বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ৩৮

0
4431

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর(খন্ডাংশ)
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন প্রহর হঠাৎ টের পায় ঘাড়ের উপর তপ্ত নিঃশ্বাস।তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় উষ্ণ ছোঁয়ার বিচরণ।নিমিঝিমি চোখ দুটো মেলে তাকাতেই দেখে আজরাহান ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
ব্ল্যাংকেট এর ফাঁক দিয়ে হালকা পিনপিনে বাতাসেই শিরশির করে উঠে প্রহর এর শরীর।অন্ধকারেও আজরাহান এর নেশার্ত চোখের ভাষা বুজতে সময় ব্যয় করে না প্রহর।আজরাহান গভীর আশ্লেষে ওর ওষ্ঠদ্বয় ডোবায় প্রহর এর অধরে।মিটিয়ে নিতে থাকে তার তৃষ্ণা।প্রহর বুঝতে পারে আজরাহান কী চায়।শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে আজরাহান কে।আজরাহান তার প্রহরিনীর ভালোবাসায় নিজেকে সিক্ত করায় ব্যস্ত।প্রহর তার রাহান ভাইয়ার ভালোবাসায় সাড়া দেওয়ায় কোনো কার্পণ্য করে না।

গত এক বছরে আজরাহান কে অনেক ভালো করে বুঝতে শিখেছে প্রহর।ছোট্ট প্রহর এর শরীরের সাথে সাথে মনেরও বিকাশ ঘটছে।স্বামীর ভালোবাসার মানে সে একটু একটু বুঝতে শিখেছে।তার রাহান ভাইয়া এখন শুধু তার রাহান ভাইয়াই নয়।তার অর্ধাঙ্গ।তার স্পর্শ মমতার পাশাপাশি আছে এক অদ্ভুত ভালোবাসার ডোর।যা অন্যান্য ভালোবাসার সম্পর্ক থেকেও গভীর।এক সুদৃঢ় বিশ্বাস,ভরসা,পাশাপাশি চলার এক অন্য নাম স্বামী নামক ব্যক্তিটি।পৃথিবীর সকল জড়তা দূর হয় সেই মানুষটির প্রেমময় স্পর্শে।

আজরাহান অনেকটা বদলে গেছে।নিজের অবাধ্য রাগ অনেকটা দমিয়ে এনেছে সে।প্রহর কেও বোঝার যথেষ্ট চেষ্টা করে ।যেহেতু প্রহর এখনো বয়সে অনেকটা ছোট তাই সব ক্ষেত্রেই অনেকটা বিচক্ষণতার সাথেই আগায়।স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যেও ভালোবাসার পাশাপাশি শরীরীয় একটা ব্যাপার আছে তা অগ্রাহ্য করার জো নেই।
প্রহর প্রাপ্ত বয়স্ক না হলেও তার মধ্যেও সে চাহিদা আছে।কিন্তু সেই মাত্রায় আজরাহান একটু বেশিই।তাই বলে নারী ভোগের বস্তু নয়।বিয়ে করলেই যে তার উপর পুরুষের শরীরীয় অধিকার ন্যস্ত হয় তা নয় তাকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখার দায়িত্বও স্বামী নামক ব্যক্তিটির।

শ্রান্ত,পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে রাতের শেষ প্রহরে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় আজরাহান।তার মিষ্টি মায়াময় চেহারা জুড়ে এক মোহনীয় স্নিগ্ধতা।

ভোরের আলো ফুটেছে অনেকক্ষন।মিষ্টি রোদে ধীরে ধীরে প্রলীন হচ্ছে মিহি কুয়াশার চাদর।শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে কাউচে বসে নির্ণিমেষ প্রহর তাকিয়ে আছে আজরাহান এর দিকে।আজ আর আজরাহান উঠবে না।সারা সপ্তাহের এই ছুটির দিনে আজরাহান বেলা দ্বিপ্রহর পর্যন্ত ঘুমের সাগরে ডুবে থাকে।কাউচ থেকে উঠে আজরাহান এর এলোথেলো চুলে আঙ্গুল গলায় প্রহর।মৃদু হাসে সে।

নিচে গিয়ে দেখে সবাই খাওয়ায় ব্যস্ত।নন্দিতা আড়চোখে তাকায় প্রহর এর দিকে।প্রহর এর লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।এই রাহান ভাইয়াটাও না!
ওড়নাটা ভালো করে মাথায় দিয়ে নেয় প্রহর।টেবিলে বসতেই নন্দিতা প্রহর এর কাছে এসে দাঁড়ায়।ওর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো–

“কিরে এতো দেরি করলি যে!
রাতে ঘুম হয়েছে তো ঠিক মতো!

