বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ২৪

0
4421

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ২৪
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

অাজ সকাল থেকেই মন খারাপ প্রহর এর।আজ ওর জন্মদিন অথচ কারো মনে নেই।সকালে উঠেই সবকিছু যেনো একটু বেশিই অস্বাভাবিক মনে হলো।অন্যদিন আজরাহান অনেকটা উচ্ছ্বাসিত থাকে।বকবক করেই সারাদিন পার করে।কিন্তু আজ কেমন যেনো গুমোটভরা হয়ে আছে।খাওয়ার টেবিলে মুখে অমাবস্যা নিয়ে বসে আছে প্রহর।

আসলে প্রহর এর জন্মদিন কবে তা কেউ জানে না।আজকের এই দিনেই চার বছর আগে প্রহর এই বাড়িতে আসে।আর এই দিনটিকেই ওর জীবনের নতুন জন্ম হিসেবে ধরা হয়।
ম্লান মুখে আজরাহান এর পাশেই বসে প্রহর।স্কুলে যাওয়ার জন্য একদম তৈরি হয়েই বেরিয়েছে রুম থেকে।আজরাহান খেয়ে যাচ্ছে।বিরস গলায় প্রহর বলল–

“রাহান ভাইয়া !!

আজরাহান সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখে জ্যাম পাউরুটি পুরে ভজ ভজ আওয়াজ করে বলল—

“বল।”

“আপনার কী কিছুই মনে নেই!!

মুখে দেওয়া পাউরুটি চিবিয়ে শেষ করে আজরাহান।কেমন যেনো গলায় আটকে আছে।টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে তা ঢকঢক করে গিলে নেয়।নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে প্রহর।এক বৃহৎ ঢোক গিলে শান্ত গলায় আজরাহান বলল–

“আমার সব মনে আছে।তুই একবার বল কোন কথাটা মনে করতে হবে!!

জ্বলে উঠে প্রহর।তেতে উঠা গলায় বলল–

“সরেন।”

গজ গজ করতে করত চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রহর।আজরাহান উচু গলায় চেচিয়ে বলল—

“কীরে না খেয়ে চলে যাচ্ছিস কেনো!!সন্ধ্যার আগে কিন্তু আর খাবার পাবি না ডিঙি নৌকা।”

আরেক পিস পাউরুটি মুখে দিয়ে দুষ্ট হাসে আজরাহান।

আজ অাজরাহান কলেজ যায়নি।সারাদিন ছাদে কিছু একটা করেছে।কাউকে ছাদেও যেতে দেয় নি।প্রহর কে স্কুলে নিয়ে যায় সানোয়ার আহমেদ।শ্রান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরে প্রহর।মুখটা একদম মলিন হয়ে আছে।ঘরে ঢুকতেই ড্রয়িং রুমে কাউচে মারশিয়াদ কে বসা দেখেই প্রহর এর নিস্প্রভ নেত্রযুগল মুহুর্তেই জ্বলজ্বল করে উঠে।উচ্ছ্বসিত গলায় বলল–

“জান ভাইয়া!!

প্রহর এর মিষ্টি আওয়াজ এ সম্বিত ফিরে মারশিয়াদ এর।দরজার কাছে তাকাতেই প্রহর কে দেখে মিষ্টি হাসে।নরম পায়ে এগিয়ে আসে প্রহর এর কাছে।উচ্ছলিত গলায় প্রহর বলল–

“কেমন আছেন জান ভাইয়া??

“ভালো।আপনি কেমন আছেন??

“আমিও।কখন এসেছেন??

“একটু আগেই।”

মারশিয়ান স্মিত হেসে স্বাভাবিক গলায় আবার বলল–

“মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে।হ্যাপি বার্থডে রেড চিলি।”

প্রহর একগাল হেসে গদগদ গলায় বলল—

“আপনার মনে ছিলো জান ভাইয়া??

মারশিয়াদ শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বলল–

“আপনাকে কী আমি ভুলতে পারি!!

