বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ৩৬

0
4651

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ৩৬
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

হেমন্তের শেষ শীতের শুরু।কনকনে শীত যেনো ধমনীর রক্ত চলাচল স্থির করে দিচ্ছে।শরীরের লোমকূপও যেনো ভয়ে শিউরে আছে।মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা।গুমোট পরিবেশ থমথমে শীত রাজার বেপোরোয়া চলাচল।রাতের ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কারণে আজ সূর্যিমামা তার বদনখানি লুকিয়ে রেখেছে স্নিগ্ধ মেঘের আড়ালে।

শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে আজরাহান।হালকা চোখ ঘুরাতেই দেখে বেড সাইড কাউচের উপর গুটি মেরে বসে আছে প্রহর।গায়ে জড়িয়ে রেখেছে কমফোর্টার।ভেজা চুল দিয়ে পানি পড়ে ভিজে গেছে কোমরের অংশ।তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট আর সাথে দাঁত।অদ্ভুত কিড়মিড় আওয়াজ তাতে।প্রহর কে দেখেই ভ্রু ক্রুটি করে আজরাহান।ব্যস্ত পায়ে প্রহর এর কাছে এসেই ধমকের সুরে বলল—

“গাধি,
ফ্যান ছেড়ে রেখেছিস কেনো?

প্রহর কম্পিত কন্ঠে নরমভাবে বলল—

“দেখছেন না চুল শুকাচ্ছি!

“এই জন্যই বলি মেয়েদের বুদ্ধি মাথায় না হাঁটুতে থাকে।”

প্রহর ভেঙচি কেটে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজেকে আরো আড়ষ্ট করে নেয় কমফোর্টারে।
আজরাহান ফ্যান অফ করে দেয়।ঘরের জানালা গুলো বন্ধ করে বারান্দার থাইটাও লাগিয়ে দেয়।হালকা উষ্ণতা ছড়াতে থাকে বদ্ধ আবহাওয়া।আজরাহান একটা টাওয়েল নিয়ে প্রহর এর ভেজা চুল মুছতে থাকে।

প্রহর কমফোর্টার থেকে নিজেকে বের করে আনে।যেনো খোলস থেকে কচ্ছপ বেরিয়ে আসলো।আজরাহান মৃদু গলায় বলল–

“এভাবে ভেজা চুলে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে রেড রোজ।”

“তাহলে মুছে দিন ভালো করে।”

আজরাহান নাকের ডগা ফুলিয়ে বলল–

“আমি কি তোর চাকর!

“নাহ।আপনি আজাইরা রাহান।”

আজরাহান হাতে থাকা টাওয়েল টা পাশে রেখে প্রহর কে জড়িয়ে ধরে কাউচের উপর শুয়ে পড়ে।প্রহর হকচকিয়ে উঠে।ব্যস্ত গলায় বলল–

“ছাড়েন,ছাড়েন বলছি।”

আজরাহান ফিচেল হেসে বলল-

“ছাড়বোনা।কী করবি!ডাক তোর ছোট মাকে।”

প্রহর চোখ মুখ বিকৃত করে বলল–

“উঠেন বলছি।”

আজরাহান বাঁকা হাসে।ব্যঙ্গাত্নকভাবে বলল—

“ছোট মা,দেখেন রাহান ভাইয়া কী করছে।”

প্রহর এর চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি ছাঁপিয়ে যায়।ক্ষুন্ন গলায় বলল–

“আপনি উঠবেন!কী ভারী!জলহস্তি মনে হচ্ছে।”

আজরাহান প্রহর এর গালে এক কঠিন চুমু খায়।সোজা হয়ে উঠে বসে।বিগলিত হেসে বলল—

“কী সমস্যা তোর!নিজের বরকে কেউ এইসব বলে!

“এসেছেন বর!
এলিয়েন কোথাকার!আরেকটু হলে যেনো আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো!কী খান আপনি!

আজরাহান প্রহর কে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে শক্ত চুমু খেয়ে বলল–

“তোকে খাই।”

প্রহর দাঁত মুখ খিচে নিজেকে আজরাহান থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে।শক্ত গলায় বলল–

“ছাড়েন আমাকে।
আপনার এই জড়াজড়ি করার অভ্যাস আর গেলো না!