প্রহর অক্ষিপুট প্রশ্বস্ত করে শক্ত হয়ে বসে থাকে।এই ভাবিটাও না!সবসময় হাটে হাঁড়ি ভাঙতে চায়।
খাওয়া শেষে সামানের ঘরে যায় প্রহর।বিছানায় হাত পা নাড়িয়ে খেলছে সামানের দুই মাসের মেয়ে সূর্যি।সামান পাশেই বসে মেয়ের গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে যেন এক মুঠো মেঘ।হাত লাগাতেই মিলিয়ে যায়।নরম পায়ে সূর্যির পাশে গিয়ে বসে প্রহর।প্রহর কে দেখেই অধর ছড়ায় সূর্যি।প্রহর আলতো হাতে সূর্যির গাল টিপে দেয়।একদম তুলোর বল।সামানের দিকে তাকিয়ে নম্র গলায় প্রহর বললো—

“আমি সূর্যি কে নিয়ে যাই বড় ভাইয়া?

সামান স্মিত হেসে কঠিন গলায় বললো–

“এতে জিঙ্গেস করার কী আছে!নিয়ে যা।”

এক হৃদয় কাঁপা হাসি হাসে প্রহর।ব্যস্ত হাতে ক্রোড়ে তুলে নেয় সূর্যি কে।বুকের সাথে একদম মিশিয়ে ধরে।সূর্যিটাও পাকনা।প্রহর এর স্পর্শ অনেক বুঝে।

সূর্যিকে নিয়ে ঘরে এসে দেখে আজরাহান সবে বিছানা থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠেছে।বৃহৎ হাই তুলে বললো–

“কোথায় গিয়েছিলি?

“নিচে।”

আজরাহান হাত বাঁড়িয়ে সূর্যি কে ছুঁতে গেলে প্রহর সরে দাঁড়ায়।নাক উঁচিয়ে বললো–

“ছিঃ!
একদম ছোঁবেন না ওকে।নোংরা লোক।”

আজরাহান ক্ষুন্ন গলায় বললো—

“নোংরামির কি দেখলিরে!

প্রহর ঝাঁঝানো গলায় বললো—

“যান গোসল করে আসেন।”

“ডিঙি নৌকা,তোর দাঁত ভাঙবো আমি।”

“যখন ভাঙবেন তখন দেখা যাবে।এখন যান।”

আজরাহান টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।বেশ কিছু সময় পর বেরিয়ে দেখে প্রহর শুয়ে আছে।উৎসুক গলায় আজরাহান বললো–

“সূর্যি কোথায় রে?

প্রহর শান্ত গলায় বললো–

“ঘুমিয়ে পড়েছে।তাই দিয়ে এসেছি।”

প্রহর হামি দিয়ে পাশ ফিরে শোয়।আজরাহান ওর কাছে এসে ভ্রু কুঁচকে বললো–

“তুই আবার শুয়েছিস কেন??

প্রহর সোজা হয়।বুকের উপর কমফোর্টার টেনে বললো–

“ঘুম পাচ্ছে আমার।”

আজরাহান শক্ত গলায় বলল–

“এতো ঘুম কী করে পায় তোর?

প্রহর ঝট করে উঠে বসে।চোখ,মুখ কুঁচকে ঠোঁট গুজ করে বললো–

“ঘুমাতে দিয়েছেন নাকী আপনি!আজাইরা রাহান।”

আজরাহান প্রহর এর সামনে ওর ভেজা চুল গুলো হাত দিয়ে ঝাঁড়া দেয়।ওর চুলের ছটা পানিতে প্রহর এর পুরো মুখ ভিজে যায়।স্বাভাবিক গলায় আজরাহান বললো—

“সপ্তাহের এই একটা দিন ই পাই।তাও এতো পিশপিশ করিস ক্যান!

