#গল্প
বৃষ্টি_ভেজা_অরণ্য
পর্ব_৫
-শাতিল রাফিয়া
কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকজনের সাথে আলাপ হল। তাদেরকে বেশ ভাল মনে হল। সবাইকে স্বতঃস্ফূর্ত লাগল।
অথচ এখানে জয়েন করার আগে ভাইয়া বলেছিল- হু হু..যা চাকরিতে। তারপর দেখবি মজা কাকে বলে! কম্পিটিশন এভ্রিহোয়ার! কেউ দেখবি সাহায্য করবে না! মুখে মধু অন্তরে বিষ! তাই বলেছিলাম আরও কয়েকদিন পর ঢোক। মাস্টার্স করে নে! তা না!
আমার কাউকেই মনে হল না তাদের মুখে মধু অন্তরে বিষ! কিংবা কে জানে! হতেও পারে! অন্তরেরটা তো আর আমি দেখতে পারছি না!
একটুপর সোনিয়া এসে বলে- আসুন কনফারেন্স রুমে।
আমি তার সাথে তার পেছনে পেছনে কনফারেন্স রুমে গেলাম। অনেকেই আগে পৌঁছে গেছে দেখলাম। অরণ্যকেও দেখালাম।
সবাই যাওয়ার পর অরণ্য একজনকে জিজ্ঞেস করে – এসেছে সবাই?
– জ্বি স্যার।
অরণ্য উঠে দাঁড়িয়ে বলে- আমাদের নেক্সট প্রজেক্টের ব্রিফিং শুরু করার আগে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। আপনারা অনেকেই নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে তার সাথে পরিচিত হয়েই গেছেন। তারপরও আমি চাই উনি নিজে এসেই উনার পরিচয় দিন।
এরপর সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে- বৃষ্টি প্লিজ আসুন!
আহা! সে এমনভাবে আমাকে ‘বৃষ্টি’ বলে ডাকল যেন কতদিনের পরিচয়! মনটা একেবারে ভরে গেল!
আমি সামনে দাঁড়িয়ে বললাম – আসসালামু আলাইকুম। আমি বৃষ্টিলেখা হক। অনেকের সাথেই এরমধ্যে কথা হয়েছে। আমার কাজ আগামীকাল থেকে শুরু করার কথা। আমি সবার সহযোগিতা কামনা করছি। থ্যাংকস সবাইকে।
হাততালির মধ্যে আমি আমার সিটে গিয়ে বসলাম। এরপর অরণ্য তার বক্তব্য শুরু করে। এবার তার কণ্ঠ আর চেহারায় আত্মভোলা হয়ে গেলাম না। সে কি কি বলছে ভাল করে শুনলাম। কিন্তু এবার সে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না।
মিশ্র এক অনুভূতি নিয়ে আমি বাসায় গেলাম। নিশা এসে প্রায় হামলে পড়ল কি হয়েছে জানার জন্য।
সব শুনে নিশা বলে- আচ্ছা বৃষ্টি একটা কথা বল তো! এই যে অরণ্যের সাথে এখন থেকে কাজ করবি, সে তোর কণ্ঠ চিনে যাবে না?
আমি চিন্তিত মুখে মাথা নেড়ে বললাম- হ্যাঁ সেটাই ভাবছি!
– তার থেকে নিশা হয়ে কথা বলাটা বন্ধ করে দে!
– না! সেটা কিভাবে হয়? কি ভাববে?
– কিছুই ভাববে না। অরণ্য নিশাকে একটা ‘উপদ্রব’ ছাড়া আর কিছুই ভাবে না!
আমি রেগে বললাম – তোকে বলেছে!
– আচ্ছা যদি তা না-ই হয় তাহলে তুই যে একসপ্তাহ ফোন দিসনি সেও কেন একবারও দিল না? এরপর তুই যখন আবার ফোন করলি তখনও তো একবারের জন্যেও জিজ্ঞেস করেনি যে তুই কোথায় ছিলিস এতদিন? ফোনে কথা বললেও তাড়াতাড়ি রেখে দেয় কেন?