আজরাহান দুষ্টমি মিশ্রিত গলায় বলল–

“যাবে কেনো রে!এখন তো আরো বাড়বে।এখন তো আমার কাছে লাইসেন্স আছে।”

“আপনার লাইসেন্স এর খ্যাতায় আগুন।ছাড় আমাকে।”

আজরাহান প্রহরকে ছেড়ে দেয়।হতবিহব্বল প্রহর নিজের কথায় নিজেই লজ্জায় মাথা নিচু করে। আজরাহান প্রহর এর মুখভঙ্গি বুঝতে দেরি করলো না।আজরাহান শান্ত গলায় বলল–

“খিদে পেয়েছে তোর?

প্রহর নিচের দিকে মুখ রেখে মাথা দুবার উপর নিচ করে হা সূচক সম্মতি দেয়।আজরাহান ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে।হতাশ গলায় বলল–

“আগে কেনো বলিস নি!গাধি!

আজরাহান উঠে গিয়ে ওর ড্রয়ার থেকে কিছু ড্রাই ফ্রুট,চকলেট রোল আর চিপস বের করে দেয়।
প্রহর আধ খাওয়া চিপসের প্যাকেট রেখে ড্রাইফ্রুট থেকে বেছে বেছে চেরি ফলের অংশগুলো মুখে পুরে দিচ্ছে।একাগ্রচিত্তে খেয়ে যাচ্ছে প্রহর।
আজরাহান নির্বিকার,নির্ণিমেষ তাকিয়ে আছে তার রেড রোজ এর দিকে।আজরাহান এর মন দর্পণে ভেসে উঠে সেই দুর্বোধ্য প্রবল বর্ষনের রাতে ভয়ে আড়ষ্ট প্রহর সারারাত আজরাহান কে জড়িয়ে ধরেছিলো।ফর্সা মলিন মুখের সেই হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক পড়া প্রহর আজ আজরাহান এর ভালোবাসার প্রহরিনী।অবচেতন মনে অস্ফুটভাবে আজরাহান বলে উঠল–

“প্রহরিনী!

প্রহর সবেই ক্রিম রোলে কামড় বসিয়েছে।চকিতে আজরাহান এর দিকে চোখের কোন সংকোচন করে তাকিয়ে ক্ষীন গলায় বলল–

“হুহ।”

আজরাহান ছোট্ট দম ফেলে শান্ত গলায় বলল–

“কিছু না।”

প্রহর ওর হাতের ক্রিম রোল আজরাহান এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল—

” আপনি খাবেন?

“নাহ।তুই তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।”

“খাওয়া শেষ।আর খাবো না।”

প্রহর হাত ঝাড়া দিয়ে হাতে লেগে থাকা খাবাবের উচ্ছিষ্টাংশ নিচে ফেলে।নিজের জামা ঝাড়া মেরে উঠে দাঁড়ায়।সেন্টার টেবিলের পাশ কাটিয়ে সামনে পা বাড়াতেই আজরাহান ওর হাত ধরে সন্দিহান গলায় বলল—

“কোথায় যাচ্ছিস??

“বাইরে।”

আজরাহান দ্বিধান্বিত গলায় বলল–

“পাগল হয়েছিস!এখন কেনো যাবি বাইরে?
এই অবস্থায় কেউ বাইরে যায়?

“ক্যান,আমি কী চুরি করেছি?

আজরাহান উষ্ণ হেসে প্রহর কে দুই হাতের বন্ধনে নিজের বুকে আবদ্ধ করে।নম্র গলায় বলল–

“করেছিস ই তো।আমার মন।এই তুই এতো মিষ্টি কেনো রে!আমার মিষ্টি পরী।”

প্রহর মুচকি হাসে।থমথমে গলায় আজরাহান এর কথা অনুকরণ করে ব্যঙ্গাত্নক ভাবে বলল–

“তুই এতো মিষ্টি কেনো রে!আমার মিষ্টি পরী।”

আজরাহান হালকা গম্ভীর গলায় বলল—

“তুই বেশি ফাজিল হয়েগেছিস।”

প্রহর পুনরায় আজরাহান কে অনুকরণ করে বলল—

“তুই বেশি ফাজিল হয়েগেছিস।”

আজরাহান চোয়াল শক্ত করে।তীক্ষ্ম গলায় বলল–

“প্রহর!!

