বৃষ্টি তোমাকে দিলাম পর্ব-১২

0
874

#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-১২

“তুমি আমার সাথে এভাবে বিট্রে করতে পারলে? আমি কত আশা করেছিলাম তোমার সাথে নীল পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট কাঠের ঘরে বাসা বাঁধব? বৃষ্টি এলে বাঁশের মাচায় হাত ধরাধরি করে বসে হা করে বৃষ্টি গিলব? বলেছিলাম তোমাকে আমার স্বপ্নের কথা! তবু তুমি পারলে এমন করতে?”

“কিন্তু আমি কিছু করিনি।”

“করেছ। তুমি রাশিককে বিয়ে করতে চাও সেটা আমাকে আগে বললেই পারতে। বন্ধুত্ব করলে কেন? সময় দিলে কেন?”

“তুমি বন্ধুত্বটাকে অন্যভাবে দেখছ কেন?”

“তুমি গ্রীন সিগন্যাল দিয়েছ তাই।”

“মোটেও না।”

“আমার প্রেমিকার কথা শুনে তবে জ্বলেপুড়ে গেলে কেন?”

“আমি জ্বলিনি। মিথ্যে বলো না।”

“তুমি মিথ্যে বলছ। আমার কাছে, নিজের কাছে। ওই ছেলেটার ক্যারিয়ার দেখে পাগল হয়ে গেছ। আমি কিছু করি না, তাই আমার সাথে প্রেম করা যায় না, আমাকে বিয়ে করা যায় না তাই তো?”

“না। ভুল বুঝছ তুমি।”

“ঠিক বুঝেছি। তুমিও অন্য সব মেয়ের মতোই। আলাদা কিছু নও।”

“এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে!”

“আমার সাথে আর কথা বলতে হবে না। গুডবাই।”

“বর্ষণ শোনো…”

আমি দৌড়াতে শুরু করলাম বর্ষণের পিছু পিছু। সে ঢিমেতালে হাঁটছে। অথচ আমি দৌঁড়েও তাকে ধরতে পারলাম না। হারিয়ে গেল কুয়াশায়।

আমি উঠে বসলাম। জানালা দিয়ে ঘোলাটে আলো আসছে। নীরা আপু ঘুমাচ্ছেন কাঁথা মুড়ি দিয়ে। আমি শীতে অল্প কাঁপছি।

এখন ভরা বর্ষাকাল। অবিশ্রান্ত বর্ষণ হচ্ছে তিনদিন ধরে। আমি ক্লাসে যাই না, ঠিকমতো খাই না, সারাদিন আবোল তাবোল ভাবি আর রাতে ঘুমালেই আজগুবি স্বপ্ন দেখি। এমন নয় যে খুব মানসিক চাপে আছি, তবে কেমন যেন অদ্ভূত অনুভূতির মেঘ সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। বৃষ্টির জলের মতো ঝুপঝাপ করে কী একটা যেন নামতে থাকে মনের জানালায়। কালচে আকাশ আর শীতল হাওয়া মনে বরাবরের মতো ভালোলাগার জন্ম দেয় না, বিষাদের মেঘ ঘনিয়ে আসে আরও। আমি কী চাই? জানি না! এসব আজব স্বপ্ন দেখার মানে কী? কখনো দেখি রাশিক প্রশ্ন করছে, তো কখনো বর্ষণ। দুজনেই নিজ নিজ জায়গায় ঠিকঠাক। সমস্যা আমার মনে। এতকিছুর পরেও আমি মন থেকে সেই সাড়াটা পাচ্ছি না যেটা বহু আগেই পাওয়ার কথা ছিল! নিজের কাছে প্রশ্ন করে করে আমি ক্লান্ত!

ক্লাস টেনে পড়ার সময় আমি জীবনে প্রথমবার প্রেমে পড়েছিলাম। গার্লস সেকশনের ক্লাস শেষ হতো সাড়ে এগারোটায়, বয়েজদের শুরু হতো বারোটায়৷ আমি যখন ছুটির পর বের হতাম, তখন ছেলেটাকে দেখতাম গেটের পাশে বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে। প্রতিদিন চোখাচোখি হতো, একটু করে ভালোলাগা বাড়ত। একদিন আমার বান্ধবীকে দিয়ে খবর পাঠাল, দেখা করলে খুশি হবে। দেখা করলাম প্রথমবার। তারপর আরও কয়েকবার। হাত-ধরাধরি করে ভয়ে ভয়ে হাঁটা। এক কাপে চা খাওয়া ইত্যাদি টুকিটাকি প্রেম চলল। তারপর এসএসি, শহরের দুই প্রান্তের কলেজে ভর্তি আর শেষে তার নতুন প্রেমিকা। সব মিলিয়ে আমার প্রথম প্রেমের ইতি ঘটিয়েছিল এরাই। কিন্তু সেই সময়ে মনের যে একটা টান ছিল, যে আকর্ষণ, যে ভালোবাসা সেটা আর কক্ষনো কারো জন্য আসেনি। না, সেই ছেলের জন্য কোনো অনুভূতি এখন অবশিষ্ট নেই, শুধুই স্মৃতি। কিন্তু অন্য কারো জন্য কেন হবে না?

সেদিন পুরোটা সময় তার চালচলন, কথাবার্তা, সুন্দর চেহারা দেখে আমি বারবার তার প্রেমে পড়ার ব্যর্থ চেষ্টাই শুধু করে গেছি!