আমি উত্তর দেওয়ার মত কিছু পেলাম না।
– যদি সে জেনে যায় বৃষ্টিলেখা আর নিশা একই মানুষ, আর তুই এতদিন তার সাথে এভাবে মিথ্যা বলেছিস, সে কি খুশি হবে? নিশা তো যাবেই যাবে আর তোকেও অফিসে দেখবি কি করে..চাকরি থাকে কি না দেখ!
আমি ভীত চোখে নিশার দিকে তাকালাম!
– নিশা তুই বুঝতে পারছিস না! অরণ্য নিশাকে দেখেনি। তাই নিশা হয়ে আমি তার সাথে অনেক কথা শেয়ার করতে পারব। তার সাথে অনেক কিছু বলতে পারব। কিন্তু বৃষ্টিলেখা হিসেবে যে কি না তার আন্ডারে জব করে, একজন এমপ্লয়ি হয়ে বসের সাথে এসব আলোচনা করা সম্ভব নয়!
– আর সে যদি বুঝে যায়? যদি কণ্ঠস্বর চিনে ফেলে বা নিশার সাথে যদি একদিন দেখা করতে চায়?
– আ..আমি জানি না!
– বাহ! চমৎকার!
– যেভাবে চলছে আপাতত চলতে দে। পরেরটা পরে দেখা যাবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
সন্ধ্যায় আমি সোনিয়াকে ফোন দিলাম। আমাকে আগামীকাল অরণ্য যে কাজগুলো দেখাতে বলেছে সেটা কিভাবে প্রেজেন্ট করলে সে খুশি হবে সেটা আমাকে জানতে হবে। রাতে অরণ্যকেও ফোন দিতে হবে। আকার-ইঙ্গিতে যদি আজকের কোন কথা জানতে পারি যে নতুন এমপ্লয়িকে কেমন লাগল সেটাও আমার কাজে দিবে।
সোনিয়া ফোন ধরে।
আমি বললাম – আপু আমি বৃষ্টিলেখা। ওই যে আজ নতুন..
সে হেসে বলল – হ্যাঁ চিনেছি। বলুন..
– আপু আমাকে প্লিজ তুমি করে বলবেন। আমি আপনার ছোটবোনের মত।
– আচ্ছা ঠিক আছে। বল। কোন প্রবলেম?
– হ্যাঁ আপু। একটা প্রবলেম।
এরপর আমি তাকে কয়েকটা জিনিস জিজ্ঞেস করে নিলাম কিভাবে করব। সেও বেশ গুছিয়ে উত্তর দিল। সোনিয়া মেয়েটাকে বেশ ভাল মনে হচ্ছে। কথাবার্তা বলে ফোন রাখার পর খুব আনন্দ লাগছে। অরণ্য নিশ্চয়ই কালকের কাজ দেখে অনেক প্রশংসা করবে!
রাতে অরণ্যকে ফোন দিলাম।
সে ফোন রিসিভ করে সুন্দর করে বলে- হ্যালো নিশা! বলুন কেমন কাটল আজ অফিসে প্রথমদিন?
আমি আনন্দিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম- আপনার মনে আছে আজ আমার অফিসে জয়েন করার কথা ছিল?
– না মনে ছিল না। আপনার ফোন পেয়ে মনে হল।
অহ! ধূর! আর আমি উল্টাপাল্টা কি ভাবছিলাম!
আমি বললাম – হ্যাঁ কাটল মোটামুটি। আপনার সারাদিন কেমন কাটল আজ?
– আমার আর কি! প্রতিদিনের মতই! মজার ব্যাপার হলো আজ আমাদের অফিসেও নতুন মানুষ জয়েন করেছে। ইনফ্যাক্ট আমার ডিপার্টমেন্টেই করেছে!
আমার ভেতরে ধক করে ওঠে! সে কি কোনভাবে কণ্ঠস্বর চিনে ফেলল?
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কি করেছে সে?
অরণ্য অবাক হয়ে বলে- কিছু করেনি! কি আবার করবে?!