প্রহর পুনরায় একইভঙিতে বলল–

“প্রহর!!

আজরাহান টুপ করে প্রহর এর অধরে এক গভীর চুমু খায়।প্রহর কিঞ্চিৎ রাগমিশ্রিত গলায় বলল–

“আজাইরা রাহান!

আজরাহান পুনরায় প্রহর কে গাঢ় চুম্বন করে।আজরাহান মিচকি হেসে ফিচেল গলায় বলল–

“আবার বল।”

প্রহর দুই হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে গমগমে গলায় বলল—

“নাহ।আর বলবো না।কসম আল্লাহর।”

আজরাহান স্মিত হেসে প্রহর এর নাকে নাক ঘষে বলল—

“রসগোল্লা আমার।
তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি।”

প্রহর একগাল হেসে বলল—

“কী?

“ওয়েট মাই লিটল হার্ট।”

আজরাহান ওর কাভার্ড থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে।প্রহর এর হাতে একটা শাড়ি বের করে দেয়। গোল্ডেন পাড় এর অফ হোয়াইট কাঞ্জিবারাম শাড়ি।প্রহর ঝুমঝুম করে হেসে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল–

“এইটা কার জন্যে?

“শেঁওড়া গাছের পেত্নির জন্যে।”

“সেইটা আবার কে?

“আমার বউ।”

“সর আজাইরা রাহান।”

আজরাহান স্মিত হেসে সরস গলায় বলল–

“যা এইটা পড়ে আয়।”

প্রহর চোখ পিটপিট করে উদাস গলায় বলল–

“আমি শাড়ি পড়তে পারি না।”

আজরাহান হালকা ঝুঁকে বলল–

“তুই পড়বি ক্যান!আমি পড়িয়ে দেবো।”

“ইশশ!
শখ কতো!যা আজাইরা রাহান।”

আজরাহান বিগলিত হেসে স্মিত গলায় বলল—

“যা পড়ে আয়।”

“যাচ্ছি।”

আজরাহান প্রহর এর হাতে ব্লাউজ আর পেটিকোট দেয়।প্রহর তা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।প্রায় মিনিট দশেক পর বেরিয়ে আসে প্রহর।সাদা পেটিকোট,ব্লাউজে আরো বেশি শুভ্র লাগছে প্রহর কে।প্রহর এর অস্বস্তিকর লাগছে।কেমন যেনো খালি খালে মনে হচ্ছে।কোনো রকমে বুকের উপর হাত দুটো ক্রস করে রেখে ছোট ছোট পায়ে আজরাহান এর সামনে এসে দাঁড়ায়।আজরাহান নেশার্ত চোখে তাকিয়ে আছে।প্রহর এর শরীরে কম্পন শুরু হয়েছে।হীমবায়ু যেনো পিনপিন করে ওর অস্থিমজ্জায় সূচের মতো বিঁধে যাচ্ছে।আজরাহান ধীর পায়ে এগিয়ে যায় প্রহর এর কাছে।ওর কোমর এর উন্মুক্ত অংশ ধরে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।শীতল পরিবেশে আজরাহান এর শরীরের উষ্ণতায় বেশ লাগছে প্রহর এর কিন্তু সাথে একপসলা লজ্জা এসে ভর করেছে ওর নাকের ডগায়।প্রহর নিম্নমুখী হয়ে তাকিয়ে আছে।আজরাহান ধীর ও নরম গলায় বলল–

“লজ্জা পাচ্ছিস রসমালাই?

