বেলির_কথা (০৩)

#বেলির_কথা (০৩)
.
.
বেলি বাড়ি এসে হাপিয়ে উঠে।দৌড়ে আসাতে এমন হয়েছে।তারপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নেয়,তারপর ঘরে ডুকে।

রুমে গিয়ে বিছানায় বসে গাল অব্ব করে আছে।ব্যাগ রেখে রুমে ই বসে থাকে।বেলিকে আসতে দেখে বেলির মা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে।
‘কি হলো?মুখ এত শুকনা লাগছে স্যার এর মার খেয়েছিস বুঝি?’
‘নাহ।’
‘তাহলে?’
‘তুমি তো সব দেখেছো?তাহলে জিজ্ঞেস করছো কেন?’

বেলির মা এবার হেসে ফেলে,
‘তাও বল শুনি? ‘

বেলি সব খুলে বলে,
‘আম্মা আমি ইচ্ছে করেই কিন্তু এমন করিনি।কোত্থেকে ছেলেটা রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল।হুট করেই পড়ে গেছে এসব।’

বেলির মা অভয় দিয়ে বলে,
‘আচ্ছা তুই ইচ্ছে করে ফেলিস নি মানে তুই অন্যায় করিস নি।তাই এত মন খারাপের প্রয়োজন নেই।আর ভয় পাওয়ার ও প্রয়োজন নেই।মনে রাখিস ভয় তারা ই পাই যারা অন্যায় করে।’

বেলি হেসে ফেলে,
‘আম্মা আমার কি মনে হয় জানো?তুমি আমাদের স্কুলের ম্যাডাম হলে অনেক ভালো হতো।একদম ম্যাডাম এর মতো ই কথা বলো।’

বেলির মা চুপ হয়ে যান।অতীতের স্বপ্ন কে মাটিচাপা দেয়ার ক্ষত টা আবার মনে পড়ে যায়।বেলির মায়ের একমাত্র স্বপ্ন ছিল শিক্ষিকা হবে।গরীব বাবার ঘরে জন্ম নিয়েও চেয়েছিল অনেক পড়বে।কিন্তু জোর করেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়।গরীব বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজ স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ে।তারপর আর পড়া হয়নি।বেলির বাবা ছিল ক্লাস ফাইভ পাশ।

তবে শাহেদকে চেয়েছিল বড় মানুষ বানাবে।অনেক পড়াবে।কিন্তু শাহেদ এর ও পড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল না।সে বাবার সাথে ই বিলে থাকত সবসময়।তারপর….!

মা কে ভাবতে দেখে বেলি বলে,
‘আম্মা কি হলো তোমার?কথা বলছো না কেন?’
‘কিছু না খেতে আয়?’
.
খাওয়াদাওয়া শেষে বেলি শুয়ে ছিল।শাহেদ যেন কোথেকে এসে চিল্লিয়ে বলতে লাগলো,
‘আম্মা বেলি কোথায়?ওরে ডাকো আজ ওর গাল দুটো আমি লাল করে ফেলবো।’

বেলির মা দৌড়ে আসেন।
‘কি হয়েছে?এত রেগে আছিস কেন?’
‘রাগব না?ও কি করেছে জানো?’
‘কি করেছে?’
‘চেয়ারম্যান চাচার ছেলে শহর থেকে আসছিল,বেলি নাকি ওরে গোবর ছুড়ে মারছে।’

বেলির মা শাহেদকে বসায়,
‘হুট করে মানুষ এর কথা শুনে তুই বেলিকে মারতে পারিস না।’
‘এত বড় অন্যায় করার পর ও মারব না?’
‘আমাকে বেলি সব বলেছে।এটা মাত্র দূর্ঘটনা।’
‘চেয়ারম্যান চাচা ভাল বলেই আমাকে আড়ালে ডেকে বলল,বোনকে যেন শাসন করি।’
‘তুই চেয়ারম্যান সাহেবকে বুঝিয়ে বলবি।’

শাহেদ চুপ করে থাকে।বেলি রুম থেকে সব শুনে ভয়ে জমে বসে থাকে।
.
পরেরদিন বেলিরা স্কুলে যাচ্ছিল।হঠাৎ পিছন থেকে ডাক পড়ে।
‘এই মেয়ে শুনো?তুমি সে না যে আমারে গোবর মেরেছিলে?’

