বেলির_কথা (১৮)

#বেলির_কথা (১৮)

.
ভোরের দিকে বেলি চোখ খুলে।পুরা শরীর ব্যথা হয়ে আছে।পাশে দেখে হাসনাত হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে।নিজের কপালের জলপট্টিটা টুস করে পড়ে যায়।বুঝা ই যাচ্ছে হাসনাত রাত জেগে জল পট্টি দিয়েছিল।আর দিতে দিতে ঘুম চলে এসেছিল।

বেলি আস্তে আস্তে হাসনাতকে ডাকে,
‘শুনোন নামাজ পড়বেন না?’

হাসনাত তাড়াহুড়া করে চোখ খুলে।
‘তোমার জ্বর কমেছে?’
‘হ্যা।নামাজ পড়বেন না?’
‘অবশ্যই।হঠাৎ চোখ লেগে এসেছিল তাই।’
.
বেলি আস্তে আস্তে উঠে ওযু করে আসে তারপর নামাজ আদায় করে নেয়।এখন একটু ফ্রেশ লাগছে।হাসনাত ও নামাজ পড়ে নেয়।প্রতিদিন মসজিদে গেলেও আজ যাওয়া হয়নি।যদিও মসজিদ বাসার পাশেই।

বেলি শাড়ির আচল ভাল করে পেছিয়ে নেয়।উদ্দেশ্য রান্নাঘর।
হাসনাত দেখে বলে,
‘তোমাকে এরকম দেখতে একদম পাক্কা গৃহিনীর মতো লাগে।’
‘হ্যা।’

হাসনাতের মনে পড়ে যায় কালকে কি নাম বলেছিল।বেলি দ্রুত হাটে।
‘আস্তে হাটো?’
‘কেন আমি কি পড়ে যাব?’
‘সাবধানে থাকলে ক্ষতি কি?’

হাসনাত বেলির পিছু পিছু হাটে।
‘কি?’
‘কি মানে?কিছুনা।’
‘পিছু পিছু আসেন কেন?আমি এখন সুস্থ।’
‘পুরুপুরি সুস্থ হও তারপর দেখাচ্ছি মজা।’
‘কেন?কি হয়েছে?’
‘আমাকে কি নামে ডেকেছিলে তখন?’

বেলি মনে করার চেষ্টা করে।
‘আমি তো আপনাকে কোনো নাম ধরেই ডাকি নাই।’
‘কি বলে মেয়ে?মনে করে বলো?’
‘সত্যিই ডাকি নাই।’
‘তাহলে ভুতে বলেছিল হাসনাইত্তা?’

বেলি কপাল কুঁচকে রাখে।তারপর হু হু করে হাসে।আর বলে,
‘নামটা ত জোস হয়েছে।’
‘তাই?আগে সুস্থ হও তারপর বুঝাবো।’

হাসনাত বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে রাখে।এতেও উনাকে কত সুন্দর দেখাচ্ছে।বেলি আরো উচ্চস্বরে হাসে।

দুজনের চা রেডি করে টেবিলে নিয়ে আসে।বেলি চায়ে ফু দিতে দিতে হাসনাতের পান করা শেষ।হাসনাত বেলির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ফু দিয়ে ঠান্ডা করে চা গুলা কি মজা লাগে আমি বুঝিনা।’
‘আমি গরম খেতে পারিনা।’
‘এরকম ফু ফু করে বাচ্চারা।বিয়ের পর থেকেই খেয়াল করছি তোমার বেশিরভাগ স্বভাব…’
‘থাক আর বলতে হবেনা।’

হাসনাত হেসে ফেলে।

দুজনের চা পান করে বসতেই হাবিবার বর কল করে যে,হাবিবা পা পিছলে পড়ে গেছে।এমন খবর শুনার জন্য এরা কখনো ই প্রস্তুত ছিল না।দুজনেই অবাক হয় সাথে ব্যথিত হয়।ব্যথা মন নিয়ে হাসনাত বলে,
‘হায় আল্লাহ! আল্লাহ ভরসা।’

হাসনাত হাবিবার বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হয়।বেলি তখন বায়না ধরে সে ও যাবে।অগত্যা বেলি কে সহ নিয়ে যায়।
.
হাবিবা বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে।
পাশে শাশুড়ি বসে আছে।বেলিকে দেখা তারা খুব খুশি হয়।বেলি হাবিবার বরকে বলে,
‘আপুর এমনটা কেমনে হলো?’