প্রহর কোনো প্রত্যুত্তর করলো না।নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে যাচ্ছে।আজরাহান প্রহর এর ঘাড় ছুঁইয়ে কানের কাছে গিয়ে বলল—

“এখন আমার সামনে এতো লজ্জার কী আছে রে!আমিই তো তোর সব।”

“যা খবিশ।”

“তোর খবিশ।”

আজরাহান মিচকি হাসি দেয়।প্রহর এর লজ্জায় গালদুটো লাল হয়ে উঠে।আজরাহান হাতের শাড়িটা নিয়ে হাঁটু ভাজ করে নিচে বসে।প্রহর স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে।শাড়ির প্রথম কোন গুঁজে দিতেই আজরাহান এর নজর পড়ে প্রহর এর সেই পোড়া দাগে।সেখানে হাত লাগাতেই কম্পিত হয় প্রহর।আজরহান শান্ত এবং গভীর গলায় বলল–

“তোকে আমি ডক্টর এর কাছে নিয়ে যাবো।মেডিসিন ইউস করলে এই দাগ ধীরে ধীরে চলে যাবে।”

প্রহর বিদ্রুপপূর্ণ গলায় বলল–

“কেনো!
ভালো লাগছে না আমাকে?

আজরাহান ছোট্ট করে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে।নীরস গলায় বলল–

“আমি কী তোকে তাই বলেছি!
আচ্ছা তোর ইচ্ছে।”

আজরাহান শাড়ি পড়ানোতে মনোযোগ দেয়।প্রহর বলল–

“রাহান ভাইয়া!!

“বল।”

প্রহর স্বাভাবিক গলায় বলল–

“আপনি যে বললেন ওই লোকটা আপনি ছিলেন।কিন্তু উনি তো বৃদ্ধ…..।”

আজরাহান প্রহর এর কথার রেশ ধরে বলল—

“ওইটা ছদ্মবেশ।আমাদের সাথে যারা কাজ করে তারা নিজেরাও জানে না আমরাও তাদের মতো সাধারণ কেউ।”

প্রহর খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।আজরাহান ভ্রু নাচিয়ে ফিকে গলায় বলল–

“হাসিছ কেনো?

“বুড়ো ঢ্যামনা।”

আজরাহান প্রহর এর কোমরে ছোট্ট করে কামড় বসায়।প্রহর ব্যস্ত গলায় বলল–

“অসভ্য লোক।”

আজরাহান শাড়ির আঁচল নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।গাঢ় গলায় বলল–

“এই অসভ্য লোকের সাথেই তোকে সারাজীবন থাকতে হবে।”

প্রহর মৃদু হাসে।আজরাহান আঁচল ভাঁজ করে তা প্রহর এর কাঁধে উঠিয়ে দেয়।সেখান থেকে নিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়।হালকা হেসে বিগলিত গলায় বলল—

“তোকে একদম বউ বউ লাগছে ডিঙি নৌকা।”

আজরাহান প্রহর কে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড় করায়।প্রহর নিম্নমুখী।হৃদয়কোণে ঢেউ খেলছে ওর।প্রহর এর সব স্বপ্নই যেনো আজ দিনের আলোয় জ্বলন্ত প্রদীপ শিখা।যার আলোয় আলোকিত প্রহর এর জীবন।আজরাহান মৃদু গলায় বলল–

“দেখ রেড রোজ,
শুনেছি বিয়ের পর না কি মেয়েরা সুন্দর হয়ে যায়।আজ সত্যি মনে হচ্ছে।এই তুই একদিনে এতো সুন্দর হয়েগেলি কী করে রে।”

প্রহর এর শরীরে অনুরণন শুরু হয়।ধীরে ধীরে অক্ষিপল্লব মেলে তাকায় প্রহর।প্রহর এর চোখ দুটো চকচক করে উঠে।এক ঐন্দ্রজালিক সৌন্দর্য ওর পুরো চেহারা জুড়ে।নিজের মনেই ভাবতে থাকে,সত্যিই কী সে এতো সুন্দর!নাকী তার রাহান ভাইয়ার ছোঁয়ায় তার রূপ তার পসরা সাজিয়েছে।আজরাহান অস্ফুট ভাবে বলল—

“আমার পিচ্চি বউ!

আজরাহান প্রহর কে কোলে তুলে নেয়।প্রহর আজরাহান এর বুকে মুখ লুকায়।আজরাহান ওকে শুইয়ে দেয় বিছানায়।নিজেও ওর পাশে শুয়ে পড়ে।বিছানায় থাকা কমফোর্টার টেনে নেয় দুজনের গায়ে।আজরাহান প্রহর এর গলায় মুখ গুঁজে ওকে জড়িয়ে ধরে।হালকা গলায় প্রহর বলল–

“রাহান ভাইয়া !

