বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ৩১

0
4809

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ৩১
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

সময়ের পরিক্রমায় ক্ষত ভরে যায় কিন্তু তার রেশ রয়ে যায় আজীবন।মানুষ ভুল করে আর ভুল থেকেই শিক্ষা লাভ করে।

আর কয়েকদিন পরই প্রহর এর ফাইনাল এক্সাম।বাসায় তেমন কেউ নেই।সানায়া নিজের ঘরে শুয়ে আছে।নন্দিতার মায়ের শরীরটা একটু খারাপ।তাই কুহেলিকা,সানোয়ার আহমেদ আর নন্দিতা তাকে দেখতে গিয়েছে।কলিং বেল বাজতেই বিরক্ত হয় প্রহর।নিশ্চয়ই পাশের বাসার পিচ্চিটা এসেছে।সেদিন এসে প্রহর এর বইটা ছিড়ে ফেলেছিলো।ইচ্ছে হচ্ছিলো এক ঘা দেই।কিন্তু কুহেলিকা ছিলো বলেই কিছু করতে পারে নি।তাই বেল শোনার পরও প্রহর তার বই এ মুখ গুঁজে রেখেছে।
পরক্ষনেই ভাবলো যদি সানায়া খুলে দেয়!
তাই সময় নষ্ট না করে দৌঁড়ে বের হয় ঘর থেকে।দরজা খুলে দেখে মারশিয়াদ দাঁড়িয়ে আছে।প্রহর কে দেখেই স্মিত হাসে।

আজ একমাস পর মারশিয়াদ এই বাড়িতে এসেছে।হসপিটালে কয়েকবার সানায়ার সাথে দেখা করতে গেলেও আজরাহান দেয় নি।বাসায় এসেছিলো দু’একবার।কিন্তু সানায়া কোনোভাবেই মারশিয়াদ এর সাথে দেখা করতে চায় না।পুরোনো ঘা নতুন করে তাজা করার প্রয়োজন বোধ করলো না সে।
প্রহর উচ্ছ্বসিত গলায় বলল–

“কেমন আছেন জান ভাইয়া!!

সরল হেসে মারশিয়াদ বলল–

“ভালো।আপনি কেমন আছেন?

“ভালো।”

মারশিয়াদ ভিতরে গিয়ে কাউচে বসে।সে জানে বাসায় তেমন কেউ নেই।মারশিয়াদ জিঙ্গাসু গলায় বলল–

“আজরাহান কোথায়??

“রাহান ভাইয়া তো একটু বাইরে গেছে।”

“ও আচ্ছা।”

সেদিনের পর থেকে আজরাহান মারশিয়াদ এর সাথে কথা বলে না।মারশিয়াদ আজও টুয়েন্টি প্লাস কল করেছে।কিন্তু আজরাহান রিসিভ করেনি।
প্রহর একগাল হেসে বলল–

“চা খাবেন??

“নাহ।
সানায়া কেমন আছে?

“ভালো।”

মারশিয়াদ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।মারশিয়াদ বার বার ঘড়ি দেখে।হাতে তার একটা ফাইল।যা দিতেই সে এখানে এসেছে।নুরাইসা অনবরত কল করেই যাচ্ছে।মারশিয়াদ বিরক্ত হয়ে তা রিসিভ করে হালকা রাগমিশ্রিত গলায় বলল–

“মিষ্টি আপনাকে কতোবার বললাম আমি আপনাকে পরে কল ব্যাক করছি।তবুও বার বার কেনো কল করছেন??

“সরি মি.জান।আচ্ছা,আপনি গিয়েই আমাকে কল করবেন।নাহলে কিন্তু আমি চলে আসবো।”

“ইটস ওকে।করবো।রাখি এখন।”

নাবীন খান নুরাইসা আর মারশিয়াদ এর সম্পর্ক মেনে নিয়েছে।
হি হি করে হেসে উঠে প্রহর।মারশিয়াদ কপাল ভাঁজ করে সন্দিহান গলায় বলল–

“হাসছেন কেনো রেড চিলি?

