#বেলীফুল
পর্ব-১
এই ঘন কুয়াশাঘেরা পৌষের বিকেলে সাপেদের সব শীতনিদ্রায় থাকার কথা, যদিও দেখা যাচ্ছে একটা সাপ ঘুমায়নি, দিব্যি লেকের পানিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্কটা লোকে লোকারন্য। একটুকু ফাঁক খুঁজে দাঁড়িয়ে পড়ে মুষড়ে আসা প্রকৃতিটা দেখতে খারাপ লাগছে না। কুয়াশা কেটে যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছে, কেমন রহস্যময় মনে হচ্ছে জগতটা। তবে সেটা সুন্দর নয়, কেমন বিষাদময়, অমসৃণ, কঠোর।
কাছে গিয়ে দেখা গেল জিনিসটা সাপ নয়, কালোমতো বাঁকা লাঠি। বরাবরের মতো ভুল প্রমাণিত হলো আফনান কানন। এটাই তার কেতাবি নাম। ডাকনাম বাবু, সেটা এখন কেউ ডাকে না। বাবা মা মারা গেছেন। বড় বোন আমেরিকায় পড়ে আছে, দু-চার বছর পর একবার আসে।
আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হলো কাননের। একটা কাজ করবে আজ, বলা যায় জীবনের শেষ কাজ। কাজটা খুবই সহজ, পুরো দুই পাতা ঘুমের ঔষধ খাবে। সে আবার একসাথে বেশি ঔষধ খেতে পারে না৷ একটা একটা করে খাবে। বাসায় যাওয়ার সময় কাচ্চি আর সেভেন আপ কিনে নিতে হবে। জীবনের শেষ খাওয়াটা মজার হোক। যদিও এখন কিছুই স্বাদ লাগে না। মুখের ভেতরটা আশ্চর্য রকমের তেঁতো হয়ে আছে। অথচ একটা সময় একাই তিনজনের খাবার খেতে পারত। বন্ধুমহলে ‘খাদক’ বলে পরিচিত ছিল। কে বিশ্বাস করবে এখন এক থালা ভাত শেষ করতে তার একটা ঘণ্টা লাগে?
***
সকালের নরম আলোয় ঘুম ভাঙল কাননের। উঠেই মনে হলো তার ওঠার কথা না, মরে যাওয়ার কথা ছিল৷ তারপরেই মনে পড়ল সে আসলে ঘুমের ঔষধ খায়নি। বলা ভালো খেতে পারেনি। বন্ধুমহলে তার আরেকটি পরিচয় ছিল, ‘ভীতু’। জীবনের মায়া যতই কাটিয়ে উঠুক, মৃত্যুর কথা ভাবলে সাহস হয়ে ওঠে না। যারা আত্মহত্যা করে মারা গেছে তাদের রীতিমতো দুঃসাহসী মনে হয়। সে বেশ কিছুদিন ধরে স্বেচ্ছায় মরে যাওয়া লোকেদের জীবনকাহিনী পড়ছে। অনুপ্রাণিত হওয়ার চেষ্টা করছে। বাঁচতে নয়, মরতে।
আবোলতাবোল ভাবার সময় কলিংবেল বাজল। এত সকালে কে? ঘড়ির দিকে ভুল ভাঙল। দশটা পাঁচ বাজে। চকিতে অফিসের কথা মনে পড়ে গেল। অবশ্য এটাও মনে পড়ল, আজ শনিবার, অফিস নেই। এলোমেলো ঘরদোরে এটাসেটা ডিঙিয়ে একটা টিশার্ট গায়ে দিয়ে দরজা খুলতে একটু দেরিই হয়ে গেল। দরজার ওপাশের মানুষটা তখন ফিরতে পথ ধরেছিল, শব্দ শুনে পেছনে ফিরেছে। বাইশ-তেইশ বছর বয়সী তরুণী। দেখতে আহামরি নয়। শ্যমলা গায়ের রঙ, চিকন স্বাস্থ্য, রেশমী চুলগুলোতে খোঁপা বাঁধা। হাতে একটা খালি বাটি। কাননের ফ্ল্যাটে কালেভদ্রে আসে শুধু বাড়িওয়ালী আন্টি। তার হাতে খাবারের পাত্র থাকলে সেটা ভরাই থাকে, খালি বাটি নিয়ে তার কাছে কেউ কেন আসবে?
