#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-১১
.
.
লাইব্রেরীর ভিতরে গিয়ে ত্রয়ী থ হয়ে যায়। ছোটো রুমে বইয়ের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন রকমের বই। ত্রয়ী এক এক করে সব দেখতে থাকে হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “পরিণীতা” উপন্যাসের দিকে। ত্রয়ী উপন্যাসটা নেয় পড়ার জন্য। তারপর বেরিয়ে যায় সেই রুম থেকে। ইফতিহাও পিছু পিছু আসে।
যখন দু’জনে তাদের রুমের কাছাকাছি তখনই তাদের সামনে এসে ইনান দাঁড়ায়।
ইনানকে দেখে ত্রয়ী ও ইফতিহা গোপনে ঢোক গিলে। ত্রয়ী তার হাত দু’টো পিছনে নিয়ে যায়।
ইনান দু’জনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছোড়ার আগেই ইফতিহা বলে,
– ভাইয়া তুমি এদিকে?
ইনান সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– তোর রুমে গিয়েছিলাম। তোকে রুমে না পেয়ে ত্রয়ীর রুমে গিয়েছি। কিন্তু তোরা রুমে নেই। কোথায় গিয়েছিলি এতো রাতে?
ত্রয়ী তোতলানো সুরে বলে,
– ক-ক-কই এতোরাত? মাত্র তো সাড়ে এগারো টা বাজে।
ইনান ধমকে বলে,
– সে যতটাই বাজুক। কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?
ইনানের ধমকে আত্মা কেঁপে উঠে দুজনের। ধরা পড়ে গেছে ভেবে ইফতিহা কান্নারুদ্ধ কন্ঠে বলে,
– আসলে ত্রয়ী আপু জোনাকি পোকা ধরতে চেয়েছিলো, তাই ছাদে গিয়েছিলাম।
ত্রয়ী ভেবেছিলো এই বুঝি ইফতিহা ভয়ের চোটে সত্যি কথাটা বলে দিবে। কিন্তু না! মেয়েটার বুদ্ধি আছে বলা যায়। ইফতিহার কথার সাথে তাল মিলিয়ে ত্রয়ী টেনে টেনে বলে,
– হ্যাঁ, আ-আ-স-স-লে আ-আমার জোনাকি পোকা ধরতে খুব বে-বেশি ইচ্ছে ক-করছিলো তাই…
ত্রয়ী কে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে ইনান বলে,
– জোনাকি পোকা ধরার ইচ্ছে তাহলে সেটা তোমাদের গ্রামে থাকাকালীন বললে না কেন? গ্রামে বেশি থাকে এসব।
ত্রয়ী বোকার মত হেসে বলল,
– তখন তো ইচ্ছে হয়নি। এখন হয়েছে। হেহেহে।
ত্রয়ীর সাথে সাথে ইফতিহাও হেসে দিয়ে বলে,
– হেহেহে, এটা সত্যি ছিলো।
ইফতিহার কথা শুনে ইনান চোখ বড় বড় করে বলে,
-এটা সত্যি ছিলো মানে? তাহলে বাকি গুলো কি মিথ্যা ছিলো?
ইফতিহার বোকা বোকা কথার জন্যই তারা ধরা পরে যাবে ভেবে ত্রয়ী তার পা দিয়ে ইফতিহার পায়ে আঘাত করে। আঘাতের চোটে ইফতিহা চেঁচিয়ে উঠে,
-আউচচ।
ইনান এবার ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
– কী হলো তোর?
ইফতিহা ত্রয়ীর দিকে তাকাতেই ও চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা দিতেই সে বলল,
– না মানে.. ইয়ে.. মানে.. মশা কামড় দিয়েছে।
ইনান চারপাশে তাকিয়ে দেখে বলল,
-এখানে তো একটা মশাও নেই।
এবার ইফতিহা কি বলবে ভেবে না পেয়ে ওর হাত দুটো পিছনে নিয়ে ত্রয়ীর হাতে চিমটি কাটতেই ত্রয়ীও চেঁচিয়ে উঠে।
তা দেখে ইনান বলে,
– তোমার আবার কী হলো?
ত্রয়ী মুখে হাসি টেনে এনে বলে,
– ও-ঐ যে মশা।
-মশা কি শুধু তোমাদেরকেই দেখতে পায়? কই আমাকে তো কামড় দিচ্ছে না?