প্রহর ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে সরস গলায় বলল–

” এমনি।”

মারশিয়াদ মৃদু হেসে আবার ঘড়ি দেখে।প্রহর এর দিকে চোখ রেখে বলল–

“আপনার রাহান ভাইয়ার মে বি আসতে সময় লাগবে।তাকে বলবেন তাকে কিছু ইমপোর্টেন্ট জিনিস দেওয়ার আছে।আমি শিহরণদের বাসায় থাকবো।সে যেনো নিয়ে আসে।”

“আচ্ছা।”

মারশিয়াদ উঠে দাঁড়াতেই আবার বসে।কিছু একটা চোখে পড়তেই চোখ জ্বালা দিয়ে উঠে।হাত দিয়ে তা ঘষতে থাকে।প্রহর উদ্বিগ গলায় বলল–

“কী হয়েছে জান ভাইয়া??

মারশিয়াদ ক্ষীন গলায় বলল–

“মে বি চোখে কিছু পড়েছে।”

“কই দেখি!

প্রহর উঠে গিয়ে মারশিয়াদ এর সামনে দাঁড়ায়।মারশিয়াদ এর হাত সরিয়ে ওর চোখের পাতা টেনে তাতে ফুঁ দিতে থাকে।

“এখন ঠিক আছে!

মারশিয়াদ চোখ ঘষতে থাকে আর বলল–

“হুম।”

প্রহর মুচকি হেসে সোজা হয়ে দাড়াতেই দেখে আজরাহান দরজায় দাঁড়িয়ে।বিবশ হয়ে আসে প্রহর এর শরীর।প্রহর কে স্থির তাকাতে দেখেই ঘুড়ে তাকায় মারশিয়াদ।আজরাহান কে দেখেই অধর প্রশস্ত করে মারশিয়াদ।দরজার সামনে গিয়ে মৃদু হেসে এক নিঃশ্বাস ফেলে নরম গলায় বলল–

“থ্যাংক গড।এট লাস্ট তোর সাথে দেখা তো হলো।”

আজরাহান শান্ত এবং কঠিন গলায় বলল–

“কেনো এসেছিস এখানে?

মারশিয়াদ ওর হাতের ফাইলটা আজরাহান কে এগিয়ে দেয়।শান্ত গলায় বলল–

“আজ থেকে তোর আর আমার সব হিসেব শেষ।তুই তোর রাস্তায় আর আমি আমার।নাউ,ইউর লাইফ ইউর রুলস।বাই।”

মারশিয়াদ ফাইলটা দিয়েই চলে যায়।আজরাহান এর শরীর প্রকম্পিত হয়।নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে আজরাহান প্রহর এর দিকে।প্রহর পাথরমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আজরাহান চোখ ধীরে ধীরে রক্তিম বর্ণ ধারণ করে।প্রহর এর কাছে এসে উতপ্ত গলায় বলল–

“কী করছিলি তুই ওর সাথে?

প্রহর শুকনো ঢোক গিলে।নির্বিকার তাকিয়ে নম্র গলায় বলল–

“রাহান ভাইয়া আমি….।”

আজরাহান চোখ মুখ শক্ত করে প্রহর এর একদম কাছে এসে হাত দিয়ে ওর গাল চেপে ধরে।ব্যথায় ককিয়ে উঠে প্রহর।ফ্যাসফ্যাসে গলায় আজরাহান বলল–

“তোকে না বলেছি একদম ওর কাছে যাবি না!কানে যায় না তোর কথা!

“ছাড়েন রাহান ভাইয়া।লাগছে আমার।”

আজরাহান এর রাগ আগ্নেয়গিরির মতো লাভা ছড়াতে থাকে।ফোঁস ফোঁস করতে থাকে আজরাহান।প্রহর এর কাঁধ চেপে গাঢ় এবং রুষ্ট গলায় বলল–

“আমাকে দিয়ে হয়না তোর!আমি কাছে আসলে তোর অস্বস্তি লাগে!আর মারশিয়াদ আসলে ভালোই লাগে!

প্রহর দাঁতে দাঁত চেপে ধরে।চোখ বড় বড় করে শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আজরাহান এর দিকে।অধরযুগল গোল করে দাঁত দিয়ে দাঁত চেপে ধরে নিজের সব শক্তি দিয়ে আজরাহান কে ধাক্কা মারে।সরে পড়ে আজরাহান কাউচের উপর।
ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে প্রহর।চোখের কোণে জমে জল।ক্রোধিত কন্ঠে চিৎকার করে বলল–

“চুপ করেন আপনি।কী বলছেন এইসব!
মাথা ঠিক আছে আপনার!

