#বৃষ্টিস্নাত_রাত্রি
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০২
পরদিন সকালে কারো নরম হাতের স্পর্শে আর মিষ্টি কণ্ঠে আমার ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি এ যেন কোন হুর পরী আমার সামনে। না না এ যে অবনী। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব লজ্জাসিক্ত হয়ে আছে। আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো ওর মাঝে হারিয়ে যেত অনেকক্ষণের জন্য। কিন্তু আমি তো সেরকম কেউ না। তাই অবনীকে দেখা মাত্রই তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলাম,
— এখন কেমন আছো? জ্বর আছে কি? তুমি বসো বসো এখানে।
আমি দ্রুত সোফা ছেড়ে উঠে ওকে বসিয়ে দিলাম। ও হয়তো বাঁধা দিতে চাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ওকে আমি বসিয়ে দি। আর পাশ থেকে কাঠের চেয়ারটা টেনে আমিও ওর সামনে বসে গেলাম। এ দৃশ্য দেখে পুরনো সে দিনের কথা মনে পড়ে যায়। আমি এভাবেই অবনীকে পড়াতাম। হয়তো ওরও সেই দৃশ্য মনে পড়ছে৷ তাই ও মাথা নিচু করে কিছুটা লজ্জাসিক্ত এবং স্থির কণ্ঠে বলে,
~ জি স্যার এখন একদম ভালো আছি। আপনি আর চিন্তা করবেন না প্লিজ। এমনিতেই অনেক কষ্ট দিচ্ছি আপনাকে।
— ধুর কি যে বলছো না তুমি। আমার সবচেয়ে পছন্দের এবং ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী ছিলে তুমি। অনেক মেধাবী ছাত্রী তুমি। মাশাল্লাহ। কিন্তু আমি আসলে বুঝতে পারছি না অবনী তোমার এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে আমাকে খুলে বলবে প্লিজ?
আমার কথা শুনে আবনী কিছুটা লজ্জা পেলেও পরমুহূর্তেই ওর সুন্দর মায়াবী মুখখানা কেমন কালো আঁধারে ঢেকে যায়। ও মাথা আরও নিচু করে বলতে শুরু করে,
~ গতকাল আমার বিয়ে ছিল। একটা অচেনা অজানা অপরিচিত ছেলের সাথে। শুধু তাই না বিয়েটা আমার অনিচ্ছায় হচ্ছিল। আচ্ছা স্যার বলুন তো, আমার অনিচ্ছায় যদি বিয়েটা হতো সেটা কি আল্লাহ কবুল করতেন বলেন?
আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম। ও আবার অসহায় কণ্ঠে বলে,
~ এইচএসসি শেষ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পাপা আর মাম্মিকে ওই বজ্জাত ছেলের বাবা-মা জোর দিয়ে ধরে৷ তার ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিবে৷ আমি বাবা-মাকে সাথে সাথে না করি। কিন্তু তারা আমার কোন কথাই শুনে না৷ তাদের কথা একটাই ছেলের পরিবার ধনী সো আমার কোন কষ্ট হবে না৷ আচ্ছা টাকা দিয়ে সত্যিই সুখ পাওয়া যায় যদি মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সব কিছু হয়?
আমি আবারও মাথা নাড়িয়ে না বললাম। অবনী এবার চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে,
~ আমি তাও মেনে নিচ্ছিলাম। কিন্তু আমার বান্ধবীরা আমার কাছে এসে বলে, ছেলে নাকি লুচ্চা। ওদের সাথে কেমন কেমন করে জানি কথা বলেছে। আর চোখের চাহনিও নাকি ভালো না৷ ওরা পরীক্ষা করে আমাকে এসে এসব বলে। এবার বলুন এসব শুনার পর কিভাবে আমি ওই বজ্জাত ছেলের হাতে আমার জীবনটা তুলে দি? তাই আর কোন পথ না পেয়ে পালিয়ে যাই। আমার ভাগ্যটা এতই খারাপ যে হঠাৎ করে মুশলধারায় বৃষ্টি নামে। তাই কোন উপায় না পেয়ে নিজেকে বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে গলির ওখানে দাঁড়িয়ে যাই। কিন্তু কি লাভ বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। আমি ঠান্ডা একদমই সহ্য করতে পারিনা। আপনি গতকাল না আসলে হয়তো আমি মরে…
— আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি। তুমি চিন্তা করো না৷ এখানে তুমি সেইফ আছো।
~ স্যার একটা রিকোয়েস্ট করি?
