#বৃষ্টিস্নাত_রাত্রি
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০৭ (শেষ পর্ব)
আমিও ওর হাসি মাখা মুখ দেখে যেই বাসার ভিতরে আসি সাথে সাথে পুরো স্তব্ধ হয়ে যাই। আরে এ আমি কার বাসায় আসলাম! আমি তাকিয়ে দেখি পুরো বাসা ঝকঝক করছে, প্রতিটি আসবাবপত্র একদম নতুনের মতো চকচক করছে। এছাড়া অনেক কিছুর পরিবর্তন দেখছি। যেমনঃ সোফা , টেবিল, টুল, পর্দা ইত্যাদি। এসবের জায়গা পরিবর্তন হয়েছে। সব মিলিইয়ে মনে হচ্ছে নতুন কোন বাসায় এসেছি। আমি অবাক পানে সবটা দেখছিলাম। হঠাৎ অবনী পাশ থেকে আস্তে করে লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
~ কেমন হয়েছে?
আমি প্রচন্ড খুশি হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলি,
– অসম্ভব অসম্ভব সুন্দর হয়েছে। মানে বলার বাইরে । তুমি কিভাবে কি করলে? হাউ?
~ আসলে সারাদিন বাসায় একা একা বসে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম, বাসাটা নিজের মতো করে সাজাই। হয়তো আপনিও খুশি হবেন তাই আর কি। আপনার পছন্দ হয়েছে?
– অনেক অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে। আমি তো নিজের বাসাকেই চিনতে পারছি না৷ আমি সত্যিই অনেক বেশি খুশি হয়েছি । ভেবে ছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু দেখো নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।
অবনী আমার মুখে ওর এত প্রশংসা শুনে যেমন খুশি হচ্ছে তেমনি খুব লজ্জাও পাচ্ছিল। লজ্জায় ওর মায়াবী মুখখানা লাল টুকটুকে হয়ে যাচ্ছিল। আর আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে ওকেই দেখছিলাম। মেয়েটা আমার জন্য কত্তো কিছু করেছে আজ। আমি আবার বললাম,
– আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর একসাথে নাস্তা করবো। তোমার জন্য অনেক কিছু এনেছি।
অবনী খুব খুশি হয়ে বলল,
~ আচ্ছা।
আমি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসি। এসে দেখি অবনী তোয়ালে হাতে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো পু্রো অবাক। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো অবনী আমার বিয়ে করা স্ত্রী। এটা ভাবতেই মনে মনে ভীষন লজ্জা পাই। হায়! এসব কি ভাবছি যা তা। আমি ওর কাছ থেকে তোয়ালেটা নিয়ে ওকে বলি,
– থ্যাঙ্কিউ। কিন্তু তোমাকে এত কিছু করতে হবে না৷ তুমি আমার বাসার মেহমান। তুমি শুধু অর্ডার করবে আমাকে। যা চাইবে এনে দিব৷ তা না করে শুধু শুধু কাজ করো।
~ স্যার আমি মোটেও সে ধরণের মেয়ে না যে এসব করব। এমনিই আপনি আমার জন্য যা করছেন তা অন্য কেউ কখনো করত না। আপনরাই জীবনটা শেষ করে দিচ্ছিল। সেখানে আপনি পর হয়েও অসহায় একটা মেয়ের জীবন বাঁচালেন৷ আমি কি এটুকু আপনার জন্য করতে পারি না?
আমি অবনীর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। মেয়েটার কথাগুলো কত্তো ভারী। একদম বড়োদের মতো কথা বলে। আমি কোন কিছু না ভেবেই ওর কাছে যেয়ে ওর গাল দুটো ধরে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলি,
— তুমি একটা পাকনা বুড়ি বুঝলে? খালি পাকনা পাকনা কথা বলো। আচ্ছা যাও তোমার যা মন চায় করো। ঠিক আছে তো?
