বেলির_কথা (১৯)

#বেলির_কথা (১৯)

.
হাসনাত দুইটা দোলনা নিয়ে আসে দুইজনের জন্য।বেলি প্রতিদিন দুইটা দোলনা ধরে ধরে আদর করে।বিছানায় দুজনকে কোথায় কোথায় রাখবে ভেবে নেয়।বেলির ভাবনার মাঝে বেশিরভাগ ভাবনা হচ্ছে বাচ্চাকে নিয়ে। বাচ্চাদের এই করবে সেই করবে।ভাবতে ভাবতে দিন যায় কিন্তু ভাবনা ফুরায় না।
বেলি ভার্সিটি কম যায়।বাড়িতে পড়া কমপ্লিট করে।শুধু পরীক্ষা দিতেই যায়।
.
বেলি জানালার গ্রীল ধরে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হাসনাত এসে পিছন থেকে ডাক দেয়।
‘বেলি?’

বেলি চমকে উঠে।
‘আরে এভাবে চমকালে কেন?আমিই তো?’
‘এমনি?’
‘তা কি ভাবছিলে?’
‘কিছুনা।’
‘বলো না?’
‘ভাবছি আমাদের বেবিদেরকে নিয়ে কিভাবে কি করবো?’
‘আচ্ছা।শুনো দুইজনকে মাঝখানে দিয়ে আমরা দুইপাশে থাকবো যাতে ওরা সেইফ থাকে।’

বেলি ভেবে বলে,
‘যখন দুজনে কেঁদে উঠবো আমি একজনকে সামলাবো।আপনাকে ও কিন্তু একজনকে সামলাতে হবে।’
‘আচ্ছা আমি একজনকে কোলে নিবো, তুমি একজনকে নিবে।’
‘জানেন আমি দুজনের মুখ দেখার জন্য খুবই এক্সাইটেড।আমি তাদের এত এত ভালবাসি।না দেখেই এত ভালবাসি।’

হাসনাত হেসে ফেলে।বেলি ইদানীং বেশি কথা বলে আগে কেমন চুপ থাকতো।প্রথম বাচ্চার সময় সব বাবা মায়েরা এমন এক্সাইটেড থাকে।হাসনাত বেলির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়।
তিন পরিবার মিলে খুশির জোয়ারে ভাসছে।

কিন্তু বেলির রেস্ট নেয়ার পর ও দূর্বলতা কাটেনা।তবুও হাসনাত যতেষ্ট কেয়ার করে।
.
.
দেখতে দেখতে হাবিবার বাচ্চা হওয়ার সময় হয়ে এলো।শাহেদ মিতুকে নিয়ে বেলিদের এখানে চলে আসে।কয়েকদিন বেলির সাথে থাকবে।হাসনাত বেলিকে তো আর গ্রামে দিবেনা তাই তারা ই এসে গেছে।অবশ্য এতে হাসনাত অনেক খুশি ই হয়েছে।মায়ের মতো ভাবিকেই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বেলির।ভাবিকে পেয়ে বেলি এত খুশি হয় যে বলার বাইরে।প্রায় অনেকদিন পর আবার তারা একসাথে থাকছে।
__

সকালে হাবিবার বর কল করে যে,তারা হাবিবাকে নিয়ে হসপিটালে গেছে।হাসনাত এটা শুনার সাথে সাথেই বের হয়।

হাবিবাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ডেলিভারি হয়।একটা ছেলে হয়েছে।
হাসনাত গিয়ে শুনতে পায় খবরটা।এমন একটা সুখবর বেলিকে না জানিয়ে কি থাকা যায়?হাসনাত বেলিকে কল করে জানিয়ে দেয়।

বেলি তখন জেদ ধরে সে ও আসবে।
কিন্তু হাসনাত রাজি হয়না।হাবিবাকে হসপিটালে কিছুক্ষণ রেখে বাসায় নিয়ে আসা হয়।

এদিকে মিতু ভাত রান্না করে। মাংস মাছ যা যা লাগবে রান্না করে।এসব কিছু হাবিবাদের বাসায় যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে।বেলি ও সাহায্য করলো।

হাসনাত এসে মিতু বেলি শাহেদকে সহ গাড়িতে উঠে।

হাসনাত বেলির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘শুনো বাচ্চা দেখতে যাচ্ছি ঠিক আছে।কিন্তু সাবধানে থাকতে হবে।’
‘আচ্ছা থাকবো।’
‘আহহ।’

বেলির ‘আহ’ শব্দে হাসনাত চমকে তাকায়।
‘কি হলো?’
‘ভাইবোন দুইটায় ঝগড়া করে মারামারি করতেছে।আসুক দুনিয়াতে দুইটাকে দুইরুমে রাখবো।’

