর কোন কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উনার কর্মকান্ড দেখছিলাম। হঠাৎ উনি আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে উনার চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। একটু পর কোমল গলায় বললেন,

—কিছু খাবে?

আমি কিছুটা অন্যমনস্কভাবেই “না-বোধক” মাথা নাড়লাম। উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,

—একটু তাড়াতাড়ি আসবেন, প্লিজ?

পূর্ণ থেমে পেছন ঘুরে এক পলক আমার দিকে চাইলেন। মাথা হেলিয়ে বললেন,

—আমি যতদ্রুত সম্ভব আসার চেস্টা করব। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে দিবোনা তোমায়।

পূর্ণ চলে যাওয়ার পর আমি কেবিনটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সাজানো পরিপাটি কেবিনটায় কোনকিছু একচুল পরিমাণও অগোছালো নেই। লোকটা বড্ড গোছালো স্বভাবের। নিজে যেমন সুন্দর ফিটফাট, ঠিক তেমনি উনার বাকি সবকিছুই পরিপাটি হওয়া চাই। উনার মতো পরিপাটি লোকের কপালে পড়ে গিয়েছি অগোছালো স্বভাবের এলোমেলো আমি! বলতে গেলে সবদিক দিয়েই আমি পুরোটাই উনার উল্টো স্বভাবের! উনার সাথে আমি কি কোনদিক দিয়েও যাই? আচ্ছা, এজন্যই কি উনি আমাকে ইগ্নোর করেন? আনমনেই হঠাৎ প্রশ্ন উঠলো আমার মনে!

আমার চিন্তায় ছেদ ঘটলো কেবিনের দরজায় নক পড়ার শব্দে। একটি মেয়েলি শব্দ শুনতে পেলাম,

—ভেতরে আসতে পারি?

—আসুন।

একটি ছিমছাম গড়নের উজ্জ্বল বর্ণের মেয়ে প্রবেশ করলো রুমে। আমাকে দেখে মিস্টি হাসি হাসলো, বিনিময়ে আমিও হাসলাম। মেয়েটি বললো,

—আপনিই তুরফা ম্যাম?

নিজের নামের সাথে ম্যাম শুনে সামান্য লজ্জা পেলাম আমি। আলতো গলায় বললাম,

—জি। আপনি?

—আমাকে তুমি করে বলুন, ম্যাম। আমি রিয়া। এখানে কাজ করি। স্যার বলেছিলো আপনি তার কেবিনে বসে আছেন একা। আপনাকে অফিস ঘুরিয়ে দেখাতে বলেছেন।

রিয়ার কথা শুনে আমি উঠে দাড়ালাম চেয়ার থেকে।

—হ্যাঁ চলো। একটু পর থেমে বললাম, আচ্ছা রিয়া। তুমি কি উনার সেক্রেটারি?

ওর দিকে আড়চোখে চেয়ে বললাম আমি। আমার কথায় হেসে ফেললো মেয়েটি। মাথা নাড়িয়ে বললো,

—না ম্যাম, আমি স্যারের সেক্রেটারি নই। উনার সেক্রেটারি রিমন, যে এখন স্যারের সাথে মিটিংরুমে আছে। আমি তো অফিসের স্টাফ, আমার এখন কাজ নেই দেখে স্যার আপনাকে টাইম দেওয়ার জন্য আমায় পাঠিয়েছেন।

রিয়ার কথায় স্তিমিত হাসলাম আমি। মনে মনে খানিকটা স্বস্তি পেলাম মেয়েটা উনার সেক্রেটারি নয় শুনে। পরক্ষণেই নিজের চিন্তাভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলাম। মেয়েটা উনার সেক্রেটারি হলেও বা কি হতো? উনার উপর সন্দেহ করিনা আমি। যত্তোসব উটকো ভাবনাচিন্তা আমার! ভাবনার পাল্লা শেষ করে রিয়ার সাথে বের হলাম অফিস দেখতে। ও আমাকে বিভিন্ন কেবিন ও স্টাফরুম দেখাচ্ছিলো। যেহেতু সবাই জানে আমি পূর্ণর স্ত্রী তাই সবাই আমাকে ম্যাম ম্যাম বলে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ আমাদের জুটির প্রশংসা করছে। আমিও আর কি করবো, হালকা হেসে সবার সাথে পরিচিত হতে লাগলাম, কথা বললাম।

মিটিংরুমের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম রিয়ার সাথে! যেতে যেতেই শুনলাম এক লোক ভারি গলায় বলছে, এবার আপনাদের সামনে প্রেজেন্ট করতে আসবেন আমাদের এমডি “মিস্টার তাজওয়ার চৌধুরী”। হঠাৎ করেই তাজওয়ার নামটা শুনে বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো আমার। ছোটবেলার প্রিয় সেই নাম! এতদিন পর? পা-জোড়া যেন আপনাআপনিই থেমে গেলো আমার। এই অফিসে তাজওয়ার ভাইয়াও আছেন? কিন্তু পূর্ণ একদিনও বললেন না যে! পরে ভাবলাম অবশ্য উনার সাথে আমার অফিসের ব্যাপারে কথাই তো হয়নি যে উনি কিছু বলবে!

