#বেলীফুল
পর্ব-১০
ইলা দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখল ওপরতলা থেকে স্ট্রেচারে করে বুড়ো লোকটাকে নিচে নামানো হচ্ছে। কী হলো উনার? দেখে অজ্ঞান মনে হচ্ছে। মরে যায়নি তো? ইলা হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওর চোখের সামনে দিয়ে নেমে গেল লোকগুলো। তাদের পেছনে কালো কোট পরা একটা ছেলেকেও দেখা গেল যেতে। চেহারাটা চেনা লাগছে। ইলা দ্রুত ওর ফ্ল্যাটের দরজা তালা দিয়ে নিচে নেমে গেল। বুড়োকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়েছে। ইলা গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ওনার?”
কাছেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, “জানি না। অবস্থা ভালো নয়।”
ইলার কেন যেন অস্থির লাগছে। বুড়োর সাথে তার কোনোদিন কথাবার্তাও হয়নি, তবু কেন যেন খারাপ লাগছে। সে একটু ইতস্তত করে বলল, “আমাকে নেয়া যাবে?”
ছেলেটা একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনি কে?”
“আমি চারতলায় থাকি।” ইলা দ্রুত জবাব দিল।
“শিওর যাবেন?”
“হ্যাঁ।”
“চলুন তাহলে।”
ইলা অ্যম্বুলেন্সে উঠে বসল। বুড়ো একটু যেন নড়ে উঠল। ইলা হাত বাড়িয়ে দিতেই তার একটা আঙুল ধরল লোকটা। আবার ছেড়ে দিল। দিশেহারার মতো তাকিয়ে বার কয়েক চোখ পিটপিট করে আবার চোখ বুজে পড়ে রইল।
হাসপাতাল কাছেই। ডাক্তার দেখেশুনে জানাল স্ট্রোক করেছেন। অক্সিজেন মাস্ক লাগানো হলো। স্যালাইনের নল ঝোলানো হলো হাতে। বুড়ো তখনো অচেতন।
ইলা বাইরে এসে করিডোরে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। ডাক্তার বলেছেন আশঙ্কাজনক কিছু হয়নি। বুড়ো এ যাত্রায় ঠিক সেরে উঠবেন। কালো কোট পরা ছেলেটা এগিয়ে এলো। ওকে অবাক করে দিয়ে প্রশ্ন করল, “আপনার নাম তুলন?”
ইলা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ছেলেটার মুখের দিকে তাকাল। ভীষণ সুন্দর দেখতে এই ছেলে। কোথায় দেখেছে একে? পরক্ষণেই মনে পড়ল ফেসবুকে! তুলনের সেই পছন্দের ছেলেটা! সাজিদ! যাকে ভুল করে গতকাল ছবি পাঠিয়ে ফেলেছিল ইলা! ইশ! ও ভুলেই গিয়েছিল এটা বুড়োর ছেলে! এতক্ষণ মনে পড়েনি কেন? সে এত বোকা কেন? আসলে বুড়োকে ওই অবস্থায় দেখে সে ভড়কে গিয়েছিল।
ওকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে সাজিদ গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কথা বলছেন না কেন?”
ইলা বলল, “আপনাকে কিছু বলার ছিল।”
“বলুন?”
“আসলে আমার নাম তুলন নয়।”
“তাহলে?”
“তুলন আমার ফ্রেন্ড। আমরা একই বাড়িতে থাকি। ওর কিছু প্রবলেম হওয়ায় আমার মোবাইল দিয়ে মেসেঞ্জারে লগইন করে আপনার সাথে কথা বলত। আমি ভুল করে আমার মেসেঞ্জার ভেবে আপনাকে ছবি পাঠিয়ে ফেলেছিলাম।”
সাজিদ কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবল। মেয়েটার সরল মুখ বলে দিচ্ছে সে মিথ্যে কথা বলছে না। তাছাড়া এতক্ষণ ওর বাবার জন্য যে সহমর্মিতা দেখাচ্ছিল সেটা খুব ভালো লেগেছে সাজিদের। সে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী নাম আপনার?”
“ইলা।”
“আপনি কি এখন বাড়ি চলে যাবেন?”
“ওনার কী হলো দেখে যেতাম…”
“বাবার অবস্থার কখন উন্নতি হয় তার ঠিক নেই। কতক্ষণ থাকবেন? ভালো কথা, বাসায় বলে এসেছেন তো?”
“আসলে এ সময় বাসায় আমি ছাড়া অন্য কেউ থাকে না। মা বাবা দুজনেই চাকরিজীবী।”
“বেশ! চলুন আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি। বাবার আপডেট আমি দিয়ে দেব।”
ইলা ব্যস্ত হয়ে বলল, “আপনার এখান থেকে কোথাও যেতে হবে না। একটা রিকশা নিলেই চলে যেতে পারব আমি।”
“ঠিক আছে। চলুন রিকশা ঠিক করে দিচ্ছি।”
ইলা উঠে পড়ল। হাসপাতালে এলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। বুড়োর কী হবে সেই চিন্তা লাগছে, তাছাড়া সাজিদ লোকটার সামনে লজ্জাও লাগছে ভীষণ! ইলাকে কী ভাবছে? খারাপ মেয়ে নয় তো?
