বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ২৫

0
4648

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ২৫
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

অনবরত গাড়ির হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে মারশিয়াদ।প্রায় পনেরো মিনিট যাবৎ বিরতিহীন ভাবে সে এই কাজ করে যাচ্ছে।নিজের ঘরের জানালা দিয়ে পর্দার ফাঁক আগলে একবার দেখেছিলো নুরাইসা।কিন্তু বাইরে আসেনি।কল করলেও তা রিসিভ করছে না নুরাইসা।মারশিয়াদ এর মন উৎকন্ঠায় ভরে উঠে।ভয়ংকর কিছু চলছে তার মনে।
কিছুক্ষন পর বাড়ির সামনের খোলা বারান্দায় এসে দাড়ায় নুরাইসা।তাকিয়ে দেখে কাতর নয়নে সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মারশিয়াদ।দুর থেকেই একে অপরের মুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট দেখতে পায় তারা।নুরাইসা ভিতরে চলে যায়।মারশিয়াদ ঠোঁট জোড়া ফাক করে এক লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে।আবারও হর্ণ বাজাতে থাকে মারশিয়াদ।বাড়ির মেইন গেইট খুলে বেরিয়ে আসে নুরাইসা।ওকে দেখেই চোখের কোন বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে মারশিয়াদ এর।এক শান্ত,স্বস্তিকর নয়নে তাকায় নুরাইসার দিকে।ধীম পায়ে নুরাইসা এগিয়ে আসে মারশিয়াদ এর কাছে।অশ্রুসিক্ত দুই নয়নে তাকিয়ে আছে নুরাইসা।মারশিয়াদ এর বুক কেঁপে উঠে।আহত গলায় বলল–

“মিষ্টি।”

শান্ত নুরাইসা হঠাৎ জ্বলে উঠে।তপ্ত গলায় বলল–

“কেনো এসেছেন আপনি এখানে!!কেনো এসেছেন!!চলে যান আপনি,চলে যান।”

মারশিয়াদ ধীর গলায় বলল–

“প্লিজ মিষ্টি আমার সিচুয়েশনটা একটু বুঝার চেষ্টা করেন।”

ঝরঝর করে কেঁদে উঠে নুরাইসা।তার চোখের স্মিত ধারা এইবার স্ফীত হয়।জড়ানো গলায় বলল—

“কিছু বুঝতে চাই না আমি।কিছু না।আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না।একটুও না।”

মারশিয়াদ লম্বা পা ফেলে নুরাইসার কাছে গিয়ে ওকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে।আর্দ্র গলায় বলল—

” আমি আপনাকে ভালোবাসি মিষ্টি।সত্যিই ভালোবাসি।কিন্তু আমি নিরূপায়।আমার হাত বাধা।”

নুরাইসা কোন শব্দ করে না।ডুকরে কেঁদে চলে।ওর চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে মারশিয়াদ এর ব্লেজার।হিম বায়ু বইছে।হেমন্তের শুরু সাথে শীতের আমেজ।মারশিয়াদ টেরপায় নুরাইসার সম্পূর্ন শরীর একদম শীতল।কম্পন শুরু হয়েছে তার শরীরে।ভেজা চুল দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ে পিঠের অনেকাংশ ভিজে গেছে।মারশিয়াদ নিজের ব্লেজার খুলে তা জড়িয়ে দেয় নুরাইসার গায়ে।

নুরাইসাদের বাড়ির অদূরেই একটা ছোট্ট পার্ক।সেখানেই একটা বেঞ্চিতে বসে আছে মারশিয়াদ আর নুরাইসা।ব্লেজার এর ভিতরে নিজেকে সম্পূর্ন গুজে মারশিয়াদ এর কাঁধে মাথা দিয়ে চোখের স্মিত নোনতা জল বিসর্জন দিচ্ছে নুরাইসা।মারশিয়াদ এক হাত দিয়ে ওকে নিজের সাথে ধরে আছে।নিজের মাথাটা হেলে দিয়েছে নুরাইসার মাথার সাথে।আশেপাশে ঠান্ডায় অনেকটা শিউরে উঠছে মারশিয়াদ এর শরীর।শীতল বাতাস শরীরের রক্তবিন্দু পর্যন্ত কাপিয়ে দিচ্ছে।ছোট ছোট কয়েকটা ঢোক গিলে নেয় মারশিয়াদ।তার বুকের কোথাও প্রশান্তি বয়ে চলছে। বুক ফুলিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মারশিয়াদ।শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বলতে লাগল–

