বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-৩

0
3051

#বেখায়ালি_ভালোবাসা,
#পাট_৩
লেখিকা:#সাবেরা_সুলতানা_রসিদ
.
মেঘ ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তার আম্মু ফোন দিয়েছে। সৈকতের ঘুমের যাতে কোন সনস্যা না হয় এ জন্য ফোনটা হাতে নিয়ে বেলকনিতে চলে যায় ।মেঘ ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিয়ে
—কেমন আছো আম্মু তোমরা ?
—আমরা ভাল আছি তুই কেমন আছিসরে মা?
—আমিও খুব ভাল আছি।
—সত্যি করে বলতো তোর কোন অসুবিধে হচ্ছে নাতো ওখানে।
—না আম্মু কোন অসুবিধা হচ্ছে না। এ বাড়ির সবাই খুব ভাল । সবাই আমাকে খুব আদর করছে।
—আর জামাই??
মেঘ তার আম্মুর এমন প্রশ্নে একটু থতমত খায় । একটু সময় নিয়ে বলে হ্যাঁ আম্মু তোমার জামাই ও ভাল খেয়াল রাখছে আমার ।
—তুই সত্যি বলছিস তো??
—হু,তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না।
—কিন্তু আমার মন কেন যেন অন্য রকম লাগছে।নিজের বিয়ের দিন যে ছেলে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় সে কেমন কি করছে বা করবে কিছু বুঝতে পারছি না।
—আচ্ছা এসব বাদ দাও আব্বু আর ভাইয়া কেমন আছে বলো?
—ভালো আছে। রাজু(মেঘের বড় ভাই) তোকে নিয়ে একটু চিন্তায় আছে। তোর আব্বুর সাথে একটু রাগারাগি করছে ।
—কেন!!?
—এই যে হুট করে বড় ঘর দেখে ছেলের সম্পর্কে কোন রকম খোজখবর না নিয়ে তোকে বিয়ে দিয়ে দিল তাই।রাজু আর আমি তোর আব্বুকে সেদিন অনেক করে বুঝিয়েছিলাম তাড়াহুড়া করে কোন কাজ করতে নেই। কিন্তু তোর আব্বু কোন কথাই শুনলো না।বিয়ের দিন সৈকতের ওভাবে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া রাজুকে ভীষণ ভাবাচ্ছে।
—তুমি ভাইয়াকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ কর। তুমি তো জানোই ভাইয়া আমাকে কতটা ভালবাসে তাই এরাকম ভাবছে।
ভাইয়া কোথায় তুমি ফোনটা ভাইয়ার কাছে দাও আমি কথা বলছি।
—ও বাসায় নেই। একটু আগে কোথায় যেন বেরিয়েছে।
—ঠিক আছে তুমি ভাইয়া আসলে বলো আমাকে নিয়ে যেন দুশ্চিন্তা না করে আমি ভাল আছি। আর আমিও সময় করে ভাইয়াকে ফোন দিব।
—ঠিক আছে।
—তুমিও আর চিন্তা করো না। খাওয়া দাওয়া ঠিকমত করো আর আব্বুর খেয়াল রেখ। এখন রাখছি।
ফোনটা কেটে পিছন ফিরতেই দেখে সৈকত ঘুম ভেঙ্গে চোখ বড় বড় করে থমথমে মুখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সিংহ তার শিকার ধরার জন্য ওত পেতে বসে আছে।
মেঘ ফোনটা টেবিলের উপর রেখে বললোঃ
—এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে গেল??
—এই তোমার সমস্যা কি বলোতো ??(রেগে)
—কই আমার কোন সমস্যা নাই তো!!?
—আমি যখনই কোন কাজ করি তখনই তুমি আমাকে বিরক্ত করছো।
—আমি!!?কই কখন!!?
—এই যে আমি এখন ঘুমাচ্ছিলাম তোমার কি দরকার ছিল এ রুমে আসার ,আসছো ভাল কথা ফোনটা আনার কি দরকার?
—মানে কি!!আমি এ রুমে আসবোনাতো কোন রুমে যাবো?আর ফোন না আনলে কথা বলবো কি করে?