— হ্যাঁ বলো।
~ আমি কি এখানে কদিন থাকতে পারি? প্রথমে চেয়েছিলাম কোন বান্ধবীর বাড়ি যাবো। কিন্তু পাপা মাম্মি সবার বাসাই চিনে। সেখানে গেলে অনায়াসে আমাকে ধরে ফেলবে। কিন্তু এখানের ঠিকানা কেউ জানে না। তাই আমাকে খুঁজেও পাবে না। আপনি যদি পারমিশন দেন আমি এখানে কদিন থাকবো। সত্যি বলছি আপনাকে কোন ডিস্টার্ব করবো না। আমি এই সোফাতেই ঘুমাবো। আপনাকে কষ্ট করে বসে বসে ঘুমাতে হবে না। আপনি যা বলবেন তাই করবো। শুধু অন্তত একটি মাস এখানে আমাকে থাকতে দিন প্লিজ। (খুব অসহায় কণ্ঠে অনুনয় করে বলল)
আমি অবনীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম,
— তুমি আমার পুরনো দিনের প্রিয় একজন ছাত্রী। আমি যখন খুব খারাপ সময় ছিলাম তোমরাই আমাকে সবচেয়ে বেশি বেতন দিতে। যার জন্য আমার অনেক সাহায্য হতো। তাই সে জন্য আমি তোমাকে এখানে থাকতে দিচ্ছি। অন্যথায় আমি কখনো একজন যুবতী মেয়েকে এখানে থাকতে দিতাম না৷ বুঝেছো?
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই অবনীর আঁধারে ঢাকা মুখখানা আবার হাস্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ও খুব মিষ্টি একটা যাকে বলে মন মাতানো হাসি দিয়ে বলে,
~ অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার৷ আপনি সত্যিই অনেক ভালো। অনেক অনেক ভালো।
আমি অবনীর দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম। মেয়েটা বয়স উনিশ ছুঁয়েছে। তবু কথা, হাব ভাব সেই আগের মতোই আছে। মানে বাচ্চাদের মতো। পরক্ষণেই নজর গেল ওর ড্রেসের দিকে। মেয়েটা আমার জামা পরে আছে। ওর যে অস্বস্তি লাগছে তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। তাই পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে একটা ড্রেসের শপের অনলাইন পেইজে চলে গেলাম। তারপর অবনীর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
— এখানে তোমার যে কয়টা ড্রেস পছন্দ হয় অর্ডার করো। যেহেতু অনেক দিন থাকছো তাই আমার জামা কাপড় পরে আর কতদিনই বা থাকবে বলো? নেও নেও অর্ডার করো।
অবনী লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,
~ স্যার আপনার এত কষ্টের টাকা আমার মতো অধমের পিছনে নষ্ট করবেন?
আমি ওর কথা শুনে হেসে দিয়ে বললাম,
— হাহা। কি যে বলো না৷ আমি আল্লাহ রহমতে এখন অনেক টাকাই আয় করি। কিন্তু আমার টাকা সহজে খরচ হয় না৷ কারণ আমার চার কূলে কেউই নেই। কার পিছনে খরচ করবো? ব্যাংক ভর্তি শুধু টাকা আর টাকা। অবশ্য সামনে একটা নিজের ফ্ল্যাট কেনার ইচ্ছা আছে। তাই বলে তোমাকে চার পাঁচ দশটা ড্রেস কিনে দিলে আমার টাকা কমবে না সিউর থাকো। নেও নেও অর্ডার দেও তো।
অবনী বেশ অবাক পানে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর হয়তো বিশ্বাসই হচ্ছে না কেউ ওর জন্য এমন করবে৷ আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওকে আমার বিকাশ নাম্বার আর পিনটা বলে দিলাম। আর বললাম যা লাগে অর্ডার করে দিও। লজ্জা করো না। বলেই ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। অবনী হয়তো আরও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি সেদিকে না তাকিয়ে চলে আসি। ফ্রেশ হতে হতে ভাবছি, বিষন্ন মাখা এই একাকিত্ব জীবনে এই ছোট মেয়েটা কি ভালো ভাবে থাকতে পারবে? আমি তো সারাদিন বাসায়ই থাকি না। ও কি করবে? একটা টিভিও নেই। তারপর আবার খাওয়া দাওয়া। আমি না হয় যেমন তেমন করে থাকতাম। কিন্তু ওকে তো সেভাবে রাখা যাবে না৷ কি যে করি। ওহ! নাস্তাও তো আনতে হবে৷ তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হই। যাক ভালোই হলো আজ শুক্রবার। নাহলে অনেক ঝামেলা হতো। ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখলাম অবনী চুপচাপ বসে আছে। আমি মুখ মুছে ওর কাছে যেতেই ও মাথা নিচু করে ফোনটা এগিয়ে দেয়। আমি নিয়ে বললাম,
— কি অর্ডার করেছো তো? নাকি আবার করোই নি?
~ না না করেছি। বিকেলের মধ্যে ডেলিভারি দিবে৷
— যাক ভালোই তাহলে। আচ্ছা তুমি বসো আমি নিচ থেকে নাস্তা নিয়ে আসি। নাহলে না খেয়ে থাকতে হবে তোমাকে।
~ সরি স্যার আপনাকে সত্যিই অনেক কষ্ট দিচ্ছি।
— একদমই না৷ তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না। লক্ষ্ণী মেয়ের মতো বসে থাকো। আমি আসছি।
আমি আমার রুমের দিকে চলেই যেতে নিয়েছিলাম হঠাৎই অবনী পিছন থেকে বলে উঠে,
~ স্যার আপনি আমাকে এখনো বাচ্চা মেয়ে ভাবেন তাই না?
