বেলির_কথা (০৭)

#বেলির_কথা (০৭)
.
বেলি ক্লাস টেনে উঠে যায়।সামনে এসএসসি পরীক্ষা।পড়ালেখাতে বেশ ভালভাবে মন দিয়েছে সে।স্কুলে এখন ক্লাসের পাশাপাশি কোচিং ও হনে।সকালে বের হয়ে বিকেলে ই আসতে হবে।

সীমা এখন তেমন স্কুলে আসে না।রিয়া মাঝেমাঝে আসে।রামিম এখন স্কুলে নেই।সে এখন কলেজ স্টুডেন্ট। তাই রিয়ার স্কুলে আসতে ভাল লাগেনা।যদি ও আড়ালে তারা দেখা করে।
প্রিয়া আর বেলি একসাথে স্কুলে আসে।
.
বেলিদের উঠানের সামনে পাকাঘর বাধা হচ্ছে।যার সব দায়িত্ব শাহেদের।ইদানীং বেলির মায়ের শরীর টা খারাপ যাচ্ছে।বেলিকে রান্নাবান্না করতে হয়।বেলি জোর করে কাজগুলো করে।মা কে এ শরীর নিয়ে কাজ করতে দিতে চায় না সে।

তবুও বেলির মা বলে,
‘পড়ালেখা করে নে,আমি এসব পারব যা?’
‘আম্মা দেখো তুমি কত শুকায় গেছো?’
‘কই শুকাইছি?তুই এনা পড়ালেখা করে আবার ঘরের কাজ সামলে শরীরের কেমন হাল করেছিস?’
‘আমি বেশ মোটা আছি আম্মা।’
‘কই তুই মোটা?’
‘মায়েদের চোখে এমন লাগে নাকি?স্কুলের সবাই আমাকে মুটোই বলে।’
‘কে বলে?আমি কাল ই স্কুলে যাব।কার বাপের খায়, না ভাইয়ের খায়?’

বেলি হেসে উঠে।
‘শোন আম্মা বিকালের দিকে আমরা ডাক্তার কাকার কাছে যাবো।’
.
বিকেলে বেলি জোর করে মা কে নিয়ে ডাক্তার কাকার ওখানে যায়।চেকাপ করে ডাক্তার বলেন,
‘বেলি তোর মায়ের আগে অনেক টেস্ট করাতে হবে।শহরে নিয়ে যা?’

বেলি বলে,
‘তুমি আমার মায়ের চিকিৎসা করাতে পারবেনা?’
‘ব্যপারটা তা নয়।আগে টেস্ট এ কি আসে আমায় দেখতে হবে।’

বেলি মা কে নিয়ে চেম্বার থেকে বের হয়।বেলির মা বলে,
‘আমি সুস্থ ই আছি।শুধু শুধু আমার সন্তানের কষ্টের টাকাগুলা নষ্ট করছিস।’
‘টাকার চেয়ে আমার কাছে আমার মা বড়।’
‘আমি এখনো বিছানার সাথে সম্পর্ক করিনি।আর এখন সামনে তোর পরীক্ষা এসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবেনা।তোকে বড় হতে হবে অনেক।তুই হলেও ভাল করে পড় অন্তত?’

মায়ের অসহায় ভরা কথায় বেলির মন গলল।বেলি বলে,
‘ঠিক আছে,তাহলে আমার এসএসসি পরীক্ষা দেয়া শেষ হলেই তারপর তোমায় নিয়ে শহরে যাব।’
.
.
আজ থেকে নিয়মিত কোচিং করতে হবে।বেলি আর প্রিয়া একা স্কুলে যায়।আগে তিনবান্ধবী কত হাসিখুশি হয়ে স্কুলে যেত।অনেকদিন হলো সীমা আসেনা।সীমার এক কাজিন থেকে জানতে পেরেছে সীমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে তাই আর স্কুলে আসতে দিচ্ছে না।বেলির এতে খুব খারাপ লাগে।
.
বেলি বাসায় ফিরে মন খারাপ করে থাকলে বেলির মা জানতে চায় -‘কি হয়েছে?’
বেলি বলে,
‘সীমাকে চাচা নাকি বিয়ে দিয়ে দিবে?’
‘এত ছোট মেয়ের কেন বিয়ে দিবে?’