আজরাহান মৃদু স্বরে বলল–

“হু।”

“আপনারা এইসব কাজ কেনো করেন!

“কেনো করি জানি না। তবে যদি আমাদের একটু সহায়তায় কারো ভালো হয় তাতে খারাপ কি!

“তাহলে ছোট মা আর ছোট আব্বুকে কেনো বলেন না যে তারা যে মানুষদের এতোটা ভালোবাসে সে অন্য কেউ নয় আপনারা।”

আজরাহান কন্ঠের গাঢ়তা বাড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল–

“পাগল হয়েছিস!এইসব বললে কী তারা আমাদের এইসব কাজ করতে দিবে!
কোনো বাবা মা তার সন্তানদের গায়ে সামান্য আঁচ লাগুক তাতেও শিউরে উঠে।আর এইসব জানার পর কী মা বাবা আমাদের যেতে দিবে না কী!

“এই জন্যই তো ছোট মা আপনাকে আজাইরা রাহান বলে।”

ফিক করে হেসে দেয় প্রহর।আজরাহান একটু মাথাটা উঁচু করে প্রহর এর গালে হাত দিয়ে ঘষা মারে।দৃঢ় গলায় বলল—

“ডরিমন দেখেছিস!নবিতা এক পর্বে বলেছিলো ওর মায়ের বকা না শুনলে না কি ওর ভালো লাগে না।ঠিক তেমন মায়ের মুখে আজাইরা রাহান না শুনলে আমার দিন কাটে না।”

আজরাহান ওর মাথাটা আলগোছে প্রহর এর বুকের উপর রাখে।এক হাতে প্রহর এর চুল নিয়ে তা আঙ্গুলে পেঁচাতে থাকে।আজরাহান স্বাভাবিক গলায় আবার বলল–

“মা আমার সাথে যতই রাগ করুক না কেনো আমি জানি মা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।দেখলি না এতোবড় একটা জঘন্য কান্ড হওয়ার পরও মা আমার একবার বলায় তোর আর আমার বিয়ে দিয়ে দিলো।”

প্রহর নিশ্চুপ।ঘুম ঘুম পাচ্ছে ওর।ঘড়িতে তখন ভোর ছয়টা।রাতে ঠিক মতো ঘুম হয়নি।প্রহর এর কোনো সাড়া না পেয়ে আজরাহান মাথা তুলে দেখে প্রহর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।আজরাহান স্মিত হাসে।বুক ভরে শ্বাস নিয়ে প্রহর এর কপালে চুমু খায়।ওর ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াতেই নড়ে উঠে প্রহর।গোলাপি দুই ঠোঁটে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে আজরাহান এর।আজরাহান সময় নষ্ট করে না।তার সে অধিকার আছে।প্রহর কে ভালো করে জড়িয়ে ধরে আজরাহান।গভীর আশ্লেষে নিজেকে আবদ্ধ করে প্রহর এর অধর সুধায়।
,
,
,
হলজুড়ে মানুষের গিজগিজ।সারারাত ব্যস্ত সময় পার করেছে আজরাহানদের বাড়ির প্রতিটি মানুষ।আজরাহান তার প্রহরিনীতে ব্যস্ত থাকলেও বাড়ির সবাই ব্যস্ত ছিলো ওদের বৌভাত এর আয়োজনে।সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবকিছু ঠিক সময়েই সম্পন্ন হয়েছে।প্রহর আজ হালকা গোলাপী রঙের উপর মাল্টি রঙের ল্যাহেঙ্গা পড়েছে।একদম বারবি ডল লাগছে প্রহর কে।
হেসে হেসে কথা বলছে মারশিয়াদ আর প্রহর।ওদের থেকে বেশ খানিকটা দুরেই দাঁড়িয়ে আছে আজরাহান।ওর পাশেই আশফিক।নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আজরাহান।হাত পা কেমন শক্ত হয়ে আছে।নির্ণিমেষ দৃষ্টি যেনো তার বজ্রকঠোর।আশফিক ওকে দেখে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বলল–

“এখন কী সমস্যা তোর!বিয়ে তো হয়েছে।”

আজরাহান থমথমে গলায় বলল–

“জানি।”

আশফিক তীক্ষ্ম গলায় বলল–

“তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?মারশিয়াদ তোর বউকে নিয়ে যাচ্ছে নাকি!