— হ্যাঁ। তুমি তো ছোটই। অনেক ছোট। (পিছনে ঘুরে বললাম)
~ ওহ!
অবনী আর কিছু বলল না। মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকে। আমিও কিছু না ভেবে হেসে চেঞ্জ হয়ে নাস্তা আনতে চলে যাই। অবনীকে ভালো ভাবে দরজা লাগিয়ে বসে থাকতে বলি। আমি সিড়ি দিয়ে নিচে আসতেই দারোয়ান চাচার সাথে দেখা হয়। তিনি আর আমি দুজনেই একসাথে সালাম বিনিময় করি। উনি প্রথমেই আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন,
— আপামনি কেমন আছে স্যার?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ওর জন্যই নাস্তা আনতে যাচ্ছিলাম।
— ওহ! আচ্ছা আচ্ছা যান৷
— চাচা শোনেন না।
— বলেন বলেন।
— ও আমার ছাত্রী ছিল আগে। বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিচ্ছিল খারাপ একটা ছেলের সাথে। তাই পালিয়ে আসে। কিন্তু বৃষ্টির জন্য আমাদের এখানে এসে দাঁড়ায়। আর আমার সাথে দেখা হয়ে যায়। এখন ও বলছে এখানে নাকি এক মাসের মতো থাকবে৷ চাচা এখন আমার কি করা উচিৎ বলেন? আপনি তো আমার বাবার বয়সি। আপনি যা বলবেন তাই করবো।
দারোয়ান চাচা হাসি দিয়ে বললেন,
— আপনারে আমি অনেক বছর যাবৎ চিনি। কোন দিন একটা খারাপ গুন আপনার মাঝে দেখি নাই। আপামনি যেহেতু বিপদে পড়ছে সাহায্য করেন। আমি আছি আপনার সাথে। কোন চিন্তা নাই।
— সত্যি বলছেন চাচা?
— জি। এবার যান নাস্তা নিয়ে আসেন।
— আচ্ছা আচ্ছা।
আমি খুব খুশি হয়ে চলে আসি। কারণ আমি যা করছি তা ভুল না৷ অবনী আমার বাসায় থাকলে তেমন কোন সমস্যা হবে না। আজকাল কেউ কারো দিকে ফিরেও তাকায় না৷ যে যার মতো থাকে। আর আমার বাসার বাড়িওয়ালা থাকে অন্য জায়গায়। মাসে মাসে বিকাশের মাধ্যমে ভাড়া পাঠিয়ে দিতে হয়। তাই সমস্যাও হবে না। এরপর নাস্তা নিয়ে বাসায় চলে আসি। একটা বেল দেওয়ার সাথে সাথেই অবনী দরজা খুলে দেয়। মনে হয় অপেক্ষা করছিল ও৷ আমি হাসি দিয়ে ভিতরে ঢুকে টেবিলে নাস্ত রেখে ওকে জিজ্ঞেস করি,
— ফ্রেশ হয়েছো?
~ জি।
— তাহলে আসো নাস্তা খাবে। আমাদের এখানে নাস্তা অনেক মজার। আশা করি ভালোই লাগবে।
~ স্যার আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি বেড়ে দিচ্ছি।
— তুমি পারবে?
~ জি। (লাজুক স্বরে)
— উমমম…আচ্ছা।
আমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি অবনী সত্যিই নাস্তা সুন্দর করে বেড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি বসতে বসতে বললাম,
— দেখেছো মেয়েটা আবার অপেক্ষাও করছে। এই শুরু করো শুরু করো।
আমি আর অবনী খেতে শুরু করি। আজ অনেক দিন পর বাইরের নাস্তা খাচ্ছি। আগে শুক্রবার আমি ১২ টার পর উঠতাম। উঠে সাওয়ার নিয়ে সোজা নামাজে চলে যেতাম। আসার সময় বাইরে থেকে খাবার এনে খেতাম। আজ অনেক দিন পর শুক্রবার এত তাড়াতাড়ি উঠে নাস্তা করতে ভালোই লাগছিল। হঠাৎ নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে অবনীর দিকে তাকাতেই আমি স্তব্ধ। কারণ ও খাওয়া রেখে সমানে কাঁদছে। যাকে বলে নিঃশব্দের কান্না। কিন্তু কেন? আমি মুহূর্তেই বিচলিত হয়ে খাবার রেখে উঠে ওর কাছে চলে যাই। ও কেঁদেই যাচ্ছে। না জানি অজান্তে কোন ভুল করেছি কে জানে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছে। তাও নিজেকে সামলে বেশ চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
— অবনী কাঁদছো কেন কি হয়েছে প্লিজ বলো? আমি কি কিছু ভুল করেছি? নাস্তা ভালো লাগে নি? অন্য কোথাও থেকে আনবো? প্লিজ কেঁদো না আমাকে বলো কি হয়েছে?
অবনী ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে বলে….
চলবে…?
সবার ভালো সাড়া চাই তাহলে খুব তাড়াতাড়ি পরবর্তী পর্ব দেওয়া হবে। আর কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু। আগের এবং পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্ট দেওয়া হবে। ধন্যবাদ।