মিতু শাহেদ হেসে ফেলে।
.
বেলি গাড়ি থেকে আগে আগে নেমে পড়ে।কারো জন্য অপেক্ষা না করেই আগেই চলে যায়।সে এতখুশি।এত বাচ্চা?ইস আল্লাহর কাছে কি বলে শুকরিয়া জানাবে ভেবে পায়না সে।

হাবিবার ছেলে দেখতে একদম হাবিবার মতো ই হয়েছে।

বেলি তাড়াতাড়ি গিয়ে ই বাচ্চাটাকে কোলে নেয়।আর বলে,
‘আমার ইচ্ছে করছে সারাদিন নিয়ে বসে থাকতে।’

তখন হাবিবা বলে,
‘তোমার হবে তো,দুইটা দুই পাশে নিয়ে বসে থাকিও।’

হাবিবা হাসনাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ভাইয়া তুমি কিন্তু বাচ্চাগুলা একদম ই নিবানা?’
বেলি বলে,
‘হ্যা আমার বাচ্চাদের কাউকে দিব না।কিন্তু বেশি কান্না করলে তখন নিতে হবে কিন্তু?’

হাসনাত হেসে বলে,
‘আচ্ছা তখন নিবো।’
হাবিবা তখন মিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘এসব ভাত আনার কি প্রয়োজন ছিল ভাবি,শুধু শুধু কষ্ট করলে?’
‘তুমি অসুস্থ তাই।ভাবি বলে ডাকো আর এটুকু করবো না?’

বেলিরা কিছুক্ষণ থেকে সেখান থেকে চলে আসে।
____

রাতের দিকে বেলি রুমে বসে ছিল।হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করে।বেলি চিৎকার করে উঠে।মিতু ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিল তখন।শাহেদ ও ঘুম।হাসনাত বাইরে আছে।মিতু বেলির গলার স্বর শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি দৌড়ে আসে।

মিতু উত্তেজিত হয়ে বলে,
‘কি হয়েছে বেলি?’
‘ভাবি আমি মরে যাচ্ছি।’
‘কি বলিস?হাসনাত!’

কিন্তু হাসনাত বাসায় নেই।
ডেইট এর আগে এমন তো পেইন হওয়ার কথা না।মিতু তাড়াতাড়ি শাহেদ কে গিয়ে ডাকে।শাহেদ হাসনাতদের ড্রাইভার আংকেলকে ডেকে বেলিকে নিয়ে হসপিটালে চলে যায়।হাসনাত তখন বাসায় আসার পথে,শাহেদ হাসনাতকে কল করে সব বলে।

হাসনাত আর বাসায় আসেনা সোজা হসপিটালে চলে যায়।
শাহেদকে দেখে এগিয়ে আসে।
‘বেলি এখন কোথায়?’

শাহেদ দেখিয়ে দেয়।হুট করে একজন ডাক্তার বের হয়।উনি চিন্তিত মুখে ডাক দেন,
‘ বেলির গার্ডজিয়ান কে?’

হাসনাত এগিয়ে এসে বলে,
‘আমি ওর হাসবেন্ড বলুন?’
‘আসলে আপনার ওয়াইফ এর একটি অপারেশন করতে হবে আপনার অনুমতি লাগবে।নইলে?’

হাসনাত ডাক্তারের হাত ধরে বলে,
‘আমার ওয়াইফ আমার জীবন,যে করেই হোক..।’

ডাক্তার বলে,
‘আমার কথা শেষ হয়নি।এ অপারেশন টা খুবই জরুরী।নয়ত মা বাচ্চা দুজনের জীবনের ঝুঁকি আছে।তবে এর পর হয়ত উনি আর মা হতে পারবেন না।রাজি থাকলে এখানে সাইন করুন।’

হাসনাত একটা টু শব্দ ও করলো না সাইন করে দিলো।
‘আমার ওয়াইফ ই আমার ভালবাসা।ওকে বাচান ডঃ?’
‘আল্লাহ কে ডাকুন!’

.
হাসনাত বেঞ্চে ধপ করে বসে,শাহেদ কাধে হাত রাখে।
‘আল্লাহ ভরসা চিন্তা করিও না।’
‘ভাইয়া ওর কিছু হলে আমি শেষ।’

হাসনাত হসপিটালে আসার সময় হাবিবাকে কল করে এসব বলেছিল।হাবিবা ও বাচ্চা নিয়ে ছুটে এসেছে।সাথে ওর বর ও এসেছে।হাবিবা ভাইকে এভাবে বসে থাকতে দেখে চিন্তিত হয়ে বলে,
‘ভাইয়া ভাবির কি অবস্থা?’