প্রহর এর চোখ দুটো চকচক করে উঠে।বিষন্ন চেহারায় খুশির ফোয়ারা বইতে থাকে।সিড়ি বেয়ে নেমে আসছে আজরাহান।ওদের দুজন কে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে চোখ মুখ শক্ত করে আজরাহান।মাথার দুপাশের শিরা দুটো অবচেতন মনেই দপ দপ করতে লাগলো।
আজরাহান আজো বুঝেনা কেনো ও মারশিয়াদ কে প্রহর এর আশেপাশে সহ্য করতে পারে না।মারশিয়াদ এর সাথে কথা বলতে দেখলেই ওর মনে হতে থাকে কেউ যেনো ওর কাছ থেকে ওর কলিজা ছিনিয়ে নিতে চাইছে।বুকের কোথাও ওর ফাঁকা ফাঁকা লাগে।আজরাহান এর অগোচরেই ওর অক্ষিযুগল আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভার মতো ফুটতে শুরু করে।আজরাহান কে দেখেই বিষম খায় প্রহর।ওর চোখের দিকে তাকাতেই যেনো প্রহর এর পৃথিবী থমকে যায়।ফর্সা মুখের কোথাও নির্মলতা নেই।উগ্রমূর্তি ধারণ করেছে আজরাহান।প্রহর আর কোনো কথা বলে না।নিশ্চল দৃষ্টিতে আজরাহান এর দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে প্রহর।মারশিয়াদ এর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায় প্রহর।

ভীষন রাগ হচ্ছে প্রহর এর।এই মানুষগুলো ওকে নিরঙ্কুশ ভালোবাসে।ওর ছোট ছোট প্রয়োজনও খেয়াল রাখে।কিন্তু আজকের এই দিন!!
এইদিন তো ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন।এই দিনেই ও মুক্তি পেয়েছে ওর বন্দি জীবন থেকে।মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করেছে।সবাই না হয় ব্যস্ততায় ভুলে গিয়েছে।কিন্তু ওর রাহান ভাইয়া!!
সে কী করে ভুলে গেলো!!

“এতো তাড়াতাড়ি কেনো এসেছিস??যা হওয়ার তা তো সন্ধ্যায় হবে।”

মারশিয়াদ অলস ভঙিতে জবাব দেয়–

“এখন কী তোর বাসায় আসতে আমাকে সময় দেখতে হবে!!

আজরাহান উষ্ণ গলায় বলল—

“ক্যান!!এইটা কী তোর শশুড় বাড়ি মনে হয়!!

মারশিয়াদ স্মিত হেসে ফিচেল গলায় বলল–

“তুই রাজি থাকলে আমার আপত্তি নেই।”

আজরাহান এর মস্তিষ্কের নিউরন গুলো বেপরোয়া গতি বাড়ায়।ক্রোধিত চোখে তাকিয়ে থাকে মারশিয়াদ এর দিকে।

মারশিয়াদ এর কথা অস্ফুট শুনতে পায় সানায়া।এক আশার ক্ষীন প্রদীপ আভা ছড়াতে থাকে তার মনে।যার দ্যুতি তার চেহারায় পরিস্ফুটন হয়।

চেঞ্জ করে বিছানায় ধপাস করে বসে প্রহর।কিছুই ভালো লাগছে না তার।এমনটা হওয়া কী খুব বেশি জরুরি ছিলো!!!
গৌধুলীর আবীর রঙ ছেয়েছে আকাশ।কমলা রঙের ছড়াছড়ি পূবের আকাশ জুড়ে।মাগরিবের আযান এর মিষ্টি সুরে ঘোর কাটে প্রহর এর।অযু করে নামায পড়ে আবারও বিমর্ষ মন নিয়ে জানালার সামনে গিয়ে দাড়ায়।এই সময়টা অনেক অদ্ভুত।না সূর্যের তেজি রশ্মি না চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণ।কোনোটাই নেই।তবুও পৃথিবীর জুড়ে এক অমোঘ মায়া ছড়িয়ে আছে।দিনের শেষ রাতের শুরু তো হবেই।
জানালা দিয়ে শিরশিরে বাতাস আসছে।কম্পন দিয়ে উঠে প্রহর এর শরীর।তাই থাই টেনে তা লাগিয়ে দেয়।শরতের শেষ হতে চলল।রাতের শুরুতে তেমন শীত না থাকলেও রাতের শেষ প্রহরে কাপন উঠে শরীরে।