ত্রয়ী মুখ টিপে হেসে বলে,
– এর জন্য আপনার আফসোস হচ্ছে বুঝি? মশার কাছে হয়তো আপনার রক্ত তেতো লেগেছে তাই কামড় দিচ্ছে না। আমাদের দুজনের রক্তে হয়তো সে মিষ্টি ঘ্রাণ পেয়েছে।
ত্রয়ীর কথা শুনে ইফতিহা মিটমিট করে হাসছে। ইনান কটমট করে করে বলল,
– কী বললে?
ত্রয়ী হাসি থামিয়ে দিয়ে থতমত খেয়ে বলে,
– বললাম, আপনার রক্ত অনেক মিষ্টি আর মশার মেবি সুগারের প্রবলেম আছে। তাই সে আমাদের তেতো রক্ত খাচ্ছে।
ইনান অগ্নিদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যেতে নিয়েও থেমে যায়। তা দেখে ত্রয়ী বলল,
– কী হলো?
-তোমার হাত পিছনে কেন? কী আছে হাতে?
ত্রয়ী হাতের বই পিছন থেকে ইফতিহার হাতে পাচার করে দিয়ে বলে,
– কই কিচ্ছু না তো, কিচ্ছু নাহ।
-হাত দেখাও?
ত্রয়ী হাত দুটো সামনে আনতেই ইনান দেখে হাত ফাঁকা।
-ঠিক আছে। রুমে যাও। অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে।
ত্রয়ী আর ইফতিহা মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বলে। তারপর দুজনের রুমের দিকে ভো দৌঁড় দেয়। রুমে গিয়ে দুজনেই বুকে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। একটুর জন্য ধরা খেতে খেতেও বেঁচে গেছে তারা। দুজনেই দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশস্ত হাসি দেয়। ত্রয়ী বইটা নিয়ে নিজের রুমে যায়। বেডে শুয়ে বুকের উপর চেপে ধরে রাখে বইটা। এই বইয়ে ইনানের ছোঁয়া আছে ভেবে নিজের ঠোঁট দুটো দিয়ে বইটাকে পরম আবেশে ছুঁয়ে দেয়।
___________________________________________________________
সকালে প্রতিদিনকার মতো ব্রাশ করতে করতে ত্রয়ী ছাদে যায়। ইনান এসে পিছন দিক থেকে ত্রয়ীকে জড়িয়ে ধরে। ত্রয়ী বিস্মিত হয়ে যায়। বিস্ময়ের সপ্তম আকাশে হা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলে,
– আপনি এখানে?
ইনান ঘুম ঘুম চোখে বলে,
– তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তাই চলে এসেছি।
ত্রয়ী মৃদু হেসে বলে,
– কেন? প্রেমে পড়েছেন নাকি?
ইনান ত্রয়ীর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলে,
– উহু, প্রেমে পড়িনি, ভালোবেসেছি!
-প্রেম আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য কী?
ইনান ত্রয়ীর কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
– প্রেম মানে হলো,
“গোছালো চুলে, কাজলে কিংবা টিপে তোমাকে আমার ভালো লাগে।
কিন্তু ভালোবাসা মানে,
এলোমেলো চুলে, ক্লান্তির ছাপ নিয়ে তোমাকে দেখতেও আমার একরাশ মুগ্ধতা কাজ করে। তুমি যেমন, তেমনই আমার ভীষণ ভালোলাগে।
প্রেম মানে,
আমার কাছে তোমাকে পরিপাটি কিংবা অসাধারণ মেয়ে হতে হবে।
অথচ ভালোবাসা মানে,
তুমি অতি সাধারণ কিংবা অনিন্দ্য কিছুই নও,
তবুও আমার কেবল তোমাকেই চাই। তুমি হলেই হবে।”
ইনানের মুখে প্রেম আর ভালোবাসার পার্থক্য শুনে ত্রয়ী ডুকরে কেঁদে উঠে । বলে,
– আমারও শুধু আপনি হলেই হবে। শুধু আপনি…
হঠাৎ ত্রয়ী তার চোখে মুখে পানির ছিটা পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসে।
তা দেখে রাবেয়া নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
– কি হয়েছিলো তোমার মা? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলে?
