#গল্প
বৃষ্টি_ভেজা_অরণ্য
পর্ব_৪
-শাতিল রাফিয়া
অরণ্য আমার নাম্বার সেভ করে রেখেছে! ইচ্ছে করল ‘ইয়াহু’ বলে চিৎকার করে উঠি! কিন্তু সত্যি সত্যি তো আর সেটা করা যায় না।
জিজ্ঞেস করলাম- কেমন আছেন আপনি?
– ভাল আছি! আপনি বললেন না তো কেমন আছেন?
আমি ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম – আমার মনটা বেশি ভাল নেই!
– কেন? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?
– হুমম। বাবা-মা বকা দিয়েছে!
অরণ্য হেসে বলল – তো কি হয়েছে? আমার মাও তো আমাকে বকা দেয়! আমি কি এজন্য মন খারাপ করে থাকব?
– আর আপনার বাবা?
অরণ্য একটু চুপ করে থেকে বলে- আমার বাবা নেই নিশা! শুনুন, মা-বাবা বকা দিলেও মন খারাপ করবেন না। চিন্তা করবেন আপনি তবুও বকাটা শুনতে পাচ্ছেন। অনেককে কিন্তু এই শাসনটুকু করার জন্য মানুষটাই বেঁচে নেই!
অরণ্যের গলা কেঁপে ওঠে! মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল! ধূর ছাতা! কেন কথাটা জিজ্ঞেস করতে গেলাম!
আমি বললাম- স্যরি! আপনার মনটা খারাপ করে দিলাম!
– না! ইট’স ওকে। আপনার মনটা ভাল হয়েছে তো?
হেসে বললাম – হয়েছে! আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলেন!
– থ্যাংক ইউ। আজ রাখি তাহলে?
– গুড নাইট!
অরণ্য বলল- টেক কেয়ার!
এই দুইদিন পর পর কথা হয় তাও এট্টুখানি! আর এত কম কথায় আমি তাকে দেখা করার কথাও বলতে পারছি না!
অরণ্যের কথা শুনে আমার মনটা আসলেই ভাল হয়ে গেল! আর তাই আমি সকালে উঠে মা-বাবাকে স্যরি বললাম।
মা বলল- শোন কোন বোনই তার বোনের খারাপ চাইবে না। রূপরেখাও চায় না।
– আমি জানি মা।
বাবা জিজ্ঞেস করেন- জান যখন তখন ওভাবে রিঅ্যাক্ট করলে কেন?
– স্যরি!
– ইশতিয়াক (দুলাভাই) আমাদের বলেছে তোমার সাথে কথা হয়েছে। সে বলেছে এই জায়গায় না আগাতে!
আনন্দে আমার সব দাঁত বেরিয়ে গেল- সত্যি!?
মা বললেন – হ্যাঁ তবে তার মানে এই নয় যে আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব। আজ আমি আমার বান্ধবীকে ফোন করব! তার এক আত্মীয়ের ছেলে..
আমি সেই ছেলের কথা শোনার কোন আগ্রহ প্রকাশ করলাম না। আপাকে ফোন করে স্যরি বলতেই সে আবারও খুশিতে ভেউভেউ করে কেঁদে দেয়! আমার আপা যে কি!
পরের একসপ্তাহ আমার অরণ্যের সাথে কোন কথা হল না। তার কারণ তিনটা।
প্রথম কারণ হল- তাকে এভাবে প্রতিদিন ফোন করলে সে আমাকে ছ্যাঁচড়া ভাবতে পারে!
দ্বিতীয় কারণ – আমি দেখতে চেয়েছিলাম তার মনেও আমার জন্য কোন স্থান তৈরি হয়েছে কি না! কিন্তু হয়নি সেটা ভালই বুঝতে পারছি! সে আমাকে একবারও নিজে থেকে ফোন দেয়নি!
আর তৃতীয় কারণ হল- আমি গত একসপ্তাহ গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। দুলাভাই আমাকে এই বুদ্ধি দিয়েছিলেন। ততদিনে আরিফও চলে যাবে। আর গ্রামে নেটওয়ার্কের সমস্যা আছে। তাই অরণ্যকে ফোন দেইনি!
