বেলীফুল পর্ব-১২

0
1100

#বেলীফুল
পর্ব-১২

কাছেই জোরে বজ্রপাত হলো। ইলা চমকে সোজা হয়ে বসল। বাইরে তাকাল জানালা দিয়ে। কাচের জানালার ওধারটা এখন ঝাপসা হয়ে এসেছে। কিছু দূরের দোকানগুলোর আলো ঘোলা বৃত্তের মতো আবছা দেখাচ্ছে। ইলা একটু ভেবে উত্তর দিল, “হ্যাঁ। তুলন আমার ভালো বন্ধু।”

“এজন্যই।”

“এজন্যই কী?”

“কিছু না। আপনি নিজের ব্যাপারে কিছু বলবেন না তাই তো?”

“কেন বলব না? কিন্তু বলার মতো আসলে কিছু নেই।”

“তাই নাকি? আচ্ছা, পড়াশুনা করেন কিসে?”

“অনার্স থার্ড ইয়ার।”

“কোন সাবজেক্ট?”

“দর্শন।”

সাজিদ চোখ বড় বড় করে বলল, “ফিলোসফির কিছু বোঝেন আপনি?”

ইলা ঠোঁট উল্টে বলল, “নাহ। পড়ার দরকার বলে পড়ছি। ক্লাস করতে ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে যাই, কী পড়ায় কিছু বুঝি না। পরীক্ষার আগের রাত পড়ে পাশ করে যাই।”

“ক্লাস করতে ভালো লাগে না কেন?”

ইলা বিরক্তির সুরে বলল, “বুড়ো বুড়ো স্যারগুলো কী পড়ায় নিজেরাও জানে না।”

“ওহ তোমার ইয়াং টিচার পছন্দ?”

“হ্যাঁ তা তো পছন্দ হবেই! কিন্তু আমার বিভাগে একটাও নেই।”

“আহারে!”

“আপনি কিসে পড়েন?”

সাজিদ হাসি চেপে বলল, “পড়ি কিছু একটা…”

ইলা পড়াশোনার কথা এড়িয়ে যেতে পারলে বাঁচে! বলল, “আপনার বাবার এই অবস্থায় আপনি এত রিলাক্সে গল্প করছেন কী করে?”

সাজিদ অন্যমনষ্ক হয়ে বলল, “ডাক্তার বলেছে এখন তেমন রিস্ক নেই।”

“কিন্তু উনি যে কিছু মনে করতে পারছেন না…”

“সেটা একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। বাবা একটা বন্দি, অন্ধকার, বিচ্ছিরি জীবন কাটাচ্ছিল। সবকিছু ভুলে গেলে সেই শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে। বাবাকে আমার কাছে নিয়ে রাখব।”

“আপনারা আলাদা থাকেন কেন?”

“বাবা একা থাকতে পছন্দ করতো।”

ইলার মনে পড়ে গেল তুলন ওকে বলেছিল এই ছেলের কথা। ঠিক কী কী বলেছিল মনে নেই, শুধু মনে আছে বলেছিল গ্রীক দেবতাদের মতো সুন্দর। ইলা তখন মনে করেছিল তুলনটা বরাবরের মতো বাড়িয়ে বলছে। কিন্তু আসলে মোটেও তা না! বাবার প্রসঙ্গ ওঠায় সাজিদ এখন দুই হাত একত্র করে টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে জানালার বাইরে কোন দূর দেশ যেন দেখবার চেষ্টা করছে। তার অপূর্ব সুন্দর মুখে বিষাদের ছায়া পড়েছে। মেঘের মতো চোখের কোণে এক টুকরো আবছা জলের ছাপ। দৃঢ় চোয়ালের রেখা স্পষ্ট হয়ে আছে। চুলগুলো সামান্য বড় হয়ে কাঁধ ছুঁই ছুঁই। ইলা কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল।

তুলনের পছন্দ আছে বলতে হবে! এই ছেলের সাথে কথা বলতে কত কষ্টই না করছে বেচারি! অথচ ওর সাথে কত সহজে পরিচয় হয়ে গেল। এবার দুটোর মিল করিয়ে দিতে হবে তাকেই। ওদের দেখা হওয়ার কথা তুলন শুনলে ভারি খুশি হবে।

“চলুন হাসপাতালে ঢুকি। বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে।” সাজিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল।

“আচ্ছা শুনুন…আপনার বাবাকে কি শুটকি ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে দেবে?”

সাজিদ হেসে বলল, “বাবা বলেছে এসব খাবে?”

“হ্যাঁ।”

“কে বানাবে? আপনি?”

“জি।”

“শুটকি ভর্তাও বানাতে জানেন?”

“খুব! সব জানি। ছোটবেলা থেকে একা একা থেকে কাজ করে সব শিখে গেছি।”

“ঠিক আছে। বাবাকে রান্না করে খাওয়াবেন এক সময়, সাথে আমাকেও ভুলবেন না যেন। তবে এখন নয়। বাবা আরেকটু সুস্থ হোক আগে।”

“আচ্ছা।”

আরও কিছুক্ষন হাসপাতালে বসে রইসুদ্দিনের সাথে গল্প করার পর ইলা উঠল। বুড়ো বার বার করে বলে দিলেন আবার যেতে। ইলা সম্মতি জানিয়ে বের হয়ে এলো। তাকে এগিয়ে দিতে এলো সাজিদ। ইলাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে বলল, “একটু মন দিয়ে পড়াশুনা করবেন কেমন? ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ট আমার একেবারে অপছন্দ।”

“ওমা! আপনি কি টিচার নাকি?”

“হ্যাঁ। ওই আপনার সাবজেক্টটাই পড়াই।”

ইলা বিষ্ময়ে হা হয়ে গেল।

সাজিদ বলল, “এখন নিশ্চয়ই আপনার আমাকে খুব পছন্দ হবে। ইয়াং টিচার খুঁজছিলেন কি না! আফসোস আপনি আমার ইউনিভার্সিটিতে পড়েন না!”

ইলা কিছু বলতে পারল না। রিকশা চলতে শুরু করল। সে মূর্তির মতো বসে রইল সারা পথ।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here