—গতকাল রাতে তোমাকে কিছু বলি নাই, শোন আজ থেকে তুমি আর এ রুমে আসবে না। আমি চাইনা আমার রুম কেউ শেয়ার করুক। এ বাড়িতে অনেক গুলা খালি রুম পড়ে আছে তুমি সেগুলোর মধ্যে যে কোন একটা ব্যবহার করতে পার,কেউ নিষেধ করবে না।
সৈকতের কথার কোন মানে বুঝতে পারল না মেঘ। একটু রেগে গেলঃ
—এই শুনুন আমি আপনার বিয়ে করা বউ । আপনার নিজের যেসব জিনিস আছে তাতে আমারও এখন অধিকার আছে । আগে এ রুমটা আপনার একার ছিল কিন্তু এখন এতে আমার ও ভাগ আছে সো এটা নিয়ে আর কথা বলবেন না।
—হ্যা বউ । এ জন্য অন্য রুমে থাকার কথা বলছি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথাতো আর বলিনি।
মেঘ মনে মনে আপমান বোধ করলো সৈকতের কথায়ঃ
—তাহলে বিয়ে করার কি দরকার ছিল?
না করলেই পারতেন।
—চাইনি করতে । জোর করে ধরে করানো হয়েছে।
মেঘ একটু ঠোঁট বাকিয়ে হাসি দিয়ে বললোঃ
—কাউকে জোর করে আবার বিয়ে দেওয়া যায়??
সৈকত মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভেবে কন্ঠটা নরম করে বললো তাহলে তুমি কেন করেছো??
—আমি তো……বলে মেঘ থেমে যায়।
—কি বলো ,তুমি কি??থামলে কেন!!?
মেঘ মনে মনে ভাবে নিজের বলা কথাই নিজেই ফেসে গেলাম।সত্যিতো মেঘ নিজেও এ বিয়েতে রাজী ছিল না। অনেকটা না পুরোপুরি ভাবে তার বাবার জোরাজুরিতে সে বিয়েটা করেছে।
—চুপ হয়ে কি ভাবছো??আচ্ছা আমি বলি,তুমি নিজেওতো এ বিয়ে করতে চাও নি ,তাহলে কেন করলে?নিশ্চয় তোমার বাবা মার কথায় তাই না??আসলে এ বিয়েটা করতে তোমাকেও একরকম জোর করা হয়েছে সেটা হয় মেনটালি আর নয় ইমোশনালি।
মেঘ কোন কথা বলে না চুপ করে সৈকতের বলা কথা শুনতে থাকে।
—কি ,আমি ঠিক বললাম তো??আর এটাই হচ্ছে জোর জবরদস্তি করে বিয়ে দেওয়া । আর আমার সাথেও তেমনটাই করা হয়েছে। বলতে গেলে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
—তাহলে কি আপনি আপনার বোঝা?
—না ,তুমি আমার বোঝা নও।
—তাহলে??
—আমি তোমাকে বোঝা মনে করতাম তখন যখন আমি তোমাকে মেনে নিয়ে স্তীর অধিকার দিতাম। আর যেহেতু আমি তেমন কিছু করিনি তাই তুমি স্বাধীন ।
সৈকতের কথা শুনে মেঘ বিস্ফারিত চোখে সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলেঃ
—তার মানে!!কি বলতে চাইছেন?
—এই তুমি কি দুধের বাচ্চা যে আমার বলা সহজ কথা তুমি বুঝতে পারছো না?
আমি যেহেতু এ বিয়েটা নিজের ইচ্ছায় করি নি তাই তোমার প্রতি আমার নিজের কোন দায়-দায়িত্ব নেই। তোমার যখন যা প্রয়োজন এ বাড়ির লোকের কাছে বলবে তারা তোমার সব প্রয়োজন পূরণ করে দিবে।
সৈকতের এসব উল্টোপাল্টা কথা শুনে মেঘের মনে মনে খুব রাগ হচ্ছে ।রোজি ভাবির মুখে বলা কথা গুলো শোনার পর সৈকতের উপর থেকে মেঘের রাগটা অনেকটা কমে গিয়েছিল কিন্তু এখন এসব শোনার পর প্রথম রাতে যতটুকু রাগ হয়েছিল তার তিন গুন বেশি রাগ হচ্ছে।
সৈকত মেঘের দিকে তাকিয়ে বলেঃ
—কথা গুলো শোনার পর তোমার খুব রাগ হচ্ছে তাই না??