বাসায় ফিরে আমি পরদিন সকালে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের একটা খবর পেলাম! ই-মেইল চেক করে আমি যত জোরে চিৎকার দিলাম আরেকটু হলে পাড়া-পড়শী ডাকাত পড়েছে ভেবে লাঠি নিয়ে ছুটে আসত! অরণ্যদের অফিসে আমার চাকরিটা হয়ে গেছে! নেক্সট মাসে জয়েনিং!
আমি আজ রাতে না পেরে অরণ্যকে ফোন দিলাম।
সে ‘হ্যালো’ বলতেই আমি খুশিতে টগবগ করতে করতে বললাম – জানেন, আমার চাকরিটা হয়ে গেছে!
– ওয়াও! কনগ্র্যাচুলেশন্স!
– থ্যাংকস!
– আপনি তো প্রথম বলেই ছক্কা মেরে দিয়েছেন!
– আমি আসলে ভাবতেও পারছি না এটা সত্যি! আমি একটু পর পর মেইলটা চেক করছি!
অরণ্য বলল- নাম করা একটা কোম্পানিতে প্রথমবারেই পেয়ে গেছেন এটা অনেক বড় ব্যাপার!
আমার একটু খটকা লাগে!
– আপনি কি করে জানেন নাম করা কোম্পানি?
– আমি জানি না। আমি আন্দাজে বলেছি। আপনার উৎসাহ দেখে মনে হয়েছে অনেক নাম করা, ভাল কোম্পানি। বাই দ্যা ওয়ে, কোন কোম্পানি?
এই সেরেছে! কি বলব এখন?
– ইয়ে.. না মানে অত নাম করা কোম্পানি নয়! নামটা হল.. নামটা হল..
– আপনি কোম্পানির নাম ভুলে গেছেন?!
– না না! নাম হল মশিউর গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রি!
এই নামের কোম্পানি আছে। আমাদের বাসার কাছেই একটা সাইনবোর্ডে অ্যাড দেখেছি আমি!
অরণ্য অবিশ্বাস্য গলায় জিজ্ঞেস করে – এই নামে আবার কোন কোম্পানি আছে নাকি?
– আছে তো! নতুন তো! তাই কেউ জানে না তেমন!
– ওকে! দোয়া করি আপনার যেন অনেক বড় জায়গায় জব হয় এরপর! ঠিক আছে আজকে রাখছি।
ফোন রেখে বিরক্ত লাগল! উহহ! এই লোকটা ফোন ধরেই খালি ‘রাখি রাখি’ করতে থাকে! আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করল না যে আমি এতদিন কোথায় ছিলাম? কেন ফোন করিনি?
অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এল! আজ আমার চাকরিতে জয়েনিং! আমি ভোরে উঠেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম! আগেই একটা নতুন ড্রেস বানিয়ে রেখেছিলাম। সেটা পরলাম। নিজের লম্বা লম্বা কোমর ছাড়ানো চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে নিলাম।
মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন – কি ব্যাপার? এত সেজেছিস কি জন্যে? চাকরি করতে যাচ্ছিস নাকি বিয়ে খেতে?
আমি অবাক হয়ে উত্তর দিলাম- শুধুমাত্র আইলাইনার, কাজল আর লিপস্টিক দিয়েছি! বেশি কোথায় সেজেছি?
ভাবী হেসে বলে- বৃষ্টি তোমার আগুনের মত চেহারা! একটু সাজলেই মনে হয় অনেক সেজেছ! আর আমি তো ভাবছি আজ তোমাকে দেখে অফিসের কাজকর্ম না থেমে যায়!
– যাও ভাবী! তোমার যে কথা!
