#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৪২
.
.
আফতাহি ত্রয়ীকে গাড়ি করে শহরের সবথেকে নামিদামি শপিং মলে নিয়ে গেলো। তারপর ভেতরে নিয়ে গিয়ে ওকে যা পছন্দ হয়, তা-ই কেনার প্রস্তাব দিলো। আফতাহি ম্যানেজারকে ডেকে ওখানকার কর্মীদের বলে সবথেকে দামি দামি আর সুন্দর ড্রেসগুলো দেখানোর কথা বলে দিলো। তারা একে একে ত্রয়ীর সামনে কতো রকমের বাহারি জামাকাপড় দেখানো শুরু করলো, কিন্তু ত্রয়ীর ওসবে মন নেই।
আফতাহি ত্রয়ীর মন ভালো করার জন্যই শপিংয়ে নিয়ে আসার প্ল্যান করেছিলো। কিন্তু সে রীতিমতোই ব্যর্থ। ত্রয়ীর মন শুধু ইনানের কাছেই পড়ে আছে। আফতাহি ত্রয়ীকে দামি দামি জিনিসপত্রের বিনিময়েও কখনো ইনানের ভালোবাসার সাথে পাল্লা দিতে পারবে না। ইনানের ভালোবাসা তো অমূল্য; যার সাথে আর কোনো কিছুরই তুলনা চলে না।
ত্রয়ীর ইনানের দেওয়া শেষ উপহারটার কথা মনে পড়ে যায়। ত্রয়ীর পছন্দের বেশ কয়েক ডজন চুড়ি। ইনান যখন সিলেট থেকে ফিরেছিলো, তখন আগেভাগেই ত্রয়ীর অভিমানটা বুঝে নিয়ে ওর মান ভাঙানোর জন্য চুড়িগুলো কিনে নিয়ে আসে। কাঁচের রেশমি চুড়ি। ত্রয়ী ওসব পেয়ে কতো যে খুশি হয়েছিলো, বলার বাহিরে!
টানা বেশ কয়েকদিন ধরে সেই চুড়িগুলোই হাতে পড়ে পড়ে ঘুরতো, আর ইনান আসলেই ইচ্ছে করেই রিনিঝিনি আওয়াজ করতো। ইনান হাসতো, খুশি হতো। আর তাৎক্ষণিকভাবে কতশত কবিতা ভেবে নিয়ে ত্রয়ীকে কাব্যিক ছন্দে উপস্থাপন করতো, সেটা ভাবতেই ত্রয়ীর বুকটা চিনচিন করে উঠে।
ত্রয়ীর আর এখানে ভালো লাগছে না। ওর পুরো অসহ্য লাগছে। ও বাড়ি যেতে চাই। বাড়ি গিয়েই ওর ইনানের দেওয়া চুড়িগুলো হাতে পড়ে ওদের পুরনো স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করবে। ও আফতাহিকে সাথে সাথেই মুখের উপর বলে দেয়,
-আমি কিছু কিনতে চাচ্ছি না প্লিজ। আমায় বাসায় দিয়ে আসুন।
আফতাহি ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-সেকি! কেন? এতো সুন্দর সুন্দর ড্রেস দেখাচ্ছেন উনারা। আপনার কি একটাও পছন্দ হচ্ছে না? তাহলে বলুন প্লিজ। উনারা আরো নতুন নতুন কালেকশন দেখাবে।
ত্রয়ী কিছুটা বিরক্তের স্বরেই বলে উঠে,
-বললাম তো ভালো লাগছে না আমার। ড্রেস যেমনই হউক, আমার কিছুই কেনার মুড নেই। বাধ্য হয়ে আপনার সাথে বের হয়েছি মানে এই না যে আপনি যা বলবেন, তা-ই করতে হবে আমায়। আমি এখন বাসায় যেতে চাইছি প্লিজ আমায় যেতে দিন!