হাসনাত চুপ করে থাকে।হাবিবা আর প্রশ্ন করে না।

কিছুক্ষণ পর অটি থেকে একজন নার্স বের হয়,কোলে একটি বাচ্চা নিয়ে হাসনাতের সামনে আসে।নার্স ডাক দেন,
‘মি: হাসনাত?’

হাসনাত দ্রুত এগিয়ে যায়।তার চোখ ছলছল হওয়ার কারণে ভাল করে দেখছে ও না।
‘আপনার মেয়ে?’

বাচ্চাটি হাসনাতের কোলে দেয়।হাবিবা খুশি হয়ে এগিয়ে আসে।কিন্তু হাসনাত বলে,
‘আমার ওয়াইফ?’
‘আপনার ওয়াইফ বিপদমুক্ত এখন।’
‘আর আমার সন্তান আরেকটা?’

নার্স আর জবাব দেয়না।কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়।হাসনাত ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার জমজ বাচ্চা হওয়ার কথা ছিল যে ড:?’
‘সরি মি: হাসনাত আপনার আরেক বেবি ছেলে ছিল, কিন্তু জন্মের পরেই মা*রা যায়।’
‘ড:!’
‘আই আম সরি।’

হাসনাত ফুফিয়ে কাদে।ছেলেরা নাকি অতি দুঃখে এভাবে কাদে।হাসনাত মেয়ের দিকে তাকায়।একদম তার মতোই হয়েছে।
হাসনাত হাবিবাকে বলে,
‘আমার ছেলে কার মতো দেখতে হয়েছে?’

হাসনাত মেয়েকে কোলে নিয়ে সেই নিষ্প্রাণ দেহটাকে দেখতে যায়।পিছুপিছু হাবিবা শাহেদ মিতু ও যায়।
সাদা কাপড়ে কি ছোট দেহটা শুয়ে আছে।হাসনাত মুখটা দেখে আরো কেদে উঠে,
‘একদম আমার মতো হয়েছে রে?’

হাবিবা কেদে কেদে বলে,
‘ধর্য্য ধরো ভাইয়া।আল্লাহ একটা নিয়ে গিয়ে আরেকটা তো ফিরিয়ে দিয়েছেন।এই অনেক শুকরিয়া।’

হাসনাত মেয়েকে জড়িয়ে রাখে।
‘আমি বেলিকে কি জবাব দিব বল?’

হাবিবার বুক কেপে উঠে।
‘জানিস ও এই দেহ দেখলে পাগল হয়ে যাবে রে।আমি ওকে কি বলে সান্তনা দিব বল?’
.
.
হাসনাত নিজ হাতে দেহটাকে কবরে রেখে আসে।তারপর আবার হসপিটালে ফিরে আসে।

হাবিবা নিজের ছেলেকে ঘুমিয়ে হাসবেন্ড এর কোলে দিয়ে,ভাইয়ের মেয়েকে জড়িয়ে রাখে।

হাসনাত শুকনা মুখ নিয়ে বেলির পাশে বসে থাকে।বেলি দুইটা বাচ্চা যদি না দেখে কেমন রিয়েক্ট করবে?আর যদি এ অবস্থায় ওর যদি কিছু হয়ে যায়?হাসনাত কিছুই ভাবতে পারছেনা।

অনেকক্ষণ পর বেলির জ্ঞান ফিরে।

বেলি চোখ খুলে প্রথমে হাসনাতকেই দেখতে পায়।হাসনাত এতই গভীর ভাবনায় ছিল বেলির জ্ঞান ফিরেছে খেয়াল করেনি।
বেলি হাসনাতের চুল স্পর্শ করে।হাসনাত এর ঘোর কাটে।

বেলির দিকে তাকায়।বেলি হাসার চেষ্টা করে।
‘আমার সন্তানদের আনুন তাদের একটু মন ভরে দেখি।কতদিনের তৃষ্ণা বলুন?’

‘তুমি কেমন আছো?’
‘ভাল আছি।আমার কথা ছাড়ুন।আমি আগে আমার সন্তানদের দেখবো।’
.

হাবিবা এসে হাসনাতের কোলে মেয়েকে দেয়।হাসনাত বেলিকে দেয়।বেলি খুশি হয়ে মেয়ের কপালে চুমু খায়।
‘একদম আপনার মতো হয়েছে।কি ছোট ছোট হাত,পা আর মুখ।’
‘তুমি খুশি?’
‘হ্যা,অনেক্ক।’

হাসনাত হাসার চেষ্টা করে।
বেলি বলে,
‘এবার আমার সন্তান আরেকটাকে আনুন।সে কার মতো হয়েছে?আপনার মতো না আমার মতো?’

চলবে..

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

#তাহরীমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here