বৃষ্টিস্নাত_রাত্রি পর্বঃ ০৩
লেখকঃ আবির খান
হঠাৎ নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে অবনীর দিকে তাকাতেই আমি স্তব্ধ। কারণ ও খাওয়া রেখে সমানে কাঁদছে। যাকে বলে নিঃশব্দের কান্না। কিন্তু কেন? আমি মুহূর্তেই বিচলিত হয়ে খাবার রেখে উঠে ওর কাছে চলে যাই। ও কেঁদেই যাচ্ছে। না জানি অজান্তে কোন ভুল করেছি কে জানে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছে। তাও নিজেকে সামলে বেশ চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
— অবনী কাঁদছো কেন কি হয়েছে প্লিজ বলো? আমি কি কিছু ভুল করেছি? নাস্তা ভালো লাগে নি? অন্য কোথাও থেকে আনবো? প্লিজ কেঁদো না আমাকে বলো কি হয়েছে?
অবনী ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে বলে,
~ আজ প্রথম পাপা মাম্মিকে ছাড়া এভাবে এতদূর আছি। তাদের ছাড়া নাস্তা করছি। (বলেই আবার কান্না)
অবনী ওর বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। তাই খুব নাজুক একটা মেয়ে বলা যায় ওকে। যখন যা চেয়েছে বাবা-মা তাই এনে দিয়েছে। অনেক আদর সোহাগে বড়ো হয়েছে ও। তাই হয়তো বাবা-মাকে ছাড়া ওর কষ্ট হচ্ছে। আর বাবা-মাকে ছাড়া যে কি কষ্ট সেটা আমার চেয়ে আর কেই বা ভালো বুঝবে। সেই বিশ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছি। আজ দশটি বছর পরও তাদের শূন্যতা আমায় দুর্বল করে দেয়। দশ বছর আগে ৪ এপ্রিল বাবা-মা দুজন গ্রাম থেকে ঢাকা রওনা হন আমার সাথে দেখা করবেন বলে। তখন আমি ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের শেষে। খুব খুশি হয়ে ছিলাম বাবা আসছে আমার কাছে। একসাথে খাবো, কথা বলবো। কিন্তু সেই ভাগ্য আর হইলো না। হঠাৎ বাবার ফোন থেকে কল আসে আর অপরিচিত এক কণ্ঠ বলে উঠে, আমার বাবা-মা দুজন নাকি আর নেই। বাস এক্সিডেন্ট করেছে। বাসের সবাই মারা গিয়েছে। বিশ্বাস করবেন না মনে হলো কি বুকের ভিতরটা মুহূর্তেই দুমড়ে মুচড়ে শেষ। শ্বাস নিতেও পারছিলাম না। পায়ের পাতা আমার শরীরের ওজনও ধরে রাখতে পারে নি। পড়ে যাই আমি মাটিতে। আমার চার কূলে আর কেউই রইলো না। আমাকে কেউ আর বলবে না, নীল কেমন আছিস? নীল খেয়েছিস? নীল ঠিক মতো পড়ছিস তো? নীল! এই নীলের আর কেউই রইলো না৷ কেউই না৷ সেদিন থেকেই জীবন যুদ্ধ শুরু। আপনরা পর হয়ে গেল। আর পর’রা আপনের মতো গলায় হাত দিয়ে পাশে রইলো। মানে আমার বন্ধুরা। আমাকে কয়েকটা টিউশনি খুঁজে দিল ওরা। সেখানে থেকেই অনেক বড়ো আর পরিচিত একজন টিউশনি টিচার হই। আর আজ থেকে চার বছর আগে এই অবনী আমার কাছে রোজ পড়তো। অন্যসব ছাত্রছাত্রীরা সবসময় ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতো। কিন্তু অবনী যতক্ষণ পড়া না বুঝতো কিংবা ওর মন না ভরতো ও পড়তেই থাকতো। যার জন্য ও হয়ে উঠে আমার মোস্ট ফেবারিট স্টুডেন্ট। সেই ছোট্ট অবনী আজ কত্তো বড়ো হয়ে আমার সামনে বসে কাঁদছে। আমি ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি,
— বাবা-মার কাছে যাবে? চলো দিয়ে আসি তাহলে।
অবনী দ্রুত চোখ মুছে না না করে বলে,
~ না না স্যার আমি এখন কোন ভাবেই বাসায় যেতে পারবো না। নাহলে আমাকে ওই খারাপ লোকের সাথে বিয়ে দিবে সিউর।
— আচ্ছা আচ্ছা। শোনো মন খারাপ করো না৷ আমাদের উচিৎ সব পরিবেশেই মানিয়ে নেওয়া। তাহলে জীবনটা অনেক সহজ লাগবে৷ কঠিন কঠিন বিষয় গুলোও দেখবে সহজ লাগছে। বুঝেছো?
