বেখেয়ালি মনে পর্ব-৯

0
820

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-০৯
.
.
ত্রয়ীর ঘুম ভাঙে সকাল দশটার পর। এমন ঘুমকাতুরে মেয়ে ইফতিহা কমই দেখেছে। কাল রাতে এসে যে ঘুমিয়েছে, সেই বিরতিহীন আজ সকাল দশটায় ভেঙেছে। বেশ গাঢ় ঘুমও বটে। ত্রয়ী রুম থেকে বেরিয়ে নিচ তলায় নেমে আসে। কাল রাতে এসে কোথায় ঘুমিয়েছে সেটাও খেয়াল নেই তার। নিচে এসেই ত্রয়ী হা হয়ে যায়। বিশাল বাড়ি। ওদের ঢাকার বাড়িটার তিন চার রুম মিলিয়ে এই বাড়ির ড্রইং রুম। মেইন ডোরের সোজা বরাবর ড্রইং রুম। তার ডান পাশে তিনটা বেড রুম। বাম পাশে কিচেন রুম আর ডাইনিং রুম। বাড়ির ভেতরেই সিড়ি তা দিয়ে দোতলায় যায়। ডুপ্লেক্স বাড়ি তবে বিশাল বড় বাড়ি।

ইফতিহা সোফায় বসে আছে। তা দেখে ত্রয়ী তার দিকে এগিয়ে যায়। ত্রয়ীকে দেখে ইফতিহা ভেজা গলায় বলল,
– বসো আপু।

ত্রয়ী ইফতিহার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো ও এখনো কাঁদছে। হয়তো দাদা ভাইয়ের খুব আদরের নাতনি ছিলো সে।
ত্রয়ী বলল,
– এখনো কাঁদছো?

ইফতিহা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ত্রয়ী ওকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– এভাবে কাঁদলে দাদা ভাইয়ের আত্মা কষ্ট পাবে। তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না উনার আত্মা কষ্ট পাক, তাই না?

ইফতিহা মুখ তুলে ত্রয়ীর দিকে তাকায়। তারপর চোখ মুছে বলে,
– না আপু আমি কখনোই চাইনা আমার দাদা ভাইয়ের আত্মা কষ্ট পাক। আমি আর কাঁদবো না।
– এইতো লক্ষ্মী মেয়ে।

ত্রয়ী রুমের এদিক ওদিক তাকাতেই ইফতিহা বলল,
– বাড়িতে কেউ নেই আপু। সবাই দাদা ভাইয়ের কবর যিয়ারত করতে গেছে। কিছুক্ষনের মধ্যে ফিরে আসবে। তুমি বরং এখন বাড়িটা ঘুরে দেখো।
– কিন্তু আমি তো বাড়ির কিছুই চিনিনা। কীভাবে ঘুরে দেখবো?
– আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি চলো।
ত্রয়ী ইফতিহার সাথে বাড়ি ঘুরে দেখবে উঠে দাঁড়ালো। দোতলায় এসে তারা থামলো।

ইফতিহা ছাদের সিড়ির বাম দিকটায় নিয়ে গিয়ে চারটা বেড রুম দেখিয়ে বলল,
– এখানের রাইট সাইডের রুম টা ইয়াদ ভাইয়ার। আর মাঝের টা আমার, তারপরের টায় ফুপ্পি আসলে থাকে। একদম লেফট সাইডেরটা গেস্ট রুম। তোমাকে যে রুমে থাকতে দিয়েছে।
ত্রয়ী ভাবছে ইনানের রুমের কথা। রুমটা কোথায় দোতলায় নাকি নিচতলায়?
ত্রয়ীকে ভাবান্তর অবস্থায় দেখে ইফতিহা বলে,
– কী ভাবছো আপু?
ত্রয়ী শীতল গলায় বলল,
– নিচতলায় কার রুম?
– নিচতলায় তিনটে রুম। তার মাঝে একটা ছোটো চাচ্চুর রুম। একটা মা-বাবার। অন্যটা দাদাভাইয়ের ছিলো।
-তাহলে ইনানের রুম কোথায়?
আপন মনে আওড়াচ্ছে কথাটা ত্রয়ী।
ইফতিহা বলল,
-চলো তোমাকে ইনান ভাইয়ার রুম দেখাই। ভাইয়া মেবি রুমে নেই।

ইনানের নাম শুনে ত্রয়ীর মন অস্থির হয়ে উঠে। খুব দ্রুত গতিতে পা ফেলে সে। ইফিতিহা সিড়ির ডান পাশে এসে থামে। হাতের আঙ্গুল দিয়ে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে বলে,
– এটা ইনান ভাইয়ার রুম। ভেতরে গেলে তোমার ওই রুম থেকে আর বেরোতে মন চাইবেনা। ভীষণ সুন্দর করে রুম টা সাজানো। ভাইয়া নিজ হাতে রুমটায় পেইন্টিং করেছে।
ইফতিহা ইনানের রুমের ডোর অবধি গেলেই নিচে ওর মায়ের গলা শুনতে পায়।
– তুমি রুমে ঢুকে দেখো। ভাইয়া রুমে নেই। আমি নিচে যাচ্ছি। সবাই বোধহয় চলে এসেছে।
কথাটা বলে আর এক মিনিটও সেখানে দাঁড়ায় না ইফতিহা। ভো দৌঁড়ে নিচে চলে যায়।