কথাটা শেষ হলে আমি অনুভব করি আমি অবনীর খুব কাছে। ওকে ধরে আছি আমি। আমার দুই হাত ওর নরম নরম গাল দুটো ধরে আছে। অন্যদিকে অবনীর চোখে মুখে অসম্ভব লজ্জা। ওর হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে আমাকে এত কাছে পেয়ে। অবনী অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর এ ভাবে তাকানোর মাঝে আমি অনেক কিছু দেখছি। তাহলে কি আসিফ ঠিক বলেছিল? কিন্তু কেন জানি আমি বুঝতে পারছি না। আসলে অবনী কি চাচ্ছে। তাই আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে টেবিলে এসে বসতে বসতে বলি,
— কই আসো আসো। খাবার গুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।
অবনী কোন মতে নিজেকে সামলে আমার সাথে টেবিলে বসে। আমি প্রথমে পিজ্জা বের করে ওকে এক স্লাইস দি আর আমিও এক স্লাইস নি। তারপর দুজনে খেতে শুরু করি। দেখলাম অবনী খুব মজা করে খাচ্ছে। ও হয়তো এসব খেয়েই অভ্যস্ত। আমি ওর সামনে বাকি বক্সগুলো এগিয়ে দিয়ে বললাম,
— এগুলো সব তোমার জন্য৷ একদম লজ্জা করবে না। এই যে আমিও খাচ্ছি কিন্তু।
ও খেতে খেতে লজ্জাসিক্ত মুখখানা নিয়ে মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলে। আমি মুচকি হাসি। তারপর আবার বলি,
— তোমার জন্য সারাদিন চিন্তা হয়েছে। বাসায় একা ছিলে। ভাবছিলাম কি করবে সারাদিন একা একা। এসে তো দেখি তুমি পুরো তুলকালাম করে ফেলেছো। এত কিছু শিখলে কবে? আমি জানতাম ধনী পরিবারের মেয়েরা শুধু টাকা উড়াতে জানে, বসে বসে খেতে জানে। কিন্তু তুমি তো আমার সব ধারণা বদলে দিলে। কিভাবে তুমি এমন হলে বলো তো?
দেখলাম অবনী খুব লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জায় কেমন কেমন জানি করছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— ওমা লজ্জা পাচ্ছো কেন? বলো? লজ্জার কি আছে?
~ আসলে স্যার আমি একজনকে খুব পছন্দ করতাম। ইভেন এখনো করি। তার জন্য আমি নিজেকে বদলে ফেলেছি। কখনো যদি সে আমাকে তার জীবন সঙ্গিনী করে আমি যেন তার সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারি, তার খেয়াল রাখতে পারি, তার একাকিত্বকে দূর করতে পারি তার জন্যই আমি সব শিখেছি।
আমি অবাক পানে অবনীর কথা শুনছিলাম। তার মানে ও কাউকে ভালবাসে। অনেক বেশি ভালবাসে। ঠিক আমার মতো। আমিও কাউকে এমন ভালবেসে ছিলাম। কিন্তু সে আমাকে বাসে নি, আমার হয় নি। আমার হতে চায় নি। অবনী কাউকে ভালবাসে শুনে কিছুটা খারাপ লাগলো। জানি না কেন। আমি সব ভুলে মুচকি হেসে বললাম,
— যাকে এত ভালবাসো সে কি জানে? কখনো বলেছো তাকে? নাকি রিলেশনে আছো?
~ না না রিলেশনে নেই। আসলে কখনো সাহস হয় নি বলার। যখন সাহস কুড়িয়েছি তার আগেই সে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমি আবার তাকে পেয়েছি। ভাবছি এবার বলেই দিব। যা আছে কপালে হবে৷
— বাহ! হুম তাই করো। বেশি দেরি করো না। নাহলে যদি আবার বিয়ে দিয়ে দেয়। আচ্ছা ছেলেটা কি করে? ওর কি বিয়ের বয়স হয়েছে? তোমাকে হ্যাপি রাখবে তো?
অবনী আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
~ স্যার সে অনেক ভালো। সবসময় আমার খেয়াল রাখে, আমার খারাপ সময় আমার পাশে থাকে। আমাকে অনেক সুন্দর করে বুঝায়৷ হুম তার বিয়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু সে কেন জানি বিয়ে করতে চায় না৷ জানি না সে আমাকেও তার করে নিবে কিনা৷ নাকি সে আমাকে কখনো ও ভাবেই দেখেই নি। জানি না আমি কিছু।
— অনেক কম্পলিকেটেড ব্যাপার। চিন্তা করো না। লাগলে আমি ছেলেটার সাথে কথা বলবো। তাকে বুঝিয়ে বলবো। যে তুমি তার জন্য কত্তো কিছু শিখেছো।
আমার কথা শেষ হতেই হঠাৎ অবনী হেসে দেয়। আমি পুরো বোকা হয়ে যাই। ও হাসছে কেন! আমি জিজ্ঞেসও করি।
— কি হলো হাসছো কেন?