আজরাহান কন্ঠের ক্রোধ আরও বাড়িয়ে বলল–

“আমার মাথা ঠিক নেই!
এখন তোর আমাকে পাগল মনে হয়!হবেই তো।আমাকে পাগল মনে হয় আর ওই মারশিয়াদ কে তোর আশিক মনে হয়!

“চুপ করেন আপনি।
কী বলছেন এইসব জান ভাইয়ার নামে আপনি!
ছোট মা ঠিক ই বলে আপনি আসলেই একটা পাগল,উন্মাদ।”

আজরাহান তড়িৎ বেগে প্রহর এর কাছে এসে ওর হাত দুটো চেপে ধরে ক্রুর কন্ঠে বলল—

“আমি উন্মাদ!!
আয় দেখাচ্ছি তোকে উন্মাদ কাকে বলে!

আজরাহান প্রহর এর হাত টেনে ওর ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।ওদের দুই জনের জোরালো কথাবার্তার আওয়াজ এ নেমে আসে সানায়া।আজরাহান এর রাগে অগ্নিশর্মা মুখচ্ছবি দেখে আৎকে উঠে সানায়া।আজরাহান এর হাত থেকে প্রহর এর কে টান দিয়ে সরাতে গেলেও সানায়া ব্যর্থ।বলল–

“ভাইয়া কী করছো!
ছাড়ো প্রহর কে।”

আজরাহান শক্ত গলায় বলল–

“তুই সর এখান থেকে।”

প্রহর অস্ফুট ভাবে বলল—

“দেখোনা সানায়া আপু,রাহান ভাইয়া কী সব বলছে!

“ভাইয়া ছাড়ো ওকে।”

“তুই মাঝখানে একদম কথা বলবি না।”

আজরাহান যেভাবে প্রহর এর হাত চেপে ধরেছে তাতে ব্যথায় ছটফট করছে প্রহর।চোখ দিয়ে অনবরত ঝড়ছে পানি।তেতে উঠা গলায় প্রহর বলল–

“ছাড়েন,ছাড়েন আমাকে।”

“ক্যান,তোর না শরীরের অনেক জ্বালা।চল আজ তোর সব জ্বালা মিটিয়ে দিবো।”

সানায়া চিৎকার করে বলল—

“ভাইয়া,
এইসব কী ধরনের কথা !ছাড়ো বলছি প্রহর কে।”

প্রহর কম্পনরত গলায় বলল—

“আপনি,আপনি আসলেই একটা জঘন্য লোক।”

আজরাহান থেকে হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়া মোচড়ি করে প্রহর।ছাড়াতে না পেরে তপ্ত গলায় আবার বলল–

“ছাড়েন আমাকে।অসভ্য,জংলী,জানোয়ার।”

আজরাহান ফুঁসে উঠে।দারাজ গলায় বলল–

“জানোয়ার এর জানোয়ারগিরি দেখাবো তোকে আমি আজ।চল।”

“ভাইয়া ছাড়ো ওকে।”

আজরাহান দূর্বল ধাক্কায় সরায় সানায়া কে।সানায়ার শরীর এমনিতেও দূর্বল।আজরাহান এর হালকা ধাক্কায় ধপাস করে পড়ে নিচে পড়ে সানায়া।ও উঠতে উঠতে আজরাহান প্রহর কে নিজের ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।সানায়া অবিরত কড়াঘাত করে দরজায়।তপ্ত গলায় বলল–

“ভাইয়া দরজা খোলো।প্লিজ ছাড়ো প্রহর কে।”

আজরাহান বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে প্রহর কে।মাথাটা উঁচু করে হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে প্রহর।আহত গলায় বলল–

“রাহান ভাইয়া প্লিজ যেতে দিন আমাকে।”

আজরাহান জোরালো গলায় বলল–

“ক্যান, এখন কী সমস্যা!আমি তো জানোয়ার তাই না!
দেখ জানোয়ার কী করতে পারে।আজকের পর আমি ছাড়া আর অন্য কারো কথা ভাবতেও তোর শরীর শিউরে উঠবে।
ভালোবেসেছিলাম তোকে আমি।কিন্তু তুই!!
তোর কাছে আমার ভালোবাসার মূল্য নেই।তাহলে জানোয়ার ই ভালো।তুই আমারই হবি।”

আজরাহান ওর শার্টের বাটন খুলতে থাকে।প্রহর এর শিড়দাড়া বেয়ে নেমে আসে এক হিম শীতল ধারা।যা ওর পুরো শরীর কে বরফ করে দিচ্ছে।কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রহর।ঘনত্ব বেড়েছে শ্বাসের।চোখের কোন বেয়ে পড়ছে উপচে পড়া জলধারা।