ত্রয়ী কিছুক্ষন ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে রুমে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা?
রুমের দরজা কাঁচের। বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। সে পা বাড়াতে চায় ছাদের দিকে। কারো পারমিশন ছাড়া তার রুমে ঢুকা ঠিক না ভেবে চলে যেতে নেয়। কিন্তু উতলা মনটাও যে বারবার ওদিকেই হারিয়ে যেতে চাইছে। ত্রয়ী মনের সাথে পেরে না উঠে দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করে।
রুমে ঢুকে দরজার দিকে ফিরে চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
– রুমের মালিক তো আর রুমে নেই। এতো ভয় পাওয়ার কি আছে ত্রয়ী? তুই শান্ত হয়ে রুমটা দেখে নে।

মাথা ঘুরিয়ে নিতেই চোখ যায় ডোর বরাবর বেডে থাকা মানুষটার দিকে।
ইনান ঘুমোচ্ছে। অফ হোয়াইট কালারের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের সাথে ব্লু কালারের টি-শার্ট পড়ে আছে সে। বুকের মধ্যে একটা ডায়েরি রেখে তা দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে।

ঘুমন্ত চেহারাটা খুব টানছে ত্রয়ীকে। তাই সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। রুমের এক কর্ণারে বনসাই রাখা আর তার পাশেই একটা ছোট্ট চারাগাছের টব। ব্যাপারটা বেশ কিউট লাগলো ওর। নিরবে হাসলো সে। রুমের সেন্টার টেবিলটায় একপাশে সারি সারি ছোট্ট তিনটা টব রাখা। কোথা থেকে যেন বেলি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যালকনি থেকে? হতে পারে!
ডান পাশের দেয়ালে পেইন্টিং করা বিশাল এক গাছ। অন্যপাশে বেশ কয়েকটা ওয়ালম্যাট ঝুলানো। একটা রকিং চেয়ার দেখতে পাচ্ছে ত্রয়ী। ইচ্ছে করে ওটায় বসে একটু দোল খেতে। আহা মনে হবে যেন ইনানের কোলে আরামে বসে আছে। ভেবে নিজে নিজেই একটা লজ্জামাখা হাসি দেয় সে৷ ধ্যত কিসব যে ভাবে!

বেডের উপরের দেয়ালে বাধাই করা বড় একটা ফ্রেমে ইনানের ছবি। ছবিতে ইনান হাসছে। চারপাশে চা বাগান।

ছবিটা দেখে ত্রয়ী ঢোক গিললো। ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হলো খুব। কিন্তু কেন যেন পারছে না!
রুমের একদিকে একটা কর্ণার রেক রাখা, আর তার পাশের সাইড টেবিলের উপর রাখা বেশ কয়েকটা আকর্ষণীয় শো পিস। বিভিন্ন প্রকার অর্কিড ও ক্রিপারজাতীয় গাছ দিয়ে জানালার গ্রিল সাজানো।
দেখতে দেখতে ওর ব্যালকনির দিকে চোখ যায়। ওখানের ডোরটা থাই গ্লাসের, আর তাতেও ব্ল্যাক আউট পর্দা ঝুলছে। চারপাশ দেখতে দেখতে এক অনন্যরকম আভিজাত্য খুঁজে পায় সে এখানে। সত্যিই মনোমুগ্ধকর রুম!
ত্রয়ী ব্যালকনির দিকে পা বাড়ালো। আলতো হাতে পর্দা সরিয়ে খুব ধীরে ডোর খুললো। রুমের সাথে লাগোয়া ব্যালকনি, তবুও তার বিশালতা অনেক। উপরে ছাদ থাকলেও চারপাশে গ্রিল নেই। অর্ধেক দেয়াল করা, বাকিটা খোলা। দক্ষিণমুখী ব্যালকনি হওয়ায় বাতাস আসছে শোঁ শোঁ করে।

ঝুলানো টবে নানা রকম ফুল। রেইনলিলি, মর্নিংগ্লোরি, লাকিব্যাম্বু, পামগাছ, ইঞ্চিপ্ল্যান্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। কত রকমের পাতাবাহারের গাছ! ব্যালকনির কর্ণারেই একটা লম্বা ল্যাম্প শেড রাখা৷ বাহ! ব্যালকনির ছাদ থেকে ঝুলানো রয়েছে বাহারি রকমের আলো৷
বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর ত্রয়ী পিছন ঘুরতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলো। ত্রয়ীর কোমল মুখটা কারোর প্রশস্ত বুকের স্পর্শ পায়। সাথেই সাথেই তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। দ্রুত চোখ খুলে দেখতে পায় ইনান সামনে। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম! সেকেন্ডের মধ্যে ছিটকে সরে যায় ত্রয়ী। পুরো গায়ে শিহরণ জেগে উঠে। ভেতরটা কেমন যেন করে উঠে। ইনান ত্রয়ীর এমন অদ্ভুত আচরণ বুঝে উঠতে পারেনা। তার আগেই ত্রয়ী দৌঁড়ে পালিয়ে যায় তার সামনে থেকে। ইনান চেয়ে থাকে ত্রয়ীর দৌঁড়ানোর দিকে।