“আমার যখন দশ বছর বয়স তখন একদিন সকালে শিরা আর তার মা কে নিয়ে আসে বাবা।কিন্তু কি যেনো অজানা কারণে বাবা আর দাদুর মাঝে সেদিন প্রচন্ড ঝগড়া হয়।শিরা ওর মায়ের পাশে দাড়িয়ে খুব কেঁদেছিলো সেদিন।একদম পুতুলের মতো দেখতে ছিলো শিরা।আমি তো খুব ছোট তাই কিছুই বুঝতে পারি নি।শুধু দূর থেকে দাড়িয়ে আমি আর মম সবটা দেখছিলাম।”

মারশিয়াদ থামে।নুরাইসা ওর মাথাটা উঠিয়ে উৎসুক নয়নে তাকিয়ে থাকে মারশিয়াদ এর দিকে।মারশিয়াদ ফিকে গলায় আবার বলল–

“কিন্তু তার কয়েকদিন পর মম শিরা কে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে।দাদু প্রথমে মানতে চায় নি।কিন্তু কোনো একটা কারণে বাধ্য হয়ে শিরা কে আমাদের বাড়িতে থাকতে দেয়।কিন্তু ওর মা কে কখনো আমাদের বাড়িতে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি।আমি জানতে পারি শিরা আমার বোন।আমাদের শরীরে একই বাবার রক্ত।কিন্তু মা আলাদা।”

মারশিয়াদ শুকনো ঢোক গিলে।অতীতের বিষাক্ত স্মৃতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।গলায় পাকিয়ে আসছে না বলা কষ্ট গুলো।আবার বলল–

“শিরার মা সবসময় আমাদের বাড়ির বাইরে থেকে ওর সাথে দেখা করতো।দেখা করে আসার পর খুব কান্নাকাটি করতো।মা ছাড়া কি করে থাকতে পারে ওইটুকু মেয়ে!!
কিন্তু ভাগ্য যে বড় নির্মম!!মম শিরা কে খুব ভালোবাসতো।ধীরে ধীরে শিরা অভ্যস্ত হতে শুরু করলো আমাদের।শিরা আর আমি একই স্কুলে পড়ালেখা করতাম।এক সাথে বড় হয়েছি।
কিন্তু নিয়তি বড় নিষ্ঠুর।সাত বছর আগে বাবা কোনো একটা কাজে বাংলাদেশে আসেন।মম কে সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো।কিন্তু মম আসে নি তাই জোড় করে শিরার মা কে সাথে নিয়ে আসে।”

মারশিয়াদ অধর ছড়িয়ে এক তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে।গলার সাথে সাথে অধর যুগলও শুষ্ক হয়ে উঠে।ঠোঁট চিপে তা ভিজিয়ে নেয়।এক ধরনের চাপা অস্থিরতা অনুভব করছে সে।ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে।নুরাইসা আহত গলায় বলল–

“জান,আপনি ঠিক আছেন!!!

মারশিয়াদ যথাসাধ্য নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছে।মনের উচাটন কিছুতেই কমছে না।নুরাইসা আরও শক্ত করে মারশিয়াদ এর হাত জড়িয়ে ধরে।বিরস গলায় মারশিয়াদ আবার বলল–

“বাংলাদেশে আসার কিছুদিন পর বাবার অ্যাকসিডেন্ট হয়।বাবা আর শিরার মায়ের স্পট ডেথ হয়।দাদু আর মম পুরোপুরি ভেঙে পড়েন।দাদুর এটাক হয়।বিছানায় পড়েন তিনি।মম এর সাথে বাবার তেমন ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো না।তবুও পতিব্রতা বলেও একটা কথা আছে।
বেশকিছু দিন পর দগ্ধ বুকের যন্ত্রণা নিয়ে বিদায় নেন দাদু।শিরা কে আটকাতে পারি নি।ওর ধারণা ওর মায়ের মৃত্যুর জন্য বাবা দায়ী আর দাদু সারাজীবন ওকে ওর মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে।তাই পুরুষদের প্রতি ওর বিতৃষ্ণা বেড়ে যায়।মম কেও ভুল বুঝে।ওর ধারণা সেদিন মম বাবার সাথে আসলে হয়তো ওর মা বেঁচে যেত।শিরা বাংলাদেশে চলে আসে।আর ওর পিছু পিছু আমিও।ওকে কী করে একা ছাড়ি!!