সানায়া এখনো দরজায়ে একের পর এক চাপড় মেরে যাচ্ছে।কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না।কল করবে ভেবেছে কুহেলিকা কে।কিন্তু তাতেও কী হবে!তারা আসতে আসতে যা হবার হয়ে যাবে।কলিং বেল বাঝতেই আত্নায় পানি ফিরে সানায়ার। হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে সানায়া।আশফিক কে দেখেই কাঁদতে থাকে।ঘটনার আকস্মিকতায় আকাশ ভেঙে পড়ে যেনো আশফিক এর মাথায়।
দরজায় একের এক থাবা মেরে আশফিক উঁচু গলায় বলল—

“আজরাহান দরজা খোল বলছি।পাগলামি করিস না।বের হয়ে আয় বলছি।”

ভিতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।সানায়া দমবন্ধ করা গলায় কিছু একটা বলে আশফিক কে।আশফিক তাতে সম্মতি দেয়।বাড়ির বাইরে চলে যায় আশফিক।সানায়া এখনো দরজা ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে।প্রায় মিনেট দশেক পর দরজা খুলে দাড়ায় আশফিক।সানায়া ত্রস্ত পায়ে রুমে ঢুকে পড়ে।প্রহর গুঁটি মেরে বসে আছে বিছানায়।আজরাহান কিছু দূরত্বেই।হাত দিয়ে টপ টপ করে পড়ছে রক্ত।সানায়া কে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে ওকে জড়িয়ে ধরে প্রহর।
,
,
,
ল্যাপটপে ভিডিও কল করেছে নুরাইসা।সারাদিন মোবাইলেও কল করতে থাকে।মারশিয়াদ বেজায় বিরক্ত।তারপরও কিছু বলে না।কেনো যেনো মেয়েটার কথা শুনলেই ওর সব রাগ পানি হয়ে যায়।নির্ধা,শিহরণ ও পাশে বসা।কিছুদিনের মধ্যেই মারশিয়াদ আর নুরাইসার আকদ হবে।মারশিয়াদ নুরাইসা কে নিয়ে আমেরিকা চলে যাবে।আর ওখানেই ওদের রিসিপশন বড় করে হবে।নির্ধা কয়েকটা শাড়ি আর জুয়েলারি চুজ করেছে।সেগুলোই দেখাচ্ছে নুরাইসা কে।
ডোর বেল বাজতেই দরজা খুলে মারশিয়াদ।বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে প্রহর।মারশিয়াদ কে দেখেই ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোঁপাতে থাকে প্রহর।অপ্রস্তুত হয় মারশিয়াদ।প্রহর কে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি দিয়ে গাঢ় গলায় বলল–

“কী হয়েছে আপনার!এমন অবস্থা কী করে হলো?

প্রহর আওয়াজ করে কেঁদে উঠে।মারশিয়াদ ওকে নিয়ে ভিতরে কাউচে বসায়।সেন্টার টেবিল থেকে একগ্লাস পানি দিয়ে বলল–

“এটা খেয়ে নিন।”

প্রহর মাথা এপাশ ওপাশ করে না সম্মতি দেয়।মারশিয়াদ শান্ত গলায় বলল–

“পানি টা খেয়ে নিন রেড চিলি।আর কী হয়েছে তা খুলে বলেন।”

নির্ধা আর শিহরণ চোখ মুখ কুঁচকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রহর এর দিকে।মারশিয়াদ ওদের দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় বলল–

“তোরা যা এখান থেকে।”

প্রহর পানিটা ঢকঢক করে গিলে নেয়।হেচকি তুলচে প্রহর।মারশিয়াদ এর কপালে ভাঁজ পড়ে।এমন কী হলো!!
শীতল গলায় মারশিয়াদ বলল–

“শান্ত হোন।প্লিজ।কী হয়েছে বলেন তো?