~ জি স্যার। এবার আপনি প্লিজ খান। আমার জন্য আবার সমস্যা হলো। সরি।
— আরে একদম না। তুমিও এবার খাও। আর কান্না করো না৷ এত কিউট একটা মেয়েকে কান্নায় একদম মানায় না।
অবনী বেশ লজ্জা পায়৷ চোখ মুখ মুছে চুপচাপ খেতে থাকে। আমিও আর কথা বাড়াই না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ভাবছি কি করবো এখন। হাতে অনেক সময়। অবনীকে দেখলাম চুপচাপ সোফায় বসে আছে। ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো আমারতো ল্যাপটপ আছে। সেটা ওকে দিলে ওর সময় যাবে। আর আমি ফোনে কাজ করতে পারবো। তাই আলমারি থেকে ল্যাপটপটা বের করে ওর সামনে রাখলাম। আর বললাম,
— এই নেও তোমার খেলনা। হাহা। যা দেখতে মন চায় দেখো। আমি একটু অফিসের কাজ করি ওকে?
অবনী খুব খুশি হয়ে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলে,
~ আচ্ছা।
এরপর আমি আমার রুমে চলে আসি৷ আসিফকে একটা কল দি। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার পাশে সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে আছে। ওকে যদি না জানাই অবনীর কথা ও নিশ্চিত ভীষণ রাগ করবে। একটা রিং হতেই ও কল রিসিভ করে।
— হ্যাঁ ভাই বল। কেমন আছিস?
— এইতো আলহামদুলিল্লাহ তুই?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
— এই বাসায় আইসা পর। তোর ভাবী আজকে ভালো মন্দ রান্না করতেছে। আয় একসাথে খাই। এই যে ওই বলছে।…ভাইয়া চলে আসেন চলে আসেন। (আসিফের ওয়াইফ মানে রিনা পাশ থেকে বলছে)
— আজ না রে। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জানাতে তোকে কল দিয়েছি।
— হ্যাঁ হ্যাঁ বল। কোন সমস্যা ভাই?
— না মানে আসলে হয়েছে কি..
এরপর আসিফকে সবটা খুলে বললাম। ও সব শুনে হাসতে হাসতে বলে,
— ভাই তোর সাথে কাহানীটা সিনেমার মতো হয়ে গেল। দেখিস অবনীর সাথে তোর প্রেম ভালবাসা হয়ে যাবে৷ হাহা৷
— ধুর পাগল হইছিস নাকি? আমি ওর থেকে কত্তো বড়ো। এই ত্রিশ বছরের বুড়াকে ও জীবনেও পছন্দ করবে না। আর আমি তো ওর স্যার। ওকে কখনো ছাত্রী ছাড়া অন্য নজরে দেখিনি। সামনেও দেখতে পারবো না৷ এখন তোকে যা বললাম সেটা বল।
— বলছি, শোন তুই যা করছিস ভালোই। একটা অসহায় মেয়েকে সাহায্য করছিস। এখানে খারাপ কিছু না৷ তুই চিন্তা করিস না৷
— অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই৷ যাক তুই খারাপ ভাবে নিস নি শুনে ভালো লাগলো।
— তোর উদ্দেশ্য সৎ। এটাই বড়ো বিষয়। আচ্ছা শোন সন্ধ্যায় আমি আর রিনা আসবো নে তোদের সাথে দেখা করতে। আর খাবারও নিয়ে আসবো নে তোদের জন্য৷ সো রাতের খাবারের ব্যবস্থা করিস না৷
— আরে এমনিই আয় না৷ আবার খাবার আনতে হবে না৷
— চুপ থাকতো। খালি বাইরের খাবার খাস৷ বাসার হাতের রান্নাও খেয়ে দেখ৷ কত বললাম এবার বিয়েটা কর। কিন্তু তুই আমার কথাই শুনিস না। এবার বউ নিজে তোর কাছে হেঁটে আসছে। এবার পালাবি কই! হাহা।
— শালা তুইও না। রাখলাম। সাবধানে আসিস।
— হাহা। আচ্ছা।
ফোন রেখে দিয়ে রুমের বাইরে অবনীর দিকে তাকালাম। মেয়েটা মিটমিট করে হাসছে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে। একদম বাচ্চা একটা মেয়ে। বয়সে বড়ো হলেও মনের দিক থেকে এখনো ওকে বাচ্চা লাগে আমার। অজান্তেই ওকে দেখে হেসে দিলাম। যাইহোক দেখতে দেখতে দুপুর চলে আসে। অনলাইনে খাবার অর্ডার দিয়েছিলাম। সেটা চলেও এসেছে। আমি খাবার রিসিফ করে নামাজের জন্য রেডি হই। তারপর অবনীর জন্য একটা ট্রাউজার আর আমার একটা শার্ট বের করে ওর হাতে দিয়ে বলি,
— আমি তাহলে নামজে যাচ্ছি। তুমি সাওয়ার নিয়ে আপাতত এগুলা পরো। বিকেলের মধ্যে তোমার ড্রেস তো চলেই আসছে। তখন সেগুলো পরে নিও।
~ আচ্ছা।
— তাহলে দরজা লাগিয়ে দেও আমি আসছি।
অবনীকে রেখে নামাজে চলে যাই। নামাজ শেষ করে বাসায় এসে বেল দিতে কিছুক্ষণ পর অবনী দরজা খুলে। আমি ভিতরে ঢুকে অবনীর দিকে তাকাতেই…
চলবে…?
সবার ভালো সাড়া চাই তাহলে খুব তাড়াতাড়ি পরবর্তী পর্ব দেওয়া হবে। আর কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু। আগের এবং পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্ট দেওয়া হবে। ধন্যবাদ।