বেলীফুল পর্ব-১৩

0
1019

#বেলীফুল
পর্ব-১৩

নাজমিন ফর্ম ফিলআপ করে কার কার যেন সিগনেচার লাগবে সেসব আনতে গেছে৷ তুলন বসে আছে কলেজের লম্বা করিডোরের শেষ মাথায়। বৃষ্টি নেমেছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে দেবদারু গাছগুলোকে। বৃষ্টি তার পছন্দ নয়, কিন্তু আজ কেন যেন বিরক্ত লাগছে না। গতরাতের অভিজ্ঞতার পর সবকিছুই তাকে অন্যরকম শান্তি দিচ্ছে।

বার বার আনমনা হয়ে পড়ছিল তুলন। আপনমনেই হেঁটে একটা থাম ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা গোলাপগুলো দেখছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল দূর থেকে দৌড়ে আসা কাউকে। বৃষ্টির বেগ ক্রমেই বাড়ছে। মানুষটা দৌড়ে এসেও বাঁচতে পারেনি। কাকভেজা হয়ে গেছে।

তুলন নিজের মুগ্ধ হওয়ার সবটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করেই মুগ্ধ হলো ভিজে চুপসে যাওয়া ছেলেটাকে দেখে। মাঝারি গায়ের রঙ, একমাথা কোঁকড়া চুল, অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়িগোঁফ আর মাদক চাহনি! কালো জ্যাকেটে কী ভীষণ সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে! তুলন পলক ফেলতে ভুলে গেল।

ছেলেটা তাকে আরও বিষ্ময় চড়িয়ে দিতেই মাথা ঝাঁকিয়ে চুল থেকে পানি ঝরালো। জ্যাকেটটা ঝাড়ল। তারপর রওনা হলো ভেতরের দিকে। তুলনের মুগ্ধ দৃষ্টি অবশ্য তার চোখ এড়িয়ে যায়নি। সে যাওয়ার আগে বলে গেল, “আপনাকে গোলাপি রঙে মানায়নি, নীল পরলে আকাশের মতো দেখাতো।”

তুলনের গলা শুকিয়ে কাঠ। ভাবি এসে চিমটি কেটে তবে হুঁশ ফেরাতে পারে তার। তুলন ফেরার সময় বারে বারে পেছন ফিরে চাইল। যদি ছেলেটাকে আরেকবার দেখা যায়!

***

কানন আজ অফিসে যায়নি। ঘুম থেকেই উঠতে পারেনি সকালে। সকাল থেকেই আজ আকাশটা আঁধার হয়ে আছে। তাই সে বুঝতে পারেনি কখন বেলা গড়িয়েছে। যখনই চোখ খুলেছে, মনে হয়েছে এখনো ভোর, আরেকটু ঘুমানো যাক! শেষে যখন উঠেছে তখন দেখল বেলা সাড়ে এগারোটা! সে সময় আবার বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে।

বহুদিন পর বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করেছে বলে ছাদে গিয়ে ভিজেও এসেছে খানিক। অবশ্য মনে মনে কানন জানে, সে ছাদে গিয়েছিল মনে ক্ষীণ আশা নিয়ে, হয়তো এই বৃষ্টি দেখে ইলাও ভিজতে আসবে। কিন্তু আসেনি। মেয়েটা আশেপাশে থাকলে ভালো লাগে, কিন্তু সেটা নিজের কাছে স্বীকার করতেও রাগ লাগে কাননের।

নিচে নেমে সে দেখেছে ইলাদের ফ্ল্যাট তালা দেয়া। গেল কোথায় মেয়েটা? একেবারে উড়নচণ্ডী, পাগল ছাগল। উড়তে উড়তে কবে যে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় তাই নেই ঠিক! এই বৃষ্টি বাদলার দিনে গেছে কোথায়!

কাননের আজ কী যেন হয়েছে! সে সুন্দর করে গোসল করে খিচুড়ি বসিয়ে দিল। বেশি ঘুমিয়ে আর ভিজে মাথা যন্ত্রণা করছে বলে কড়া করে চা বানিয়ে খেয়ে নিল। বেশ ফ্রেশ লাগতে লাগল তার। খিদে বেড়ে গেল। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। ইলাকে ডেকে নিয়ে খাওয়া যেত যদি! একটু পর পর সে দরজা খুলে দেখছে ইলা আসছে কি না! কিন্তু কিসের কী! কোথায় বসে আছে কে জানে!