প্রহর আবারো ঝমঝমিয়ে কাঁদতে শুরু করে।মারশিয়াদ অস্থির হয়ে উঠে।ওর হাত পা ঝিমঝিম করছে।ব্যস্ত গলায় বলল–

“প্লিজ রেড চিলি।থামেন।কী হয়েছে বলেন আমাকে।”

প্রহর অনেক কষ্টে কান্না থামায়।হেচকি তুলে তুলে সব ঘটনা খুলে বলে।সবটা শুনে মারশিয়াদ এক সুদীর্ঘ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।ভারী গলায় বলল–

“আপনার এখানে আসা উচিত হয়নি রেড চিলি।আজরাহান জানলে বিষয়টা একদম খারাপ হবে।”

ধরা গলায় প্রহর বলল–

“আমি আর ও বাড়িতে যাবো না।”

“কোথায় যাবেন আপনি?

“আমি আপনার কাছে থাকবো।”

“তা হয় না রেড চিলি।”

“কেনো!আপনি আমাকে বের করে দিবেন বাড়ি থেকে।”

মারশিয়াদ দুবোর্ধ্য হাসে।ধীর গলায় বলল—

“আপনার রাহান ভাইয়া আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।সে আপনাকে ভালোবাসে।”

প্রহর শান্ত গলায় প্রশ্ন করে–

“ভালোবাসলে তাকে কষ্ট দিতে হয়?

মারশিয়াদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল–

“ভালোবাসালেই কষ্ট পেতে হয়।লোহা পুড়তে পুড়তে যেমন শক্ত হয় তেমন কষ্ট পেতে পেতে ভালোবাসা খাঁটি হয়।চলেন আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি।”

প্রহর ব্যস্ত গলায় বলল–

“নাহ।আমি যাবো না।যাবো না আমি।আপনি বলেন তাহলে আমি চলে যাই।আর কখনো আসবো না আপনার কাছে।”

প্রহর কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ায়।মারশিয়াদ ব্যগ্র হয়ে ওর হাত টেনে ধরে।প্রহর ফিরে তাকাতেই মারশিয়াদ ওর হাত ছেড়ে নরম গলায় বলল–

“সরি।বসেন।কোথাও যেতে হবে না আপনার।”

প্রহর আবারো বসে।নিঃশব্দে কাঁদছে প্রহর।চোখ দিয়ে পড়ছে শ্রাবনের অথৈ ধারা।মারশিয়াদ এর মন ব্যাকুল হয়ে উঠে।এই মুখের হাসির জন্যই সেদিন না চাইতেও প্রহর কে না জানিয়ে মারশিয়াদ আমেরিকা চলে যায়।কিন্তু আজ !
মারশিয়াদ নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে প্রহর এর দিকে।প্রহর মাথা তুলে আনম্র গলায় বলল–

“আমার খিদে পেয়েছে।”

মারশিয়াদ উচ্ছল হাসে।সরস গলায় বলল–

“আপনি বসেন আমি কিছু নিয়ে আসছি।”

দরজায় দাঁড়িয়ে সমস্ত কিছু শুনতে পায় নির্ধা শিহরণ।শিহরণ চিন্তিত মুখে কপাল ভাঁজ করে বিছানায় বসে।নির্ধা রাগমিশ্রিত গলায় বলল—

“হলো তো এইবার।এই সবকিছুর জন্য জান ভাইয়া দায়ী।
কী দরকার ছিলো ওই পাগলটার কাছে বাচ্ছা মেয়েটাকে ছেড়ে যাবার!

শিহরণ লম্বা শ্বাস ফেলে গাঢ় গলায় বলল–

“যা জানো না তা নিয়ে কথা বলবে না।আজরাহান মোটেও ওই ধরনের ছেলে নয়।”

“কোন ধরনের ছেলে তা বোঝার বাকী নেই।এই তার ভালোবাসা !
একটা বাচ্চা মেয়েকে রেপ করতে চায়!

শিহরণ ধমকে উঠে বলল–

“একদম বাজে কথা বলবে না।আজরাহান কিছুই করেনি।শুধু ওকে ভয় দেখিয়েছ।”

“ভয়!কিসের ভয়!
ভাবো তো ওই বাচ্চা মেয়েটার মনের অবস্থা এখন কী!
তোমরা পুরুষরা শুধু নিজের কথাই ভাবো।”

“তুমি চুপ করবে!
যাও তো এখান থেকে।একদম ঘ্যানঘ্যান করবে না কানের কাছে।”

“সত্য সবসময় তিতা ই হয়।”
,
,
নুরাইসার অনবরত কলে বিরক্ত হয়ে তা রিসিভ করে মারশিয়াদ।কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে মোবাইল পকেটে গুঁজে নেয়।পাস্তা বানাচ্ছে প্রহর এর জন্য।

“মিষ্টি, আপনি কেনো বারবার কল করেন?