উৎসুক চোখে মিটিংরুমের দরজার সামান্য ফা-ক দিয়ে উঁকি দিলাম আমি। হালকা অন্ধকার রুমে প্রোজেক্টরের আলোতে পিছন হতে উঠে উনি হেটে গেলেন সামনে। উনি সামনের দিকে ফিরতেই প্রোজেক্টরের উজ্জ্বল আলোতে জ্বলজ্বল করে উঠলো তার সুন্দর চেহারা! পূর্ণকে প্রেজেন্টেশন দিতে দেখে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো আমার! বিস্মিত নয়নে উনার দিকে চেয়ে রইলাম আমি! পূর্ণই কি তবে আমার সেই তাজওয়ার ভাইয়া? তাহলে উনি কোনদিন আমায় বলেননি কেন?

রিয়ার ডাকে ধ্যান ভেঙে গেলো আমার! কাপা কাপা হাতে মিটিংরুমের দরজাটা কোনমতে লাগিয়ে পাশ ফিরলাম আমি। এ বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে উঠা দায় আমার জন্য!! হৃদয়ের মধ্যে হাতুড়ি পিটছে যেন। মাথার মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নের সমাহার! এদিকে রিয়া আমায় বারবার জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছি, সামনে যেতে বলছে। আমি কোনরকম ঘোর কাটিয়ে উঠে এগিয়ে চললাম ওর সাথে। মাথার মধ্যে সমীকরণ মিলানোর চেস্টা করতে করতেই আবার পূর্ণর কেবিনের সামনে চলে আসলাম। এবার আমি পূর্নদৃষ্টিতে লক্ষ্য করলাম কেবিনের দরজায়। যার সামনে স্পষ্ট লেখা আছে “এমডি তাজওয়ার চৌধুরী”। বুঝলাম তখন পূর্ণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় আমি দেখতে পারিনি দরজায় উনার নাম। আনমনেই উনার নামের অক্ষাংশের উপর হাত বুলিয়ে গেলাম আমি।

রিয়া আমাকে ভেতরে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিছু খাবো কি না। আমি আবারও না করলাম কেননা আমার মন এখন অন্য চিন্তায় মগ্ন। এরই মধ্যে রিয়ার ফোন আসায় ও কাজের জন্য চলে গেলো। একা একা বসে ভাবতে লাগলাম পূর্ণর কথা। উনি বড় হওয়ার সাথে সাথে বেশ পরিবর্তন হয়েছেন! ছোটবেলায় সেই তাজওয়ার ভাইয়ার সাথে এখনকার পূর্ণর কোন মিলই পাইনা আমি। তখন কতসুন্দর হাসিখুশি থাকতেন, ভালোভাবে কথা বলতেন আমার সাথে। এখন এরকম চুপচাপ, গম্ভীর কিভাবে হলেন? কি কারণ থাকতে পারে?

অবশ্য একটা বিষয়ে উনার মধ্যে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। উনি তখনো আড়াল থেকে আমার কেয়ার করতেন, খানিকটা এখনও করেন। যা উনি প্রকাশ করতে না চাইলেও মাঝেমধ্যে উনার আচরণে প্রকাশ পায়!! মাথা নিচু করেই নিজমনে হালকা হেসে ভাবলাম আমি!

মাথায় টোকা পড়তেই চমকে উঠে উপরে তাকালাম। মাথা তুলে উপরে তাকিয়ে দেখি পূর্ণ দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমার সামনে। এক ভ্রু তুলে চেয়ে আছেন আমার দিকে। উনাকে ভালোভাবে খেয়াল করলাম। ফর্সা কপালে মুক্তোর মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম। এই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত চেহারায়ও কি ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে!! ছোটবেলা থেকেই তাকে প্রচন্ড ভাল্লাগতো আমার। এজন্যই তো উনাকে বিয়ে কর‍তে চাইতাম! আর আজ ভাগ্যের অপরুপ খেলায় আমি ঠিকই তার সাথেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি! ভাবতেই শরীর শিউরে উঠলো আমার! হঠাৎই লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। তার দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম নাহ আমি! চাহনী ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরলাম।

—কি হয়েছে তোমার?