আফতাহি কিছু বলতে যাবে, তখনি ত্রয়ী ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই আফতাহির উদ্দেশ্যে বলে,
-আপনি কি আমায় ড্রপ করে আসবেন? নাহলে কিন্তু আমি নিজেই একা একা চলে যাবো। আপনাকে একদমই দরকার নেই আমার।
-আরে রাগ করছেন কেন? আপনার ভালো না লাগলে আমার তো আর কিছু করার নেই। আমি দিয়ে আসবো। আসুন।
অগত্যা আফতাহি ত্রয়ীকে বাসায় দিয়ে আসতে রাজী হয়ে নেয়। ও ভেবেছিলো, ত্রয়ীকে এদিক সেদিক একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসলে, মার্কেটে নিয়ে আসলে ওর হয়তো ভালো লাগবে। কিন্তু আফতাহির ধারণা ভুল ছিলো। ও মনে মনে আফসোস করছে। এভাবে ঘুরতে এসেও ত্রয়ীর যে মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে, কে জানতো?
ত্রয়ীকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে যায় আফতাহি। বাসায় ফিরেই রুমে দরজা লাগিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ত্রয়ী। ইনানের চুড়িগুলো হাতে পড়ে পাগলের মতো কেঁদে কেঁদে ওদের একসাথে কাটানো দিনগুলোর কথা মনে করতে থাকে।
_______________________________________________________
ত্রয়ীর কিছুদিন ধরেই নিশানের ব্যবহারগুলো কেমন যেন অদ্ভুত অদ্ভুত মনে হচ্ছে। এমনিতে কথাবার্তা ভালোই বলে, কিন্তু হুট করে যদি ফোন করা অবস্থায় ওর সামনে চলে আসে কেউ, তবেই একটু ইতস্তত বোধ করা শুরু করে। আজ নিয়ে বেশ কয়েকদিন ব্যাপারটা লক্ষ করেছে ত্রয়ী। আজকেও ত্রয়ী যখন হঠাৎ নিশানকে কার সাথে কথা বলছে জিজ্ঞেস করলো, ও বেশ থতমত খেয়ে গেলো। আমতা আমতা করে উত্তর দিলো, ওর কোন বন্ধুর সাথে কথা বলছে।
কিন্তু তাহলে প্রতিবারই এমন অযথা অপ্রস্তুত হওয়ার কারণ কী? বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে ত্রয়ীকে। ও ওর দুই ভাই – তিশান আর নিশানের মধ্যে ছোট ভাইয়া নিশানের সাথেই খুব বেশি ফ্রি। কিন্তু ওর এই ভাইয়াই হঠাৎ এমন আজব আজব ব্যবহার করছে কেন? তাই শুধু ফোনের ব্যাপারেই! মনে হয় যেন এড়িয়ে যেতে চাইছে। আজকাল তো নিশানের ফোনটাও ত্রয়ীকে ধরতে দেয় না। অথচ আগে এমন কখনোই হয় নি।
দুপুরের শেষভাগ!
নিশান আর ত্রয়ী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কারোর মুখেই কোনো কথা নেই। নিশান ওর ফোন চাপছে। আর ত্রয়ী একটা বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে সে নিশানের দিকে তাকায় এবং জিজ্ঞেস করে,
-আচ্ছা ভাইয়া একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-হ্যাঁ বল্।
-তুমি কি কিছু লুকোচ্ছো?
নিশান কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়,
-মানে?
-আগে তো এতো খেয়াল করতাম না। কিন্তু ইদানীং লক্ষ করছি, তোমাকে হুটহাট কিছু জিজ্ঞেস করলে তুমি কীরকম জানি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাও। কোনো সমস্যা হয়েছে ভাই?
নিশান হকচকিয়ে কিছুটা নড়েচড়ে দাঁড়ায়। ফোনের স্ক্রিন অফ করে পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে,
-না না কী সমস্যা হবে আবার? কিছু হয় নি তো।
-সত্যি ভাইয়া? নাকি আমায় বলতে চাচ্ছো না তুমি?