মারশিয়াদ নিঃশব্দ নিঃশ্বাস ফেলে।ভারী হওয়া বুকটা একটু একটু করে হালকা হচ্ছে।মাথাটা পিছন দিকে হেলিয়ে দেয় মারশিয়াদ।নুরাইসা শান্ত গলায় বলল–

“এই জন্যই আপনি প্রহর কে আপনার জীবন থেকে যেতে দিয়েছেন??

মারশিয়াদ প্রজ্জ্বলিত চোখে তাকায় নুরাইসার দিকে।প্রদৃপ্ত গলায় বলল–

“এইসব আপনাকে কে বলেছে!!শিরা??

“হুম।”

মারশিয়াদ গাল ফুলিয়ে উষ্ণ বাতাস ছাড়ে মুখ দিয়ে।স্মিত হেসে বলল–

“শিরা ছোটবেলা থেকেই একরোখা।একবার যা মাথায় ঢুকে তা না করা পর্যন্ত ও ক্ষান্ত হয় না।
রেড চিলি আমার রেসপন্সিবিলিটি।আমি সবসময় তার পাশে থাকব।আর আপনি আমার হৃদয়ে।”

নুরাইসা কান্না জড়ানো গলায় বলল—

“তাহলে কেনো আপনি আমাকে ছেড়ে যেতে চান!!কেনো ভুলে যেতে চান আমাকে??

মারশিয়াদ ফিকে গলায় বলল–

“নাবীন স্যার আমার সম্পর্কে সব জানে।সব পিতামাতা ই তার মেয়েকে ভালো পাত্রস্থ করতে চায়।আপনার প্যারেন্টসও তার ব্যতিক্রম নয়। কোনো পিতাই তার মেয়েকে এমন ছেলের কাছে বিয়ে দিতে চাইবে না মিষ্টি যার পরিবার বিক্ষিপ্ত।”

হালকা তেতে উঠে নুরাইসা।আর্দ্র ও তীক্ষ্ম সুরে বলল–

“আপনি তো আমাকে ভালোবেসেছেন।আমার বাবা কেনো আসবে মাঝে!!

“সেটাই আমার ভুল।আমি ভাবতে পারি নি নাবীন স্যার আপনার বাবা।আমি এমনিতেও তার কাছে ঋনী।”

নুরাইসা অভিমানী গলায় বলল–

“তাই বুঝি আমাকে ভুলে গিয়ে ঋণ শোধ করতে চান!!

নুরাইসা উঠে দাড়ায়।মারশিয়াদ এর সামনে গিয়ে স্থির হয়।সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।মারশিয়াদ ওর মাথাটা সোজা করে।চোখে টলমল করছে পানি।নুরাইসা ওর দু হাতের আজলায় নেয় মারশিয়াদ এর মুখ।সরস ও আনম্র গলায় বলল–

“আপনি সত্যিই আমাকে ভুল যাবেন জান???

মারশিয়াদ উঠে দাড়ায়।সহজ গলায় বলল–

“আমি আপনাকে ভালোবাসি মিষ্টি।আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।”

“যদি বাবা না মানে তাহলে ভুলে যাবেন আমায়??

“নাহ।ভাববো আপনি আমার জীবনে বসন্তদূত হয়ে এসেছিলেন।গ্রীষ্মের শুরুতে তার উষ্ণতায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন।”

নুরাইসা জ্বলে উঠে।উত্তেজিত গলায় বলল–

“নাহ।আমি আপনার হৃদয়ের আকাশের ধ্রুভতারা।যা কখনো আপনাকে ছেড়ে যাবে না।”

নুরাইসা ঝাপটে ধরে মারশিয়াদ কে।মৃদু আওয়াজ তুলে ওর ক্রন্দন।ধরা গলায় বলল–

“আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচবো না জান।বাঁচবো না।প্লিজ আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না।যাবেন না আমাকে ছেড়ে।”

মারশিয়াদ দূর্বল হাতে নিজ থেকে আলগা করে নুরাইসা কে।নরম গলায় বলল–

“শান্ত হোন মিষ্টি।আমি চেষ্টা করবো।”

“কেনো আপনি নিজেকে ছোট করেন!!কেনো হেরে যান আপনি!!