অবনী হাসতে হাসতে বলে,
~ আপনার এই কথা গুলো আয়নাকে বইলেন তাহলেই হবে৷ কারণ আমি যাকে ভালবাসি সে আয়নাতে থাকে।
কথা শেষ করেই ও হাসছে। আমি তো পুরো ভয় পেয়ে যাই। কি সাংঘাতিক কথা! তাহলে কি ও কোন ভূতকে ভালবাসে? হায়! হায়! আমি ভরকে যাই ওর কথা শুনে। ওর ভালবাসার মানুষ আয়নার ভিতর কিভাবে থাকবে? আমার মাথায় কাজ করছিল না৷ আমি শুধু ভাবছি আর ভাবছি। আর অবনী মিটমিট করে শুধু হাসছে। অবনী আবার বলে উঠে,
~ আচ্ছা আসুন খাবার গুলো শেষ করি। নাহলে নষ্ট হয়ে যাবে৷
— ওকে ওকে।
আমি খেতে খেতে অবনীর দিকে আড় চোখে তাকাই। কেন জানি ওকে অনেক সাহসী মনে হচ্ছিল। হঠাৎ ওর কি হলো বুঝলাম না৷ এদিকে ওর রহস্যময় কথার জাল আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আয়নার ভিতরে কেউ কিভাবে থাকে? আবার আমার কথা গুলো আয়নাকে বলতে বলেছে। কারণ ওর ভালবাসায় মানুষ আয়নার ভিতর থাকে! নাহ এখানে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। কিন্তু সেটা কি? আমাকে বের করতে হবে৷ অবশ্যই বের করতে হবে৷ আমি গভীর চিন্তায় যখন ডুবন্ত তখন অবনী আমার দিকে মিষ্টি একটা চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থাকে আর খায়। আমি সেদিকে খেয়ালই দেই নি৷ এরপর খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আমি অবনীকে আমার ফোনটা দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করি। আর মাঝে মাঝে ভাবতে থাকি ও ঠিক কি বুঝালো। সেদিন রাতের পর দেখতে দেখতে টানা পাঁচ/ছয় দিন চলে যায়৷ আজ প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল অবনী আমার সাথে। ও এখন আমার সাথে অনেকটা ফ্রী। আগের মতো চেপে চেপে কথা বলে না। আমার সাথে হাসি মজা করে। আমার কাছে ভালোই লাগছিল সবকিছু। তবে একটা সমস্যা হচ্ছিল। আর সেটা হলো আমি অফিসে আসলে ওর সাথে প্রায় দীর্ঘ ৯/১০ ঘণ্টা কোন কথা হয় না। তাই ওকে সারপ্রাইজ দিতে স্যামসাং এর দামী একটা ফোন কিনলাম। সাথে একটা সিমও। আজ ওকে অনেক খুশি করা যাবে৷ হয়তো এই ফোন দিয়ে ও ওর ভালবাসার মানুষটার সাথে কথা বলে সময় পার করতে পারবে। ফোন কিনে বাসায় আসতে আসতে রাত ৮ঃ৪৫ বেজে গেল। সেই বসুন্ধরা থেকে বাসায় এসেছি। উফ! রাস্তায় যা জ্যাম। আমি বেল দিতেই সাথে সাথে দরজা খুললো অবনী। আমি ওর দিকে তাকাতেই স্তব্ধ। অবনীর চোখে পানি! আমি মুহূর্তেই সবকিছু ব্ল্যাংক দেখি। অবনী কাঁদছে কেন? আমি ওকে নিয়ে ভিতরে এসে দরজা লাগিয়ে অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
— একি তুমি কাঁদছো কেন কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে বলো প্লিজ?
