#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৩৪
.
.
নিশান কল রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে ইফতিহা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আকস্মিক কেঁদে উঠায় নিশান হকচকিয়ে যায়।
ভয়াল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– এই মেয়ে, কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?
ইফতিহা হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,
– ভাইয়া!
ভাইয়া শব্দটা উচ্চারণ করেই আবারও ফুঁপানো শুরু করে মেয়েটা। নিশান ওকে মিনিট দু’য়েক সময় দেয় নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য।
ইফতিহা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– ইনান ভাইয়ার কন্ডিশন আগের থেকে ক্রিটিকাল হয়ে উঠেছে।
ইনান নামটা শুনে নিশান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। থমথমে গলায় বলল,
– তুমি গিয়েছিলে ভাইয়ার কাছে?
– না, ইয়াদ ভাইয়া আর ভাবী গিয়েছিলো। ভাবীকে দেখেই ইনান ভাইয়া উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। বুঝোই তো মানসিক রোগীরা চাইলে কি কি করতে পারে।
এ বলেই ইফতিহা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে। নিশান তাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো কথা খুঁজে পায়না। আজ পাঁচটা বছর ধরে এভাবেই রোজ কাঁদে মেয়েটা! শুধু ও না, ওর বাসার বাকি লোকগুলোও একই ভাবে কাঁদে।
আর এদিকে ত্রয়ী! ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। হাহ্! প্রানবন্ত একটা ছেলেকে চোখের নিমিষেই পাগল করে দিলো।
সময় করে এক ফাঁকে গিয়ে ইনানকে দেখে আসতে হবে। নিশান কিছু বলার আগেই ফোন কেটে যায়।
ত্রয়ী দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে নিশানের কথাগুলো শুনেছে। এতে সে যা বোঝার বুঝে গেছে। চোখের পানি চিবুক বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ছে তার। কী এমন পাপ করেছিলো সে? যার জন্য তাকে আজ এই কঠিন দোটানায় পড়তে হচ্ছে?
এমন প্রশ্ন মস্তিষ্কে সারাক্ষণ ঘুরে। কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না।
_______________________________________________________
ভোরবেলায় ফজরের নামাজ পড়ে ত্রয়ী বেরিয়ে পড়ে বাসা থেকে। কোথায় যাবে সে জানে না। অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে সে পা বাড়িয়েছে। ক্লান্ত হয়ে হাঁটছে সে। বাসা থেকে কিছুদূর আসার পর ত্রয়ী খোলা আকাশের পানে মুখ তুলে তাকায়।
সূর্য উঁকি দিচ্ছে। পাখিদের কিচির মিচির আওয়াজ কমে আসছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে পাখিদের মিষ্টি ডাকটা ক্রমশই কমে যায়। শরতের আকাশ দেখতে কতই না চমৎকার! নীল আকাশের মাঝে শুভ্র মেঘের ছড়াছড়ি। ত্রয়ী বহুকাল এমন মন দিয়ে আকাশ দেখে না। আজ দেখছে!
আকাশ পানে তাকিয়েই ত্রয়ীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পানি জমেছে চোখের কোণে। ত্রয়ী আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে আবারও উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে শুরু করে।
সূর্য আজ খুব তেজি হয়ে উঠেছে। খুব গরম পড়ছে আজ। ত্রয়ী ঘামছে, খুব ঘামছে! পানির তেষ্টাও প্রচুর পেয়েছে তার। আশেপাশে পানির দোকান আছে কি না ত্রয়ী দেখছে। কিছুটা এগিয়ে সে একটা চায়ের টঙ দেখতে পায়। গটগট পায়ে সেদিকটায় এগিয়ে যায় সে। পানি খেয়ে তেষ্টা মিটায়।
মাথাটা কেমন ঘুরছে তার। মনে হচ্ছে যেকোনো মুহুর্তে জ্ঞান হারাবে। মাথা চেপে ধরে বিকট আওয়াজে চিৎকার দিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে ত্রয়ী।
একটা মেয়ে হঠাৎ করে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছে এমন দৃশ্য অনেক লোক ভীড় করে দেখছে। অথচ, কেউ সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসছে না। মানুষের যে দিন দিন বিবেক লোপ পাচ্ছে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এটা!
রাস্তায় জটলা দেখে আফতাহি গাড়ি থেকে নেমে আসে। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে দেখে একটা মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে রাস্তার মাঝখানে। চুলগুলো মুখের সামনে ছড়িয়ে আছে দেখে মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে। আফতাহি ধীরে ধীরে মেয়েটার সামনে বসে। চুলগুলো সরিয়ে মুখের দিকে তাকাতেই সে হকচকিয়ে যায়।
_______________________________________________________
ইনান শুয়ে আছে একটা অ্যাসাইলামে। উন্মাদ সে এখন! ফ্যালফ্যাল চোখে ছাদের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে একা একাই খিলখিল করে হাসছে সে। হঠাৎ চোখ যায় দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক জোড়া দম্পতির দিকে।
মনের ভেতরটা মোচড় দেয়। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছে সে। চুলগুলো টেনে ধরে জোরে আওয়াজ করে সে।
মনে আসছে না তার। একটা মেয়ে মুখ আবছা আবছা চোখের সামনে ভাসছে। কে সে?