ধড়াস করে দরজা খুলে ভিতরে আসে সানায়া।প্রহর কে কিছু বলতে না দিয়ে টেনে নিয়ে আসে বাইরে।বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে প্রহর।পুরো ড্রয়িং রুম বেলুন আর কালারফুল ফিতে দিয়ে সাজানো।মারশিয়াদ,সামান আর ওদের পরিবারের সবাই উপস্থিত।কিন্তু আজরাহান ছিলো না।এক এক করে সবাই উইশ করে প্রহর কে।কেক কেটে তা খাইয়ে দেয়।প্রহর এর চোখ ছলছল করে উঠে।রক্তের সম্পর্কবিহীন এই মানুষগুলো ওকে যে ভালোবাসা দিয়েছে তা কোনোভাবেই শোধ করতে পারবে না।
কিন্তু প্রহর এর কাতর দুই চোখ তার রাহান ভাইয়া কে খুজে চলছে।সানায়া ওকে এক পাশে টেনে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল ছাদে যেতে।আজরাহান সেখানেই প্রহর এর জন্য অপেক্ষা করছে।প্রহর এক মুহুর্তও দেরি না করে লম্বা লম্বা পা ফেলে ছাদে উঠে আসে।

বিমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখছে চারপাশ।পুরো ছাদ জুড়ে কালারফুল লাইটিং করা।ছাদের ফ্লোর জুড়ে গোলাপের পাপড়ি বিছানো।সেই সাথে লাভ শেপ এর বেলুন।ছাদে লাগানো গাছগুলোতেও ছোট ছোট মরিচ বাতি লাগানো।দেখে মনে হচ্ছে আকাশ জুড়ে তারার ঝিকিমিকি।ছাদের কার্নিশের সেই হাসনাহেনা ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি গন্ধ।প্রহর এর চোখের ভিতর প্রতিফলিত হচ্ছে ছাদে জ্বালানো লাইটের টিম টিম আলো।হঠাৎ একটা হিমেল হাওয়া এসে কাপিয়ে দেয় প্রহর কে।নরম পায়ে ওর পিছনে এসে দাড়ায় আজরাহান।দুই হাতে দিয়ে প্রহর এর কোমড় জড়িয়ে ধরে ওর পিঠ ঠেকায় নিজের বুকের সাথে।আজরাহান এর শরীরের উষ্ণতায় কাপন থামে প্রহর এর।আলতো করে নিজের চিবুক রাখে আজরাহান প্রহর এর কাঁধে।আজরাহান এর মুখের উষ্ণ ফু তে চোখ বন্ধ হয়ে আসে প্রহর এর।আজরাহান আরেকটু আড়ষ্ট করে নেয় প্রহর কে নিজের সাথে।কানের কাছে মৃদু ছন্দে বলল—

“শুভ জন্মদিন মাই লিটেল হার্ট।আজকের এই দিনে আমার জীবনে আসার জন্য আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা নিবেন।”

আজরাহান এর মুখে আপনি সম্মোধনে চকিত হয় প্রহর।ওর হাতের বাধনের মধ্যেই নিজেকে ঘুরিয়ে আজরাহান এর মুখের দিকে মুখ করে দাড়ায়।গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আজরাহান এর দিকে।প্রহর নিজের দু হাত দিয়ে আজরাহান বুক আকড়ে ধরে।শান্ত এবং উৎসুক গলায় বলল–

” এইসব আপনি কখন করলেন??

“যখন তুই স্কুলে ছিলি।”

“আপনার মনে ছিলো!!!

“আমি আমার শ্বাস ভুলে যেতে পারবো কিন্তু তোকে ভুলতে পারবো না।”
হ্যাপি বার্থডে রেড রোজ।”

প্রহর খিলখিলিয়ে হাসে।নিজের পা দুটো আজরাহান এর পায়ের উপর উঠিয়ে একটু উচু হয়ে চুমু খায় আজরাহান এর গালে।আজরাহান উচ্ছলিত হয়ে প্রহর কে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে।একটা ছোট্ট বাচ্চার মতো নিজেকে একদম গুজে দেয় প্রহর আজরাহান এর বুকে।অস্ফুটভাবে আজরাহান বলল—

“প্রাণহারিণী আমার।”

কতোক্ষন এভাবে একে অপরের সাথে মিশে ছিলো ওরা জানে না।প্রহর কে নিজের বুক থেকে আলগা করে দাড় করায় আজরাহান।পকেটে থেকে একটা ভারি পায়েল বের করে আনে।প্রহর এর এক হাত নিয়ে তার উল্টো পিঠে চুমু খায় আজরাহান।মিষ্টি,শান্ত,স্নিগ্ধ গলায় আজরাহান বলতে লাগলো—–