ত্রয়ী ঘুম ঘুম চোখে সবার দিকে তাকায়। এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো ভেবে মন খারাপ হয়ে যায়। মৃদু কন্ঠে বলে,
– কিছু হয়নি তো।
রাবেয়া বলেন,
– তাহলে বিড়বিড় করে কী বলছিলে?
ত্রয়ী স্বপ্নে বলা কথাগুলো মনে করে। সাথে সাথে ওর বুকে হাতুড়ি পিটা শুরু হয়ে যায়। অন্যদিকে ফিরে নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর শীতল গলায় বলে,
– জানিনা কী বলেছি। মনে করতে পারছি না।
-আচ্ছা সে যাই হোক, তুমি বেডে না ঘুমিয়ে ফ্লোরে ঘুমোচ্ছিলে কেন?
উদ্বিগ্ন কন্ঠে কথাটা জিজ্ঞেস করে রাবেয়া হক।
উনার কথায় ত্রয়ী নিজের দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করে আসলেই সে ফ্লোরে বসে আছে। কিন্তু ও তো বেডে শুয়েছিলো তাহলে ফ্লোরে আসলো কীভাবে? পড়ে গেছে? তাহলে ব্যথা পেলো না কেন? নাকি স্বপ্নে এতোটাই বিভোর ছিলো যে ব্যথা পেয়েছে কিন্তু সেটা তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দেয়নি?
ত্রয়ী কিছু বলছে না দেখে ইফতিহা বলে,
– আম্মু, ত্রয়ী আপু হয়তো পড়ে গেছে। এখন লজ্জার জন্য আমাদের বলতে পারছেনা। আমি তোমাকে বললাম না? আমার রুম থেকে একটা বিকট শব্দ শুনেছি। সেটা হয়তো আপুর পড়ে যাওয়ার শব্দ ছিলো।
ইফতিহার কথা শুনে ত্রয়ীর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে লজ্জায়। এতো বড় হয়েও কীভাবে সে বেড থেকে পড়ে যেতে পারে?
এদিকে ত্রয়ী পড়ে গেছে শুনে সবাই হাসছে তবে আড়ালে। এমনিতেও মেয়েটা লজ্জা পেয়েছে। এখন ওর সামনে হো হো করে হেসে দিয়ে আর নতুন করে কেউ ওকে লজ্জায় ফেলতে চায় না।
ত্রয়ী চারপাশে তাকিয়ে দেখে ইনান আসে নি। এর জন্য সে আবারও নিঃশ্বাস ছাড়ে। অন্তত তার সামনে এমন লজ্জাজনক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি ওকে। এটাই অনেক।
রাবেয়া ইয়াদ কে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে বলেন,
– ত্রয়ী তুমি একা ঘুমাতে পারবে নাকি ইফতিহা থাকবে তোমার সাথে?
– না না আন্টি আমি একাই থাকতে পারবো।
-আচ্ছা তাহলে বেডে শুয়ে পড়ো। একা উঠতে পারবে তো?
-পারবো।
ত্রয়ী বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে গেলেই কোমরে টান খায়। ব্যথায় কাতরে উঠে।
তা দেখে রাবেয়া হক আর ইফতিহা ধরে ওকে উঠায়। ইফতিহা বলে,
– আম্মু আমি ব্যথার ঔষধ নিয়ে আসি। পড়ে যাওয়াতে হয়তো বেশ ব্যথা পেয়েছে আপু।
-হ্যাঁ, জলদি নিয়ে আয়।
ইফতিহা ঔষধ নিয়ে আসলে ত্রয়ী সেটা খেয়ে নেয়। তারপর চোখ বন্ধ করে ফেলে। রাবেয়া হক ত্রয়ীর মাথাত হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। সাথে ইফতিহাও যায়।
সবাই চলে যাওয়ার পর ত্রয়ী ওর দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে বলে,
-ইশ কি লজ্জা! কি লজ্জা!
ভাগ্যিস উনি সামনে ছিলেন না। আচ্ছা স্বপ্নে যে কথাগুলো উনি আমাকে বললেন, তা কি বাস্তবেও বলবেন?
সত্যিই কি উনি আমার প্রেমে পড়বে? না, না, প্রেম নয়, ভালোবাসবে তো?
.
.
চলবে।