বেখেয়ালি মনে পর্ব-৪৩

0
667

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৪৩
.
.
কয়দিন ধরেই ইনানের ঘুম ভালো হচ্ছে না। রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে কতোবার যে জেগে জেগে উঠে, হিসেব নেই। ওর শুধু মনে হয় কেউ ওকে ডাকছে, ওকে মনপ্রাণে টানছে গভীরভাবে। ইনান ঐ অজানা ডাকেই সাড়া দিতে চায়; কিন্তু তখনি ওর ঘুম ভেঙে যায়। ইনান লাফ দিয়ে উঠে পড়ে ঘুম থেকে। অস্থিরভাবে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। উঠে এক গ্লাস পানি খায়। ইনানের ঘাম ঝরছে। ওর চোখের সামনে কিসব দৃশ্য জানি ঝাপসা ঝাপসা ভেসে উঠছে। কিন্তু ইনান সেসব স্পষ্টভাবে মনে করতে পারছে না।

আর ঘুমিয়ে থাকতে পারে না ইনান। ভোররাতেই জেগে যায়। আযানের সাথে সাথে ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য ইয়াদকে ডেকে নিয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যেও রওনা হয়। নামাজ শেষে দুই ভাই মিলে মর্নিং ওয়াকটাও সেরে নেয়। তারপর বাড়ি ফেরার পথে ইয়াদ একটা দোকানের সামনে খানিকের জন্য একটু থেমে দাঁড়ায়। ইনানও ইয়াদের সাথে সাথে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কী রে? কিছু কিনবি নাকি?

ইয়াদ কিছুটা উশখুশ করছিলো। ইনান আবারো প্রশ্ন করে,
-ঐ কী হলো? কী কিনবি? কিনলে তাড়াতাড়ি কিনে নে। খুব খিদে পেয়েছে ভাই। গিয়েই রাক্ষসের মতো খেতে বসে যাবো।
কথাটা বলেই একটা হাসি দেয় ইনান। ইয়াদও হাসে ওর সাথে। তারপর ইনানকে জিজ্ঞেস করে,
-ভাইয়া, আমি তো টাকা নিয়ে বের হইনি। তোমার কাছে ১৫ টাকা হবে?
ইয়াদের কথা শুনে হাসতে থাকে ইনান,
-আরে মাত্র ১৫ টাকার জন্য এতো আমতা আমতা করছিলি? বড় ভাইকে এটা বলতে আবার এতো সময় লাগে?

কিন্তু সাথে সাথেই আবার ওর মুখের হাসিটা বিলীন হয়ে যায়। ইয়াদ কিছু বলার আগেই ইনান যুক্ত করে,
-কিন্তু ইয়াদ.. আমার কাছেও তো এখন টাকা নেই। দরকার হয় না। তাই আর কি। কিন্তু দাঁড়া আমার সাথে আমার ফোন আছে তো।
বলেই ইনান ওর ফোনটা পকেট থেকে বের করতে থাকে আর বলে,
-নে এখন বিকাশে দেখি কত টাকা আছে। হাজার দেড়েকের মতো ছিলো মনে হয়। তুই তোর ইচ্ছেমতো টাকা তুলে নে যা।
-না না ভাই। আমার তো শুধু ১৫ টাকা হলেই চলবে। থাকুক, আমি পরে কিনে নেবো’খন।

ইনান চোখ রাঙিয়ে তাকায় ইয়াদের দিকে,
-পরে কেন কিনবি? আমার ভাইয়ের এখন কিনতে ইচ্ছে হয়েছে, তো এখনি কিনবে, ব্যস! তুই তাহলে ১০০ টাকাই তুলে নে যা। তারপর বাকি টাকা তোর কাছে রেখে দিস।
-না না ভাই। থাকুক না?
-চুপ। যা বলছি, তা-ই কর্ যা!
ইয়াদ আর কথা বাড়ায় না। একটা প্রাণখোলা হাসি হেসে পাশের দোকান থেকে বিকাশ থেকে টাকা তুলে নেয়৷