“চুপ করেন।যান এখান থেকে।ঘুমাবো আমি।”

আজরাহান উঠে দাঁড়ায়।টাওয়েল দিয়ে চুল ঘষতে থাকে।মিচকি হেসে ফিচেল গলায় বললো–

“তোর তো ভাগ্য ভালো আমার মতো স্বামী পেয়েছিস।আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এখন এক ডজন বাচ্চার মা বানিয়ে ছাড়তো তোকে।”

“আপনার মাথা।”

“তোর মুন্ড।”

“খবিশ আজাইরা রাহান।”

আজরাহান বিগলিত হাসে।চুল শুকিয়ে তা ঠিক করে নেয়।গায়ে একটা মেরুন রঙের শার্ট জড়ায়।প্রহর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।আজরাহান এর ফর্সা শরীরে মেরুন রঙ যেনো কালো আঁধারে উঁকি মারা চাঁদের মতো লাগছে।প্রহর স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলো–

“কোথায় যাবেন?

“এন জিও তে।”

“তারাফ ভাইয়ার সাথে?

“হুম।”

“কখন আসবেন।”

“শিউর না।কেন?

“আপনি তো এখনো কিছু খান নি?

আজরাহান মিষ্টি গলায় বললো–

“আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না রেড রোজ।তুই খেয়ে নিস।আমার আসতে দেরি হবে।”

আজরাহান প্রহর এর কপালে ছোট্ট চুমু খায়।
,
,
,
এনজিও তে গত সপ্তাহে পাঁচজন মেয়েকে আনা হয়েছে।তারা সবাই উপজাতি।মেয়েগুলো তাদের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান এর হাতে লালসার স্বীকার।প্রথমে কেউ মুখ খুলেনি।কিন্তু শেষ বার যখন একটা দশম শ্রেনীর মেয়েকে তার আপন মামার কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে কিনে নিয়ে টানা একমাস শারীরিকভাবে পৈশাচিক অত্যাচার করে তখন মেয়েটি সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে পুলিশের কাছে যায়।আর তখন মেয়েটিকে উল্টো দোষ দিয়ে ভরা গ্রামবাসীর সামনে জীবন্ত আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।

কথাগুলো শুনেই ছলছল করে উঠে প্রহর এর চোখ।আজরাহান প্রহর এর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে কথাগুলো বলছিলো।প্রহর ধরা গলায় বললো–

“রাহান ভাইয়া, আপনি আমার মেয়েকেও বিক্রি করে দিবেন?

আজরাহান ঝপাৎ করে উঠে বসে।প্রহর এর অক্ষিপল্লব ভিজে আছে ওর চোখের নোনতা জলে।আজরাহান তার অঞ্জলি করে প্রহর এর মুখ একটু উঁচু করে ধরে বললো—

“এইসব কী বলছিস তুই!আমার মেয়ে আমার কলিজা।আর আমার কীরে,আমাদের মেয়ে।আমার মেয়েকে আমি আমার মাথার তাজ বানিয়ে রাখবো।
আগে তুই আমাকে বাবা হওয়ার সুযোগ তো দে লিটেল হার্ট।”

প্রহর বিগলিত হাসে।আজরাহান প্রহর এর গালে শক্ত চুমু খেয়ে উষ্ণ গলায় বললো–

“এই,তুই এখনো আমাকে ভাইয়া কেন বলিস।পরে তো আমাদের সোনাই মোনাই আমাকে বাবার বদলে মামা বলে ডাকবে।”

প্রহর ঝুমঝুম করে হেসে উঠে।আজরাহান প্রহর এর গলায় নাক ঘষে স্বাভাবিক গলায় বললো–

“হাসিছ কেন তুই!কষ্ট করবো আমি আর এওয়ার্ড পাবে অন্য কেউ।তা হবে না।”

আজরাহান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রহর কে।ওকে নিয়েই শুয়ে পড়ে বিছানায়।

দরজায় করা নাড়ে নন্দিতা।হালকা উঁচু গলায় বললো—-

  1. “দেবরজি কারেন্ট চলে গেছে।গাজী ট্যাংক খালি।সাবধান!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here