অবনী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
~ আপনি এত দেরি করেছেন কেন? জানেন আমি কত ভয় পেয়েছি….এমনি তো সাড়ে ছয়টা সাতটার মধ্যে চলে আসেন। আজকে আট টা বেজে গিয়েছে। আমি কত ভয় পেয়েছি জানেন? কত উলটা পালটা চিন্তা এসেছে মাথায়…এএএ…
আমার ওর কান্না দেখে নিজেরই খুব খারাপ লাগছিল। আসলে ভুলটা আমারই। আগেই ওকে ফোন কিনে দেওয়া উচিৎ ছিল। তাহলে ও এত ভয় পেতো না। আমি ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি,
— সরিইই একদম সরি। আসলে তুমি যাতে আমাকে যেকোন সময় যে কোন প্রয়োজনে কল দিতে পারো সেটারই ব্যবস্থা করেছি। আর এখন থেকে তোমার বোরিং ফিলও হবে না৷ কারণ তোমার জন্য নিয়ে এসেছি দাঁড়াও দেখাচ্ছি…
আমি ব্যাগ থেকে অবনীর জন্য কেনা নতুন ফোনটা বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি,
— এই যে তোমার নতুন ফোন৷ এটা কিনতে গিয়েই দেরি হয়ে গেল। এখন থেকে আমাকে তুমি যে কোন সময় কল দিতে পারবেন। শুধু আমাকে না তোমার ভালবাসার মানুষটাকেও কল দিয়ে কথা বলতে পারবে৷ আমি নতুন সিমও লাগিয়ে দিয়েছি। নেও নেও দেখো পছন্দ হয়েছে কিনা।
অবনী বেশ অবাক হয়ে চোখের অশ্রু গুলো মুছে ফোনটা বের করে দেখে। ও বেশ অবাক হয়ে বলে,
~ এটা তো খুব দামী ফোন৷ আমাকে কিনে দিলেন কেন এত দামী ফোন?
— আমার তো কেউ নেই যাকে কিছু দিব। তাই তুমি যেহেতু আছো তোমাকেই দিলাম। তাছাড়া সারাদিন অনেক কিছু করো তুমি আমার জন্য। বলতে পারো এটা তার জন্যই গিফট করলাম তোমাকে।
~ স্যার আপনি আসলেই একটা পাগল। তবে অনেক ভালো পাগল। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ৷ আপনাকে ফোন দিয়ে সারাদিন জ্বালাবো। হিহি।
— হাহা। তাই নাকি? আচ্ছা জ্বালাইও।
অবনী লজ্জা পায়। লজ্জায় মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলে,
~ যান ফ্রেশ হয়ে আসেন। আমি চা দিচ্ছি আপনাকে।
— আহরে তোমাকে কতো খাটাচ্ছি আমি।
~ স্যার রাগ করবো কিন্তু।
— আচ্ছা আচ্ছা যাও নিয়ে আসো। তোমার হাতের চা আসলেই অনেক মজার। আমার খুব ভালো লাগে।
অবনী খুব মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চলে যায়। আর আমিও ফ্রেশ হতে চলে যাই। অবনীকে কাঁদতে দেখে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন কিছুটা শান্তি লাগছে। সাথে এটা ভেবেও খুশি হলাম যে, এই দুনিয়াতে কেউ একজন আমার জন্য এত চিন্তা করে। আমাকে নিয়ে এত ভাবে। তবে এসব ক্ষণিকের জন্য। আর তিন সপ্তাহ পরই অবনী চলে যাবে৷ ওর ভালবাসার মানুষটাকে বিয়ে করবে৷ সুখে শান্তিতে থাকবে। আর আমি সেই আবার একাকিত্বকে আলিঙ্গন করে নিব। যাইহোক ফ্রেশ হয়ে এসে অবনীর হাতের চা খেলাম। ওর সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। দুজনে অনেক হাসলাম। অবনী নতুন ফোন পেয়ে অনেক খুশি। হঠাৎ ও খুব চুপচাপ হয়ে যায়। আমি চিন্তিত স্বরে বললাম,
— কি হলো চুপ হয়ে গেলে যে?
~ আজ এক সপ্তাহ হলো। পাপা মাম্মি হয়তো অনেক চিন্তায় আছে। অবশ্য আমি চিঠিতে লিখে আসছি যে আমি আমার একটা ফ্রেন্ডের বাসায় থাকবো। আমাকে যেন না খুঁজে। তাও খুব মিস করছি তাদের। একটা কল দিব?