বেলি সব মাকে বুঝিয়ে বলে।আর রামিম আর রিয়ার কথাগুলো ও বলে যা মাকে বলা প্র‍য়োজন ছিল।বেলির এসব শুনে হাসে।কিন্তু রামিম কে নিয়ে কিছুই বলেনা।

বেলির মা সীমার ব্যপারে শুনে বলে,
‘তুই তোর চেয়ারম্যান চাচাকে গিয়ে সব খুলে বল।তারপর চাচাকে নিয়ে সীমাদের বাসায় যা ওর বাবাকে বুঝা যে এসব অন্যায়?’
‘আমি ছোট আমার কথা কি চাচা শুনবে?’
‘চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি?’

বেলি বিকেলের দিকে চেয়ারম্যান এর বাড়ি যায়।রামিম বেলিকে এখানে দেখে বেশ অবাক হয়।বেলিকে দেখে বলে,
‘এখানে কি?’

বেলি রামিম কে সালাম দেয়,
‘আসলে ভাইয়া চাচার কাছে একটা দরকারে এসেছি।’
‘কি দরকার?কোনো নিচু মনের মেয়েকে আমাদের বাসায় ডুকতে দিবোনা।’
‘বুঝিনি আপনার কথা?’

রামিমের চিল্লানির স্বর শুনে তার মা আসেন।বেলিকে তিনি চিনেন।বেলিকে দেখে খুশি ই হন।
‘আরে বেলি যে?আসো ভীতরে আসো?’
‘নাহ চাচিমা।আমি চাচার কাছে একটু জরুরী কথা বলতে এসেছিলাম।রামিম ভাইয়া ও আসতে পারেন?’

রামিমের মা রামিমের বাবাকে ডাকতে যায়।বিকেলে তিনি বাড়িতেই থাকেন।

রামিম অবাক হয়।এ মেয়ের সাথে এত রাগ করে কথা বলল অথচ তার ব্যবহার কত ই না সুন্দর।তার চামড়া কালো হলেও মন কালো কেমনে হয়?রিয়া কি মিথ্যা ই বলেছে?রিয়াকে রামিম যতেষ্ট ভালবাসে।

বেলি বলে,
‘ভাইয়া আপনার আর রিয়ার ব্যপারে শুনেছি আর অনেক খুশি ও হয়েছি।আপনাদের বেশ ভালো মানাবে ও।আমি আগেও আপনাকে বড়ভাইয়ের মতো সম্মান করতাম এখনো করি। আমি আপনার ছোটবোনের মতো।তাই আপনাকে বড়ভাই হিসেবে একটা দায়িত্ব দিতে এসেছি?’

রামিম আগের করা সব পাগলামি আর খারাপ ব্যবহার এর জন্য বেলির কাছে ক্ষমা চায়।আর বলে,
‘কি দায়িত্ব বুঝিয়ে বলো?’

রামিমের বাবা সহ আসলে বেলি সীমার ব্যপার টা বুঝিয়ে বলে।বেলির ভাল রেজাল্ট এর খবর পুরা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই চেয়ারম্যান ও বেলিকে স্নেহ করতে শুরু করে।তাই বেলির কথাকে তিনি গুরুত্ব সহকারে নেন।
‘ঠিক আছে।আমি ও তোমাদের সাথে যাবো।বাল্যবিবাহ তো ঠিক না।’

বেলি সবাইকে নিয়ে সীমাদের বাড়ি যায়।বাড়িতে চেয়ারম্যান এসেছে নিয়ে কানাঘুষার শেষ নেই।সীমা ঘরের জানালা দিয়ে বেলিকে দেখে খুব খুশি হয়।কিন্তু সীমার বাবা বলেছে,
‘ঘরের বাইরে এক পা ও দিবি না।পা দিবি মানে সে পা কে*টে টু*করো করে ফেলবো।’

বাবার কথাকে সীমা কোনকালে অমান্য করেনি।করবে ও বা কেন।বাবার কথা কি অমান্য করে সুখী হওয়া যায়?যায় না।

চেয়ারম্যান সীমার বাবাকে ডেকে পাঠায়।উঠানেই তিনজন দাঁড়িয়ে ছিল।সীমার মা তিনজনকে চেয়ার এনে দেন।
গ্রামের আরো অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায়।এখানে এসে বেলিরা আরো একটা খবর পায়।পরশু ই সীমার বিয়ে।
বেলি চমকে যায়।

সীমার বাবা আসতেই চেয়ারম্যান কে সালাম দেয়।বেলি সীমার বাবাকে সালাম দেয়।
সীমার বাবা বলে,
‘আপনারা আমার বাড়িতে?কি সৌভাগ্য আমার?’