টাকা তোলা শেষ হলে ইনান ইয়াদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-তা তুই কিনবি কী?
ইয়াদ দাঁত বের করে হেসে উত্তর দেয়,
-একটা চিপস কিনবো। মিস্টার টুইস্ট!
ইনান অবাক হয়ে তাকায়,
-কেন?
ইয়াদ একটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলে,
-না মানে.. অর্পি মিস্টার টুইস্ট খেতে খুব পছন্দ করে কি-না। তো চিপসটা দেখেই ওর জন্য নিতে ইচ্ছে হলো। ইফতিহা তো ওটা পছন্দ করে না, নাহলে ওর জন্যও নিতাম।

ইনান হাসে কথাটা শুনে। তারপর বলে,
-আরে বোকা, তাহলে একটা করে নিবি কেন? শোন, ১০০ টাকায় যতটা মিস্টার টুইস্ট হয়, ততোটাই নিয়ে নে। পাগল।
বলেই ইনানও হাসতে থাকে। আর ইয়াদও ইনানের জোরাজুরিতে চিপস কিনে খুশিমনে বাড়ির পথে হাঁটা লাগায়।

কিন্তু এদিকে অর্পির এই চিপস পছন্দের কথা শুনে ইনানের মনে আবারও কি যেন ঘুরঘুর করতে শুরু করে।

অর্পি ইয়াদের স্ত্রী। বিয়ে হয়েছে বছর খানেক হবে। ইয়াদ আর অর্পি একই ভার্সিটিতে পড়তো। ঘটনাক্রমে ধীরে ধীরে অর্পিকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলো ইয়াদ। কিন্তু ভালোবাসতে ভয় পেতো। ওর বড় ভাইয়া ইনানের কথা মনে হয়ে যেতো। যদি শেষমেশ ভালোবেসে ইনান আর ত্রয়ীর মতো ইয়াদও অর্পিকে না পায়?

তাই একদিন সাহস করে ইয়াদ ওর পরিবারকে অর্পিকে পছন্দ করার কথা খুলে বলে। ও বিয়ে করতে চায় অর্পিকে। ওরা যেন সম্বন্ধ নিয়ে যায়। বিয়ে হলে ভালোবাসাবাসি হবে, নাহলে এখানেই থেমে যাক সব। ইনানের মতো কষ্ট ও সহ্য করতে পারবে। যে চোখে দিনরাত নিজের ভাইকে এসাইলামে ভালোবাসার মানুষটার পাগলামি করতে দেখেছে, সেই চোখে ও আর অন্য কাউকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখার সাহস করতে পারে না।

ছেলের কথা শুনে মোস্তফা হক আর রাবেয়া হকও বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে অর্পির বাড়িতে উপস্থিত হন। সব দেখে শুনে আলহামদুলিল্লাহ দুই পরিবারই ওদের বিয়েতে খুশি খুশি রাজী হয়ে যায়। মেয়ের বাড়ি থেকে খুব জলদি দিনক্ষণ দেখে বিয়েটা সেরে ফেলার জন্যও তাগাদা দিতে থাকে। কিন্তু ইনান ওর মানসিক অসুস্থতার দরুন তখনও এসাইলামে, ইনানকে বাদ দিয়ে কীভাবে ওরা ইয়াদের বিয়ে দেবে?

ওদিকে কন্যাপক্ষও আর অপেক্ষা করতে চাইছিলেন না। অবশেষে দুই পক্ষের সম্মতিতেই এক শুক্রবারে ইয়াদ আর অর্পির বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। দুই পরিবারের সবাই উপস্থিত। শুধু ইনান ছাড়া। ও যে তখনো এসাইলামেই চিকিৎসাধীন আছে। তাই বাহির বাহির ছেলেপক্ষের সবার মুখেই বিয়ের আমেজ থাকলেও, মনে মনে ওদের সবারই কিন্তু ইনানের কথা ভেবে চাপাকষ্ট অনুভব হচ্ছিলো।

যাকগে! অর্পির কথা মনে হতেই ইনানেরও মনে হয়, ইনান নিজেও যেমন এভাবে কার জন্য যেন চিপস কিনতো, চকলেট কিনতো, আইসক্রিম কিনতো। কিন্তু কার জন্য? ইনান ভাবতে থাকে। খুব গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে। কিন্তু ও মনে করতে পারছে না। ও শুধু ওর চোখের সামনে ঘোলাটে ঘোলাটে কিছু প্রতিচ্ছবিই অনুভব করতে পারে; কিন্তু স্পষ্টভাবে কিচ্ছুটি মনে করতে পারে না! কিচ্ছু না।

