বৃহন্নলার ডিভোর্স পর্ব-এক মাহাবুবা বিথী

ধারাবাহিকগল্প
বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব-এক
মাহাবুবা বিথী

একদিন আমার চেম্বারে একটা অদ্ভূত মেয়ে আসলো। মেয়েটির নাম রুমি। সে এসেই আমাকে বললো,
—-আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিতে চাই।
আমি ওকে বললাম,
—কি কারনে আপনি আপনার স্বামীকে ডিভোর্স দিতে চান।
মেয়েটি বললো
—আমার স্বামী পুরুষত্বহীন।
আমি তাকে বললাম,
—–চট জলদি কোন ডিসিশন নেওয়া উচিত নয়। আজকাল অনেক রকম চিকিৎসা আছে।সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে অনেক সময় সুস্থ হয়ে যায়।
সে আমাকে বললো,
—–একটা মেয়ে যখন সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম হয় তখন শ্বশুর বাড়ির লোক কিংবা স্বামী কেউ আর অপেক্ষা করে না।মেয়েটিকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। সেই কারনে আমিও একই পন্থা অবলম্বন করছি।
আমি তাকে বললাম,
—-আপনার স্বামীর কোন মেডিকেল রিপোর্ট আপনার কাছে আছে?
মেয়েটি বললো,
—-নেই।আমার শাশুড়ী লুকিয়ে রেখেছে।যদিও চুরি করে আমি দেখে ফেলেছি।মোবাইলে ছবি তুলে রাখতে চেয়েছিলাম।আমার স্বামী চলে আসাতে সম্ভব হয়নি।
তখন আমি তাকে বললাম,
—-আপনি আপনার স্বামী দুজন মিলে আমার চেম্বারে আসুন।আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে।
এই কথা বলে মেয়েটিকে আমি সেদিনকার মতো বিদায় করে দিলাম।
এরপর ছ,মাস পার হয়ে গেলো।হঠাৎ একদিন ছুটির দিনে আমার ডোরবেলটা বেজে উঠলো।দরজা খুলে দেখি,রুমি দাঁড়িয়ে আছে।এলোমেলো বেশ আলুথালু কেশ।আমাকে সালাম দিয়ে বললো,
—-আপু ভাল আছেন?
আমি ওকে বললাম,
—-তুমি ঠিক আছোতো?
ও আমাকে বললো,
—-আপু আমি একদম ঠিক আছি। আজকে আমি আপনাকে এক বৃহন্নলার ডিভোর্সের গল্প বলতে এসেছি।
আমি ওকে আমার চেম্বারে নিয়ে বসালাম।
আমি রাবেয়া চৌধুরী।লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারী পাশ করে দেশে এসে অসহায় বঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করছি।আর ওদের অধিকার আদায়ে লড়াই করে যাচ্ছি।
অতঃপর রুমির কাছে ওর গল্পটা শুনতে চাইলাম।ওকে দেখে আমার খুব বিদ্ধস্ত মনে হলো।ও ওর গল্প বলা শুরু করলো।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রুমি।ওদের পাঁচ সদস্যের সংসার ছিলো। বাবা সরকারী অফিসের কেরানি।খুব সৎ লোক ছিলেন।বেতনই ছিলো ওনার একমাত্র সম্বল।রুমি একটা সরকারী কলেজ থেকে মার্কেটিং এর উপর মাস্টার্স করেছে। রুমির বড় ভাই রায়হান একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে।রুমির বাবা দেশের জমি বিক্রি করে ছেলেটাকে মানুষ করে। এর মাঝে ওর ভাইয়ের একটা চাকরি হয়।প্রবেশন পিরিয়ড তিন মাস।এই সময় ওর ভাইকে অফিস কর্তৃপক্ষ পনেরো হাজার টাকা বেতন দেয়।
রুমির বাবা রুমিকে বিয়ে দিতে চায়।যদিও রুমি আগে চাকরি করতে চেয়েছিলো কিন্তু রুমির বাবার ইচ্ছে রুমির বিয়েটা আগে হোক পরে নাহয় চাকরি করা যাবে।
হঠাৎ ওদের সংসারের ছাদটা ভেঙ্গে পড়ে।রুমির বাবা হার্টঅ্যাটাক করে মারা যায়।কিছুদিন রুমি বিয়ের ব্যাপারটা শোকের বাড়িতে চাপা পড়ে থাকে।এর মাঝে রুমির ভাইয়ের কানাডায় একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা হয়ে যায়।পাঁচ বছরের পিএইচডি কোর্স নিয়ে রাশেদ কানাডায় পাড়ি জমায়। এতে রুমির মা খুব খুশী হয়।শোকের মাঝে কিছুটা আশার আলো দেখতে পায়। রুমিও বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতে থাকে। ওর ছোটো বোনটা তখনও স্টুডেন্ট।ওর বাবার পেনশনের টাকা ভাইয়ের পাঠানো বিশহাজার টাকা আর কোচিং সেন্টার থেকে কিছু আয় দিয়ে কোনরকমে ওর মা সংসারটা চালিয়ে নেয়।
এভাবে ওদের পরিবারে দু,বছর সময় পার হয়ে যায়।রুমির বয়সটাও বাড়তে থাকে।মা আয়শা বেগম রুমির বিয়ে নিয়ে খুব তোড়জোড় শুরু করে। রুমির বয়স এখন আটাশ বছর। ও একটু হেলদি। এই কারনে সবাই ভাবে ওর বয়স অনেক বেশী।
রুমি আমাকে বললো,
—-জানেন আপু,আমি একটু মোটা।সরকারী কলেজ থেকে মার্কেটিং এ মাস্টার্স করেছি। ছেলে পক্ষ আমাকে দেখতে এসে বলে,”মেয়ের বয়স অনেক বেশী। পাবলিক ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেনি।ওর তো ক্যারিয়ার হবে না। অথচ ছেলের মাথায় চুল কম।ছেলেও মোটা হালকা ভুঁড়িও আছে।বেসরকারী ব্যাংকে অফিসার হিসাবে চাকরি করে। এসবে ছেলে পক্ষের কোন সমস্যা নেই।যত দোষ মেয়েদের বেলায়। ছেলে আমার থেকে সাত আট বছরের বড়।এতেও সমস্যা নাই। আমার কেন বিয়ে হতে দেরী হলো? শারীরিক কোন প্রবলেম আছে কিনা যতসব ফাউল প্রশ্ন করতে থাকে। এসব শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। আর আমার মা মিডিয়া সেন্টারে টাকা দিয়ে ফতুর হয়ে যাচ্ছে।বাবা না থাকার কারনে আত্মীয় স্বজনও তাদের হাত সরিয়ে নেয়।
এইভাবে রুমিদের দিনগুলি পার হতে থাকে।মেল বন্ধন নামে একটা মিডিয়া সেন্টার থেকে রুমির একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে। রুমি ও রুমির মা দু,জন মিলে মিডিয়া সেন্টারে চলে যায়। সেখানে ছেলের মা আর খালা রুমিকে দেখতে আসে।প্রথম দেখায় ওরা রুমিকে পছন্দ করে। রুমিরও খুব ভাল লাগে।কারণ ওরা কোন ফালতু প্রশ্ন রুমিকে করে না। ওখানেই রুমির মা আর ছেলের মা সিদ্ধান্ত নেয় সামনের শুক্রবার ছেলে আর মেয়েকে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করিয় দিবে। ওখানে যদি ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে তাহলে ওরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিবে।