আজরাহান কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আশফিক এর দিকে।আজরাহান এর কঠোর দৃষ্টিতে নিষ্প্রভ হয় আশফিক।আজরাহান আবারো মারশিয়াদ এর দিকে তাকায়।ম্লান গলায় বলল–

“কেনো যেনো মারশিয়াদ কে প্রহর এর পাশে আমার একদম সহ্য হয় না।মনে হয় ও আমার প্রহরিনী কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবে।মাঝে মাঝে মনে হয় একজন নিউরোলোজিস্ট কে আমার মস্তিষ্কের স্নায়ু গুলো টেষ্ট করতে বলি।আসলে কী সমস্যা তাতে!
মনে হয় পূর্বজন্মে মারশিয়াদ আমার কাছ থেকে আমার প্রহরিনী কে কেড়ে নিয়েছে।”

কথা শেষ করে আজরাহান স্মিত হাসে।ভাবুক মনে
আশফিক তাকিয়ে আছে আজরাহান এর দিকে।আজরাহান এর প্রতিটি কথা আশফিক এর কর্নকুহর হলেও ওর মস্তিষ্কে তা জায়গা করতে পারে না।যেনো আজরাহান এর প্রতিটি কথা ওর কান ছুঁয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
আজরাহান ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে ওদের কাছে।মারশিয়াদ এর কাছে গিয়ে একে অপরের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়।আনম্র গলায় আজরাহান বলল–

“সরি ইয়ার।তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি আমি।”

মারশিয়াদ শান্ত এবং স্বাভাবিক গলায় বলল–

“ভুলে যা ওইসব।আমি কিছু মনে রাখিনি।বাট আমার রেড চিলিকে একদম কষ্ট দিবি না।তাহলে তোর খবর আছে।”

আজরাহান সোজা হয়ে দাঁড়ায়।বিগলিত হেসে বলল–

“কথা দিলাম।তোর রেড চিলিকে আমি সবসময় আগলে রাখবো।”

মারশিয়াদ প্রসন্ন হাসে।শান্ত গলায় বলল–

“রেড চিলি,ভুলে যাবেন না তো আপনার জান ভাইয়া কে?

প্রহর কথা বলে না।কষ্ট হচ্ছে ওর।কাতর চোখে তাকিয়ে আছে মারশিয়াদ এর দিকে।মারশিয়াদ আবার গাঢ় গলায় বলল–

“যাওয়ার আগে একবার আপনার মিষ্টি কন্ঠটা তো শুনি!

প্রহর আহত গলায় বলল–

“এখনই চলে যাবেন?

“হ্যাঁ।নাহলে লেট হয়ে যাবে।”

“আর আসবেন না?

“আসবো না কেনো!আমার রেড চিলির চিল্লার পার্টিকে দেখতে আসবো তো।”

প্রহর লাজুক হাসে।আজরাহান গম্ভীর গলায় বলল–

“আর কয়েকটাদিন থেকে গেলে পারতি।”

“উহু!
মম এর শরীরটা ভালো নেই।আর মিষ্টিকেও দেখতে চেয়েছে।”

একে অপরের চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে ওরা।মারশিয়াদ নির্বিকারভাবে বলল–

“আসি রেড চিলি।ভালো থাকবেন।হ্যাপি ম্যারিড লাইফ।”

মারশিয়াদ হৃদয়হরণ করা হাসি দিয়ে ঘুড়ে পা বাড়ায়।প্রহর নির্ণিমেষ তাকিয়ে আছে।ওর মনে হচ্ছে ওর আপন কেউ ওকে ছেড়ে দুরে বহুদুরে চলে যাচ্ছে।সে কী আর কখনো ফিরবে না!!