ইনান ওসব ভাবার চেষ্টা আড়ালে রেখেই ইয়াদের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে বাসায় উপস্থিত হয়।

______________________________________________________

রাতে আলফাজ সাহেব টেবিলে খেতে বসেই দেখেন নিশান আর ত্রয়ী এখনো খেতে আসে নি। উনি রিসাকে জিজ্ঞেস করে,
-বউমা, নিশান আর ত্রয়ী কোথায়? খেতে ডাকো নি ওদের?
রিসা টেবিলে খাবার আনতে আনতে জবাব দেয়,
-ডেকেছি তো বাবা।
তখনি নিশান সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে চেচিয়ে বলে,
-আমি এসে গেছি, এসে গেছি!

নিশান মাত্র চেয়ার টেনে বসতে যাবে, তখনি তিশান ওকে বলে,
-বসার আগে ত্রয়ীকেও ওর রুম থেকে ডেকে নিয়ে আয় যা।
নিশান একটু বিরক্তভাব নিয়ে দুষ্টামি করে বলে,
-ধুর সবাই কাজ করানোর জন্য শুধু আমাকেই পায়!
তিশান হেসে নিশানের পিঠটা হালকা চাপড়ে দেয়।
নিশানও হাসতে হাসতে ত্রয়ীকে ডাকতে ওর রুমের দিকে চলে যায়।

দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকতেই নিশান দেখে ত্রয়ী ফ্লোরে হাটুগেড়ে দুহাতের উপর মাথা নিচু করে বসে আছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। নিশান ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ওর দিকে,
-এই ত্রয়ী, কী হয়েছে তোর?
নিশান গিয়ে ত্রয়ীর মাথাটা তুলে ধরে। মুখ তুলতেই দেখে ত্রয়ীর চোখ মুখ ফুলে একদম লাল হয়ে আছে। চোখদুটোও ভেজা ভেজা। নিশান আতঙ্কিত মনে জিজ্ঞেস করে,
-এই বোন, কাঁদছিলি তুই? কাঁদে না বোন। আয় নিচে খেতে আয়। চল্ ওয়াশরুমে চোখমুখ ধুয়ে নিবি।

নিশানের কথা শুনে ত্রয়ী আবারও কান্নায় ফেটে পড়ে,
-ভাইয়া, আমি ইনানকে ভুলতে পারি না ভাইয়া। আমি ওকে ছাড়া বাঁঁচবো না ভাইয়া। বিশ্বাস করো নিজেকে এখনি পুরো লাশ মনে হয় আমার। তুমি ইনানকে আমার কাছে এনে দাও ভাইয়া প্লিজ? তোমার পায়ে পড়ি।
-কাঁদে না ত্রয়ী, কাঁদে না। শান্ত হ। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখ্। উনি যা করেন, সব বান্দার ভালোর জন্যই করেন। যা ফ্রেশ হয়ে আয়, প্লিজ বোন? আমি অপেক্ষা করছি জলদি আয়। প্লিজ?
নিশানের করুণ অনুরোধ দেখে ত্রয়ী চেয়েও আর কোনো কথা বলতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে।

ত্রয়ী আর নিশান দুজনেই ডাইনিং রুমে এসে চেয়ার টেনে খেতে বসে। ত্রয়ী একদম চুপচাপ। কোনোরকম টু শব্দটিও করছে না। এমনকি মুখ তুলেও কারোর দিকে তাকাচ্ছে না। অবশ্য এমনটা ওর প্রায় নিত্যদিনকারই স্বভাব হয়ে গেছে। পরিবারের সবার থেকেই ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়েছে। একমাত্র নিশান ছাড়া। কারণ একমাত্র ওর এই ভাইটাই যে ওকে খুব বুঝে, ওকে সাপোর্ট করে, ভরসা জোগায়।

খাওয়ার মাঝখানেই হঠাৎ আলফাজ সাহেব ত্রয়ীর বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে। মিসেস তনয়ার উদ্দেশ্যে উনি বলেন,
-শুনেছো? আফতাহি তো ত্রয়ীকে বিয়ে করতে রাজী। ওর বাবাও খুব শিগগিরই বিয়ের দিন তারিখটা ঠিক করে ফেলতে চান।

কথাটা শুনেই ত্রয়ী আৎকে উঠে। মিসেস তনয়া ব্যাপারটা বুঝেও ত্রয়ীকে বললেন,
-শোন্ ত্রয়ী, আমরাও খুব জলদি তোর আর আফতাহির বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই। আশা করি, কোনোরকম ঝামেলা বাধাবি না তুই।
কথাটা শুনেই ত্রয়ী খাবারের প্লেটটা ছুড়ে ফেলে দেয় ফ্লোরে, আর চেচিয়ে বলে,
-মা, আমি ইনানকে ছাড়া আর কাউকেই নিজের স্বামী হিসেবে মানতে পারবো না। আর কাউকেই না!