“আমার অতীত যে আমার পিছু ছাড়ে না।”

“আমি আপনার বর্তমান জান।আমার আপনার অতীতের কোনো প্রয়োজন নেই।আমি শুধু আপনাকে চাই।”

মারশিয়াদ ওর হাত দিয়ে নুরাইসার চোখ মুছে দেয়।চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে।ঠোঁট জোড়া কেমন শুষ্ক হয়ে আছে। হয়তো সারাদিন খায়ওনি।বিবর্ন রঙ ধারণ করেছে চেহারা।ঘন ঘন ঢোক গিলছে নুরাইসা।মারশিয়াদ দু হাত রাখে নুরাইসার দুই গালে।হালকা ঝুকে নুরাইসার অধর থেকে শুষে নেয় ওর সকল ভয়,জরাজীর্ণতা।শিরশির করে উঠে নুরাইসার শরীর মারশিয়াদ এর উষ্ণ স্পর্শে।
,
,
,
সকাল হতেই সবাই গম্ভীরতার সাগরে ডুবে আছে।কী হয়েছে!!কেনো হয়েছে!!কখন হয়েছে!!এই ধরনের কোনো প্রশ্ন নেই।শুধু আছে যা হয়েছে তার চেয়ে ভয়ংকর কিছু হয়নি তাতেই শুকরিয়া।

রাতের খাওয়ার পর নন্দিতার বাবা মা চলে যায়।সবাই থাকলেও সেখানে সানায়া কে দেখা যায় না।ওর ঘরে না পেয়ে কিছু একটা ভেবে নন্দিতা ছাদে পা বাড়ায়।ছাদে যেতেই বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষন নন্দিতা।হতবুদ্ধি নন্দিতা কী করবে ভেবে পায় না।ওর বিকট চিৎকারে ছুটে আসে সবাই ছাদে।
সানায়া আসাড় হয়ে পড়ে আছে।ক্ষীন নিঃশ্বাস চলছে ওর।ঠান্ডায় পুরো শরীর যেনো জমে বরফখন্ড ধারণ করে।আজরাহান শশব্যস্ত হয়ে কোলে তুলে নেয় সানায়া কে।সেই রাতেই পাড়ার ডক্টর কে অনুনয় করে ধরে বেধে নিয়ে আসে সামান।সবাই থমকে আছে।সানায়ার পুরো মুখ ফ্যাকাশে রঙ ধারণ করেছে। প্রেশার ফল করেছে সানায়ার।ডক্টর স্যালাইন দিয়েছে।পুরো ঘরে থমথমে পরিবেশ।নিস্তব্ধতা যেনো কুড়ে খাচ্ছে সবাইকে।আজরাহান প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সানায়া ফিকে মুখের দিকে।কুহেলিকা সানায়ার মাথার কাছে বসে আলতো হাতে ওর চুলে হাতড়িয়ে যাচ্ছে।সানোয়ার আহমেদ এর বুকে ভীষন ব্যথা হচ্ছে।কোনো ধরনের প্যানিক সে নিতে পারে না।আজরাহান তাকে নিজের ঘরে শুইয়ে দিয়ে এসেছে আর আশ্বস্ত করেছে সানায়ার কিছুই হবে না।নন্দিতা এমনিতেও লজ্জায় আছে নাবীন খানের ব্যাপারটা নিয়ে।তার উপর সানায়ার এই অবস্থায় হকচকিয়ে উঠে সে।অপ্রিতিকর পরিস্থিতি।

সবাই কে যার যার ঘরে গিয়ে রেস্ট নিতে বলে আজরাহান।সারারাত নিজের বোনের শিয়রে বসে থাকে আজরাহান।তার ছোট্ট পরীটার এমন কী হলো!!

সকালে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে হেমন্তের হলুদ মিষ্টি আলো এসে পড়ছে কিচেন রেক এর উপর।এই রোদ বেশ আরাম দায়ক।আজরাহান নরম পায়ে রান্না ঘরে এসে দাড়ায়।সারারাত না ঘুমানোর ফলে চোখ জ্বালা করছে আজরাহান এর।মাথার বা পাশটায় নিদারুণ যন্ত্রণা হচ্ছে।নন্দিতা ওকে দেখেই জবরদস্তি মৃদু হাসে।ম্লান গলায় বলল–

” এখন কী অবস্থা??