“আপনার সাথে কথা না বললে আমার ভালো লাগে না।”

“তার জন্য সঠিক সময় প্রয়োজন।”

“আচ্ছা,আচ্ছা সরি।কী হয়েছে প্রহর এর?

মারশিয়াদ ঘটনা খুলে বলতেই ফুঁসলে উঠে নুরাইসা।রাগি গলায় বলল–

“ছিঃ
লোকটা আসলেই শয়তান।একদম প্রহর কে যেতে দিবেন না আপনি।”

মারশিয়াদ মৃদু ছন্দে হেসে বলল–

“তা কী হয় নাকী!

“কেনো?

“সে অন্যের আমানত।আমি তার রক্ষনাবেক্ষনকারী।”

নুরাইসা দুঃখী গলায় বলল–

“যদি আবারো সে এমন করে!

“নাহ।ভুল মানুষ একবারই করে।দ্বিতীয় বার যা করে তা হলো ভুল থেকে নেওয়া শিক্ষার প্রয়োগ।”

“ওকে রেখে দিন না আপনার কাছে।”

“জান ভাইয়া!

প্রহর এর ম্নান কন্ঠে পিছন ফিরে তাকায় মারশিয়াদ।কান থেকে ইয়ারফোন খুলে পকেটে রাখে।ব্যস্ত গলায় বলল–

“আপনি এখানে!
আপনি যান আমি আসছি।”

মারশিয়াদ প্যান থেকে পাস্তা ঢেলে নেয় একটা বাটিতে।প্রহর নীরস গলায় বলল–

“আপনি নুরাইসা আপু কে খুব ভালোবাসেন তাই না!

মারশিয়াদ ম্লান চোখে তাকিয়ে বলল–

“হ্যাঁ।”

প্রহর অস্ফুটিত গলায় বলল–

“সবাই কেনো আপনার মতো হয় না!!

যা মারশিয়াদ স্পষ্ট শুনতে পায়।প্রহর ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

“খেয়ে নিন রেড চিলি।”

প্রহর কোনো কথা না বলে হা করে।মারশিয়াদ নিশ্চল হেসে প্রহর এর মুখে খাবার তুলে দেয়।মারশিয়াদ এর মনে পড়ে ঠিক এইভাবে ইনশিরাহ কেও খাইয়ে দিতো।ওর মনে হলো যেন ছোট্ট ইনশিরাহ বসে আছে।

,
,
“এখন কেমন আছ প্রহর?

বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে মারশিয়াদ নুরাইসার সাথে।

“ভালো।রেস্ট নিচ্ছে।”

“আপনি ওকে আমাদের সাথে নিয়ে চলেন।কোনো দরকার নেই ওই অসভ্য লোকটার কাছে ফিরে যাওয়ার।”

মারশিয়াদ গা দুলিয়ে হেসে উঠে।স্বাভাবিক গলায় বলল–

“আপনাকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয় আমার।রেড চিলি তো পুরাই আউট অফ কন্ট্রোল।”

“আমায় অপমান করা হচ্ছে!

“চেঞ্জ দ্যা টপিক।যা ভবিতব্য তাই ই হবে।
আপনি রাতে ঘুমান না কেনো মিষ্টি?
দিস ইজ ব্যাড হেভিট।”

“আমার রাতে ঘুম আসে না।”

“এইসব চলবে না।এখন থেকে অভ্যাস করেন।আমি রাত জেগে থাকতে পারবো না।”

“এমা, সারারাত ঘুমালে রোমান্স করবো কখন?

“সবকিছুর নির্দিষ্ট সময় থাকে।এর জন্য আপনাকে সারারাত জাগতে হবে না।”

মোবাইল এর অপর পাশ থেকে হি হি করে হাসতে থাকে নুরাইসা।এভাবে চলতে থাকে ওদের কথা।আর তা দুর থেকে দেখছে প্রহর।শান্ত তার দৃষ্টি।
,
,
,
ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেয় কুহেলিকা আজরাহান এর গালে।উত্তেজিত গলায় বলল–

“তুমি এতোটা নিচে নামতে পারো আমি ভাবতেও পারি নি।কী করে পারলে তুমি!