আমি এবার একটু বাজিয়ে দেখতে চাইলাম – নাম কি তার? কেমন কাজ করে সে?
– নামটা.. নামটা খুব কমন আবার আনকমন! কি যেন..বর্ষা.. না.. না..
আমার মেজাজাটা এত খারাপ লাগল আর বলার মত না। সে আমার নাম ভুলে গেছে! আআআহহহহহ!!!
অরণ্য বলে- মনে পড়েছে। বৃষ্টিলেখা! হ্যাঁ উনার নাম বৃষ্টিলেখা। বৃষ্টি আর লেখা দুইটা নামই খুব কমন। কিন্তু বৃষ্টিলেখা নামটা একসাথে আনকমন।
আমি বললাম – সুন্দর নাম।
অরণ্য হেসে বলে- হ্যাঁ। ভেরি বিউটিফুল নেইম!
– কাজকর্ম পারে?
অরণ্য হাসতে হাসতে বলল- আজ না উনাকে নিয়ে অনেক মজার একটা ব্যাপার হয়েছে। আমি উনাকে একটা ব্রিফিং দিচ্ছিলাম। উনি মনোযোগ দিয়ে না শুনে অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পরে যখন একটা প্রশ্ন করলাম তখন তো আর উত্তর দিতে পারেলন না! আর আমি তখন বললাম এরপর থেকে মন দিয়ে শুনবেন। তখন উনি যা একটা লজ্জা পেয়েছেন না..
রাগে আমার গা কিড়কিড় করতে থাকে! আমি পুড়ে মরি অনলে আর তুমি ভাসছ সুখের সাগরে? এটা তোমার আনন্দদায়ক ঘটনা?
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই অরণ্য আবার বলে- তবে পরে আমার নিজেরই খুব খারাপ লেগেছে। মেয়েটাকে প্রথমদিন এভাবে অপ্রস্তুত না করলেও হতো!
আমি জিজ্ঞেস করলাম- তবে কেন করলেন? আসলেই তো উনার কত খারাপ লেগেছে বলুন তো!
অরণ্য দুঃখী গলায় বলে- আসলেই! পরে বুঝতে পেরেছি। আসলে উনার সাথে কথা বলার আগে হেড স্যার ফোন করেছিলেন। একটা প্রবলেম সলভ করতে। ওইটা নিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল একটু। তাই পরে এসবের মধ্যে উনি যখন শুনছিলেন না তখন এরকম বলে ফেললাম! আসলেই ব্যাপারটা উচিৎ হয়নি!
এবার আমার আবার ভাল লাগতে থাকে। সে ইচ্ছা করে করেনি বরং মেজাজটা একটু খারাপ হয়েছিল বলে করে ফেলেছে। আর এই প্রথমবার অরণ্য আমার সাথে এতক্ষণ ধরে কথা বলছে! কোন ঘটনা শেয়ার করছে! আহা!
আমি হেসে বললাম – আপনি তো বুঝতে পেরেছেন। তাহলেই হবে!
অরণ্য হেসে বলে- ঠিক আছে। রাখছি আজকে। গুড নাইট।
পরদিন আমি মন দিয়ে গুছিয়ে রিপোর্ট রেডি করলাম। যদিও মনটা বারবার উড়ে উড়ে অরণ্যের রুমে চলে যাচ্ছিল! কারণ আমি যেখানে বসি সেখান থেকে তার রুম সরাসরি দেখা যায়। সে মাঝেমধ্যে হেঁটে দরজার সামনে দাঁড়ালে তাকে আরও দেখা যায়! ইশশ! এই অনুভূতি আমি বলে প্রকাশ করতে পারব না! যখনই মনটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল আমি সেটাকে টেনে নিয়ে কাজে মন দিলাম।
এরপর খুবই আগ্রহ নিয়ে অরণ্যের রুমে নক করে জিজ্ঞেস করলাম- মে আই কাম ইন?
অরণ্য হেসে বলে- প্লিজ!