” শরতের এক টুকরো রোদ হয়ে ভালোবাসি তোমায়,
রঙধনুর সাত রঙ হয়ে ছুয়ে যাবো তোমার হৃদয়,
গোধূলির আবীর রঙ হয়ে ছুয়ে যাবো তোমার অক্ষিপল্লব,
বর্ষার স্নিগ্ধ কদম্বলতিকা জড়ানো তোমার অঙ্গে
আমি বিনিদ্র রজনী পাড়ি দিতে চাই তোমার সঙ্গে,
আমার আঁধার ঘরের প্রভাতকিরণ তুমি
তোমার ছোয়ায় পূর্ন আমার হৃদয়ের তৃষ্ণার্ত মরুভূমি,
আমার হৃদয়হারিণী,আমার শত জনমের তপস্যা,আমার প্রাণেশ্বরী,

আমি তোমার হতে চাই…….
তুমি আমার হবে কী?????

—–তানভি

আজরাহান এক হাটু ফ্লোরে গেড়ে অন্য হাটু ভাজ করে বসে প্রহর এর দিকে এক হাত বাড়িয়ে মোহবিষ্ট গলায় বলল—

” মে আই???

প্রহর অবাক করা চোখে তাকিয়ে আছে।খুশিতে ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।নিজেকে সংবরণ করে প্রহর।দুই হাতে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে।গায়ে চিমটি কেটে বুঝতে চায় সে কী সত্যিই দেখছে না কী তার কল্পনা!!!
না,যা হচ্ছে সব সত্যি।একদম সত্যি।তার অসাঢ় হৃদয়ের কম্পন যেনো বিদ্যুত বেগে চলছে।প্রহর নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছে।আজরাহান এর ওই সম্মোহিত দুচোখ যেনো ওকে এক অপার্থিব দুনিয়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।ধীরে ধীরে কম্পিত বাম পা উঠিয়ে দেয় আজরাহান এর ভাজ করা হাটুর উপর।তার বিপরীতে এক উষ্ণ আবেদনময় হাসি উপহার দেয় আজরাহান।প্রহর এর মনে হচ্ছে যেনো এখনই পৃথিবী থমকে যায়।এভাবেই থমকে যায় সবকিছু।ওর রাহান ভাইয়া যেনো এভাবেই সারাজীবন ওর দিকে এই মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।এই জীবনে ওর আর কিছুই চাওয়ার নেই।

আজরাহান ওর নরম হাতে আলগোছে প্রহর এর পায়ে পায়েল পড়িয়ে দেয়।এক উষ্ণ চুম্বন করে সেখানে।কেপে উঠে প্রহর এর শরীর।এরই নাম কী ভালোবাসা!!!

আজরাহান উঠে দাড়াতেই প্রহর ঝপ করে ওর বুকে পড়ে।ওর মনে হচ্ছে যেনো আজ এই মুহুর্তেই মিশে যেতে ওর রাহান ভাইয়ার সাথে।আজরাহান প্রহর এর হৃদকম্পন অনুভব করে।স্বাভাবিক নয়,অস্বাভাবিক মাত্রায় তা কম্পিত হচ্ছে।ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে প্রহর এর।আজরাহান দূর্বল হাতে জড়িয়ে ধরে প্রহর কে।স্নিগ্ধ গলায় বলল–

“ক্লাম ডাউন রেড রোজ।মেরে ফেলবি না কী আমাকে!!

আজরাহান মৃদু ছন্দে হাসে।প্রহর কোনো শব্দ করে না।আজরাহান ও নির্বিকার।ক্ষনকাল বাদ আজরাহান অনুভব করে ভেজা স্পর্শ।ফুপিয়ে উঠে প্রহর।আজরাহান ব্যস্ত হয়ে ওকে সোজা করে।প্রহর এর অক্ষিযুগল বেয়ে বয়ে চলছে শ্রাবনের স্মিত ধারা।আজরাহান উদ্বেগপূর্ণ গলায় বলল–

“কী হয়েছে তোর!!
কাঁদছিস কেনো তুই????

প্রহর হেচকি তুলে আনম্র গলায় বলল—

“আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো রাহান ভাইয়া!!!
আপনার জীবনে আমার প্রয়োজন কখনো ফুরিয়ে যাবে না তো!!

“এইসব কি বলছিস তুই??