আমি রাশিককে ‘হ্যাঁ’ বলে দিতেই পারি! কিন্তু যদি কখনোই তার প্রতি মুগ্ধতার চেয়ে বেশি ভালোবাসার জন্মই না নেয় তবে? সারাজীবন এভাবে কি কাটতে পারে?

রাশিককে বলেছি একটু সময় দরকার। নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে বিয়ের কথা ভাবব। সে রাজি হয়েছে, কিন্তু বলেছে জলদি করতে। কারণ তার বাড়িতে বিয়ের জন্য জোরাজোরি করতে শুরু করেছে।

রাতে কিছু খাইনি। সন্ধ্যায় খুব ঝাল করে বানানো মুড়িমাখা খেয়েছিলাম নীরা আপুর সাথে। তাই আর খেতে ইচ্ছে হয়নি। শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি, হঠাৎ বর্ষণের মেসেজ এলো।

ওর সাথে ঝামেলা মিটে গেছে এখন৷ কথাবার্তা হয় প্রায়ই। আগের মতো সাড়া দেয় না৷ আজ এমন কী হলো যে এত মজার একটা মেসেজ লিখেছে?

“ধারা! তুমি কি বৃষ্টির ধারা নাকি ধারাবাহিক নাটক?”

উত্তর দিলাম, “কী বলতে চাও?”

“কিচ্ছু না। কেমন আছেন ম্যাডাম?”

“যেমন থাকার কথা।”

“খুব জঘন্য? বাড়ি থেকে দূরে কেউ ভালো থাকে না। জানি।”

“সেজন্য না।”

“সেজন্যই। বাড়ি চলে এসো। কতদিন দেখা হয় না!”

“তুমিই তো ঈদে ছিলে না।”

“এবার এসো, থাকব।”

“আসব।”

“ওখানে বৃষ্টি হয়?”

“খুব!”

“এখানেও।”

“বাহ।”

“তোমার কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো শেষ হয়ে গেছে।”

“তা তো হবেই।”

“তোমাদের বাড়িটা মৃত মনে হয় জানো?”

“মা বাবা আছেন তো।”

“তবুও।”

“কী আর করার!”

“তুমি এবার বৃষ্টিতে ভিজেছ?”

“না।”

“এর কোনো মানে হয়? আমি ভিজছি রোজ।”

“জ্বর আসে না?”

“উহু! ভিজতে ইচ্ছে করে না তোমার?”

“জানি না।”

“খুব বেশি বিষন্ন?”

“হুম।”

“মন খারাপের টনিক আছে আমার কাছে।”

“কী শুনি?”

“কী করছ শুনি?”

“শুয়ে আছি।”

“উঠে পড়ো। ভিজতে চলে যাও। দেখবে মন ভালো হয়ে যাবে।”

“পাগল?”

“তা খানিকটা। তবে ট্রাই করে দেখতে দোষ কী?”

“ধুর!”

“আমি ওয়েট করছি ধারা। যাও। এসে মেসেজ দিও।”

ওর পাগলামি বুদ্ধি আমারও কেমন মাথায় চড়ে গেল আচমকা। পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হয়ে এক দৌড়ে চলে গেলাম নিচে। হলের মাঝে গোল চত্বরে কাঠগোলাপ গাছের নিচে সিমেন্টে বাঁধানো বেদীতে গিয়ে বসলাম। বৃষ্টির জল গাছের পাতা চুইয়ে পড়তে পড়তে মিনিটখানেকের মাথায় ভিজিয়ে দিয়ে গেল আমায়। আমি চুপটি করে ভিজতে থাকলাম৷ বৃষ্টির শব্দ বাদে চারদিক নিস্তব্ধ। প্রায় সবাই ঘুমে, আঙ্গিনার বড় বাতিটা ছাড়া প্রায় সব আঁধার। সেটার উল্টোদিকে বসেছি বলে সহজে কেউ দেখবে না আমায়। ঠান্ডা পানির কণাগুলো কাটার মতো বিঁধছিল শুরুতে। এখন অসম্ভব ভালো লাগছে। দাঁতে দাঁত লেগে যাবার অবস্থা, তবু বসে রইলাম। মনের মেঘ বৃষ্টি হয়ে কখন ঝরে গেল টেরই পেলাম না।

আধঘন্টা পর উঠে গোসল করে জামাকাপড় বদলে শুতে গেলাম। বর্ষণ তখনো জেগে। লিখলাম, “ভিজেছি।”

সাথে সাথে উত্তর এলো, “দারুণ! এবার ফিলিংস বলো।”

“খুব খুব ভালো।”

“থ্যাংস দাও।”

“অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

“ফোন করি? কতদিন গলা শুনি না তোমার!”

“করো।”

অনেকদিন পর বর্ষণের গলা শুনে এত ভালো লাগল, বলার মতো না। তবে ভেজার কারনে নাকি ক্ষুধায় কে জানে, ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিল। কখন ঘুমিয়েছি জানি না। সকালে যখন উঠলাম, দেখি বর্ষণ মেসেজ দিয়ে রেখেছে, “জানো ধারা, তুমি হালকা নাক ডাকো। আমি রেকর্ড করে রেখেছি। কী কিউট!”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here