বেলি পিছনে তাকিয়ে দেখে চেয়ারম্যান কাকার ছেলে।কাল যে ভাই আম্মারে বলেছিলো।

বেলি নরম গলায় বলে,
‘আমি তো কাল ইচ্ছে করে এমন করিনি।আমাকে ক্ষমা করে দিন।’

ভয়ে বেলি কেঁদে ফেলে।
‘আরে আরে কাঁদছ কেন?অই দেখো আচ্ছা যাও ক্ষমা করেছি।নাম কি তোমার?’
‘বেলি।’
‘বাহ সুন্দর নাম তো।আমি রামিম।এখন থেকে তোমাদের স্কুলেই পড়ালেখা করবো প্রায় দেখা হবে আমাদের।’

বেলি কিছু না বলে আবার হাটা দেয়।রিয়া,প্রিয়া, সীমা তারা ও চুপ করে চলে যায়।
____________

দেখতে দেখতে বেলি ক্লাস এইট পাশ করে।এবং ভাল ফল ও আনে।আগের চেয়ে লম্বা আর চেহারা ও অনেক মায়াবি হয়।।শাহেদ খুব খুশি বোন পড়ালেখায় ভালো করছে।গ্রামের লোকের মুখে মুখে বেলির নাম।সেটা শাহেদ কেন যেকোনো ভাইয়ের ই ভাল লাগবে।
.
শাহেদ একটা ডায়েরি কিনে আনে বেলির জন্য এবং বেলিকে দেয়।
‘ভাইয়া এটা কেন?’
‘কেন আবার লিখা লিখবি?’

বেলি ডায়েরি টা যত্ন করে রাখে।ভাই দিয়েছে বলে কথা।
.
রামিম এখন বেলিকে প্রায় ফলো করে।সেটা বেলি খেয়াল না করলে ও রিয়া খেয়াল করে।তবে রিয়ার সহ্য হয়না।কোথায় রামিম সুন্দর ছেলে আর কোথায় বেলি কালি।হিংসার বশে বেলিকে রিয়া বলে,
‘একটা বিষয় খেয়াল করেছিস?’
‘কি?’
‘রামিম ভাই সবসময় তোকে অন্যনজরে দেখে।তোর সাথে ভাব জমাতে চায়।’
‘কই না তো।’
‘হ্যা তাই খেয়াল করিস।কিন্তু আর যাইহোক তোর সাথে রামিম ভাইয়ার যায় না। ‘

রামিমের কথা বলতে বলতে সে হাজির।হাতে চিপস আর জুস।হাসিমুখে বলে,
‘নাও বেলি এসব তোমার জন্য।’
‘এসব কেন?আর আমাকে ই বা কেন দিবেন?’
‘এমনি,নাও না?’
‘নাহ নিবো না।অযতা আমি আপনার দেয়া কিছু কেন নিবো?’

রিয়া তখন হাত বাড়িয়ে বলে,
‘ভাইয়া আমাকে দেন আমি কিছু মনে করব না।’

রামিম চুপ করেই রিয়াকে দিয়ে দেয়।তারপর বেলির হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে চলে যায়।

বেলি কাগজ খুলে দেখে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,
‘আমি তোমাকে ভালবাসি,তুমি কি আমাকে ভালবাসবে?’

রিয়া ও এটা দেখে। সে মনে মনে রাগে ফেটে পড়ে। বেলির দিকে হিংসার নজরে তাকায়।বেলি কিছু মনে করেনা।কাগজটা রিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়।বেলির এমন বোকা কান্ড দেখে রিয়া অবাক ই হয়।
.
.
পরেরদিন

আজ বাবা দিবস(গল্পে বাবা দিবস ঠিক আছে?)<একটা গাল অব্ব করার ইমুজি>

আজকে স্যার বলেছে যার যার বাবাকে নিয়ে স্কুলে আসতে।ছোটখাট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।আর ক্লাসের ক্যাপ্টেন দের তাদের বাবার সম্পর্কে এবং কার বাবা কি পেশায় আছে সে সম্পর্কে ও বলতে হবে।বাবার জন্য কবিতা অথবা গান গাইতে হবে।

বেলি যেহেতু ক্লাসের ক্যাপ্টেন সেহেতু তাকে ও বক্তব্য রাখতে হবে।

সকাল থেকেই বেলির মন খারাপ।তবুও সে মন খারাপ মাকে দেখায় না।সে এমনিতে বলেছে আজ স্কুলে অনুষ্ঠান আছে।

বেলি একা স্কুলের উদ্দেশ্য বের হয়।রিয়া,প্রিয়া,সীমা তারা তাদের বাবার সাথেই যাবে।

বাবার কথা ভাবতেই বেলির চোখ ছলছল করে উঠে।সবার বাবা আছে তার নেই এটা সে ভাবতেই পারেনা।
মাঝেমাঝে স্বপ্নে আসতো এখন তো তাও আসেনা।বেলি কি পচা হয়ে গেলো?

বেলি স্কুলে গিয়ে চুপচাপ একটা বেঞ্চে বসে।সবাই বাবার হাত ধরে ধরে আসে,আর পাশাপাশি বসে।বেলির মতো আরো কয়েকজন আছে যারা একা এসেছে।

আশপাশ থেকে অনেক বাবার গল্প সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।কান্নাটা আরো তীব্রতর হলো।কারোর বাবা টিচার,কারোর ডাক্তার,কারোর চাকুরীজিবি।

বেলির বুক ফেটে কান্না আসতেছে।কেন এত তাড়াতাড়ি বাবাকে আল্লাহর কাছে যেতে হলো?আজ এ দিবসে সবাই বাবার প্রতি ভালবাসা জানায়।বাবা বেচে থাকলে প্রতিটা দিবস ই তার বাবা দিবস হতো।