ইলা বাসায় ঢোকার সময় দেখল কাননের ফ্ল্যাটে তালা দেয়া নেই। এসে পড়েছে হনুমান সাহেব। আজ তাকে আর জ্বালাতে ইচ্ছে হলো না। নিজের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল ইলা। দুপুরে কিছু খেলও না। বিকেলের দিকে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলো তার কাছে। ধরতেই বুঝতে পারল সাজিদের ফোন। তখন নাম্বার নিয়ে রেখেছিল।
“কেমন আছেন উনি?”
“এখন ভালো। জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু আমাকে ঠিকঠাক চিনতে পারছে না।”
ইলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “খেয়েছে?”
“হ্যাঁ। খাইয়ে দিয়েছি।”
ইলা খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করল, “আপনি খেয়েছেন?”
সাজিদ একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমি খেতে ভুলে গেছি।”
“খেয়ে নিন তাহলে। রাখছি।”
ইলা ফোন রেখে আবার শুয়ে পড়ল। জ্বর জ্বর লাগছে কেন? হাসপাতাল থেকে ভাইরাস নিয়ে এলো কোনো? মনে পড়ল সে নিজেও কিছু খায়নি দুপুরে। এজন্যই হয়তো দুর্বল লাগছে। এই অবেলায় ভাত খাওয়ার ইচ্ছে হলো না। ঘন করে দুধ জ্বাল দিয়ে মগভর্তি চা বানিয়ে দুটো বিস্কুট দিয়ে খেয়ে নিল। একটা ব্যাগের অর্ডার পৌঁছে দিতে হবে গতকাল। কাজ অর্ধেকই বাকি। সেটা নিয়ে বসে গেল সে।
সাজিদ ফোন রেখে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। এত যত্নে বহুদিন কেউ তাকে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেনি। মেয়েটা ভীষণ ভালো। সে ফোনে ইলার ছবিটা বের করে তাকিয়ে রইল অনেকটা সময় নিয়ে। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। কিছু খাওয়া দরকার এবার।
★
তুলনকে রাতে আরেক ছেলেপক্ষ দেখতে আসার কথা। তার মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে আছে। এখন মাথায় পানির পাতিল বসিয়ে দিলে ফুটতে থাকবে নিশ্চিত। এত উঠেপড়ে কেউ ওর পেছনে লাগেনি কখনো। খুব কান্না পাচ্ছে। বাসা থেকে বের হওয়া বারণ। তাকে সময় দেয়া হয়েছে সাজতে। অথচ তার কিছু ছুঁয়ে দেখারও রুচি হচ্ছে না। তুলন ঠিক করল সে সাজবে না। দরজা ভেতর থেকে ভালো করে আটকে দিল। কানে হেডফোন গুঁজে খাটের কোণে মেঝেতে বসে পড়ল সে। বাড়ির লোক ডেকে মরে যাক, তার শোনার প্রয়োজন নেই। ওরা চাইলেই একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের ওপর নিজেদের ইচ্ছে চাপিয়ে দিতে পারে না!
লাউড মিউজিক শুনলে কষ্ট কমে যায়। বাংলা গান সব ন্যাকা ন্যাকা লাগছে! হিন্দি গান শুনবে? নেহা কাক্কারের নতুন গানটা! ভলিউম বাড়িয়ে দিল সর্বোচ্চ। মেঝেতে শুনে পড়ল গান শুনতে শুনতে।
ঘন্টা চারেক পরের কথা। তুলনের বাড়ির লোকজন প্রচুর ধাক্কাধাক্কি করেও সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। কিন্তু তুলনকে কোথাও দেখতে পেল না। কোথায় গেল তুলন? ঘরে নেই! বদ্ধ ঘর থেকে যাবে কোথায়? ওর ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট্ট একটা বারান্দা আছে। বারান্দায় আবার গ্রীল নেই। এখান দিয়ে কোনোভাবে পালিয়ে গেল না তো! যা ডানপিটে মেয়েটা! হয়তো পাইপ বেয়ে নেমে গেছে! কিন্তু কার সাথে গেল? সবার মাথায় হাত!
ছেলেপক্ষ তখন ড্রইং রুমে বসে সবই শুনছে। মেয়ে দেখতে এসে এরকম অভিজ্ঞতা এই প্রথম। লোকগুলো নেহায়েত ভদ্রলোক বলেই উচ্চবাচ্য না করে বিদায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু প্রচার হয়ে গেল, মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে!
তুলনের ঘুম ভাঙল রাত একটায়। সে তাকিয়ে দেখল কোন অন্ধকার গহ্বরে সে আছে। প্রথমটায় কিছুই বুঝতে পারল না। পরে আস্তে আস্তে মনে পড়ল ঘটনা। গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। হেডফোন কখন যেন কান থেকে খুলে গেছে। আর সে গড়িয়ে খাটের নিচে চলে গেছে। খাটের নিচ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে মাথা তুলতেই মায়ের সাথে চোখাচোখি হলো। তিনি খাটের ওপর বসেছিলেন। তুলনকে দেখে ভূত দেখার মতে চমকে উঠলেন তিনি। তুলন ভয়ে একেবারে চুপসে গেল। তার ধারণাও নেই এদিকে কী থেকে কী হয়ে গেছে!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু