বৃষ্টিস্নাত_রাত্রি লেখকঃ আবির খান পর্বঃ ০৬

#বৃষ্টিস্নাত_রাত্রি
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০৬
আমার পুরো শরীরের সাথে অবনী এখন মিশে আছে। আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি। ও ভয়ে আমার বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে আমাকে শক্ত করে ধরে আছে। কি হলো এটা! এরকমটা তো হওয়ার কথা ছিল না। এখন কি হবে? যখন ও জানতে পারবে আমি মজা করেছি? একটা ঢোক গিলে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে বললাম,

— চলে গিয়েছে। দেখেছো আগেই বলেছিলাম এখানে থাকা যাবে না, নয়তো তেলাপোকা মহাশয় তোমাকে আরও ঝামেলায় ফেলবে।

আমি কথা শেষ করা মাত্রই অবনী আমাকে ছাড়ার বদলে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আর আস্তে আস্তে করে বলছে,

~ আমার খুব ভয় করছে। এই তেলাপোকাকে আমি ভীষণ ভয় পাই। প্লিজ ওটাকে সরান। প্লিজ…

অবনীর শরীরের নরম স্পর্শ আর ওর উষ্ণতা আমি স্পষ্ট অনুভব করছি। জীবনে প্রথম এমন অসম্ভব সুন্দর কোন কিছু অনুভব করছি। একটা মেয়ের স্পর্শ যে এত টা মধুর হয় জানা ছিল না। আমার জায়গায় হয়তো অন্যকেউ হলে নিজেকে সামলাতে পারতো না। কিন্তু আমার কাছে একটা মেয়ের সম্মান আর তার আমার প্রতি বিশ্বাসটা অনেক বড়ো। তাই আস্তে করে অবনীকে ধরে আমার থেকে ছাড়িয়ে ওর থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে আমার কান দুটো ধরে বলি,

— প্লিজ রাগ করো না। আসলে তেলাপোকা ছিলোই না। তোমাকে সোফা থেকে উঠাতে একটু মজা করেছি। ভাবি নি তুমি এত ভয় পাবে। সরিইইই। এই যে কান ধরে সরিইই।

অবনী অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আর এদিকে আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে আড় চোখে ওকে দেখছিলাম বারবার। মনে মনে ভাবছি ও হয়তো আমার উপর চড়াও হবে রাগ করবে। কিন্তু আমার সব ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ও হঠাৎই অট্টো হাসিতে ভেঙে পড়ে। সেকি তার মন মাতানো হাসি। হাসতে হাসতে ও বলছে,

~ হিহিহি। ইয়াহু ইয়াহু। সবসময় স্যাররা স্টুডেন্টের কান ধরায় আজ আমি স্যারকে কান ধরিয়েছি। কি মজা কি মজা।

অবনী শুধু আমাকে দেখে হাসছে আর মজা নিচ্ছে। আমিও ওর কথা শুনে মুচকি হাসি দিয়ে আস্তে আস্তে কান ছেড়ে দিয়ে লজ্জা পাচ্ছিলাম। আর ওর হাসিটা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। তারপর অবনী আস্তে আস্তে করে আমার একটু কাছে এসে বলে,

~ স্যার আপনাকে অনেক কিউট লাগছিল। হিহি।
— চুপ দুষ্ট। যাও বেডে গিয়ে শুয়ে পড়ো। নাহলে কিন্তু সত্যি সত্যিই তেলাপোকা চলে আসবে৷
~ এএএএ…ভয় দেখান কেন এত? যাচ্ছি তো।
— হাহা। যাও। শুভ রাত্রি। কোন সমস্যা হলে ডাক দিও। সংকোচ করো না৷
~ আচ্ছা৷

অবনী আমার রুমে চলে যেতে নেয়। আর আমি ঘুরে সোফাতে শোয়ার জন্য ব্যবস্থা করছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে অবনী ডাক দেয়।

~ স্যার..

আমি ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলি,

— হুম বলো? কিছু লাগবে?

খেয়াল করলাম অবনীর পুরো মুখখানা লাল টুকটুকে হয়ে আছে। মানে ও ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। ওর লজ্জাসিক্ত মুখখানাও অসম্ভব সুন্দর লাগছে। ও লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে আর চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,

~ আপনার মতো একজন মানুষকে পাওয়া সব মেয়েরই স্বপ্ন। আপনি সত্যিই অনেক ভালো। অনেক অনেক বেশি ভালো। আসি। শুভ রাত্রি।

বলেই ও একপ্রকার লজ্জায় দৌড়ে চলে গেল। আমি মুচকি হাসলাম। নিজের এত প্রশংসা শুনতে ভালোই লাগছে। কিন্তু অবনী এই কথাটা কেন বলল? সব মেয়ের মধ্যে কি ও পড়ে? নাকি ও বাদে? কি জানি। এসব ভাবতে চাই না৷ অবনী আমার জীবনের কয়েকদিনের মেহমান মাত্র৷ ওর খেয়াল রাখা আমার একমাত্র দায়িত্ব। আমার দ্বারা ওর বিন্দু পরিমাণ ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না। একটা মেয়ে আপনাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করলো আপনার কাছে একটু সাহায্য চাইলো। আর আপনি তার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তার ক্ষতি করবেন? এতে করে কি হবে জানেন? আপনি পুরুষ সমাজে কাপুরষ নামে আখ্যায়িত হবেন। আর নারী সমাজ আপনাকে ঘৃণা করবে। তাই কখনোই কোন অসহায় মেয়ের সুযোগ নেওয়া উচিৎ না৷ বরং সে যদি ভুলও করতে নেয় আপনার উচিৎ তাকে থামানো। তার বিশ্বাসটুকু রক্ষা করা। আমি সেটাই করেছি। আর সামনেও তাই করবো। অবনীর কথা ভাবতে ভাবতে সোফায় শুয়ে পড়ি। শুয়ে শুয়ে ভাবছি, এই একাকিত্ব জীবনে আমার সঙ্গী কে হবে? না আছে বাবা-মা, না আছে কোন আত্নীয় স্বজন। কেই বা দিবে আমার মতো অনাথ একটা ছেলের হাতে তার মেয়ে? কেউই না। তাই আসিফ অনেক বার বলার পরও বিয়ের দিকে আমি যাই নি। কারণ আমার দূর্বলতার জন্য যদি আমাকে কেউ আবার রিজেক্ট করে আমি সেটা মানতে পারবো না৷ আজ থেকে কয়েক বছর আগে আমিও কারো প্রেমে পড়েছিলাম। কাউকে অনেক ভালো লেগেছিল। কাউকে অনেক ভালবেসেছিলাম। কিন্তু আমার চার কূলে কেউ না থাকায় সে আমায় না করে দিয়েছিল। আমার হাতটা ধরে বলে নি, নীল আমি আছি তোমার পাশে। আমার শুধু তোমাকেই লাগবে আর কাউকে না। সে এটা বলে নি। তার কাছে আমার পরিবার, টাকা, ধনসম্পদ এগুলো থাকাই মেইন ছিল। সেদিনের পর এই ভাঙা মন আর জোড়া লাগে নি। একাকিত্বকেই আমার জীবন সঙ্গী বানিয়ে নিয়েছি। লাগবে না কারো ভালবাসা, লাগবে না কারো আমার হাত ধরা। আমি একাই ভালো আছি। অনেক ভালো। এসব ভাবতে ভাবতে অনেক ঘুম চলে আসে চোখে৷ কাল সকালে আবার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে৷ তাই নিজের বিষন্নতাকে আর না মনে করে ফোনে এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে যাই।

পরদিন সকালে,

ফোনের এলার্মটা সেই কখন থেকে বেজেই যাচ্ছে। ঘুমের চোখেই ফোনটা খুঁজে এলার্মটা বন্ধ করলাম। তারপর আড়মোড়া দিয়ে আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকাতেই অদ্ভুত কিছু দেখলাম। যেটা আমাকে বেশ অবাক করলো। আর সেটা হলো কাঁথা। আমার গায়ে কাঁথা আসলো কি করে? বাসায় আমি ছাড়া শুধুমাত্র অবনী আছে। তাহলে ও দিয়ে গিয়েছে? হ্যাঁ ও ছাড়া আর কেই বা দিবে! বিষয়টা খুব ভালো লাগলো। বাচ্চা মেয়েটা আমাকে নিয়ে কত্তো ভাবে। ওহ! সরি সরি অবনী মোটেও বাচ্চা না৷ ও অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা সব বুঝে। ওর কথা ভেবে হাসি দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে রুমে উঁকি মেরে দেখি অবনী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই ওকে না ডেকে বাইরে থেকে তালা মেরে নাস্তা আনতে চলে যাই। তাড়াতাড়ি নাস্তা এনে আবার বাসায় চলে আসি। অবনী এখনো ঘুমাচ্ছে। আমি টেবিলে সুন্দর করে নাস্তা বেড়ে অফিসের জন্য রেডি হতে থাকি। রেডি হয়ে পাউরুটিতে জ্যাম লাগিয়ে খেয়ে নি। সকাল সকাল বেশি খেয়ে অফিসে যেতে একদম ভালো লাগে না। তাই অল্পই খাই আমি। নাস্তা করে এবার অফিসে যেতে হবে৷ ঘড়িতে ৯ টা নাগাদ বাজতে চলছে। আমি আস্তে আস্তে অবনীর কাছে গেলাম। দেখলাম ও ঘুমাচ্ছে। ওকে ডাক দিলাম।

— অবনী…. অবনী…

দুটো ডাক দিতেই চোখ মেলে তাকায় ও। আমাকে দেখে দ্রুত উঠে বসে। আর বলে,

~ সরি সরি দেরি হয়ে গেল। আপনি তো পুরো রেডি হয়ে গিয়েছেন৷ ইসসস…আমি কিছুই করতে পারলাম না৷ এখন কি করবো আমি? আপনি নাস্তা করেছেন?
— আহহা! শান্ত হও। হ্যাঁ করেছি। তোমার নাস্তা টেবিলে রাখা আছে। উঠে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিও। আর দুপুরে দারোয়ান চাচা তোমাকে খাবার দিয়ে যাবেনে। আর রাতেরটা আমি এসে ব্যবস্থা করবো। কোন চিন্তা করো না কেমন? নেও এবার দরজাটা লাগিয়ে দেও। আমাকে যেতে হবে। দেরি হচ্ছে। আর আমি আর দারোয়ান চাচা ছাড়া কেউ আসলে ভুলেও দরজা খুলবে না ওকে?
~ ঠিক আছে। সরি আমি এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম। আপনাকেই সব করতে হলো।
— হয়েছে। আসো দরজা দেও।
~ জি। সাবধানে যাবেন কিন্তু।
— আচ্ছা।

এরপর অবনীকে বিদায় দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্য রওনা হই। কিন্তু মনটা কেন জানি বাসাতেই পড়ে রইলো। জানি না কিন্তু কেন জানি ওর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। ঠিক মতো একা থাকতে পারবে কিনা? ফোন ল্যাপটপ কিছুই তো নেই বাসায়। সারাদিন যে ও কি করবে? সেটাই ভাবছি৷ দারোয়ান চাচাকে বলেছি, দুপুরে অনলাইন থেকে খাবার আসলে সেই যেন রিসিভ করে উপরে দিয়ে আসে। তাও চিন্তা হচ্ছে। ও আমার উপর ভরসা করে আমার কাছে আছে। হয়তো সেই ভরসার জন্যই এত চিন্তা হচ্ছে।

অন্যদিকে,

নীল চলে গেলে অবনী দরজাটা লাগিয়ে দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে কতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আর ভাবে সারাদিন কি কি করবে? তার উপর একা বাসায়। একটু ভয় ভয় করছিল। কিন্তু হঠাৎই ওর মাথায় একটা কথা আসে। আর সাথে সাথে ও খুব লজ্জা পায়। মায়াবী মুখে মুচকি একটা হাসি নিয়ে লম্বা ঘন কালো কেশগুলো খোপা করে ফেলে। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তার টেবিলে বসে। দেখে নাস্তার প্লেটের নিচে একটা চিঠি। ও দ্রুত খুশি হয়ে বেশ কৌতূহল নিয়ে চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করে।

— সরি বাসায় কোন ফোন বা ল্যাপটপ কিছুই রেখে যেতে পারি নি। জানি না সারাদিন কি করে সময় কাটাবে। তবে মন খারাপ করো না আমি তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবো। আর কোন সমস্যা হলে নিচে দারোয়ান চাচার কাছে গিয়ে আমাকে কল দিও। তাহলে সে কল দিবে৷ আর হ্যাঁ ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো। মন খারাপ করো না আবার।

অবনী চিঠিটা পড়ে ওর বুকের সাথে সেটা জড়িয়ে ধরে চোখ দুটো বন্ধ করে লজ্জাসিক্ত মুখখানা নিয়ে মুচকি হাসছে। ওর ভিতরে যত ভয় সংকোচ যা ছিল সবই মুহূর্তের মধ্যে নাই হয়ে যায়। নীলের চিঠিটা ওকে অনেক সাহসী করে তুলে। অবনী বেশ মজা করে নাস্তা খেয়ে সুন্দর করে সবকিছু ধুয়ে কিচেনটাও পরিস্কার করে ফেলে। তারপর হাতে চা নিয়ে খেতে খেতে নীলের পুরো বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। ছোট বাসা হলেও বাসাটা অনেক সুন্দর। ঘুরতে ঘুরতে বারান্দায় যায় অবনী। বেশ সুন্দর একটা বারান্দা। বসার জন্য একটা ছোট চেয়ারও আছে। অবনী লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে চেয়ারে বসে। কিন্তু শহরের কোলাহল আর যানবাহনের শব্দ ওর মাথাটা ধরিয়ে দেয়। তাই আর বেশিক্ষণ সেখানে না বসে অনেকটা বিরক্ত হয়ে ও বাসার ভিতরে চলে আসে। এসে চায়ের কাপটা কিচেনে রেখে ও ঠিক করে আজ পুরো বাসাটা ও পরিস্কার করবে। নীলকে অবাক করে দিবে। একদম ওর মন মতো করে বাসাটা সাজাবে ও। অবনী কাজে লেগে যায়। কারণ ওর মনে হচ্ছিল ও এ বাসার নতুন বউ। নীলের বউ। ওর প্রিয় স্যারের স্ত্রী। এসব ভেবে লজ্জায় গুলুগুলু হয়ে যাচ্ছিল অবনী। মনের সুখে গান গাইতে গাইতে কাজ করছিল ও। সত্যিই আজ নীল অনেক অবাক হবে৷ অবনী শুধু নীলের আসার অপেক্ষায় আছে। নীলও খুব অস্থির হয়ে আছে বাসায় আসার জন্য। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। অবনী অধীর আগ্রহ নিয়ে সোফায় বসে নীলের জন্য অপেক্ষা করছে। কখন নীল আসবে? কখনো ওর শূন্য মনটা আবার ভরে যাবে নীলকে দেখে।

আমি দ্রুত কাজ শেষ করে বাসার জন্য রওনা হই। আসার সময় সন্ধ্যার নাস্তার জন্য অনেক কিছু কিনে নেই। যাতে অবনী অনেক খুশি হয়। কিন্তু আমি তো জানি আমাকে খুশি করার জন্য অবনী উল্টো অপেক্ষা করছে। বাসায় এসে মেইন গেইটের সামনে একটা বেল দিতেই অবনী দ্রুত দরজা খুলে। ওর চোখে মুখে ভীষণ উত্তেজনা। আমি ভিতরে ঢুকে সবার আগে ওর হাতে বড়ো একটা পিজ্জার বক্স, সরমা, বার্গার স্যান্ডউইচ এগুলো দি। ও এসব দেখে পুরো অবাক। আমিও হাসি মাখা মুখ দেখে যেই ভিতরে আসি আমি পুরো হা করে তাকিয়ে আছি। আরে এ আমি কার বাসায় আসলাম? আমি তাকিয়ে দেখি…

চলবে…?

সবার ভালো সাড়া চাই তাহলে খুব তাড়াতাড়ি পরবর্তী পর্ব দেওয়া হবে। আর কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু। আগের এবং পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্ট দেওয়া হবে। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here