ছেলেটার নাম আবীর। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রুমি আর আবীরের দেখা হয়। আবীর রুমিকে বলে,
—-আমার মা যেহেতু আপনাকে পছন্দ করেছে তাই আমারও আপনাকে পছন্দ।আপনাকে আমার কোন জিজ্ঞাসা নাই।
রুমিরও ছেলেটাকে ভাল লাগে।যেই ছেলে নিজের মাকে এতো সম্মান দেয় সে পৃথিবীর প্রতিটি নারীকে সম্মানিত করে। রুমির আরও ভাল লাগে ওদের কোন ডিমান্ড ছিলো না। ভদ্রতা করে রুমির মা যা দিবে তাতেই ওরা খুশী থাকবে।ওদের একটা চাওয়া ছিলো কাবিন অনেক কম হতে হবে। ছেলে পক্ষ এক লক্ষ একটাকা ধার্য করে। এটা রুমির ভাই মেনে নিতে চায় না। কম পক্ষে পাঁচলক্ষ টাকা দেনমোহরে রুমির মাকে রাজি হতে বলে। অবশেষে অনেক দেন দরবারে দু,লক্ষ টাকা দেন মোহরে এক লক্ষ টাকা উসুলে বিয়ে ঠিক হয়।

আবীর একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে সহকারী রেজিষ্ট্রার পদে কাজ করে। একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে আবীর এমবিএ পাশ করেছে। আবীরের বাবার নিজেদের ফ্লাট আছে। আবীরের ছোটো ভাই ডেভেলপারের ব্যবসা করে। এই ব্যবসাটা আবীরের বাবার ছিলো। বয়স হয়ে যাওয়াতে আবীরের ভাই সাব্বির ব্যবসা দেখাশোনা করে। চারজনের ছোটো সংসার। সব মিলিয়ে রুমির মার ছেলেটাকে পছন্দ হয়। রুমির মার একটাই চাওয়া মেয়েটা যেন শ্বশুরবাড়িতে আদরে থাকে।
আত্মীয় স্বজনের নানা রকম কটু কথায় আর রুমি একটু মোটা হয়ে যাওয়ায় পাশাপাশি বয়স বাড়তে থাকায় মা রুমির বিয়েটা নিয়ে বেশ তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নিলো।
রুমি আমাকে বললো,
—-আপু আপনি সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন পড়েছেন?
আমি বললাম,
—-হ্যা পড়েছি।
ও আমাকে আবারও বললো,
—আমার বয়স যখন বারো বছর তখন আমি সাতকাহন পড়েছি। দীপাবলির চরিত্রটা আমাকে অনেক কাঁদিয়েছে।সেই সাথে বিয়ে সম্পর্কে আমার একটা ভীতিও তৈরী হয়েছে। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দীপাবলির সাথে কোথায় যেন আমার একটা মিল রয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here