***

ইলা একটা লাইব্রেরির সামনে এসে রিকশা থেকে নামল। কিছু খাতা-কলম কেনার ছিল। সেসব নিয়ে কয়েকটা গল্পের বইও কিনে নিল। অনেকদিন ধরে ভাবছিল কাননকে কিছু গল্পের বই উপহার দেবে, দেয়াই হচ্ছে না। কত চেষ্টা করেছে সে হনুমানটার জন্মদিন জানার, বলেই না। কী ভেবে কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এসে সে কয়েকটা র‌্যাপিং পেপারও কিনে নিল। দিলে সুন্দর করেই দেয়া যাক!

সে যখন দরজা খুলছে, তখন কানন পেছন থেকে ডাকল। “শোনো!”

ইলা অবাক হয়ে বলল, “আমাকে ডাকছেন?”

“না, তোমার সাথে যে ভবঘুরে শয়তান সারাদিন ঘুরঘুর করে তাকে ডাকছি।”

ইলা হাসিমুখে বলল, “কী বলবেন বলুন।”

“খিচুড়ি রেঁধেছি। খাবে?”

“অবশ্যই। আমি কিচ্ছু রাঁধিনি। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে!”

“আচ্ছা এসো।” বলে দরজা ভিড়িয়ে রাখল কানন।

ইলার খুশিতে গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। কানন কক্ষনো তার সাথে এত সুন্দর করে কথা বলেনি!

সে ব্যাগটা ঘরে রেখে হাতমুখ ধুয়ে কাননের ফ্ল্যাটে ঢুকল। খিচুড়ির সুন্দর ঘ্রাণ বের হয়েছে। সাথে আলুভর্তা করেছে কানন। খিচুড়ির সাথে কে আলুভর্তা খায়! অবশ্য ভর্তা, লেবু, কাঁচামরিচ দিয়ে পরিবেশন করেছে সুন্দর করে। ইলা হেসে বলল, “আপনি তো দারুণ কাজকর্ম পারেন! করেন না কেন?”

কানন গম্ভীর থাকার চেষ্টা করল শুধু। কিছু বলল না।

ইলা প্রথম লোকমা মুখে দিয়ে মুখ কুঁচকে ফেলতে নিয়েও সামলে নিল। অনেক কষ্টে গিলল। কাননও ততক্ষণে খাবার মুখে দিয়েছে। অতিরিক্ত লবণ হয়েছে খিচুড়িতে। সে তিক্ত মুখে বলল, “এজন্যই কিছু করি না। জীবনে কোনোকিছু ভালোভাবে করতে পারলাম না!”

প্লেটটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে উঠে চলে যেতে উদ্যত হলো। ইলা দ্রুত উঠে কাননের হাত ধরে ফেলে বলল, “ভুল সবার হয়। তার জন্য কেউ মরে যেতে চায় না। না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দেয় না৷ জীবনকে দোষ দিয়ে বেড়ায় না।”

“তো কী করব? খেতে পারবে এসব?”

“এসব খেতে কে বলেছে? আলুভর্তা ভালো হয়েছে। ভাত বসিয়ে দিচ্ছি। আমাদের ঘরে ডাল রান্না আছে। আধঘন্টার মধ্যে আমরা খেতে চলেছি অত্যন্ত সু্স্বাদু খাবার! জীবন আমাদের অনেক অপশন দেয়। একটা কাজ না করলে অন্যটা ট্রাই করা উচিত!”

“এত পাকা পাকা কথা বলতে হবে না!”

কাননের মেজাজ ঠিক হলো না। ইলা চলে গেল নিজের ফ্ল্যাটে। ঠিক আধঘন্টা পর ফিরল। শুধু ভাত আর ডাল না, ইলিশ মাছ ভাজিও করে এনেছে। দু’জনেই তৃপ্তি করে খেল।

খাওয়া শেষে ইলা সব গোছাতে গোছাতে বলল, “দেখেছেন আমাকে আপনার কত প্রয়োজন?”

কানন তখন গম্ভীর হয়ে রইলেও ইলা বের হয়ে যাওয়ার সময় দরজা আটকে দেয়ার আগে বলল, “তোমাকে আমার প্রয়োজন হলেও আমাকে তোমার কোনো প্রয়োজন নেই ইলা। আমি কারও কাজে আসার মতো নই।”

ইলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল কানন। ইলা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এমন আধপাগল রোগীকে কেমন করে ঠিক করবে সে জানে না। এই মুহূর্তে ভালো, পরমুহূর্তেই খারাপ। আশ্চর্য পাবলিক! একটা সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালে কেমন হয়? কানন কি যাবে?