আমি ভেতরে ঢুকে তাকে বললাম- আপনি যে রিপোর্টগুলো রেডি করতে বলেছিলেন!
অরণ্য আজ একটা নেভীব্লু শার্ট পড়েছে। তাকে দেখে আমার মনে হল মাথা ঘুরে পড়েই যাই!
– আপনি তো টু ফাস্ট! অনেক তাড়াতাড়ি করে ফেলেছেন।
আমি মনে মনে বললাম- এই রিপোর্ট তোমার মন মতো করার জন্য কম কষ্ট করেছি?
আমি তাকে রিপোর্টগুলো দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- ঠিক আছে?
অরণ্য একটু উল্টেপাল্টে দেখে বলে- মনে হয় ঠিক আছে।
আশ্চর্য! একটু প্রশংসা করবে না? খুব ভাল হয়েছে বা এই টাইপ কিছু?
আমি জিজ্ঞেস করলাম- সত্যি?
অরণ্য অবাক হয়ে বলে- কি সত্যি?!
– ঠিক আছে কি না?
– হ্যাঁ! ঠিক আছে তো!
– ওহ!
ওর সামনে থেকে যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু যেতে তো হবেই।
আমি বেরোতে গেলে সে পেছন থেকে ডাক দিল- এক মিনিট! বৃষ্টিলেখা!
আমি চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম – হ্যাঁ বলুন।
– গতকাল আপনার এখানে ফার্স্ট ডে ছিল। আমি যদি কোনভাবে আপনার সাথে মিসবিহেভ করে থাকি, বা কোনভাবে আমার কথায় আপনার খারাপ লাগলে আই অ্যাম স্যরি!
আমি চমকে উঠলাম! সে সত্যি আমাকে ‘স্যরি’ বলল!
সে আবার বলে- যদিও গতকালই বলা উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি গতকাল অনেক বিজি ছিলাম, কাজে ডুবে ছিলাম, আর সেভাবে মাথায়ও আসেনি!
আমি সুন্দর করে হেসে বললাম- ইট’স ওকে।
এটা কোন মুভি নয়। যদি মুভি হত তাহলে এখন আমি সহ অফিসের সবাই কাগজপত্র উড়িয়ে নাচানাচি শুরু করে দিতাম! কিন্তু এটা যেহেতু মুভি নয় তাই গান আর নাচ চলতে থাকল আমার মনের ভেতর!
বেশ কয়েকদিন ধরে আমার মন খারাপ। তার কারণ দুইটা।
প্রথম কারণ – বেশ অনেকদিন হয়ে গেছে আমার অফিসে কিন্তু আমি কোনভাবেই অরণ্যের মনের গহীনে যেতে পারছি না। আমি যত মন দিয়ে ভাল করে রিপোর্ট বানাই না কেন সে শুধু বলে ‘ঠিক আছে’। কোন প্রশংসা করে না এছাড়া! আমি যখন নিশা হয়ে তার সাথে কথা বলি সে বৃষ্টিলেখার কথা সেভাবে বলে না। আমি জিজ্ঞেস করলেও নর্মাল উত্তর দেয়! তার মনে না নিশার জন্যে কোন জায়গা আছে, না বৃষ্টিলেখার জন্যে! আবার এতদিনে সে একবারও বলেনি যে নিশা আর বৃষ্টিলেখার কন্ঠস্বর একইরকম! সে কি বুঝতে পারেনি নাকি তাও জানি না! কিভাবে তার মনের মধ্যে প্রবেশ করব আমি? এসব চিন্তা করলে প্রচন্ড অস্থির লাগে!