অফিসে পৌঁছে আমি আমার কাগজপত্র নিয়ে রিসিপশনে কথা বললাম। আগের দিনের মত আজও আমাকে তিনতলায় পাঠিয়ে দিল। সেখানে রিসিপশনে কথা বললে মেয়েটি ফোন করে কাকে যেন ডাকে।
একটুপর আমি একটা মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখি। মেয়েটাকে আমি চিনতে পারলাম। এটা সোনিয়া! সেদিন অরণ্যদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। আমার থেকে তিন চার বছরের বড় হবে।
সে এগিয়ে এসে হেসে বলে- আমার নাম সোনিয়া। আপনি?
– আমি বৃষ্টি.. বৃষ্টিলেখা!
– ওয়াও! বিউটিফুল নেইম!
– থ্যাঙ্কিউ!
– আসুন। আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে।
কাজ বুঝতে বুঝতে সোনিয়ার কাছ থেকে জানতে পারলাম এই ডিপার্টমেন্টে দুইজন নতুন মানুষ নেওয়া হয়েছে। একজন জয়েন করবে না। বাকি আমি জয়েন করেছি। এছাড়াও পুরো অফিসের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে অনেক নতুন এমপ্লয়ি নেওয়া হয়েছে।
সবচেয়ে খুশি লাগল তার শেষ কথাগুলো শুনে- আপনার রিপোর্ট করতে হবে সরাসরি অরণ্য স্যারের কাছে। মানে আমাদের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ম্যানেজারের কাছে। স্যার একটুপরেই আপনাকে ডাকবেন। আমাকে বলেছে যেন আগে সব বুঝিয়ে দেই। আর তখন স্যারই আপনাকে সবার সাথে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দেবেন।
– ঠিক আছে।
– আর আজকে তো প্রথম। সব দেখুন। কাজ বুঝুন। প্রথমদিকে একটু কঠিন লাগতে পারে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
অরণ্য আমাকে একটুপর ডাকবে এটা শুনেই আমার অস্থির লাগছে! ছটফট করছি! উল্টাপাল্টা না কিছু বলে ফেলি! আচ্ছা সে বুঝে যাবে না তো যে আমিই নিশা! কি হবে তাহলে? এই বিষয়টা তো আগে ভেবে দেখিনি।
আমি আমার সিটে বসলাম। সোনিয়া চলে গেল।
মিনিট দশেক পরেই আবার ফিরে এসে বলে- স্যার ডাকছেন। আসুন।
– আ..আমাকে?
সোনিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে – হ্যাঁ! কিন্তু আপনি এরকম নার্ভাস হচ্ছেন কেন?
– না মানে..
– স্যারকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। স্যার খুবই হাসিখুশি। রাগারাগি, বকাঝকা করেন না। তবে হ্যাঁ বেশি রেগে গেলে আবার ঝামেলা হয়ে যায়! আসুন।
আমার হার্টবিট বেড়ে গেল! মনে হচ্ছে এখন অতি এক্সাইটমেন্টেই মরে যাব!
সোনিয়া আমাকে অরণ্যের রুমের সামনে নিয়ে আসে। ওমা! এটা তার রুম?! তার রুমটা আমার বসার ওপেন স্পেস থেকে সরাসরি দেখা যায়।
দরজা নক করে সোনিয়া জিজ্ঞেস করে- স্যার আসব?
ভেতর থেকে সেই বিখ্যাত গলার আওয়াজ পেলাম যেই কণ্ঠ শুনে আমি আজ এখানে!
– হ্যাঁ আসুন।
সোনিয়া ভেতরে ঢুকে আমাকে বলে- আসুন।
আমি ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকি! ইশশ! এতদিন তাকে দেখার জন্য চোখ দুটো ছটফট করেছে। আজ সে আমার চোখের সামনে বসে আছে। আমি এখন দিনের অর্ধেকটা সময় তার কাছাকাছি থাকব!
অরণ্য আমার দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করে – কেমন আছেন?
প্রথমেই এরকম কোন প্রশ্ন আমি আশা করিনি! আমার প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে! এদিকে সোনিয়া আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেছে!
অরণ্য বলল- বসুন।
আমি বসে বললাম – ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
– ভাল আছি। কেমন লাগছে নতুন অফিস?
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই তার ফোনটা বেজে ওঠে! সে রিসিভ করে একটু গম্ভীর হয়ে যায়!