ছোটবেলা থেকেই বেলির বাবা একটা গান গেয়ে গেয়ে বেলিকে আদর করতো।গানটা ই আজ বেলি গাইবে।

সবাই উপস্থিত হওয়ার পর প্রধান শিক্ষক সবাইকে অভিনন্দন জানায়।তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।তারপর অন্যান্য টিচার টাও উনাদের বাবা সম্পর্কে বলেন।রামিমের বাবা মানে এলাকার চেয়ারম্যান ও উপস্থিত তাই তিনি ও বক্তব্য রাখেন।

তারপর স্টুডেন্টদেরকে বক্তব্য দিতে বলেন।অনেকেই সুন্দর করে বক্তব্য প্রদান করে।রামিম নিউ টেন এ উঠেছে।তাকে সবাই চিনে।

রামিম ও বক্তব্য তার বাবার অনেক প্রশংসা করে পাশাপাশি গর্ববোধ করে।সবাই মোটামুটি বাবাকে নিয়ে গর্ববোধ করলো,শুধু তারা ই সংক্ষেপে বক্তব্য রাখলো যাদের বাবা দিনমজুরী অথবা কম আয়ের মানুষ।

আস্তে আস্তে বেলির ডাক পড়ে।কান্না মুছে সে উঠে দাঁড়ায়।
.
সবার উদ্দেশ্য সালাম দিয়ে বেলি বলে,
‘আমার বাবা নেই।’

কথাটা ছোট্ট হলেও সবার বুক কেপে উঠে।

বেলি বলে,
‘বাস্তবে আমার বাবা নেই।কিন্তু আমার বাবা আমার কল্পাণায় আছে।রোজ আমি বাবার সাথে কথা বলি,হাসি।আর আজিবন থেকে ও যাবে আমার মনের মাঝে।বাবাকে নিয়ে আমি কি বলবো?সে যোগ্যতা আমার হয়েছে?
এখানে উপস্থিত অনেকের বাবা ডাক্তার,টিচার,ইঞ্জিনিয়ার,চাকুরীজিবি।তাই তারা তাদের বাবাকে নিয়ে গর্ববোধ করে।কিন্তু কিছু স্টুডেন্ট আছে তারা তাদের বাবাকে নিয়ে বলতে পারেনা।কারণ তাদের বাবারা রিক্সাচালক,ভ্যানগাড়ি চালক,কৃষক।
আজ এখানে দাঁড়িয়ে আমি বলতে চাই আমার বাবা কৃষক ছিলেন।তাই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।কেন জানেন?
আমার আম্মা বলে,
‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা।’
আমি যখন হয়েছি তখন আমার বাবা চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি হয়েছিলেন।
সবশেষে বলতে চাই মন্দ হোক আর ভাল হোক বাবা,আমার বাবা।পৃথিবীতে বাবার মতো আর কি আছে কেউ বা?

বেলি চুপ হয়ে যায়।প্রধান শিক্ষক বলেন,
‘বাবাকে নিয়ে একটা কবিতা অথবা গান শুনাও?’

বেলির চোখ ছলছল হয়ে আসে।বাবার সাথে কাটানো মুহুর্ত আহ কি সুন্দর ছিল।বেলি গাওয়া শুরু করে,

‘কাটেনা সময় যখন আর কিছুতে
বন্ধুর টেলিফোনে মন বসেনা
জানলার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা
মনে হয় বাবার মত কেউ বলেনা
আয় খুকু আয়…
আয় খুকু আয়…

আয়রে আমার সাথে গান গেয়ে যা
নতুন নতুন সুর নে শিখে নে
কিছূই যখন ভাল লাগবেনা তোর
পিয়ানোয় বসে তুই বাজাবিরে
আয় খুকু আয়…
আয় খুকু আয়…

সিনেমা যখন চোখে জ্বালা ধরায়
গরম কফির মজা জুড়িয়ে যায়
কবিতার বইগুলো ছূঁড়ে ফেলি
মনে হয় বাবা যদি বলতো আমায়
আয় খুকু আয়
আয় খুকু আয়..

বেলি এবার থেমে যায়।থেমে থেমে বলে,

ছেলেবেলার দিন ফেলে এসে
সবাই আমার মত বড় হয়ে যায়
জানিনা ক জনে আমার মতন
মিষ্টি সে পিছুডাক শুনতে যে পায়
আয় খুকু আয়…
আয় খুকু আয়…

বেলি এবার হু হু করে কেঁদে উঠে।আর বলে,

‘কতদিন হয়ে গেলো আব্বা আমারে বলেনা ‘আয় খুকু আয়’ কতদিন হয়ে গেলো ‘বেলিফুল’ বলে আব্বা আদর করেনা।কতদিন হয়ে গেলো আমি আর এ ডাক টা ডাকি না ‘আব্বায়া’

মেয়ে বাবাকে এত ভালবাসে,সে মেয়ের বাবা কিভাবে এত দূরে চলে গিয়ে আর ফিরে আসেনা,এ কেমন বাস্তবতা?

উপস্থিত সকলের চোখে পানি চলে আসে।

চলবে……

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

#তাহরীমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here