হাবিবার বর বলে,
‘বাথরুম এ গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে গেছে।তারপর কাদতে কাদতে বেহুশ হয়ে গেছে।’
‘আপুর আরো সাবধান হওয়া উচিৎ ছিল।’
‘হুম।’
‘ডাক্তার কি বলেছে?’
‘পেটে আঘাত কম লাগায় বাচ্চা ঠিক আছে।’

হাসনাত হাবিবার বরকে বলে,
‘সাবধানে রেখো।এখন এই সময়েই আমাদের বেশি যত্ন নিতে হবে এদের।যা বাচ্চাদের মতো কান্ড ঘটাচ্ছে।’

কথাটা বেলিকে উদ্দেশ্য করে বলেছে হাসনাত।বেলি সেটা ভালই বুঝতে পারছে।হাবিবা ঘুম থেকে উঠে যায়।
সে হঠাৎ করেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে,
‘আমার বাচ্চা?’

বেলি অভয় দিয়ে বলে,
‘ঠিক আছে সব,তুমি উত্তেজিত হইয়ো না।’

বেলিকে জড়িয়ে ধরে হাবিবা কেঁদে ফেলে,
‘অনেক ভয় পেয়েছিলাম বেলি।ভেবেছিলাম এই বুঝি মানিকটা আমায় ফাঁকি দিয়ে দিলো।’

বেলি হাবিবার পিঠে হাত বুলায়।
‘আল্লাহ ভরসা।’
.
বেলিরা চলে আসে।হাবিবা ভাতে খেয়ে যেতে বলেছিল। কিন্তু অসুস্থ থাকায় বেলি কিছুতেই রাজি হয়নি।তাই চলে আসে।
আজ হাসনাতের অফ ডে হওয়ায় কলেজ যায় না।

গাড়িতে বসেই বেলি হাসনাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘প্রত্যেক মা তার সন্তানকে এত ভালবাসে।আপুর অসহায় চোখ টা দেখেই আমার বুকটা কেপে উঠছিল।কিছু হলে আল্লাহ, আপুকে বাঁচাতে পারতাম?’

হাসনাত চুপ থেকে তারপর বলে,
‘এত বকবক না করে নিজের খেয়াল রাখলে হয়।কত বলি বেশি বেশি খেয়ে শক্তি বাড়াতে তা না?’
‘আমি ত খাই ই?’
‘আরো খেতে হবে।’

বেলি হাসনাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘প্রত্যেক মা কতটা সাধনা করে ছোট একটি মুখ দেখার জন্য তাইনা?কিন্তু সেই মুখ যদি তাকে ছেড়ে চলে যায় কেমন লাগে?আমি এমন হলে বাচব ই না আর।’

হাসনাত রাগ দেখিয়ে বলে,
‘কি সব বলো?আল্লাহ ভরসা বলো যে না?এখন আবার এসব কথা কেন বলছো?’
‘জানেন আম্মা বলতো মা হলে তখন বুঝবি।সত্যি আমি এখন থেকে তাকে নিয়ে কত ভাবছি কত ভয় আমার।’
‘এত ভয় পেতে হবেনা।আমি আছি না?’

হাসনাত একটু হেসে বলে,
‘আচ্ছা বেলি একটা বিষয় খেয়াল করেছো?’
‘কি?’
‘তুমি আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে যাচ্ছো?’

গাড়ির আয়নার গ্লাসে বেলি নিজেকে দেখে।সে এমনিতেই খেয়াল করেছে কেমন যেন ফর্সা হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু মুখে বলে,
‘আপনার ত আমাকে সুন্দর লাগেই।’
‘নাহ সত্যি ই তুমি সুন্দরী হয়ে যাচ্ছো।যাইহোক মেয়ে হোক ছেলে হোক তোমার মতোই হোক সেটাই চাই।’

বেলি কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে বলে,
‘জানেন আমি বিয়ের আগে চাইতাম আমার একটা পরীর মতো মেয়ে হোক যাতে কেউ কালো বলে অবহেলা না করে।’

হাসনাত কৌতুহলী হয়ে বলে,
‘এখন কি চাওনা এটা?’
‘নাহ।এখন চাই আল্লাহ আমাকে হাত পা সব ঠিকঠাক ওয়ালা সুস্থ বাচ্চা দিক।’

‘এমন কেন?’