—না রাগ হবে কেন আমার এখন খুশিতে ধেইধেই করে নাচতে ইচ্ছে করছে।
সৈকত মুচকি হেসে বললোঃ
—তাহলে নাচ আমিও একটু দেখি।
কথাটা শুনে মেঘের মেজাজ আর খারাপ হয়ে গেল।
আমি জানি তোমার খুব রাগ হচ্ছে আর এ জন্যই তুমি তোমার দুপায়ের আঙ্গুল এমন করছো।
সৈকতের কথা শুনে মেঘ নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে দু’পায়ের বৃদ্ধাআঙ্গুল নাড়ানো বন্ধ করল।
মেঘ রাগ ভুলে অবাক হয়ে বললোঃ —আপনি কি করে বুঝলেন যে রাগ হয়েছে বলেই আমি পা এমন করছিলাম।
সিক্স সেন্স বললো। মানুষের যখন অতিরিক্ত রাগ হয় তখন তার শরীর অটোমেটিক কোন না কোন ভাবে সেটা কন্ট্রোল করেতে চাই আবার তা প্রকাশ করে । তোমার রাগ হলে তুমি পায়ের আঙ্গুল গুলে এরাকম কর।
সৈকত যেটা বললো সেটা হান্ডেড পারসেন্ট সত্যি কথা। মেঘের খুব বেশি রাগ উঠলে মেঘ পায়ের আঙ্গুল দিয়ে মাটি খোড়ার মত করে । সেটা হোক ফ্লোর বা বিছানায় যখন যেমন থাকে সেখানেও সে এরকম করে।
—এখন যাও আমি ঘুমাবো।
—ঘুমাবেন মানে!নাস্তা করবেন না??
—না তুমি যাওতো। (বিরক্তি নিয়ে)
—তাহলে আমি এখন কোথায় যাবো??
—সেটাও কি আমি বলে দিব!?যেখানে খুশি যাওনা এবাড়িতে এখনও তোমার অনেক কিছু দেখার বাকি আছে সেগুলো দেখ।
—আর আমি যে আপনার জন্য নাস্তা নিয়ে আসলাম সেটার কি হবে?
—খাবনা নিয়ে যাও। আমার খাওয়ার সময় হলে আমি অন্য কাউকে ডেকে খাবার নিয়ে আসতে বলবো । এখন যাও।
—মেঘ আর কথা না বাড়িয়ে মুখ কালো করে নাস্তার ট্রে নিয়ে দরজা পর্যন্ত আসতেই
—এই শোন
মেঘ ভাবে মনে হয় সৈকত নাস্তা করবে তাই থামতে বলছে। মেঘ মনে মনে খুশি হয় কারণ ও নিজেও তো এতক্ষন না খেয়ে বসে আছে। অবশ্য ক্ষুদাটা অনেক আগেই লেগেছে কিন্তু সৈকতের জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করছিল। কেউ কিছু মনে করুক আর না করুক নতুন বিবাহিত স্বামী-স্তী এক সাথে বসে খাবার খাবে এটা দেখতে ভাল লাগে।মেঘের মনে অনেক ছোট ছোট স্বপ্ন ছিল বিয়ের পর দুজনে বসে খাবে মাঝে মাঝে একে অন্যর মুখে তুলে খাইয়ে দিবে —–
—জ্বী বলুন।
—তোমার ঐ সাইরেন টাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও।
—মানে??সাইরেন আবার কি??
সৈকত চোখ দিয়ে ইশারা করে বলে ওই যে ওটা।
মেঘ তাকিয়ে দেখে সৈকত ফোনকে সাইরেন বলছে।
—আপনি এটাকে সাইরেন কেন বললেন?
—তাহলে কি বলবো?সময় নেই অসময় নেই পু করে বেজে ওঠে । কি দরকার এসব ঝামেলা সঙ্গে রাখার ??
—আপনি সবসময় সবকিছুকে এত ঝামেলা মনে করেন কেন??এটা না থাকলে বর্তমান সময়ে মানুষকতটা অসহায় সেটা জানেন না ??
—হুম অসহায় না ছাই। মানুষ যে একটু শান্তি মতো ঘুমাবে ,খাবে,কারো সঙ্গে বসে কথা বলবে তার কোন উপায় নেই এটা এমন একটা চিজ যে অলটাইম কোন না কোন কাজে বাগড়া দিবেই।
—কেন মনে হচ্ছে আপনি ফোন ব্যবহার করেন না?