“বলেন না রাহান ভাইয়া আপনি কখনো আমাকে ছুড়ে ফেলে দিবেন না তো!!
যদি কখনো মনে হয় আমি আর আপনার কোনো কাজেই আসবো না!!!

আজরাহান শক্ত হয়ে দাড়ায়।প্রহর এর চিবুকে হাত দিয়ে ওর মুখ টা একটু উচু করে।তপ্ত এবং গাঢ় গলায় বলল—

” ওই চাঁদ কে দেখ।
যতদিন ওই আকাশের বুকে চাঁদ থাকবে ততদিন তুই আমার বুকে থাকবি।ওই চাঁদের আলো যেমন কোনো দিন ফিকে হবে না ঠিক তেমন আমার জীবনেও তোর প্রয়োজন কখনো ফুরাবে না।তুই সারাজীবন আমার নিঃশ্বাস হয়ে থাকবি।যদি আমি তোকে ভুলে যাই তাহলে আমি আমার নিঃশ্বাস কে ভুলে যাবো।আর নিঃশ্বাস কে ভুলে যাওয়া মানে আমি মৃত।আর মৃত মানুষ কখনো কাউকে ভুলতে পারে না শুধু একবুক স্মৃতি নিয়ে হারিয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে।তেমন আমিও হারিয়ে যাবো সেদিন।”

বুক কাপিয়ে কেঁদে উঠে প্রহর।আজরাহান কে জড়িয়ে মনের আশ মিটিয়ে কাঁদে।যেনো ওর মনের সকল ভয়,সঙ্কা,দ্বিধা সব আজ ওর চোখের পানিতে ভেসে ওকে মুক্ত করে দিয়ে যাচ্ছে।

হালকা গলার কাশির আওয়াজ এ আজরাহান এর বুক থেকে সরে দাড়ায় প্রহর।চকিতে তাকিয়ে দেখে ওদের পিছনে দাড়িয়ে আছে মারশিয়াদ।মারশিয়াদ কে দেখেই লজ্জায় চোখ নামায় প্রহর।কিছু না বলে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে সিড়ে বেয়ে নামার জন্য গেলে মারশিয়াদ এর সামনে গিয়েই হোচট খায়।মারশিয়াদ আলগোছে ওকে সামলায়।নরম গলায় মারশিয়াদ বলল–

“সাবধানে রেড চিলি।”

প্রহর ধীর গলায় নির্নিমেষ তাকিয়ে বলল–

“সরি।”

“ইটস ওকে।নিজের খেয়াল রাখবেন।”

প্রহর যেতেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আজরাহান।প্রদৃপ্ত গলায় বলল–

“তুই এখানে কেনো এসেছিস!!!কে আসতে বলল তোকে??

মারশিয়াদ অলস ভঙিতে ছাদের কিনারায় গিয়ে দাড়ায়।দু হাত পকেটে গুজে শক্ত এবং স্বাভাবিক হয়।আজরাহান উত্তেজিত গলায় আবার বলল—

“কথা বলছিস না কেনো তুই!!!

মারশিয়াদ নিস্প্রভ চোখে তাকায়।নিরস গলায় বলল–

“নাবীন স্যার তোর আর তোর মারমেইড এর বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে এসেছে।”

আজরাহান তপ্ত গলায় বলল–

“হোয়াট??

মারশিয়াদ হালকা হেসে বলল–

“তোর জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।”

আজরাহান ত্রস্ত পায়ে নিচে যায়।মারশিয়াদ এর বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক শীতল দীর্ঘশ্বাস।অনবরত ভাইব্রেট হচ্ছে মারশিয়াদ এর মোবাইল।গত দুইঘন্টা ধরে কল করে যাচ্ছে নুরাইসা।মারশিয়াদ রিসিভ করছে না।নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে ওর কাছে।নুরাইসার কান্না একদমই শুনতে ইচ্ছে করছে না মারশিয়াদ এর।ফিফটি প্লাস মিসডকল।
এই শীতের মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাসেও অনবরত ঘামছে মারশিয়াদ।নুরাইসা কিছু করে না বসে!!!
নিজেকে ও সামলাতে পারবে কিন্তু নুরাইসা!!ওর তো সে ক্ষমতা নেই।

মারশিয়াদ এর পাশে এসে দাড়ায় সানায়া।এক উষ্ণ উজ্জলতা ওর চেহারা জুড়ে।শান্ত গলায় বলল–

“কেমন আছো জান??