মেয়েটা বোধহয় বুঝতে পারল ব্যাপারটা। বলল, “চিনি আছে? আমার সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস। চিনির বয়াম খুঁজে পাচ্ছি না…”
একটা চেনে না জানে না ছেলের কাছে কেউ চিনি নিতে আসে? মেয়েটাকেও সে চেনে না। কখনো দেখেনি। এখনকার দিনে পাশের বাড়ি থেকে খাবার জিনিস আদান-প্রদানের চল ছিল সেটা জানতই না কানন। সে এখনও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা বোধহয় মুখ দেখে মনের কথা বলে দিতে পারে, কিংবা কাননের অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষমতা বেশি, কোনটা কে জানে, মেয়েটা বলল, “আমি ইলা। এইযে পাশের ফ্ল্যাটেই এসেছি৷ আপনার বাড়িতে যদি চিনি থেকে থাকে তো..”
কানন আর কথা বাড়াল না। বলল, “ভেতরে এসে বসুন, দেখি আছে কি না।”
মেয়েটা ভেতরে ঢুকল ঠিকই, তবে বসল না। কাননের পেছন পেছন রান্নাঘরে ঢুকল। রান্নাঘরের অবস্থা গরুর ঘরের চেয়েও খারাপ। একপাশে গাদা করে রাখা পেঁয়াজের খোসা, ছড়ানো ছিটানো পাতিল, ঢাকনা, এঁটো কড়াই, গতকালকের বাসি তরকারি বিকট গন্ধ ছড়িয়েছে। মেয়েটা দরজায় দাঁড়িয়ে নাক কুঁচকে ফেলল। কানন ওর বাটিতে চিনির ঢালতে ঢালতে মনে মনে হাসল। আহারে! একটা ‘টিপিক্যাল লাভস্টোরি’ হতে হতে হলো না!
***
“আপনার কী ফুল পছন্দ?”
“বেলী।”
“ওহ। আমার আবার পছন্দ কৃষ্ণচূড়া।”
“ঘ্রাণ নেই।”
“তা না থাক, অমন ফুল দেখেও সুখ।”
কী একটা ভাবল কানন। বলতে বলতেও বলল না মুখে চলে আসা কথাটা৷ ফিরল ইলার দিকে। “আপনি আজ কী নিতে এসেছেন?”
“মসুর ডাল।”
কানন ডালের কৌটাসুদ্ধ মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “নিয়ে যান।”
“এতটা লাগবে না।”
“না লাগলে নাই। রেখে দেন। আমার কাজ আছে। এখন কথা বলতে পারব না।”
ইলা মুখ ভার করে চলে গেল। কানন একটু বিরক্ত। মেয়েটা জ্বালাচ্ছে প্রচুর। দু’দিন পরপর এটা সেটা চাইতে আসে। থাকলে নিয়ে যায়, না থাকলে বসে যায় গল্প করতে। কত যে কথা বলরতে পারে! একদিন তো জোর করে তার ঘরদোর গুছিয়ে দিয়ে গেছে। কী অবস্থা! মেয়েটা পরিশ্রমী। বাবা মা দু’জনেই চাকরি করে। সেও নিজের পড়াশোনার খরচ চালায় কাজ করে। অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা। হাতের কাজ করে বিক্রি করে। কাননকে ইতিমধ্যে চারপাশে সুতার কাজ করা একটা আয়না উপহার দিয়েছে ইলা। কাননের বাসায় আয়না ছিল, ভেঙে যাওয়ার পর আর কেনা হয়নি। বাথরুমের নোনা ধরা আয়না দিয়ে দিব্যি চলে যেত। মেয়েটার আয়নার বদৌলতে দুই বেলা মুখ দেখা হয়। এই ধ্বসে যাওয়া চেহারা দেখে আবারও মরতে ইচ্ছে হয় তার৷ কিন্তু মরার সুযোগ পাচ্ছে না সে। হুট করে মরার চেয়ে আয়োজন করে মরা ভালো। সেজন্য শুক্রবার আদর্শ দিন। অন্যান্য দিন ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসে, মরার মতো শক্তিও থাকে না।