বেলি নড়েচড়ে বসে বলে,
‘জানেন কালো হলেও একটা সুস্থ মানুষ, মানে যাদের আল্লাহ সবকিছু দিয়ে পাঠান তারা নিজের কাজ নিজে করে ও কিন্তু সাচ্ছন্দ্যে জীবন চালিয়ে দিতে পারে।হয়ত কালো বলে মানুষ অবহেলা করে কিন্তু মানুষের অই সামান্য অবহেলা গায়ে লাগেনা।
কিন্তু যদি আল্লাহ একটা হাত অথবা পা,অথবা চোখ,অথবা কান না দেন তাহলে তাদের মতো অসহায় আর অবহেলিত আর কেউ হয়না।তারা অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হয় প্রায়।তাদের কত কষ্ট হয়।সে কষ্টের চেয়ে কি কালো হওয়াটা বেশি কষ্টের বলুন?
তাই আমি চাই সুস্থ ই হোক।এটা আল্লাহর কত বড় নেয়ামত আমাদের জন্য।আমাদের যাদের হাত পা সব ঠিক দিয়ে আল্লাহ পাঠিয়েছেন অনেক অনেক শুকরিয়া।আমি আগে কালোর জন্য মন খারাপ করলেও এখন করিনা।তাই এমনটায় চাই।’

হাসনাত হেসে বলে,
‘এইজন্য আমি আমার বউকে এত ভালবাসি।তোমার ভাবনাগুলো অদ্ভুত হলেও সত্যি।তবুও আমরা আল্লাহর কাছে কতই না অভিযোগ করি।’

বেলি মনে মনে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়।
.
দুজনে কথা বলতে বলতে গাড়ি থেকে নামে। বেলি একটু দাঁড়াতে ই আবার কেমন যেন মাথা ঘুরে উঠে।হাসনাত গাড়ি রেখে এসে বেলির হাত ধরে।

‘কি হলো?’
‘অই মাথা ঘুরছিলো।’
‘চলো আবার ডাক্তারের কাছে যাই।’
.
বেলিকে ডাক্তার বেডরেস্টে থাকতে বলেছে।সাথে আল্টাস্নোগাফ করতে বলেছে।সেখান থেকে জানতে পারে বেলির পেটে জমজ সন্তান আছে।দুজনে এটা শুনে খুব খুশি হয়।বিশেষ করে হাসনাত ই বেশি খুশি হয়।

কলেজে যতক্ষণ থাকে আরকি।বাসায় এসে বেলির পিছু ছাড়েনা।

বেলি কিছুদিন মিতুর কাছে থাকতে যায়।কিন্তু একদিন যেতে না যেতে হাসনাত কিছুতেই শান্তি পায়না।যদিও হাসনাতের যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু কলেজ ছিল বলে যাওয়া হয়নি।গ্রামের অনেকে বেলিকে দেখতে আসে।

ঠিক দুইদিন পর হাসনাত গাড়ি নিয়ে হাজির।কিন্তু মিতু কিছুতেই বেলিকে যেতে দিবেনা।মিতু হাসনাতকে বলে,
‘শুনেন ভাইয়া মেয়েদের প্রথম সন্তান হওয়ার সময় বাপের বাড়িতেই থাকে।আর কয়েকদিন থাক?’
‘কিন্তু ভাবি আমি বেলিকে এখানে রেখে শান্তি পাচ্ছি না।’

মিতু বেলির কানে কানে গিয়ে আস্তে করে বলে,
‘ভাগ্য করে একটা বর পেয়েছিস।’

মিতু বেলিকে সাবধানে থাকতে বলে দুজনকেই বিদায় দেয়।হাসনাত ফেরার সময় বেলিকে নিয়ে শপিং এ যায়।
হাসনাত খুশি হয়ে বলে,
‘আজকে ডাবল ডাবল সবকিছু নিবো।পোশাক থেকে শুরু করে সবকিছু ই ডাবল নিবো।’
‘আচ্ছা।’

বেলি অনেকগুলো পোশাক আর খেলনা পছন্দ করে।পোশাকগুলো এত ছোট।পোশাক গুলোকেই আদর করে ফেলতে মন চায়ছে।

শপিং শেষে দুজনি বাসায় ফিরে।
পোশাক গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে।খেলনা গুলো জায়গা মতো সাজিয়ে রাখে।

বেলি হাসনাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমি ভেবেছি কি জানেন?আমাদের একটা বিষয় খুবই মিল।’
‘কি?’
‘আপনি ও বাচ্চাপাগল,আমিও প্রচুর বাচ্চাপাগলী।হি হি।’

হাসনাত বেলির হাসির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।হাসনাত বেলির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
‘এই হাসির জন্য ই এত আয়োজন,এই হাসিটায় আমার প্রয়োজন।’

চলবে….

#তাহরীমা

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here