আজরাহান থমথমে গলায় বলল–

“ভালো।”

উৎসুক গলায় নন্দিতা বলল–

“কী হয়েছিল ওর??

আজরাহান বিরস হাসে।আর শান্ত গলায় বলল–

“কী হয়েছে জানি না।আর জানতেও চাই না।আর কেউ ওকে কোনো প্রশ্নও করবে না।”

“কিন্তু আজরাহান….।”

“বললাম তো এই বিষয়ে আর কোনো কথা হবে না।”

নন্দিতা নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে অপরাধী সুরে বলল–

“কালকে বাবার ব্যাপারটার জন্য আমি দুঃখিত।আসলে বাবা আমাকে এই বিষয়ে কিছুই বলে নি।যদি বলতো তাহলে আমি আগেই সব ক্লিয়ার করে বলতাম।”

“ইটস ওকে ভাবী।স্যার কে আমার তরফ থেকে থ্যাংকস বলো।অন্তত তার জন্য মা বুঝতে পেরেছে তার আজাইরা রাহান এর ডিমান্ড কতো!!

নন্দিতা স্মিত হাসে।আর বলল–

“তুমিও না!!

আজরাহান চোখে হাসে।সানায়ার জন্য খাবার নিয়ে চলে যায়।
,
,
খাবার নিয়ে এক ঘন্টা যাবৎ বসে আছে আজরাহান।সানায়া উঠে বসেছে।ভীষন দূর্বল সে।একদিনেই চোখের নিচটায় কালি পড়ে গেছে।দু পাশের চোয়াল একদম চুষা আমের মতো হয়ে গিয়েছে।এতো করে বলছে তাও কিছু মুখে নিচ্ছে না সানায়া।
কুহেলিকা ওর মুখের সামনে বসে খাবার হাতে নিয়ে অধীর আগ্রহে বসে আছে।সানায়া নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে।আজরাহান উঠে দাড়ায়।সানায়ার দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে দেখে।আজরাহান দূর্বোধ্য হাসে।ফিচেল গলায় বলল–

“মা,,
ওকে ভালো করে দেখো।এই তুই সত্যি আমার বোন তো!!
না মানে তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে পাড়ার মোড়ের ওই জট চুলওয়ালা বুড়ি তার নাতি।ওই সত্যিই তুই ওই বুড়ির নাতি নাকী!!!

ফিক করে হেসে দেয় প্রহর।সানায়া তাকাতেই নিজের ঠোঁট চিপে ধরে প্রহর।আজরাহান ওর দুই হাত দিয়ে সানায়ার গাল এপাশ ওপাশ করে।সরস গলায় বলল–

“এই তোকে তো কোনো দিক থেকে আমার বোন মনে হয় না।”

আজরাহান ওর হাত টা সানায়ার মুখের সাথে লাগিয়ে বলল–

“দেখ তোর তো গায়ের রঙও ম্যাচ হয়না আমার সাথে।আর চেহারা তা তো কোনো এঙ্গেল থেকেই না।”

বেচারি সানায়া আহ্লাদী গলায় ঘ্যান ঘ্যান করে বলল–

“মা দেখো না।”

“আরে দেখার কী আছে!!তোর চেহারা দেখ আর আমার চেহারা দেখ।আমার চেহারা দেখে যে কেউই বলবে আমি মায়ের ছেলে আর তুই!!
ও শিট !!আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তোকে তো বাবা পূব পাড়ার পুলের তলা থেকে নিয়ে এসেছিলো।
ছেহ!!!

সানায়া ভ্যা ভ্যা করে কেদে বলল–

“মা!!
তোমার আজাইরা রাহান কে কিছু বলো।”

কুহেলিকা সরস গলায় বলল–

“তাহলে খেয়ে নে।ও তো মিথ্যে কিছু বলে নি।একদিনে কী অবস্থা করেছিস চেহারার।”

আজরাহান ব্যস্ত হাতে খাবারের প্লেট টা হাতে নেয়।প্রহর আর কুহেলিকা কে চলে যেতে বলে।

সানায়া এখনো থম মেরে বসে আসে।আজরাহান শান্ত গলায় বলল–

“হা কর।”

“নাহ।খাবো না আমি।”

“খা।নাহলে কিন্তু তোকে সত্যিই আমি ওই জট ওয়ালা বুড়ির কাছে দিয়ে আসবো।নাহলে ওই ডাস্টবিন এ।তোর চেহারার সাথে একদম যাবে।”

“ভ্যা।”

ভেঙচি কাটে সানায়া।আজরাহান একগাল হেসে সরস গলায়া বলল–

“হা কর পাগলি।”

আজরাহান একটু একটু করে ওর মুখে খাবার দিচ্ছে।সানায়া বাধ্য মেয়ের মতো তা খেয়ে যাচ্ছে।তার ফাঁকেই আজরাহান বলল–

“তোর মনে আছে ছোট বেলায় রিশাদ তোর চুল টেনে দিয়েছিল??

