বেলীফুল পর্ব-২

0
2045

#বেলীফুল
পর্ব-২

“আপনি কি চান আমি সত্যি সত্যি খাই?”

কাননের এতক্ষণে হুশ ফিরল। সে ঝট করে ইলার হাত থেকে হারপিকের বোতলটা নিয়ে ছুড়ে ফেলল। তারপর ইলার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল দরজার কাছে। দরজা খুলে তাকেও প্রায় ছুড়ে দিল ওপাশে। কঠিন স্বরে বলল, “আর কোনোদিন আমার ফ্ল্যাটের আশেপাশে দেখলে খবর আছে।”

ইলা বলতে চাইছিল সে আশেপাশেই থাকে, যাবে কেমন করে? কিন্তু বলার আগেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল সশব্দে। ইলার মনে হলো যথেষ্ট অপমান হয়েছে। আর দরকার নেই এই ছেলের কাছে যাওয়ার৷ সব হয়েছে তুলনের জন্য। এসব কুবুদ্ধি ওর মাথা থেকে বের হয়েছে। ওকে না ধরলে চলছে না।

কাননের আজও মরা হলো না। মরা এত কঠিন কে জানত! কয়েকটা বিস্কুট সমেত চায়ের কাপদুটো অবহেলায় পড়ে আছে। কী মনে করে সে টি টেবিলটার কাছে গিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। তারপর বিস্কুটগুলো চায়ে ডুবিয়ে খেল। দুই কাপ চাও সাবাড় করল। দেখল তাতে খিদে লেগে গেছে আরও। অথচ একটু আগেও খিদেটিদে কিছু ছিল না। খাওয়ার কিছু নেই ঘরে। একবার ভাবল রাতটা না খেয়েই দেবে, আবার মনে হলো এখন কিছু না খেলে সে মরেই যাবে, যদিও সে মরতেই চাইছে। কিন্তু সেটা অন্তত খিদেয় নয়।

এখন শীত নেই বললেই চলে। বসন্ত গত সপ্তাহেও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল, এখন একেবারে প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে। কাননদের বাড়িরার সামনে গেটের কাছে একটা শিমুলের গাছ। ফুলে ভর্তি হয়ে যেন লাল লাল ছোপ বসে গেছে গাছের ডালে ডালে। বড় বড় টকটকে ফুল। এখন রাত বলে দেখা যাচ্ছে না। ফুরফুরে হাওয়া বইছে চারধারে। ও হঠাৎ পেছনে চাইল। চার তলার ওপর একটা জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ইলাকে। ওকে তাকাতে দেখে ইলা জানালার সামনে থেকে সরে গেল। কানন হাপ ছেড়ে বাঁচল। যাক, এখন তার থেকে দূরেই থাকুক মেয়েটা। বিয়ে হয়ে গেলে আরও ভালো।

***
“নাজমিন….নাজমিন…..” বহুক্ষণ ধরে ডেকে চলছে আলেয়া। তার দুই হাত আটায় মাখামাখি। ছোট জা এর পাত্তা নেই। সে আবার ডাকল, “নাজমিন….”

নাজমিন ঘরেই ছিল। তার স্বামী আজ অফিসে যায়নি। জোর করে ধরে রেখেছিল তাকে। নতুন বিয়ে তাদের। ছাড়ছিল না সহজে। সেটা কি এখন ভাবিকে বলা যাবে? এদিকে বোধহয় ভাবি রাগ করতে শুরু করল! আর পারা যায় না! সংসার জীবনে এক ফোটা মিষ্টি থাকলে বাকি পুরোটা ঝাল। প্রতিদিন যেন একটা করে সাসপেন্স মুভি চলে। ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষা নেই!

নাজমিন রান্নাঘরে উঁকি দিল, “ভাবি ডেকেছেন?”