এই ইলা মেয়েটা আসার পর থেকে শুক্রবারেও তার মরার সুযোগ হচ্ছে না। প্রতি শুক্রবার সে কিছু না কিছু রান্না করবে। সেটা আবার কাননের জন্য নিয়ে আসবে। বসে বসে তার খাওয়া দেখবে, তারপর যাবে। ইলার তার দিকে হা করে চেয়ে থাকা মুখটা দেখলে মনে হয় মেয়েটা তার প্রেমে পড়েছে ভালোভাবেই। খাওয়া শেষে গল্প করে বিদায় নেবে সে। তার পরপরই ঘুম চলে আসবে কাননের। ঘুম থেকে উঠলে আলস্য পেয়ে বসে তাকে। মরার শখ আর হয় না। মহা ঝামেলায় পড়া গেছে!
***
পরের শুক্রবারের কথা। আজ কানন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে মরবেই, সে যে করেই হোক! তার হাতে একটা হারপিকের বোতল। জিনিসটা খেতে কী পরিমাণে বাজে হবে সেটা চিন্তা করেই কাননের বিতৃষ্ণা জাগছে। কিন্তু কী আর করার! ভালো জিনিস দিয়ে মরতে সময় লাগে, এটা খেলে মরা সোজা। সে বোতলের মুখ খুলতে খুলতে শুনল কলিংবেল বাজছে। নিশ্চিত ইলা। এই মেয়ে অসময়ে আসতে এক্সপার্ট। মন চাইল ধরে ওকেও হারপিক খাইয়ে দিতে।
দরজা খুলে দিতেই ইলা ঢুকল হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে। হারপিকের বোতলটা দেখে হেসেই খুন।
“আপনি এটা দিয়ে ঘর পরিষ্কার করবেন? এটা তো বাথরুমের জন্য!”
“আপনি কেন এসেছেন এখন?”
“একটা জরুরি কথা বলতে।”
“কী কথা বলুন।”
“আমার বাসায় বিয়ের কথা বলছে।”
“তো?”
“আমার ছেলে পছন্দ নয়।”
“তো?”
“আপনি আমাকে বিয়ে করে ফেলেন। আমি অনেক ভালো মেয়ে।”
কানন ধমক দিয়ে বলল, “যত্তসব ফালতু কথাবার্তা! আপনি যান তো এখান থেকে।”
“প্লিজ….”
“বিয়ে কি ফাজলামি নাকি?”
“না, এজন্যই আপনাকে বলছি৷ আপনি তো বিয়ে করবেন তাই না? তো আমাকেই করেন।”
“আপনাকে কে বলেছে আমি বিয়ে করব?”
“বিয়ে না করলে কি দেবদাস হয়ে ঘুরবেন?”
“না মরে যাব।”
“তাহলে আমিও মরব।”
“মানে?”
“মানে মরব। আপনি আমাকে বিয়ে না করলে।”
বলতে বলতে ইলা এক ছুটে গিয়ে হারপিকের বোতলের মুখ খুলে ফেলল। কানন হতভম্বের মতো চেয়ে রইল সেদিকে। সে জীবনে কোনো কাজ সফলভাবে করতে পারেনি, উল্টে ঝামেলা বাঁধিয়েছে। সফলভাবে মরতে পারারও কোনো কারণ নাই সেটা আগেই বোঝা উচিত ছিল!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
*পেজে পাঠক কারা আছেন সাড়া দিন 😇*