আর দ্বিতীয় কারণ হল- বড়আপার শ্বশুর অসুস্থ। বড়আপা, দুলাভাই আগামীকাল গ্রামের বাড়ি যাবে। হয়তো উনাকে সাথে করে নিয়েও আসবে। সেটা সমস্যা নয়। মা-বাবা আর ভাইয়াও আগামীকাল গ্রামের জমিজমা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে সেটা মেটাতে গ্রামে যাবে। দুলাভাই আর আমাদের পাশাপাশি গ্রামে বাড়ি। তারা তাই একসাথেই যাচ্ছেন। সেই ভোরবেলা রওনা দিয়ে কাজ শেষ করে, আপার শ্বশুরকে নিয়ে সেদিনই রওনা দিবে। আগামীকাল ছুটি কিন্তু দুলাভাই আর ভাইয়ার পরদিনই অফিস আছে। আপার ক্লাস আছে। আমি আর ভাবী একা থাকব। তাই তারা একইদিনে ফিরে আসবেন। এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল।
কিন্তু আপা তিতুনকে আমাদের কাছে রেখে যাবেন! তিতুন বাচ্চা মানুষ একদিনে এত জার্নি করতে পারবে না। এইসব যন্ত্রণা থেকে যত দূরে সরে যেতে চাই তত কেন আমার ঘাড়ে চেপে বসে? খুব ভাল বুঝতে পারছি একে পুরো সময় জুড়ে আমাকেই দেখতে হবে। কারণ ভাবী মেঘমালাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। কিছু বললে এখন বিতিকিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হয়ে যাবে আর আপা তো কেঁদে নাস্তানাবুদ করবে! ইচ্ছা করল আমিই হাত-পা ছড়িয়ে বসে ভেউভেউ করে কাঁদি!
এইসব সমস্যা নিয়েই রাতে অরণ্যকে ফোন দিলাম।
সে আনন্দিত গলায় ফোন ধরে- হাই নিশা!
– খুব খুশি মনে হচ্ছে?
– হ্যাঁ! আমার আপু আর ওর ছোট বেবি এসেছে আজকে বেড়াতে। ওর বেবিটা কাছে থাকলে কি যে খুশি লাগে!
আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- আপনার বাচ্চাকাচ্চা ভাল লাগে?
– হ্যাঁ অবশ্যই! বাচ্চাদের ভাল না লেগে উপায় আছে?
আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম- বাঁদর একেকটা!
অরণ্য হেসে বলে- কি বললেন? বাঁদর?
– না মানে এই যে কত দুষ্টু!
– নিশা দুষ্টামি বাচ্চারাই করবে! নাকি আপনি চান বুড়োরা দুষ্টামি করুক? দৌড়ঝাঁপ, চিৎকার চেঁচামেচি না করলে বাচ্চা হল কেন তারা?
বলে কি এ? পাগল নাকি?
– বাই দ্য ওয়ে, আপনি তার মানে বাচ্চাদের পছন্দ করেন না?
আমি বললাম – না। বাচ্চাদের দেখলেই আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে! আমার সাথে বাচ্চা জড়িত অতীত ইতিহাস খুব একটা ভাল না!
এরপর অরণ্যকে সেই নিয়ে দুটো ঘটনা শোনাতেই সে হা হা করে হাসতে শুরু করে! আমি এদিকে মুখ শুকনো করে তার হাসি থামার অপেক্ষা করলাম।
সে হাসি থামিয়ে বলে- আসলে আপনি নিজে থেকে কখনোই ট্রাই করেননি ওদের কাছে যাবার!
– কাছে যাবার?
– হ্যাঁ। শুনুন আপনি দুটো দিন ট্রাই করুন। আপনার বোনের বেবির নাম কি যেন বলেছিলেন?
– তিতুন।
– হ্যাঁ তিতুনের সাথে মিশুন, খেলাধুলা করুন। হাসিমুখে দুইবার কথা বলে আদর করুন। ও আপনার ফ্যান হয়ে যাবে। বাচ্চাদের ভোলানো খুব সোজা। আর তারা আদর বোঝে। আপনি চেষ্টা করুন দেখবেন আপনি নিজেই ওদের ভালবাসতে শুরু করেছেন। সারাদিনের ক্লান্তি একটা বাচ্চার হাসি দেখে দূর করে ফেলা সম্ভব! আর আপনার অ্যাসাইনমেন্টে দাগান যে ভুল সেটা বুঝলে তো ওই বাচ্চাটি দাগাত না। সে আপনার সাথে ড্রয়িংরুমে বসে গম্ভীরমুখে চা খেত!