সানায়া অস্ফুভাবে বলল–

“হুহ।”

“কি করেছিলাম ওর সাথে আমি??

সানায়া নরম ও গদগদ গলায় বলল–

“তুমি ওর মাথার সব চুল ফেলে ওকে ন্যাড়া বানিয়ে দিয়েছিলে।”

“আর তোর ক্লাসের সিমান যে তোর জামার উপর কালি ফেলে দিয়েছিল!!

“তুমি ওকে রাস্তায় হাটার সময় গর্তে ফেলে দিয়েছিলে আর তাতে কাদায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল।”

“আর স্বপ্নার কথা মনে আছে??

স্বপ্নার নাম শুনতেই খিলখিল করে হেসে উঠে সানায়া।উচ্ছ্বসিত গলায় বলল—

“মনে আছে মনে আছে।”

আজরাহান সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ম্লান গলায় বলল

“তাহলে আজ কেনো ভুলে গেলি তোর ভাইয়াকে!!

সানায় কাতর নয়নে তাকায় আজরাহান এর দিকে।আজরাহান গাঢ় গলায় বলল–

“মনে রাখিস তোর এই ভাই সবসময় তোর পাশে আছে।কাল কী হয়েছে আমি তোকে জিঙ্গেস করবো না।তোর যেদিন ইচ্ছে হবে তুই বলবি।হুম??

“হুম।”

,
,
সানায়া কে খাইয়ে প্রহর এর ঘরে আসে আজরাহান।হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে প্রহর।দেখে আজরাহান অলস ভঙিতে নিশ্চল হয়ে বসে আছে।নরম পায়ে ওর পাশে এসে দাড়ায় প্রহর।ফিকে গলায় বলল–

“সানায়া আপুর কী হয়েছে রাহান ভাইয়া??

আজরাহান সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরস গলায় বলল–

“তোকে এইসব নিয়ে ভাবতে হবে না।খেয়েছিস তুই??

“হুম।”

আজরাহান পা গুটিয়ে বসে।প্রহর কে আলগোছে ওর সামনে বসায়।প্রহর এর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফু দেয়।কেঁপে উঠে প্রহর।আজরাহান এক হাত দিয়ে প্রহর এর মুখের উপর ছড়ানো চুল গুলো ওর কানের পিছনে গুজে দেয়।প্রহর স্থবির হয়ে নিচে চোখ নিবদ্ধ করে বসে আছে।আজরাহান হালকা গলায় বলল–

“কী হয়েছে তোর??

“কিছু না।”

“তাহলে চুপ করে আছিস কেনো??

“তাহলে কী নাচবো??

“ওই এতো প্যাঁচ প্যাঁচ করিস কেনো??

“সরেন।”

আজরাহান এক হ্যাচকা টানে বিছানায় শোয়ায় প্রহর কে।ওর উপর উবু হয়ে ব্যস্ত গলায় বলল–

“একবার বিয়ে হতে দে তোর প্যাচ প্যাচ যদি আমি বন্ধ না করেছি!!

“সরেন,সরেন বলছি।না হলে ছোট মা কে ডাকব।”

“ডাক।মা এসে দেখুক তার ছেলে ফুলসজ্জা করছে।”

“ছিঃ!
আমি কিন্তু সত্যিই ছোট মা কে ডাকবো!!

“আচ্ছা।”

প্রহর সবেই অস্ফুটভাবে কুহেলিকা কে ডাকার জন্য অধর জোড়া ছড়িয়ে আর তখনই আজরাহান প্রহর এর অধর সাগরে নিজের নাও ভাসায়।

চলবে,,,

(বিঃদ্রঃ
মারশিয়াদ এর কষ্টে আজ অনেকেই প্রসন্ন হবেন😒😒😒)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here