“ভালো।”

“তোমার কী কিছু হয়েছে!!এমন দেখাচ্ছে কেনো??

মারশিয়াদ স্মিত হাসে।ফিকে গলায় বলল–

“তেমন কিছু নয়।আই এম ফাইন।”

সানায়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।মারশিয়াদ এর মোবাইল এখনো থেমে থেমে ভাইব্রেট করছে।অধর প্রসারিত করে মিষ্টি হেসে সানায়া বলল–

“একটা কথা জিঙ্গেস করি??

“হুম।”

“তুমি কাউকে পছন্দ করো??

মারশিয়াদ এর বুকটা ধক করে উঠে।আসলে কী সে কাউকে পছন্দ করে!!!
হ্যাঁ।করেতো তো।তার মিষ্টি কে।মারশিয়াদ কী যেনো মনে করে।ব্যস্ত গলায় বলল–

“নাহ।ভালোবাসি।”

তটস্থ পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান হয় মারশিয়াদ।কিন্তু হঠাৎ করে সানায়ার বুকের বা’পাশে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়।বুকটা কেমন যেনো ভারী হয়ে আসে।থেমে থেমে নিঃশ্বাস আটকে আসে ওর।হঠাৎ কী যেনো হলো!!ধুপ করে নিচে বসে পড়ে সানায়া।ঝরঝর করে ওর দুচোখ বেয়ে পড়তে থাকে বাদলের ধারা।এমন কেনো হচ্ছে!!ওর বুকে এতো কেনো ব্যথা হচ্ছে!!!কেনো ওর মনে হচ্ছে ও শেষ হয়ে যাচ্ছে!!!অক্ষিপল্লব ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে সানায়া।হেলে পড়ে সেখানে সানায়া।তার ঘন নিঃশ্বাস আরো ঘন হতে লাগল।কম্পন উঠা শরীর ধীরে ধীরে বিবশ হয়ে আসছে।

আজরাহান কে দেখেই বিচলিত হয় কুহেলিকা।প্রহর এর জন্য আজরাহান এর পাগলামি কারো অজানা নয়।মাইন্ড ডাইভ্রার্ট হতে আজরাহান এর বিন্দুমাত্র সময় লাগে না।কিন্তু আজকের আজরাহান এক অন্য আজরাহান।শান্তভাবে সানোয়ার আহমেদ এর পাশেই বসে আজরাহান।শান্তু এবং গাঢ় গলায় বলল–

“আমার পক্ষে নুরাইসা কে বিয়ে করা সম্ভব নয়।”

নবনীতা কিছু বলতে যাবেন তার আগেই তার হাত চেপে ধরে চোখে দিয়ে ইশারা করে নাবীন খান।অতি স্বাভাবিক গলায় বললেন–

“ওকে।আমি তোমার মতামত কে সম্মান করি।”

“ধন্যবাদ স্যার।”

প্রহর ওর ঘরের দরজার ফাক গলিয়ে দাড়িয়ে ছিলো।আজরাহান এর জবাব এ প্রশান্তি বয়ে চলে ওর মন জুড়ে।প্রহর এর আর কিছু শোনার ইচ্ছা জাগলো না।বিছানাই গিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়লো।সিলিং এর দিকে নির্বিকার তাকিয়ে আজরাহান এর কথা ভাবতে লাগলো।

আজরাহান কুহেলিকা আর সানোয়ার আহমেদ এর দিকে নিগূঢ় ভাবে তাকালো।চোখ ঘুরিয়ে নাবীন খান এর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল–

“আমি আমার বাবা মায়ের পরে যদি কাউকে সম্মান করে থাকি তাহলে সে আপনি।আপনাকে আমি আমার আদর্শ মানি।আর আমি নিশ্চিত আপনি যা করবেন অতি বিচক্ষণতার সাথেই করবেন।বৃত্তের পরিধি দেখেই তার কেন্দ্রবিন্দু নির্ধারণ করা যায় না।যদি না আপনি সঠিক পদ্ধতি জানেন।”

আজরাহান এর কথা কারো বোধগম্য না হলেও নাবীন খান বুঝতে পেরেছেন আজরাহান কী বলতে চায়।তিনি আর কোনো কথা বাড়ান না।উপর থেকে নেমে আসা ঝড়ের গতিতে যাওয়া মারশিয়াদ এর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে সবাই।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here