ফোন রেখে ভাবতে বসলাম আসলেই কি তাই? আমার তো কোনদিন তাদের সাথে খাপ খায় না। ঠিক আছে। আগামীকালই সেই চেষ্টা করে দেখব। অরণ্য, তুমি আমাকে দিয়ে আর কি কি করাবে?
পরদিন ভোরে আপা ঘুম থেকে উঠিয়ে দিল।
ছয়টায় সবাই মিলে বেরিয়ে গেল। আমি আমার রুম থেকে উঠে গিয়ে তিতুনের পাশে ঘুমালাম। ঘুম ভাঙল ভাবীর ডাকে।
– বৃষ্টি নাস্তা দেয়া হয়েছে। তিতুনকে নিয়ে এসো। আমি বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে তিতুনকে খাইয়ে দিচ্ছি।
উঠতে গিয়ে দেখি তিতুন ঘুমের মধ্যে একটা হাত আমার পেটের ওপর দিয়ে রেখেছে। আমার কাঁধের কাছে এসে আমার সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে। আমি ঠিক করেছি আজ কোনভাবেই কারও সাথে বিরক্ত হব না। কিন্তু এটা একবারেই সত্যি আজ ঘুমন্ত তিতুনকে আমার সাথে এভাবে লেপ্টে ঘুমাতে দেখে আমার খুব মায়া হল! মৃদু হেসে তিতুনের কপালে টুক করে একটা চুমু দিলাম। আমি জানি না এই ফিলিংসটা অরণ্যের কথার জন্য হয়েছে কি না, কিন্তু যেই কারণেই হোক এই অনুভূতিটা একদম সত্যি, একেবারে অন্যরকম!
তিতুনকে ডেকে তুললাম। সে উঠেই দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। এই নিয়ে তিনবার বলেছি বাথরুমে চল হাতমুখ ধুয়ে দিই। সে একটা খেলনা প্লেন নিয়ে লাফানো শুরু করে। মেজাজটা খারাপ হলেও কিছু বললাম না। অরণ্যের কথাটা মনে করলাম- ‘বাচ্চারাই দুষ্টামি করবে!’ আমি এরপর তাকে কোলে নিয়ে জোর করে ডায়পার পাল্টে দিলাম। বাথরুম থেকে পানি এনে চোখমুখ ধুইয়ে দিলাম। যদিও সে পুরো সময় হাত-পা ছুঁড়তে লাগল কিন্তু আমি কিছুই বললাম না। ভাবী এসে অবাক হয়ে গেল!
– তুমি ওর মুখ ধুইয়ে দিয়েছ?
আমি মৃদু হেসে মাথা নাড়লাম!
– ওয়াও!
তিতুনের জন্য সুজি বানানো আছে। আপা তাকে কিভাবে যেন শুইয়ে খাওয়ায়। আমি সেইসব না করে তার হাতে ইউটিউব ধরিয়ে মুখে গপাগপ দিয়ে দিলাম। যদিও কাজটা খুবই ভুল করেছি। বাচ্চাদের ইউটিউব দেখানো একেবারে উচিৎ নয়। তবুও এখন করলাম কারণ ইতিমধ্যেই আমি বেশ বিরক্ত হয়ে গেছি। আর আমি তো ঠিক করেছি আজ তিতুনকে কিছু বলব না।
তিতুনকে খাইয়ে ওকে কিছু খেলনা দিয়ে বসিয়ে আমি নিজে নাস্তা করলাম। এরপর আমিও ওর সাথে খেলতে বসলাম। ওকে ছবির বইতে ছবি দেখালাম। কালার দিলাম রঙ করতে। ওর খেলনাপাতি দিয়ে খেললাম।আর তিতুনও সুন্দর করে আমার সাথে মিশে গেল! আমার একদমই খারাপ লাগছিল না। একটুপর চারতলার সেই দুষ্টু ছেলে এল।
আমি ওকে আজ নিজেই একটা মার্কার আর একটা খাতা ধরিয়ে দিয়ে বললাম- এবার দাগাও!