—না ,করি না। কারণ ওটা ব্যবহার করার আমার দরকার হয়না। যদি আমাকে কখনও কারো দরকার হয় তাহলে ঠিক সে আমাকে খুজে বের করবে। আগের দিনের যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা ভুলে গেছ।
মেঘ রুমের চারপাশটা ভাল করে তাকিয়ে দেখে সত্যি রুমে কোন ফোন বা টেলিফোন লাইন ও নেই । সৈকত তাহলে সত্যিই কোন ফোন ব্যবহার করে না।
মেঘ ফোনটা হাতে নিয়ে বের হওয়ার আগে সৈকতের দিকে তাকাই।
সৈকত কোন কথা না বলে শুইয়ে পড়ে।
মেঘ দরজা টেনে দিয়ে বাইরে চলে আসে। ————**——**——**————
মেঘ ,এই মেঘ
মেঘ চোখ মেলে তাকাতেই দেখে রোজি তার পাশে দাড়িয়ে আছে।
মেঘ তাড়াতাড়ি করে আধশোয়া থেকে উঠে বসে।
—তুই এখানে স্টাডি রুমে আর আমি তোকে সারা বাড়ি খুজে আসলাম। সৈকতের কাছে জিঙ্গাসা করলাম ও বললো জানে না।
—আসলে ভাবি এখানে এসে বই পড়ছিলাম তারপর কখন যে চোখটা লেগে গেছে বুঝতে পারিনি।
—চল হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিবি। সৈকত ডাইনিংয়ে বসে অপেক্ষা করছে।
সৈকতের ডাইনিংয়ে বসে অপেক্ষা করার কথা শুনে মেঘ একটু অবাক হল। মনে মনে ভাবে সত্যিই কি উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছে নাকি অন্য কিছু।
—কিরে চল।
—হ্যা ভাবি চলুন।
হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিংয়ে আসতেইঃ
—কি ব্যাপার কোথায় ছিলে সারা বাড়ি খুজেও নাকি তোমাকে পাওয়া যাচ্ছিল না।
—স্টাডি রুমে ।
—ওও
রোজি এসে বললোঃ
তাহলে তোরা খেয়ে নে আমি অনি কে ঘুম পড়িয়ে দিই। আর কোন কিছুর দরকার হলে মন্জু(কাজের মেয়ে)কে ডাকিস।
মেঘ হ্যা সূচক ঘাড় নাড়ায় ।
মেঘ সৈকতের প্লেটে খাবার তুলে দেয়।
—কি হল তুমি নিচ্ছ না কেন?
—আপনি খেয়ে নিন আমি পরে খাচ্ছি।
—কেন আমার সঙ্গে বসে খেতে কোন সমস্যা?
—না।
—সকাল থেকে না খেয়ে বসে আছো কেন?
মেঘ চমকে চোখ তুলে তাকাই সৈকতের দিকে।
অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওখানে সকালের সে নাস্তার ট্রেটা দেখলাম তাতে দুজনের নাস্তা ছিল । আমি তো তখন বলেছিলাম খাবনা তাহলে তুমি কেন না খেয়ে বসে ছিলে?
—কেন না খেয়ে ছিলাম সেটা আপনি জানেন না!??
—এরপর থেকে আর এরাকম করবে না। আমার খাওয়ার কোন ঠিক ঠিকানা নেই।
—এ কথাটা সকালে বলে দিতে পারতেন। তাহলে আর অপেক্ষা করতাম না। অনেকটা অভিমানের সুরে কথাটা বলে মেঘ।
—বর্তমান যুগের আধুনিক মেয়ে হয়ে তুমি যে ,সেকেলে মা চাচীদের মতো পতিভক্তি দেখাবে তাতো বুঝতে পারিনি ।
—মানে!!?
—মানে তেমন কিছু না। ঐ যে তোমার সাইরেন বাজতে শুরু করেছে এখন তোমার খাওয়া টাও ঠিক মত হবে না।
মেঘ এবার বুঝলো যে কেন সৈকত তাকে পতিভক্তির কথা বললো।
মেঘ মুচকি হাসি দিয়ে বললো আপনি খেয়ে নিন ভাইয়া ফোন করেছে একটু কথা বলি।
সৈকত একটা হাসি দিয়ে মাথা ঝাকায় ।
মুহূর্তের মধ্যে মেঘের মনে হয় মানুষটা এমন কেন এই চেনা এই অচেনা———-
(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here