“জি ডেকেছি। আসেন৷ এসে আমাকে একটু উদ্ধার করেন।”

ওই হলো! মনে মনে কী বলল নাজমিন নিজেও বুঝল না। রান্নাঘরের পাশটাতে ছোট্ট এক চিলতে বারান্দা। সেখানে শিল পাটা রাখা। বাটতে হবে আদা রসুন। ব্লেন্ডার মেশিন নামক জিনিস থাকতে এই বাড়িতে আদিম যুগের পদ্ধতি কেন ব্যবহার করা হয় সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস নাজমিনের আজতক হয়নি৷ সে বারান্দায় পা দিয়েই হা হয়ে নিচে তাকাল। তিল তলার ওপর থেকে স্পষ্ট দেখতে পেল ঘটনাটা। চাপা স্বরে ডাকল, “ভাবি দেখে যান…”

ওর গলায় কিসের গন্ধ পেয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠে এলো আলেয়া। নিচে তাকিয়ে দেখল শিমুল গাছটার কোণায় দাঁড়িয়ে আছে তুলন৷ গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে অপর পাশে একটা ছেলে। বয়সে তুলনের সমানই হবে। ওকে একটা চিঠি দিল। তুলন সেটা হাতে নিতে নিতে হেসে গড়িয়ে পড়ে পারলে! পরমুহূর্তে সেটা লুকিয়ে ফেলল ওড়নার ভাজে। তারপর চুপিসারে রওনা দিন ভেতরের দিকে। একবার উপরে চাইলে দেখতে পেল তার দুই ভাবির মুখে বাঁকা হাসি। মনে মনে যে কী চলছে!

***
বিকেলবেলা ছাদে বসে আছে দুই বান্ধবী। দু’জনেরই মুখ গোমড়া৷

“কী হয়েছে তোর?” অবশেষে প্রশ্ন করল ইলা। সে ভেবেছিল তুলনকে ঝাড়বে, কিন্তু এসে দেখে বেচারির মুখ শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে আছে।

“মার খেয়েছি।”

“কেন?”

“দেখে ফেলেছে।”

“কী দেখে ফেলল?”

“ওকে।”

“কাকে?”

“উফ গাধা! ওইযে বললাম না ছেলেটা আমাকে প্রপোজ করেছে ওকে।”

“ওকে কে কোথায় দেখল?”

“দুই ডাইনী ভাবি দেখেছে। আমি একটু দেখা করতে গিয়েছিলাম সকালে।”

“কোথায় দেখা করলি?”

“বাসার সামনেই।”

“বাসার সামনে কেন দেখা করলি? ওকে বলতি তোর বেডরুমে চলে আসতে।”

“ইলা তোকে আমি কিন্তু ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব।”

“তুই ছাগলের মতো কাজ করলে বলব না? বয়ফ্রেন্ডের সাথে কেউ বাসার সামনে দেখা করে?”

“ও আমার বয়ফ্রেন্ড না।”

“তো কী?”

“বাজিয়ে দেখছি।”

“যত্তসব! কী বলল এসে?”

“ডেয়ার দিয়েছিলাম আমাদের বাসার সামনে আসতে পারে কি না! ভেবেছিলাম পারবে না। এই বাড়িতে ওর ফুপু থাকে। সে যদি দেখে ফেলে এই ভয় ছিল। কিন্তু ছেলে দেখি চলে এসেছে। এখন আমি পেছন ফিরি কেমন করে?”

“ভালো করেছিস। বাসায় এখন কী অবস্থা?”

“মা বলেছে বিয়ে দিয়ে দেবে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। একদম সিরিয়াস। আজকেই ঘটককে খবর দেবে।”

“দিক। পাত্র কি আর ছেলের হাতের মোয়া নাকি?”

“সেটাই। যাক বাদ দে। তোর কথা বল।”

“ভুয়া বিয়ের কথা বলেছিলাম হনুমানটাকে। সুইসাইড করব এই হুমকিও দিয়েছিলাম। কাজ হয়নি।”

“কী বলল?”