ও একবার আমার দিকে আর একবার মার্কারের দিকে তাকাচ্ছে। এরপর মহানন্দে দাগানো শুরু করে। এসব করতে করতে কোনদিক দিয়ে সময় চলে গেল বুঝতেই পারলাম না।
তাহলে কি অরণ্যের কথাই সত্যি? আমি সবসময় ভয় পেয়ে বাচ্চাদের কাছ থেকে দূরে সরে ছিলাম?
গোসল করানোর সময় তিতুন আর আমি পানি ছিটিয়ে ছিটিয়ে একে অন্যকে ভিজিয়ে দিলাম। নিজেরাই হেসে গড়াগড়ি খেলাম! ভাবী আমাকে দেখে বারবার অবাক হতে লাগল! দুপুরে খাওয়ানোর সময় এবার আর তিতুনকে ইউটিউব দেখালাম না। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বললাম। গল্পের কোন আগামাথা নেই। কিন্তু সে সেটাই শুনল। দুষ্টামি যে করল না এমন নয়। কিন্তু তার দুষ্টামিগুলো এখন আর আগের মত অত খারাপ লাগছে না!
মাঝখানে আপার সাথে কথা বলল। বেশি ভালো করে কথা বলা গেল না। কারণ গ্রামের নেটওয়ার্ক খুবই খারাপ।
সবাই রাত এগারোটায় ফিরে এল। আমি তিতুনের সাথে ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।
আপা এসে ডেকে বলল- গ্রামে নেটওয়ার্কের এত সমস্যা! ফোনই করতে পারলাম না। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না তুই তিতুনকে এতক্ষন রেখেছিস!
ভাবী বলে- আমাকে ধরতেই দেয়নি। সন্ধ্যায় তিতুন উঠে যখন আপনাকে খুঁজছিল আমি তো ভয় পেয়েছিলাম! কিন্তু বৃষ্টি আপনার আর ভাইয়ের বিয়ের ভিডিও চালিয়ে দিল! আর তিতুনও চুপ করে গেল।
আপা বলল- আমিও ভয় পেয়েছিলাম। আর রাস্তায় এত জ্যাম!
আপা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে- বৃষ্টি আমার বোন!
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম – আপা প্লিজ! এখন এসব কান্নাকাটি না। আমার ঘুম পাচ্ছে প্রচন্ড!
আপার চোখ থেকে তবুও দুইফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে!
আজ রাতে অরণ্যকে ফোন করলাম না।
তবে একটা মেসেজ দিলাম- থ্যাঙ্কিউ। তিতুনের সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ হয়ে গেছে! অন্য বাচ্চাদের সাথেও এখন থেকে ফ্রেন্ডশিপ করতে পারব!
আমি একটা রিপ্লাই পেলাম – মাই প্লেজার!
আরেকটু বড় করে দুইটা লাইন লিখলে কি হত?
ইদানিং আমি সময় পেলে মেঘমালাকে রাখি। সে ভাবীর মত খুব শান্ত, লক্ষী হয়েছে। আজকাল হাসতে পারে। সেই হাসি দেখলে আসলেই যে কারও মুখে হাসি ফুটে উঠবে।
ভাবী একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করে – বৃষ্টি তোমার কিছু হয়েছে?
– কি হবে?
– ভাল কিছু?
– মানে?
– তুমি অনেক বদলে গেছ।
মা বললেন – হ্যাঁ। বৃষ্টি তুই আসলেই অনেক চেঞ্জ হয়েছিস। গুড। এখন তোকে বিয়ে দিয়ে আমিও শান্তি পাব।
আমি মাথা নেড়ে উঠে গেলাম।
আজ আমি খুব খুশি। খুব খুব খুশি। আজ প্রথমবার অরণ্য আমার হাত ধরেছে। আসলে ধরেনি। ফাইলটা দেওয়ার জন্য তার হাতের সাথে আমার হাতের স্পর্শ হয়েছে! আমি চমকে উঠেছিলাম!