_________________________________________________________

রাবেয়া হক ডাইনিং এ বসে অপেক্ষা করছেন ইনানের জন্য। কাল রাত থেকে না খাওয়া ছেলেটা। সকালেও কিছু খায়নি। ইনান আসতেই তার মুখে ফুঁটে হাসির রেখা। কাছে ডেকে বলেন,
– আয় বাবুসোনা, কী খাবি?
ইনান চেয়ারে বসে বলে,
– যা আছে তাই দাও আম্মু।
রাবেয়া ভাত আর মুরগীর মাংস দেন। সাথে পাঁচরকমের ভর্তা। ইনান খুব ভর্তা পছন্দ করে। ইনান ভাত খেতে খেতে বলে,
– বাকিদের সবার খাওয়া শেষ?
– হ্যাঁ, সবাই ভাত ঘুম ঘুমোচ্ছে। কাল থেকে সবার উপরেই তো ধকল গেছে।
– ইয়াদ কোথায়?
– রুমে আছে। কেন কোনো দরকার?
– না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। ইয়াদ ঘুম থেকে উঠলে আমার রুমে পাঠিয়ে দিও।
– ঠিক আছে।
ইনানের খাওয়া শেষ হতেই সে তার রুমে চলে যায়।

ত্রয়ীর ঘুম আসছেনা। তাই সে রুমের ভিতরেই পায়চারি করছে। হঠাৎ করেই দরজায় করাঘাত হয়।
-ত্রয়ী?
ত্রয়ী নিজের ওড়নাটা ঠিক করে নিয়ে দরজা খুলে। ইনানকে দেখে বিব্রতবোধ করে। মনে মনে আওড়ায়,
– অসময়ে উনি এখানে কেন?
ইনান ঠোঁটে হালকা হাসি এনে বলে,
– ঘুমোচ্ছিলে?
ত্রয়ী মিইয়ে যাওয়া গলায় জবাব দেয়,
– না। ঘুম আসছে না।
– তাহলে রুমে না থেকে ইফতিহার সাথে গল্প করলেও তো পারো।
– ইফতিহা তো ঘুমে।
– ইফতিহা দুপুরে হাজার মার খেলেও ঘুমোয় না। রুমে টিভি দেখছে তুমিও দেখো গিয়ে।
ত্রয়ীর মন ছোটো হয়ে যায়। ভেবেছিল, ইনান তার নিজের রুমে যেতে বলবে, তার সাথে গল্প করতে বলবে। কিন্তু এসব না করে সে ইফতিহার রুমে যেতে বলছে।
ত্রয়ী ছোটো করে বলে,
– আচ্ছা।
ইনান চলে যায়। ত্রয়ী ইফতিহার রুমের দিকে পা বাড়ায়।

___________________________________________________________

বিকেলে ত্রয়ী ছাদে যায়। ছাদেও হরেক রকমের ফুল। এই পুরো বাড়িটাই যেনো ফুলময়। ছাদের পাশেই বিশাল কৃষ্ণচূড়ার গাছ। কৃষ্ণচূড়ার শুকনো একটা ডালে এক জোড়া পাখি বসে আছে। পাখি দু’টো তাদের কিচির মিচির আওয়াজ তুলে তাদের মনের সকল অনূভুতি প্রকাশ করছে।

ত্রয়ী পাখিদের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে। তখনই ছাদে আগমন হয় ইনানের। সে পিছন থেকে বলে,
-একা যে?
ত্রয়ী মাথা ঘুরিয়ে বলে,
– সঙ্গী পাবো কোথায়?
– এখনই সঙ্গী চাও?
– সঙ্গী কে না চায়? কেউ প্রকাশ্যে চায়, কেউ কল্পনায়। পার্থক্য এতুটুকুই।
ইনান হাসে। তবে এ হাসি নিঃশব্দে নয়।
ত্রয়ী অবাক গলায় বলে,
– হাসছেন যে?
– হাসতে নেইকো মানা।
ইনানের কথায় ত্রয়ী ও হাসে। দু’জনে এক সঙ্গে হেসে উঠে।

ত্রয়ী আপন মনে বলে,

“সঙ্গী চাই, হ্যাঁ আপনাকে চাই।
আপনার মাতাল করা হাসিটার প্রেমে পড়তে চাই।
আপনার উষ্ণ ছোঁয়ায় নিজেকে আবিষ্ট করতে চাই।
সত্যিই আপনাকে চাই,
দিনে চাই, রাতে চাই।
সকাল, সন্ধ্যায় চাই।
গ্রীষ্মে, শীতে চাই।
উন্মুখ হয়ে থাকতে চাই, লোভী হয়ে থাকতে চাই।
আপনার সাথে মিশে থাকতে চাই, মিশে যেতে চাই।
শুধু আপনাকেই চাই।”

.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here