— হুম হুম দেও। বলো তুমি ভালো আছো। দেখো কি বলে।
~ ঠিক আছে। মাম্মিকে কল দি।
— ওকে।
অবনী ওর মাকে কল দেয়। কিছুক্ষণ রিং হতেই ওর মা ফোন রিসিভ করে,
~ হ্যালো কে বলছেন?
~ মাম্মি আমি অবনী….
~ মামনীইইই….কই তুই? কেমন আছিস? আমাদের ছেড়ে কোথায় গিয়েছিস বল? এখনি চলে আয় মা। তোর বাবা আর আমি ভালো নেই তোকে ছাড়া।
~ শান্ত হও আমি অনেক ভালো আছি মাম্মি। তবে তোমাদের অনেক মিস করছি।
~ মা তুই এভাবে বিয়ের আসর থেকে পালালি কেন? একটা বার আমাদের কথা ভাবলি না? আমাদের মান ইজ্জত সম্মান সব শেষ।
~ পাপা কি তোমার পাশে?
~ হ্যাঁ।
~ একটু লাউডে দিবে?
~ দিচ্ছি।
~ পাপা, আমি ইচ্ছা করে পালাই নি। বাধ্য হয়েছি। তোমরা টাকা পয়সা দেখে অন্ধের মতো একটা খারাপ ছেলের হাতে আমাকে দিয়ে দিচ্ছেলে। আমার ফ্রেন্ডরা ছেলেটাকে দেখে এসে বলেছে, ছেলেটার নজর খারাপ, শুধু তাই না সে আমার বান্ধবীদের সাথে খুব খারাপ বিহেভও করেছে। যেই ছেলের বিয়ের আগেই চরিত্র এমন সে কিভাবে আমাকে ভালো রাখবে বলো পাপা? তাই আমি চলে এসেছি। আর হ্যাঁ আমি একজনকে খুব ভালবাসি। সে আমার মন মতো। আমি বিয়ে করলে শুধু তাকেই করবো। তোমরা তাকে খুব ভালো করেই চিনো। তোমাদের খুব পছন্দও ছিল তাকে। আমি আমার বাকি জীবনটা তার সাথেই কাটাবো। কারণ তার মাঝে আমি পাপা তোমার আদর্শ তোমাকে খুঁজে পেয়েছি। আমি খুব তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে তোমাদের কাছে আসবো। তোমরা আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি খুব ভালো আছি। অনেক যত্নে আছি। যেমনটা তোমরা আমাকে যত্নে রাখো।
অবনীর বাবা কিছু বলে না। ওর মা বলে উঠে,
~ মামনী আমাদের উপর রাগ করিস না। আমরা বুঝতেই পারি নি ছেলেটা খারাপ ছিল। তোর বান্ধবীরা আমাদের সব বলেছে। বলনা তুই কোথায়? তুই যাকে বলবি তার সাথেই তোর বিয়ে দিব।
~ আমি যাকে ভালবাসি সেই ছোট থেকে, আমি গত সাত দিন যাবৎ তার সাথে আছি। সে আর কেউ নয় আমার সেই নীল স্যার। আমি ওনাকে বিয়ে করবো পাপা মাম্মি। শুধু ওনাকেই আর কাউকে না।
হঠাৎই অবনীর বাবা বলে উঠেন,
— নীল! ওকে নিয়ে বাসায় চলে আয়। ওর সাথেই তোর বিয়ে দিব আমি যাহ। বাবা হয়ে একবার ভুল করেছি। এবার মেয়ে যা বলবে তাই করবো। তাড়াতাড়ি চলে আয় মা। আর পারছি না আমরা।
~ সত্যি বলছো পাপা? তুমি ওনার সাথে আমাকে বিয়ে দিবে? (অবাক হয়ে)
— হ্যাঁ মা। তোর খুশিতে আমাদের খুশি। আর নীলকে আমি চিনি। ও আসলেই খুব ভালো একটা ছেলে। আমার কোন অবজেকশন নেই।
~ আমরা কালই আসছি পাপা। থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ সো মাচ তোমাদের।
~ হ্যাঁ মা তাড়াতাড়ি আয়।
আমি অবনীর পাশে বসেই ওর কথা শুনছিলাম। হঠাৎ করে ওর এই কথাগুলো শুনে আমি লাফিয়ে উঠি। পুরো স্তব্ধ হয়ে যাই। অবনী ফোন কেটে আমার দিকে লজ্জাসিক্ত মুখখানা নিয়ে তাকায়। আমি এখনো বুঝতে পারছি না এটা কি হচ্ছে। অবনী উঠে একটা ছোট আয়না এনে বলে,