নিশান এবার কিছুটা এগিয়ে এসে ত্রয়ীর দু’কাধে নিজের হাত দুটো রেখে বলে,
-এমন কিচ্ছু হয়নিই বোন। তুই অযথা চিন্তা করছিস। কিছু হলে তো আমি বলবোই। তোকে তো অবশ্যই! অন্তত তোর কাছে কি আমি কোনো বিষয় লুকাতে পারি বল্?
ত্রয়ী ডানে বামে মাথা ঝাঁকায়,
-উঁহু।
নিশান একটা হাসি দিয়ে ত্রয়ীর উদ্দেশ্যে বলে,
-আচ্ছা যা এখন গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নে। আমারও ঘুম ঘুম পাচ্ছে।
বলেই একটা হাই তুলে নিশান। তারপর ত্রয়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বারান্দা থেকে নিজের রুমের দিকে চলে আসে।
_____________________________________________________
নিশান ওর রুমে গিয়ে চোখ বুজে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আহ! বড্ড বাঁচা বেঁচে গেলো ত্রয়ীর কাছ থেকে! আরেকটু হলে দারোগাদের মতো জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিচ্ছিলো। এসব ভাবতে ভাবতে ফ্যানের সুইচটা চালু করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় নিশান।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকে। এপাশ ওপাশও করে। আধা ঘন্টার মতো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিশানের এখনো ঘুম আসছে না। ওর মাথায় কিছু একটার চিন্তাভাবনা ঘুরছে হয়তো। না এভাবে আর শুয়ে থাকা যায় না। ঘুম আসছে না; তো অযথা শুয়ে থেকে লাভ নেই। বরং কিছুক্ষণ একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসা যাক।
ব্যাপারটা ভাবার দু’মিনিটের মধ্যেই নিশান পৌছে যায় ছাদে। বিকেলের পরিবেশ। আকাশটা বেশ ঝকঝকে! সাদা, নীল আর ধূসর রঙের মিশ্রণ। নিশান ধীরে ধীরে ছাদের রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে যায়। গায়ে খুব ফুরফুরে বাতাস লাগছে। নিশান রেলিং ধরে ছাদ থেকে এদিক সেদিক তাকায়। চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে।
হঠাৎ দেখে এক জোড়া কপোত-কপোতী পরস্পরের আঙুল জড়িয়ে এক নির্জন রাস্তার ধীরে ধীরে পায়চারি করছে। নিশানের বুঝতে একটু বেগ পেতে হয় নি যে ওরা দু’জন প্রেমের মধ্যেই ডুবে আছে আর দুজন দুজনের ভালোবাসার আলাপেই মেতে উঠেছে হয়তো! নিশানের ঠোঁটের কোণে অজান্তেই একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে। ওর ইফতিহার কথা মনে পড়ে যায়।
প্রায় পাঁচ-ছয় বছর আগেকার হোটেলে অবস্থানকালের সেই পুরনো দিনটির কথা!
যেদিন নিশান ইফতিহার খেয়াল, যত্ন আর ভালোবাসার লোভে পড়ে নিঃসংকোচেই ওকে সারাজীবনের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে নিয়েছিলো!
ইফতিহা তো প্রথমবারে কোনো উত্তরই দেয় নি। রীতিমতো লজ্জা পেয়ে অপ্রস্তুত ভাবে ওয়াশরুমে চলে গেলো। নিশান বেকুবের মতোই হা করে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়েছিলো। ইফতিহা কি রাগ করলো? এখন কি এসে রিয়েক্ট করবে খুব? তারপর কি বাড়ির সবাইকেও বলে দেবে? হায় হায়! তাহলে তো কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে!