হলের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নুরাইসা।চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ।একরাশ ক্লান্তি এসে যেনো ওকে ঝাঁপটে ধরেছে।গতরাতে মারশিয়াদ আর সানায়াকে ওইরকম অপ্রস্তুত মুহূর্তে দেখে টানা তিনঘন্টা নাকের জল আর চোখের জল ঝড়িয়েছে নুরাইসা।
সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখা নুরাইসার মন টা কাঁদা মাটির মতো।এইবয়সের আবেগ আর বিবেক এর পার্থক্য বোঝা বড় মুশকিল।কিন্তু চাইলেই এই কাঁদামাটিকে নিজস্ব রূপ দেওয়া যায়।মারশিয়াদ তার ধৈর্য্য আর বিচক্ষনতার সাথে পুরো ব্যপারটা হ্যান্ডেল করে।মারশিয়াদ এর প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসার দরুন নুরাইসাকে বোঝাতে বেশি বেগ পেতে হয়নি।কিন্ত তবুও নুরাইসার মনের গহীনে এক অজানা উচাটন বারবার কড়া নেড়ে যাচ্ছে।

সামনে সানায়া কে দেখে অপ্রস্তুত হয় নুরাইসা।কপালে দেখা যায় চিন্তার গভীর রেখা।ওকে দেখে পাশ কাটাতে চাইলে সানায়া নুরাইসার হাত ধরে ওকে থামায়।স্বাভাবিক গলায় অনুনয়ের স্বরে বলল–

“আই এম সরি নুরাইসা।”

নুরাইসা কোনো কথা বললো না।চোখের কোন ক্ষীন করে কতক্ষন চেয়ে থাকলো সানায়ার দিকে।সানায়া ফিকে গলায় আবার বলল–

“ক্ষমা করবে না আমাকে?

নুরাইসা গাঢ় গলায় বলল–

“আমার কাছে কেনো ক্ষমা চাইছো!যার সাথে দোষ করেছো তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাও।”

সানায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–

“রেগে আছো এখনো!

ওদের কথার মাঝখানে মারশিয়াদ এসে দাঁড়ায়।সানায়া কে দেখে স্মিত হাসে।অধর ছড়িয়ে সরস গলায় বলল–

“কেমন আছো সানায়া?

মারশিয়াদ এর কথায় সানায়া মাথা নিচু করে ফেলে।এক হাত দিয়ে অন্য হাতের নখ খুঁটতে থাকে।ওর পাশে এসে দাঁড়ায় তারাফ।মৃদু ও দৃঢ় গলায় বলল–

“অপরাধী সে যে নিজের অন্যায় বুঝেও স্বীকার করে না।অনুতপ্ত হওয়ার চেয়ে বড় সাজা হতে পারে না।”

তারাফের দিকে চোখ তুলে তাকায় সানায়া।হৃদয় বিগলিত হাসি দিয়ে তারাফ হ্যান্ডশেক এর জন্য হাত বাড়ায় মারশিয়াদ এর দিকে।মারশিয়াদ তা লুফে নেয়।স্নিগ্ধ ও মোহনীয় কন্ঠে সানায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল–

” আমি তোমাকে বলেছিলাম না আমার চেয়ে ভালো কাউকে পাবে তুমি।হি ইজ দ্যা ওয়ান।”

তারাফ হালকা গলায় বলল–

“থ্যাংক ইউ।”

ধীরে ধীরে সবাই এসে জড়ো হয় ওদের বিদায় জানানোর জন্য।নুরাইসা বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে।এর আগে কখনো এতোদুরে যায়নি সে পরিবার কে ছেড়ে।

ইনশিরাহ ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে মারশিয়াদ এর দিকে।মারশিয়াদ ওর কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে শান্ত গলায় বলল—

” একবার সময় করে এসো।মম যাওয়ার আগে যেনো তোমায় একবার দেখতে পায়।”

ইনশিরাহ মারশিয়াদ কে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠে।সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা যাত্রা শুরু করে ওদের গন্তব্যে।
,
,
,
জানালা পাশে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে একটা শল গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে নির্ণিমেষ নিকষ কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে প্রহর।একটা প্লেন উড়ে যেতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠে ওর মুখ।নির্বিকার ভাবে বলল–

“রাহান ভাইয়া!