মেয়ের কান্ড দেখে তনয়া মুহুর্তেই চেয়ার ছেড়ে উঠে ত্রয়ীর কাছে গিয়ে বাম হাতে ওর চুলের মুঠি ধরে হুংকার দিয়ে উঠে,
-এত্তো তেজ হয়ে গেছে তোর? তাই না? আজকের এই দিন দেখার জন্য তোকে এতো আদর যত্ন করে বড় করে তুলেছি আমরা? হ্যাঁ?
মা মেয়ের এমন অবস্থা দেখে ওখানে উপস্থিত সবাইই স্তম্ভিত হয়ে গেছে। নিশান ত্রয়ীর কষ্টটা অনুভব করে দুঃখে মাথা নত করে ফেলে। ও এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু ওর হাতে করার মতো কিছুও নেই।

তনয়া আবারো রাগীকন্ঠে ত্রয়ীকে বলতে থাকে,
-তোর বিয়ে তো আফতাহির সাথেই হবে। আমাদের কি মাথা খারাপ? যে ঐ পাগল ইনানের সাথে তোর বিয়ে দেবো? কখনোই না! এবার তো যত জলদি সম্ভব, ততো শীঘ্রই তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করবো আমরা। দেখে নিস।
বলেই উনি আবার আলফাজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-তোমার আদরের মেয়ের কী অবস্থা দেখেছো তো? খুব তো মেয়েকে মাথায় তুলে রাখতে! আজ দেখলে তো? এক বাইরের ছেলের জন্য তোমার মেয়ে আমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করছে? হাহ্!
কথা শেষ করেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেন।

আলফাজ সাহেব তনয়ার সাথে সম্মতি জানিয়ে রাগ চেপে ত্রয়ীকে গম্ভীরমুখে বলেন,
-শোনো ত্রয়ী। তোমাকে নেহাত খুব ভালোবেসে বড় করেছি আমি, তাই এখনো খুব ভালোভাবেই কথা বলছি তোমার সাথে। বেয়াদবি করো না। ইনানকে ঝেড়ে ফেলো মাথা থেকে। আমরা খুব জলদিই আফতাহির সাথে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবো।
ত্রয়ী কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে,
-বাবা! তুমি তো আমায় সেই ছোটবেলা থেকেই যা চেয়েছি, তা-ই দিয়েছো। সবসময় আগলে রেখেছো। তাহলে এখন কেন তোমার মেয়ের খুশিটাকে গুরুত্বটা দিচ্ছো না? কেন বুঝতে পারছো না বাবা? আমি ইনানকে ছাড়া বেঁচেও মরার মতো আছি বাবা। আমি ইনানের সাথে হাসিখুশি বাঁচতে চাই বাবা। অন্য কারোর সাথে না। প্লিজ আমার ইনানকে ফিরিয়ে দাও! প্লিজ?

ত্রয়ীকে এমন অসহায়ের মতো কান্নাকাটি করতে দেখেও আলফাজ সাহেব বা মিসেস তনয়ার হৃদয় গলে না। আলফাজ সাহেব মেয়ের দিকে আর তাকিয়েই দেখেন না। খাবার ফেলে রেখেই চেয়ার থেকে উঠে যান আর কঠোরভাবে বলেন,
-ত্রয়ীর বিয়ে হবে, তো শুধুই আফতাহির সাথেই হবে। আর এটাই শেষ কথা!
বলেই আলফাজ সাহেব গটগট পায়ে ওখান থেকে প্রস্থান করেন। মিসেস তনয়াও ত্রয়ীর থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যান। তিশান, নিশান আর রিসা নিরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে রয়। ত্রয়ী তখনো কাদছেই।
রিসা পরে ত্রয়ীকে সামলাতে সামলাতে ওখান থেকে নিয়ে যায়।

.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here