সীমার মা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘বউ নাস্তাপানির ব্যবস্থা কর।চেয়ারম্যান সাব আসছে বাড়িতে।’

চেয়ারম্যান হাতের ইশারায় থামতে বলে,বলেন-
‘আমরা তোমার এখানে নাস্তা খেতে আসিনি।আমরা একটা দরকারি কাজে এসেছি।’
‘বলুন না?’
‘শুনছি তোমার মেয়েকে নাকি বিয়ে দিচ্ছো?’
‘হ্যা আপনারে বলতাম ত কাল ই।অনেক বড়ঘরের পাত্র।’
‘আমি সেটা জানতে চাইনি।তুমি কি জানো ওর বয়স কত?’
‘হ্যা আমি ওর বাপ আমি জানবো না?’
‘তুমি কি এটা জানো বাল্যবিবাহ দেয়া ঠিক না?’
‘জানি।কিন্তু এমন ভাল পাত্র আর আসবে না।আমার মতো গরীবের মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে এই অনেক?’

বেলি তখন কথার মাঝে বলে,
‘আমি ছোট হয়ে কথা বলার জন্য দুঃখিত।যতই ভাল পাত্র হোক চাচা সীমার বয়স আর অই পাত্রের বয়স আকাশপাতাল তফাৎ।তাছাড়া অই পাত্রের আরো দুইবউ বাচ্চা আছে।ভাল পাত্র কি এত বিয়ে করে।শুনেছি ছোট বউকে ভাল দেখে ও না,অত্যাচার করে।আপনার মেয়েকে কি সুখে রাখবে?’

চেয়ারম্যান বলে,
‘তুমি সব কাজ করছো আইনবিরোধী।এই যে যৌতুক দিচ্ছো এটাও ত ঠিক না।’

সীমার বাবা বলে,
‘এসব আপনাদের কে বলেছে?সীমা নাকি?ওর মতো বেহায়া মেয়ে তো দেখিনি।নিজের বাপরে এভাবে গ্রামের মানুষকে দিয়ে অপমান করে?’

বেলি বলে,
‘আপনি ভুল বুঝছেন সীমাকে।আচ্ছা আমায় বলুন তো বিয়ের আগে আপনি টাকা দিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন।তো সে পাত্র যদি বিয়ের পর ও এভাবে টাকা চায়তে থাকে,আর টাকা না দিলে যদি আপনার মেয়েকে অত্যাচার করে তখন কি আপনি ভাল থাকবেন?তাছাড়া সীমার শারীরিক সমস্যা ত হবেই।একটা সময় সে মানসিক যন্ত্রণা তে ভুগবে।আপনি সেটা বাবা হয়ে সইতে পারবেন?আপনারা ভবিষ্যৎ ভাবেন না।বর্তমান দেখেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন।আর আপনারা সুযোগ দেন বলেই এরা টাকা নেয়ার সাহস পায়।আপনার মেয়েকে স্ব-সম্মানে নিয়ে যাবে।টাকা কেন দিতে হবে?’

সীমার বাবা চুপ করে থাকেন।বেলি বলে,
‘আপনার মেয়েকে পড়ালেখা করান।বড়লোক পাত্র না দেখে, ছেলে মানুষ কিনা সেটা দেখে বিয়ে দিন চাচা।সীমা ভালই থাকবে।আর বিয়ে দিতে হলে কিছুদিন পরে দেন।এভাবে পড়ার মাঝে এসব?
আর সে পাত্র ভাল হলে বউবাচ্চা থাকতে এত বয়সে এত অল্পবয়সী মেয়ে বিয়ে করতে পারতো না?’

সীমার বাবা বলে,
‘তবে কি আমি বিয়ে ভেঙ্গে দিতাম?মেয়েটাকে কি আর কেউ বিয়ে করবে?’
‘করবে না কেন?বরং আপনার এ সৎ সাহসের জন্য গ্রামের মানুষ আপনাকে বাহ বাহ দিবে।’

বেলির কথা বলার ধরণ দেখে চেয়ারম্যান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন।আর বেলির সাথে একমত প্রকাশ করেন।

বেলি সীমার বাবার হাত ধরে বলে,
‘শুনোন চাচা মেয়েরা কখনো ভাতে মরেনা।ভাতের অভাব হলে মেয়েরা নিজের ভাতের আয়োজন নিজেই করে নিতে পারে।প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরা মরে কেন জানেন?মানসিক যন্ত্রণায়।’

চলবে….

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

#তাহরীমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here