~ বলেছিলাম না আমার ভালবাসার মানুষটা আয়নার ভিতরে থাকে। এই যে দেখুন৷
আমি আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখছি। তার মানে এই সেই আয়নার রহস্য! আবনী তাহলে আমাকেই ভালবাসে? কিন্তু কেন? ও আবার বলে উঠে,
~ আপনার কাছে পড়তে পড়তে কখন যেন আপনাকে ভালই বেসে ফেলি। কিন্তু আপনি হারিয়ে যান। বিয়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মনে হচ্ছিল যদি আপনাকে আবার পেতাম। তাই বিয়ে থেকে পালানোর সাহস পাই। আর ছেলেটাও ভালো ছিল না। ভাগ্যের কি জোর দেখুন? আমার ভালবাসার কাছেই আমাকে নিয়ে আসে। কখনো ভেবেছেন কি? একটা মেয়ে কোন কারণ ছাড়াই কেন একটা ছেলেকে বলবে আমাকে আপনার বাসায় নিয়ে যান? আমাকে আপনার কাছে রাখেন? বলবে না। আমি বলেছি কারণ আমি আপনাকে অনেক ভালবাসি। অনেক মানে অনেক। এই কদিন আপনার এত ভালো ব্যবহার আর আমার প্রতি আপনার কেয়ার দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না৷ আপনার এই একাকিত্ব জীবনের সঙ্গিনী হতে চাই। বলুন না প্লিজ, বানাবেন আমাকে আপনার এই ছোট্ট সংসারের একমাত্র পিচ্চি বউ? বানাবেন?
আমি হাসবো নাকি কাঁদবো? জানি না। চোখের অশ্রু গুলো অজান্তেই বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে। আমি কোন কিছু না ভেবেই অবনীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি,
— কোথায় ছিলে এত দিন? আগে আসলে না কেন? এই সাত দিনে আমিও যে তোমার মায়ায় পড়ে গিয়েছি। কি করবো আমি বলো? এই পিচ্চিটাকে নিজের করা ছাড়া আর কি আছে আমার করার।
~ অনেক ভালবাসি আপনাকে। আমার শুধু আপনাকেই চাই। শুধু আপনাকে।
হঠাৎ আকাশে মেঘের গর্জন। ঠান্ডা একটা বাতাস এসে আমাদের দুজনকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। সে বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ। ঠিক সেদিন রাতের মতো। আমি আর অবনী উঠে বারান্দায় যাই। দুজনে আকাশের দিকে তাকিয়ে একসাথে বলি,
— বৃষ্টি হবে ঠিক সেদিনের মতো।
আমরা একসাথে হেসে দি। অবনী আমার বুকে মাথা রেখে লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলে,
~ এই বৃষ্টিস্নাত রাত্রিটা আপনার বুকের মাঝে লুকিয়ে থেকে পার করতে চাই।
— আমিও তোমার উষ্ণতা অনুভব করে এই অসম্ভব সুন্দর বৃষ্টিস্নাত রাত্রিটা উপভোগ করতে চাই।
~ আসুন তাহলে দুজন হারিয়ে যাই অজানায়….
– সমাপ্তি।
—-> আমাদের জীবনটা বড়ো অদ্ভুত। কখনো কালো মেঘের মতো সবকিছু অন্ধকার করে দেয়। আবার কখনো বেঁচে থাকার নতুন আশার আলো হয়ে সূর্যের মতো চারদিক আলোকিত করে দেয়। নীলের অন্ধকার একাকিত্ব জীবনটা হঠাৎ করেই অবনী এসে আলোকিত করে দিল। আমাদের জীবনে আনন্দ গুলো এভাবেই হঠাৎ করেই আসে। শুধু অপেক্ষা করতে হয় সেই সময়ের। কেমন লেগেছে পুরো গল্পটি অবশ্যই জানাবেন কিন্তু। ধন্যবাদ।
© আবির খান