“বের করে দিয়েছে ওর বাসা থেকে। সব তোর বুদ্ধি। নিজে গাধা, আমাকেও গাধা মার্কা বুদ্ধি দিয়েছিস!”

তুলন কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামতে হলো। কে একজন ছাদে উঠছে। ভারিক্কি পায়ের শব্দ। দেখা গেল পাঁচতলার লোকটা। নাম রইসুদ্দিন। বয়স হয়তো পঞ্চাশের ওপর। সারাদিন বাসার দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। এই লোকের বাড়ির ফার্নিচার, পর্দা, পাপোশসহ প্রতিটা জিনিস কুচকুচে কালো রঙের। জামাকাপড়ও পরে তেমন। বাড়ির সবার ধারণা সে প্রেতচর্চা করে। যদিও কেউ সেরকম কিছু কখনো দেখেনি। লোকটা নিজের মতো থাকে৷ কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলে না। একটা ছেলে প্রতিদিন এসে বাজার করে দিয়ে যায়, ঘরের কাজকর্ম করে দেয়। সেই ছেলেও তার মনিবের মতোই রসকষহীন। দশটা প্রশ্ন করলে একটা জবাব দেয়, তাও ইচ্ছে হলে।

রইসুদ্দিন ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। ইলা আর তুলনকে যেন দেখতেই পেল না৷ পুরোটা সময় নিজের মনে গজগজ করে গেল। যাওয়ার আগে ছাদের এক কোণে লাগানো বেলীফুলের গাছের টব থেকে কিছু মাটি নিয়ে পকেটে পুরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে রওনা দিল।

এতক্ষণে মুখ খুলল তুলন৷ “এই লোক আসলে পাগল। মানসিক সমস্যা আছে।”

“থাক, তোর সমস্যা কী? উনাকে নিয়ে তুই একটু বেশিই মাথা ঘামাস।”

“কেন যে ঘামাই তা যদি জানতি!”

“কেন?”

“তুই নতুন এসেছিস তাই জানিস না। এই লোকের কাছে একটা রত্ন আছে। ওটা যদি পেতাম!”

“রত্ম মানে? কী রত্ন?”

“বলব। আগে বল ভাগ বসাবি না?”

“আচ্ছা যা বসাব না।”

“প্রমিজ?”

“ধুর বলতে হবে না।”

“আচ্ছা বলছি। ওর একটা ছেলে আছে। কী যে সুন্দর! গ্রীক দেবতাদের মতো দেখতে।”

ইলা হা হয়ে গেল। “ছেলেটা রত্ন? নাকি ছেলেটার কাছে রত্ন আছে?”

“গাধা ছেলেটাই রত্ন। দেখলে পাগল হয়ে যাবি এত সুন্দর! ”

“এখানে থাকে না কেন?”

“বাপ থাকতে দেয় না৷ একা থাকতে পছন্দ করে বুড়ো।”

“সেই রত্নটি কোথায় থাকে?”

“ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টারে। প্রফেসর বুঝলি!”

“ও বাবা! তোকে পছন্দ করে?”

“দেখেইনি কোনেদিন!”

“তাহলে?”

“তাহলে আর কী? ফেসবুক আইডি পেয়েছি, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছি, ঝুলিয়ে রেখেছে। একসেপ্ট করলে ট্রাই করব।”

“দিস তো দেখব।”

“দেব না।”

“লাগবে না যাহ৷ আমার হনুমানই ভালো।”

“যা ওর কাছেই। তোর হনুমানও কিছুদিন পর রইসুদ্দিনের মতো দরজা জানালা বন্ধ করে সারাদিন বিড়বিড় করবে। এখনই যা অবস্থা!”

“আমি ওকে ঠিক করে ছাড়ব।”

ইলার কথার ধরণে হো হো করে হেসে ফেলল তুলন৷ “আচ্ছা করিস, আগে তোকে পাত্তা তো দিক!”

“দেবে দেবে। নতুন প্ল্যান আছে মাথায়।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here