আজরাহান কাউচে বসে মোবাইল গুতোচ্ছে।প্রহর এর ডাক শুনতেই অস্ফুট ভাবে বলল–

“বল,আমি শুনছি।”

প্রহর ফিকে গলায় বলল–

“জান ভাইয়া কী আর আসবে না??

আজরাহান শক্ত গলায় বলল–

“ওর দরকার হলেই আসবে।”

প্রহর এর বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে এক শীতল দীর্ঘশ্বাস।জানালা বন্ধ করে আজরাহান এর পাশে গিয়ে বসে।স্মিত গলায় বলল–

“কী দেখেন?

“কিছু না।”

প্রহর ঝট করে আজরাহান এর মোবাইলটা ছিনিয়ে নেয়।দেখে ফ্যাশন আইডলদের ছবি দেখছে।প্রহর ভ্রু কুঞ্চি করে।কী সব উদ্ভট ড্রেস পরা!শরীরের বেশিরভাগ অংশ দৃশ্যমান।প্রহর নাক উঁচু করে বলল–

“ছিঃ
কী দেখেন এইসব।”

আজরাহান অলস ভঙিতে হাত পা ছড়ায়।নম্র গলায় বলল–

“আমি ওদের দেখি নাকী!ওদের ড্রেস দেখি।”

“বেক্কল পেয়েছেন আমাকে!

আজরাহান বিগলিত হেসে বলল—

“আর ইউ জেলাস রসমালাই!

প্রহর শক্ত গলায় বলল—

“মোটেও না।
আপনারা সব ছেলেরাই এমন।মেয়ে মানুষ দেখলে আর হুশ থাকে না।”

“দ্যাটস রং প্রহরিনী।আই এম নট দ্যাট কাইন্ড অফ পিপল।”

প্রহর আজরাহান এর গ্যালারি দেখায় ব্যস্ত।আজরাহান এর গ্যালারী ভর্তি প্রহর এর ছবি।গত তিন বছরের।আজরাহান প্রহর এর কানের কাছে গিয়ে বলল—

“এক রাতেই যে নেশা তুই আমাকে ধরিয়েছিস তা এই জনমে কাটবে নারে রেড রোজ।”

প্রহর কপট রাগ দেখিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল–

“যা খবিশ ব্যাটা।”

আজরাহান ফিচেল হাসে।প্রহর উঠে গিয়ে বিছানায় শোয়।কমফোর্টারটা টান দিয়ে তা গায়ে জড়িয়ে নেয়।আজরাহান উঠে গিয়ে লাইট অফ করে প্রহর এর পাশে শুয়ে পড়ে।কমফোর্টার এর নিচে নিজেকে আবদ্ধ করে প্রহর কে নিজের কাছে টেনে নেয়।প্রহর হাত পা ছোড়াছুড়ি করা শুরু করে।বিরক্তিকর গলায় বলল–

“ছাড়েন আমাকে,ছাড়েন।”

আজরাহান ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল—

“এতো ছাড়াছাড়ি কীসের রে!কাল ফার্স্টনাইট ছিলো তাই অনেক ছাড় দিয়েছি।আজ সব সুদে আসলে উসুল করে নিবো।”

“লুইচ্ছা ব্যাটা ছাড়।”

আজরাহান প্রহর এর ঠোঁটে দীর্ঘ সময় নিয়ে গাঢ় চুমু খায়।ওর গলায়,মুখে অনবরত চুমু খেতে থাকে।আজরাহান এর জোড়াজুড়িতে কিছুক্ষনের মধ্যেই শান্ত হয়ে যায় প্রহর। আজরাহান ধীরে ধীরে তার ভালোবাসার সাগরে ভাসাতে থাকে তার ডিঙি নৌকা কে।

“আমার বৃষ্টিস্নাত ভোরের স্নিগ্ধ রোদের সূর্য তুমি,তোমার আলোয় অবগাহনে সিক্ত হবো আমি।আমার হৃদয়ের গভীরের সর্বগ্রাসী প্রেম তুমি,সর্বনাশী প্রহরিনী,
আমার প্রথম যৌবনের শেষ ভালোবাসা তুমি।”

——তানভি

_________________সমাপ্ত_____________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here