বাহু ঝাকিয়ে বললেন উনি আমার। আমি আড়চোখে তার দিকে চেয়ে বললাম,

—কিছু নাহ।

—তাহলে গাল দুটো এভাবে লাল হয়ে আছে কেন? গরম লাগছে?? এসির পাওয়ার কমিয়ে দিবো?

উনার কথায় আমি হাসবো না কাদবো বুঝলাম নাহ। পাগল লোকটা ভাবছে আমার গরম লাগছে! না চাইতেও হেসে ফেললাম আমি! এদিকে আমার হাসির দিকে অবাকচোখে তাকিয়ে আছেন উনি। আমি উনার হাত টেনে বললাম,

—কাজ হয়েছেনা আপনার? এখন চলুন আমরা বের হবো। বড়াম্মুরা পৌঁছেও গিয়েছে এতক্ষণে হয়তো!!

পূর্ণ কিছু না বলে শান্তভাবে মাথা নাড়লেন আমার কথায়। তবে তার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি এখনও আমার চেহারার দিকে নিক্ষিপ্ত! সেটা জেনেও বিশেষ পাত্তা দিলাম নাহ উনি! এ বিষয়ে উনার সাথে পরে আলাপ করবো। আপাতত গ্রামে যাওয়া বেশি জরুরি।

_____________

অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছি। পূর্ণ পার্কিং থেকে গাড়ি বের করতে গেছেন। এখান থেকে খানিকটা দূরে রাস্তার অপর সাইডে হাওয়াইমিঠাই বিক্রি করছেন এক লোক। এক কপোত-কপোতী একসাথে হাওয়াইমিঠাই খাচ্ছে। ছেলেটা মেয়েটাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর খুব হাসাহাসি করছে দুজনে। সেদিকে একমনে চেয়ে আছি আমি। ছেলেটার জায়গায় পূর্ণকে আর মেয়েটার জায়গায় আমায় কল্পনা করতেই আনমনেই কিটকিটিয়ে হেসে উঠলাম আমি। গাড়ির হর্ণ কানে যেতেই তাকিয়ে দেখি পূর্ণ এসে গেছেন।

উনি গাড়ি থেকে নেমে আমার জন্য অপরপাশের দরজা খুলে দিলেন আমার জন্য। আমিও হেটে গিয়ে বসলাম গাড়িতে। উনি কিছু একটা ভেবে বললেন,

—আমি এক মিনিটে আসছি। বসো একটু।

আমি প্রথমে গোলগোল চোখে তাকালেও একটু পরে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। উনি গাড়ি লক করে বের হয়ে চলে গেলেন। চোখটা একটু লেগেছিলো ঠিক এমন সময় পূর্ণ ফিরে এলেন গাড়িতে। উনার দিকে তাকানোর আগেই হাতে দুটো হাওয়াই মিঠাই ধরিয়ে দিলেন আমার! খানিকটা অবাক হয়েই একবার উনার দিকে একবার উনার হাতে রাখা হাওয়াইমিঠাই এর দিকে তাকালাম আমি! উনি ঠিক কখন খেয়াল করলেন আমি হাওয়াই মিঠাই এর দিকে তাকিয়ে ছিলাম জানিনা তবে তাকে কোনকিছু না বলতেই তার করা ছোট ছোট কাজগুলো মনে দাগ কাটে আমার!! একগাল হেসে হাওয়াই মিঠাই নিলাম উনার থেকে। উনিও হালকা হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালু করলেন।

আজ কেন জানি উনার দিকে আড়চোখে তাকাতেও লজ্জা লাগছে আমার! ফাকা রাস্তায় উঠতেই জানালার কাচ অর্ধেক খুলে দিলাম আমি। সাই-সাই করে শরতের স্নিগ্ধ বাতাস প্রবেশ করলো গাড়ির ভেতরে। ছুয়ে দিয়ে গেলো আমায় আর পূর্ণকে। যে বাতাসে জুড়িয়ে গেলো মন, প্রাণ সব। সকালবেলা উনার সাথে আসতে আসতে যতটা বোর ফিল করবো ভেবেছিলাম আমার, এখন মনের অজান্তেই উনার সাথে বসে রাস্তাটা উপভোগ করছি।

আরেকবার আড়চোখে উনার দিকে তাকাতেই তার চোখে চোখ আটকে গেলো আমার! যে দৃষ্টিতে আজ ছিলোনা কোন গাম্ভীর্য, ছিলোনা কোন রাগ, ছিলো শুধুই একরাশ মুগ্ধতা!!

#চলবে

কাল দিতে না পারায় আজ যত তাড়াতাড়ি পেরেছি দেওয়ার চেস্টা করেছি। সবার মতামত জানতে চাই ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here