বলে- আচ্ছা স্যার। আমি দেখছি!
এরপর সে আবার আমাকে বলে- নামটা যেন কি বলেছিলেন?
– বলিনি এখনও। আমার নাম বৃষ্টিলেখা।
– ওকে বৃষ্টিলেখা। আপনার মেইন কাজ আগামীকাল থেকে শুরু হবে। এখন আমি কয়েকটা রুলস আর কয়েকটা বিষয় আপনাকে বুঝিয়ে দেই। আপনি আগামীকাল আমাকে সেগুলোর ওপরে রিপোর্ট দেখাবেন। আর যেকোন সমস্যায় অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন। ওকে?
আমি বললাম- ওকে।
আমি আগেই ঠিক করে এসেছি আমি অরণ্যকে জীবনেও ‘স্যার’ বলে ডাকব না! তাই ডাকলামও না।
অরণ্য আমাকে কয়েকটা বিষয় বুঝিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু আমি গালে হাত দিয়ে শুধুমাত্র তার দিকে তাকিয়ে আছি! তার কথা আমার কানে বাজছে কিন্তু মাথায় ঢুকছে না! আহা! এই মুহূর্তটা যদি থমকে যেত! এত সুন্দর একটা মুহুর্ত!
সিনেমায় মাঝেমধ্যেই দেখি নায়ক নায়িকার প্রেম হলে আশেপাশে মিউজিক বাজতে থাকে! আমার সত্যি সত্যি সেরকম মনে হচ্ছিল!
একসময় লক্ষ করি অরণ্য জিজ্ঞেস করে – বুঝতে পেরেছেন!
– জ্বি! বুঝতে পেরেছি!
অরণ্য হেসে বলে- ওকে। তাহলে বলুন সেকেন্ড যেই রিপোর্টটা করতে বলেছি সেটা কিসের ওপর আর কি করে রেডি করবেন?
তার প্রশ্ন শোনার সাথে সাথে আমার আশেপাশের মিউজিক বন্ধ হয়ে গেল! তার কারণ আমি তো আসলে মন দিয়ে শুনিনি! তাকে দেখছিলাম! কি যেন বলেছিল?
আমি বললাম – ইয়ে..ওইটা..
অরণ্যের দিকে তাকিয়ে আমি তা যাও একটু মনে করেছিলাম তার সবকথা ভুলে গেলাম! সে সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে!
অরণ্য মৃদু হেসে বলে- বৃষ্টিলেখা, আমি চাকরি করছি প্রায় পাঁচ বছর। এতদিনে এটুক বুঝে গিয়েছি কে মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে, আর কে শুনছে না! আর আপনি যে কথা শুনছিলেন না মন দিয়ে সেটা আপনাকে দেখে আমি ভালই বুঝতে পেরেছি। আর এইজন্যই প্রশ্নটা করেছি!
আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি! ছি ছি! প্রথমদিনে ফার্স্ট ইমপ্রেশনে আমি আমার প্রেস্টিজের ফালুদা বানিয়ে ফেললাম!
অরণ্য বলে- আজকে প্রথমদিন। ইট’স ওকে বাট এরপর থেকে দয়া করে আমি ব্রিফিং দেওয়ার সময় নিজের মনটাকে আমার কথার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখবেন!
আমি মাথা নিচু করেই বললাম – স্যরি!
অরণ্য বলে- ইট’স ফাইন! আসুন!
মানে আমার মন চাইল নিজেই নিজেকে ঘুষি মেরে বসি! সাথে প্রচন্ডরকম কান্না পেল! কান্না চেপে রাখতে রাখতে আমি কোনমতে তার রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। ওয়াশরুমে ঢুকে কিছুক্ষণ কেঁদেও নিলাম! এরপর চোখমুখ ভাল করে ধুয়ে মনে মনে ঠিক করলাম আমি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেই ছাড়ব অরণ্য।আমিও দেখব কতদিন তুমি নিজের অরণ্যে লুকিয়ে থাক! এই বৃষ্টিতে তোমাকে ভিজতেই হবে!
[চলবে]