মনে পড়ছে না, কিছুতেই মনে পড়ছে না। নিশান আর ইফতিহা এগিয়ে আসে তার কাছে। ইফতিহাকে দেখেই চট করে চিনে ফেলে ইনান।
দৌড়ে এসে বোনকে জাপটে ধরে। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
-মেয়েটাকে নিয়ে আয় বোন। ওকে নিয়ে আয়। আমার একা বাঁচতে কষ্ট হচ্ছে।
ইফতিহা চোখের পানি মুছে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কাকে নিয়ে আসবো ভাইয়া? কার কথা বলছো?
-জানিনা, জানিনা কে সে। আমি তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। তুই ওকে নিয়ে আয় শুধু। একা বাঁচার যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারছিনা। আমি মরে যাচ্ছি!
নিশান ইনানকে শান্ত করার চেষ্টা করলে ইনান আবারও চেঁচিয়ে বলল,
– ধরবে না আমায়। তোমরা খারাপ প্রচুর খারাপ। তোমরা আমার থেকে ওকে আলাদা করে দিয়েছো। তুমি চলে যাও, আমার সামনে থেকে সরে যাও।
নিশান উঠে দাঁড়ায়। মানসিক ভারসাম্যহীন লোকদেরকে এতো উত্তেজিত করা ঠিক নয়। তাই সে বাধ্য ছেলের মতো ইনানের সামনে থেকে সরে যায়।
নিশান চলে যাওয়ার পর ইনান ইফতিহাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– বোন, সে আমায় অনেক ভালোবাসতো জানিস? আমাকে একটুও চোখের আড়াল হতে দিতোনা। আমি যদি কখনও একটু দেরি করে বাসায় ফিরতাম আমার সাথে খুব রাগ করতো। পাগলী মেয়ে ছিলো?
ও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো কেন বোন? ও আমাকে কেন এখন ভালোবাসে না?
আমার কাছে কেন ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার বায়না ধরে না?
ইনানের পাগলামি বাড়ছে! ইফতিহার এসব সহ্য হচ্ছে না। তার সুস্থ সবল ভাইয়ার আজ কী হয়ে গেলো?
ইনান আবার নিজে নিজেই হেসে বলল,
– এই বোন জানিস? আমি না এখন কারো নামই মনে রাখতে পারি না। মনে নেই আমার কারো নাম। এই বোন তোর নাম কী?
ইফতিহা এসব বিষয়ে এখন আর অবাক হয় না। ইনানের এক্সিডেন্টটা হওয়ার পর থেকেই মাথায় এমন প্রবলেম শুরু হয়েছে। কারো নাম মনে রাখতে পারেনা। এমনকি রিসেন্ট কয়েকবছরে পরিচয় হওয়া কোনো মানুষকেও সে এখন আর চিনতে পারেনা। ত্রয়ীকেও চিনতে পারেনা! অথচ, ত্রয়ীর সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলোর কথা ঝাপসা ঝাপসা মনে আছে! ভালোবাসা বোধয় এমনই হয়।
ইনান বলল,
– বোন, ও আমাকে ছাড়া কীভাবে থাকছে? তুই চিনিস ওকে? আমার কাছে নিয়ে আসবি একবার? আমার ওকে চাই, আমায় ওকে এনে দে না। আমি বাঁচতে পারবো না ওকে ছাড়া। জানিস, আমার দম বন্ধ লাগে ওকে ছাড়া। কে ও বল্ না?
ইফতিহা অনবরত কাঁদছে। কী বলবে ও ইনানকে? যে ত্রয়ী আর কোনোদিন তার কাছে আসবে না? ত্রয়ী অন্য কারো হতে চলেছে!
ইনানকে বললেই কি সে বুঝবে? হয়তো আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে।
– এই বোন চুপ করে আছিস কেন? বল্ না, ও কি জানে না আমি ওকে কতটা ভালোবাসি? ওর জন্য আমার হৃদয় কতটা পুড়ে?
আমায় বাঁচা বোন আমায় বাঁচা। ওকে নিয়ে আমার কাছে। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি বোন। আমার.. আমার রাতগুলো নির্ঘুমে কাটে, ও কি সেটা জানে না?
ইফতিহা উঠে দাঁড়ায়, সে আর এক মুহুর্তও এখানে থাকতে পারবে না। ভাইয়ের এমন নির্মম অবস্থা সে আর সহ্য করতে পারছে না।
ইফতিহা চলে যেতে নিলে ইনান পিছন থেকে বলে,
– চলে যাচ্ছিস বোন? আমায় বাঁচাবি না? এই বোন?
ইফতিহা কান্না চেপে দৌড়ে পালায় সেখান থেকে। ভাইয়ের বলা শেষ কথাটা সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। কীভাবে ওর ভাইকে বাঁচাবে সে? ত্রয়ী যে অন্য কারো হতে চললো।
.
.
চলবে…
.
(বিঃদ্রঃ কেউ বর্তমান এই দু’পর্ব পড়ে হতাশ হবেন না। কীভাবে কী হলো, তা আমি ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে দিবো। তাই হতাশ না হয়ে, ধৈর্য্য ধরে পড়ুন)