অরণ্য স্বাভাবিকভাবে বলে- স্যরি।
আমি মৃদু হাসলাম। ইচ্ছা করছিল হাতটা জড়িয়ে ধরে রাখি!
আমি কখনোই রান্নাবান্না করি না। তবে একটা আইটেম খুব ভাল রাঁধতে পারি। সেটা হল বিরিয়ানি।
কয়েকদিন ধরে দেখছি অফিসে কেউ একজন কিছু একটা বানিয়ে আনে। সবাই মিলে লাঞ্চ টাইমে খায়। অরণ্য মাঝেমধ্যে আমাদের সাথে ক্যান্টিনে আসে। মাঝেমধ্যে হেড স্যারদের সাথে অন্য ক্যান্টিনে খায়।
আমি খুশির চোটে আজ বিরিয়ানি বানিয়ে ফেললাম। আগামীকাল ওকে খাওয়াব।
মা আমার এসব কাজকর্ম ভাল চোখে দেখছেন না।
বারবার জিজ্ঞেস করছেন- বৃষ্টি তুই কি প্রেমে পড়েছিস? সত্যি করে বল তো? অফিসের কেউ?
আমি পাত্তা দিলাম না।
পরদিন বিরিয়ানি নিয়ে গেলাম। লাঞ্চ টাইমে যখন সবাই একসাথে বসেছে আমি বিরিয়ানি বের করলাম। কাড়াকাড়ি লেগে গেল! অরণ্যের জন্য আলাদা করে এনেছিলাম। সে আজ এই ক্যান্টিনে এল না।
তড়িঘড়ি করে তার রুমে গিয়ে দেখি সে অন্য ক্যান্টিনে যাচ্ছে।
আমি বললাম- আপনি কি অন্য ক্যান্টিনে যাচ্ছেন?
সে উত্তর না দিয়ে বলে- কোন দরকার ছিল?
– হ্যাঁ। আমাদের সাথে এই ক্যান্টিনে আসবেন একটু?
অরণ্য চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলে- চলুন।
যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম- আপনার কি মন খারাপ?
– আমার খালু একটু অসুস্থ! হসপিটালে আছে।
ক্যান্টিনে অরণ্যকে দেখে সবাই বসার জায়গা করে দিল।
একজনকে বলে- স্যার খেয়ে দেখুন! অসাধারণ বিরিয়ানি!
অরণ্য হেসে বলে- আমার প্রিয় খাবার বিরিয়ানি। আপনি এনেছেন বুঝতে পারছি। রান্নাটা কে করেছে?
– আমিই করেছি!
– গ্রেট!
সে খেয়ে গেল। কোন মন্তব্য করল না!
খাওয়ার পর বলে- আমার হাতে থাকলে এই বিরিয়ানি খাওয়ানোর জন্য আপনার বেতন বাড়িয়ে দিতাম!
সবাই হইহই করে ওঠে!
– স্যার এটা আনফেয়ার!
– আমরা রান্না পারি না তাই আমাদের বেতন কম?
অরণ্য হেসে বলে- আমি বলেছি আমার হাতে থাকলে। আমার হাতে নেই তো!
অফিস ছুটির আগে অরণ্যের রুম থেকে একটা ফাইল নিয়ে যাচ্ছিলাম সে আমাকে বলে- কোন বড় শেফ থাকলে আজ নির্ঘাৎ এই বিরিয়ানি খেয়ে আপনার হাত ধরে চুমু দিত!
তার এই কথা শুনে আমি চমকে ফাইলটা হাত থেকে ফেলে দিলাম।
অরণ্য নিজেই তুলে দিয়ে বলে- থ্যাংকস। এত ভাল একটা বিরিয়ানি খাওয়ানোর জন্য।
আমি কোনমতে ‘ওয়েলকাম’ বলে বের হয়ে গেলাম! আহা! আহা! আহা!
[চলবে]