***

তুলনের মোবাইল ফেরত দেয়া হয়েছে। সে কতদিন পর ফেসবুকে লগইন করল! করেই প্রোফাইল পিকচারটা বদলে দিল। প্রোফাইল পিকচারের রিচ বেশি হয়। যারা ওকে ভুলেটুলে গেছে তাদের একটু মনে করিয়ে দেয়া যাক!

মেসেঞ্জারে ঢুকে অনেক মেসেজের মাঝেও একটা নাম চোখে ভাসল। সাজিদ!

সাজিদের আইডিতে ঢুকে বেশ একটু অবাক হলো তুলন৷ তার একাউন্ট থেকে কী যেন পাঠানো হয়েছিল, সেটা রিমুভ করা। সাজিদ লিখে রেখেছে, “আপনি এত রহস্য করছেন কেন? কে আপনি?

তুলনের চক্ষু চড়কগাছ! সে আবার কী রহস্য করল! ইলার মোবাইল দিয়ে লগইন করেছিল শেষবার। ইলা কি কিছু করল?

সে ফোন করল ইলাকে।

“তোর মোবাইল ফেরত দিয়েছে! ওয়াও!”

“হুম! কোথায় তুই?”

“তুই কোথায় সেটা বল! অনেক কথা আছে তোর সাথে!”

“আমারো।”

“ছাদে যাবি?”

“আচ্ছা। চলে আয়। আমিও আসছি।”

ইলাই আগে পৌঁছুলো। ছাদের একধার ঢালু। সেখানে বৃষ্টির পানি জমে আছে। জুতা খুলে পানিতে পা ডুবিয়ে দাঁড়াল ইলা। এখন আকাশ পরিষ্কার। নির্মল বাতাস বইছে। বাতাসে অজানা কোনো মিঠে ঘ্রাণ। তুলন লাফিয়ে লাফিয়ে ছাদে উঠে ইলাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ইলা রে….আমি বেঁচে গেছি বিয়ে থেকে!”

“কংগ্র্যাচুলেশনস! এখন অবস্থা কী বাসার?”

“এক্কেবারে ঠান্ডা। কিন্তু আমি ঠান্ডা নেই রে দোস্ত!”

“কেন? তোর কী হয়েছে?”

“আরেহ! ক্রাশের আগুনে পুড়ে আমি ডেড!”

ইলা আনন্দিত গলায় বলল, “তোর জন্য আমার কাছে প্রচুর সারপ্রাইজ আছে! এতদিন সাজিদের সাথে মেসেঞ্জারে লাইন করার চেষ্টায় ছিলি। আমি তোকে তার ফোন নাম্বারও দিতে পারি! যা হলো না এর মাঝে!”

তুলনের মনে পড়ল মেসেঞ্জারের কথা। কিন্তু তার সেটা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই এখন। হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “সাজিদ গন। অত ভাবওয়ালা আমার চলবে না রে। নতুন ক্রাশের চিন্তা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে! এত বড় ক্রাশ আমি জীবনে খাইনি! সাজিদের ওপরেও না!”

ইলা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়ে বলল, “হায় হায়! আবার নতুন কেউ! তুই কয়জনের সাথে সংসার করবি তুলন?”

“একজনের সাথেই! আমি তো একসাথে কয়েকজনকে মনে নিয়ে ঘুরি না। একের পর অন্যজন আসে। মনের পছন্দের ওপর তো আর আমার হাত নেই বল?”

ইলা বিরক্ত হয়ে বলল, “বিয়ের পর বর ছাড়া আরেকজনকে পছন্দ হলে কী করবি?”

তুলন চোখ টিপে বলল, “প্রেম করব।”

ইলা বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে অন্যদিকে তাকাল। তুলন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এগুলো তো ফাজলামো! যার সাথে বিয়ে হবে তাকে সিরিয়াসলি ভালোবাসবো।”

“তাহলে বিয়ে করে নে।”

“তাই করব। আজকের ক্রাশকে পেলেই বিয়ে করে নেব।”

ইলা কটমট করে তাকাতেই তুলন হেসে ফেলল। হেসে ফেলল ইলাও।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here