আজরাহান নিরুত্তর,নিরুত্তেজ।নিচের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ঘরের সবাই হতবাক।আজরাহান এমন কাজ করতে পারে তা ভাবনাতীত।সানোয়ার আহমেদ ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে।প্রহর এর ঘর থেকে তটস্থ পায়ে এসে ব্যস্ত গলায় সানায়া বলল–

“মা,প্রহর ঘরে নেই।”

সবাই শ্বাসরুদ্ধ করে তাকিয়ে থাকে আজরাহান এর দিকে।আশফিক ধীর গলায় বলল—

“প্রহর মারশিয়াদ এর কাছে।”

সপ্রতিভ হয়ে সবাই তাকায় আশফিক এর দিকে।আজরাহান প্রজ্জ্বলিত চোখে তাকায়।আশফিক আজরাহান এর দিকে তাকিয়ে বলল–

“মারশিয়াদ নিয়ে আসছে প্রহর কে।দে আর অন দ্যা ওয়ে।”

গাড়ি থেকে নেমে গেটের ভিতর পা রেখে দমকে দাঁড়ায় প্রহর।পেছন ফিরে মারশিয়াদ কে জড়িয়ে ধরে কম্পনরত গলায় বলল—

“আই এম সরি জান ভাইয়া।আই এম রিয়েলী সরি।”

মারশিয়াদ আলতো হাতে প্রহর কে সোজা করে দাঁড় করিয়ে একটু ঝুঁকে মিষ্টি হেসে বলল–

“আমি যা করেছি আপনার ভালোর জন্যই করেছি রেড চিলি।আপনি ভালো থাকবেন।ধৈর্য্য ধরেন।আমি সবসময় আপনার পাশে আছি।”

“আপনি যাবেন না বাসায়?

মারশিয়াদ দুবোর্ধ্য হাসে।ফিচেল গলায় বলল–

“এখন ভিতরে গেলে আপনার রাহান ভাইয়া রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিবে।বাসায় সবাই আছে।আপনি যান।”

প্রহর গুটি গুটি পায়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে।মারশিয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

কুহেলিকা কে দেখেই তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে প্রহর।কুহেলিকা শক্ত গলায় নন্দিতাকে ডেকে প্রহর কে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন।আজরাহান কিছু বলতে যাবে তখন সানোয়ার আহমেদ উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় গলায় বললেন–

“আজরাহান আর প্রহর এর বিয়ে হবে না।”

আজরাহান অস্ফুটভাবে কাতর গলায় বলল–

“বাবা!

সানোয়ার আহমেদ গম্ভীর গলায় বললেন–

“মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য কী জানো!
মনুষ্যত্ব।মনুষ্যত্ববিহীন মানুষ পশুর সমতুল্য।আর কোনো পশুর সাথে আমি আমার মেয়েকে দিবো না।”

“প্লিজ বাবা,আমার কথা তো শুনো।”

“এই বিষয়ে আর কোনো কথা হবে না।”

নিজের ঘরে গিয়ে রাগে ভাঙচুর শুরু করে আজরাহান।আশফিক নির্বিকারভাবে তাকিয়ে আছে।রুষ্ট গলায় আজরাহান বলল–

“দেখলি,দেখলি বাবা কী বললো!

আশফিক ধীম গলায় বলল–

“বড় আব্বু যা বলেছে একদম ঠিক বলেছে।ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ প্রহর।”

আজরাহান ক্ষীপ্র গলায় বলল–

“আশফিক!!

আশফিক ফুঁসে উঠে বলল—

“আমি ঠিকই বলছি।তুই প্রহর এর যোগ্য না।”

আজরাহান ওর রাগ সংযত করে।শান্ত ও নরম গলায় বলল—

“আমি প্রহর কে ভালোবাসি আশফিক।ওকে ছাড়া অামি অন্য কিছু ভাবতে পারি না।”

আশফিক বিদ্রুপপূর্ন হাসে।আর বলল–

“ভালোবাসা !ভালোবাসা !
এই তোর ভালোবাসা।একটা বাচ্চা মেয়েকে শুধুমাত্র রাগের বশবর্তী হয়ে খুবলে খেতে চেয়েছিস!তখন তোর মনে ছিলো না তুই ওকে ভালোবাসিস!

আজরাহান ধুপ করে করে নিচে বসে।তার রাগ কী করে তার ভালোবাসা কে হারিয়ে দিলো!সে পারবে না থাকতে তার রেড রোজ কে ছাড়া।প্রহর কে ছাড়া আজরাহান শূন্য।একদম শূন্য।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here