নিশান অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকে। হাটতে হাটতে ওদের রুমটার বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোট্ট একটা বেলকনি, তবে ভালোই। দু’চার জনের মতো মানুষ টুল নিয়ে সুন্দরভাবে বসে গল্পগুজব করতে পারবে। যাকগে! সেটা নিয়ে নিশানের মাথাব্যাথা নেই। ও চিন্তা করছে ইফতিহাকে নিয়ে। ও হয়তো একটু আগের বিষয়টা ভালোভাবে নেয় নি। নিশানের ক্ষমা চাওয়া দরকার ওর কাছে।
পেছন থেকে হঠাৎই কারোর খুকখুক কাশির শব্দ শুনে চমকে উঠে নিশান। ও পিছন ঘুরতেই দিকে ইফতিহা দাঁড়িয়ে আছে। ও নিশানের কাছে এসে বলে,
-শুধু অসুস্থতায় খেয়াল, যত্ন রাখার কথা বললেন কেন? আমি সুস্থ অবস্থাতেও আজীবন আপনার সেবা যত্ন করতে চাই। অসুস্থ হতেই দেবো না, এমনভাবেই আগলে রাখতে চাই আপনাকে।
কথাটা শোনামাত্রই নিশানের মুখে ধীরে ধীরে খুশির ঝিলিক ছড়াতে শুরু করলো। ও প্রচন্ড উল্লাসের সহিত ইফতিহার দিকে এগিয়ে বলে,
-কী বললে? এ্যা? আল্লাহ! সত্যি বলছো তুমি?
ইফতিহা কোনো উত্তর দিচ্ছে না। ওর মুখেও লজ্জামাখা হাসি।
নিশানকে মারাত্মক আনন্দিত লাগছে। খুশিতে ওর গলায় কথা পর্যন্ত আটকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে ওর। ও খুশির একটা হাসি দিয়ে ইফতিহার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-ভালোবাসো?
ইফতিহা লজ্জায় মাথা নোয়ালো। আর মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে নিশানের প্রশ্নের হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো। নিশানের খুশি তখন আর দেখে কে? এই মুহুর্তে নিজেকে একজন বিশ্বজয়ী প্রেমিক বলে অনুভব হচ্ছে ওর! ও হাসতে থাকে- খুশিতে, ভালোবাসা প্রাপ্তির খুশিতে!
সেই রঙিন মুহুর্তটা মনে করেই একটা প্রশান্তির হাসি হাসে নিশান। ছাদ থেকে আর ঐ দুজন প্রেমিক প্রেমিকাকে আর দেখা যাচ্ছে না। যাক! নিশানের কী? ওর আপাতত ইফতিহার কথা খুব মনে পড়ছে। রুমে গিয়ে ওকে কল দিয়ে বরং একটু কথা বলা যাক।
ওদের ঐদিনের সেই শুরু হওয়া ভালোবাসার সম্পর্কটা আজ অবধিও ওদের মনের পথ ধরে হেঁটে চলেছে। কিন্তু দুজন আর আগের মতো প্রকাশ্যে কারোর সাথে দেখা করতে পারে না, কথা বলতে পারে না! ওদের সম্পর্ক শুরু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই তো ওদের দুই পরিবারের মধ্যকার ঝামেলার জন্য দুজনকে চুপসে যেতে হয়।
কিন্তু তাদের ভালোবাসা মোটেও কমে নি, বরং দুজন দুজনকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যেন দিন দিন আরো বাড়ছে। ভালোবাসা তো অবুঝ! ওরা তো মনের মানুষটার সাথে মিলন ছাড়া আর কিছুই বুঝতে চায় না। যতোক্ষণ না অবধি নিজের মানুষটাকে একদম নিজের করেই আগলে রাখার দায়িত্ব পেয়ে যায়, ততোক্ষণ অবধি হাল ছাড়তে পারে না।
যাই হউক, ইনান আর ত্রয়ীকে কেন্দ্র করে ওদের পরিবারে হওয়া সমস্যাটার জন্য তাই লুকিয়েই ওদের সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, একদিন না একদিন হয়তো ওদের পরিবারের সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সবাইকে মানিয়ে নিয়ে ওরাও একত্রিত হবেই! আর ততোদিন অবধি তাদের ভালোবাসাটা লুকায়িতই থাকুক; আড়ালে, গোপনে, মনে মনে।
.
.
চলবে..