#বেলীফুল
পর্ব-১৪
ইলা ঠিক করেছে সে কাননকে ভালো কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবে। না দেখালে আর চলছে না৷ কিন্তু তার জন্য টাকাপয়সা লাগবে। তারচেয়ে বড় কথা কাননকে রাজি করাতে হবে৷ টাকা জোগাড় করা কঠিন হবে না, কিন্তু ওই হনুমানকে রাজি করাতে জান বের হয়ে যাবে। তবে চেষ্টা করলে কী না হয়! সকালে বাবা মা চলে যেতেই সে বের হয়ে গিয়ে কাননের ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপল।
কানন অফিসের জন্য রেডি হচ্ছিল। মাত্রই গোসল করে বের হয়েছে। পরনে একটা টাওয়েল ছাড়া কিছু নেই। কলিংবেলের শব্দ শুনেও সে তাই দরজা খুলতে গেল না। জানে, ইলা ছাড়া অন্য কেউ আসেনি। সে ধীরেসুস্থে জামাকাপড় পরল। আজকে একটা মিটিং আছে, ফর্মাল ড্রেসে সুন্দর করে যেতে হবে। সে সেভাবেই তৈরি হলো। অনেকদিন না পরা টাই ড্রয়েরে থেকে সাপের মতে পেঁচিয়ে কুঁচকে ছিল। সেটাকে বের করে ইস্ত্রি করে পরল। বহুদিন পর ক্রিমের কৌটোর মুখ খুলে মুখে খানিকটা ক্রিমও মেখে নিল।
এদিকে কলিংবেল বেজেই যাচ্ছে। এতক্ষণ দরজা খুলছে না বলে ইলা চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার৷ সে নিশ্চিত পাগল লোকটা কিছু করে ফেলেছে। মাত্রই বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটের দিকে পা বাড়াচ্ছিল সে, তখনই দরজাটা খুলে গেল। কাননকে সুস্থ, স্বাভাবিক দেখে ইলার এতটা ভালো লাগল যে সে স্থির থাকতে পারল না। এক দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে।
কানন প্রথমে জোর ধাক্কায় পিছিয়ে পড়ে যেতে গিয়ে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলেছে। তারপর ভূতের মতো হামলে পড়া মেয়েটাকে টেনে ছাড়িয়েছে নিজের থেকে। ধাতস্থ হয়ে ইস্ত্রি করা শার্টটা কুঁচকে যেতে দেখে খুবই বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার কি কমনসেন্স বলতে কিছু নেই? আর…আর…এইটা কী করলে তুমি?”
ইলা নিজেও ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। কানন তাকে যেভাবে জোর করে ছাড়িয়েছে তাতে অপমানিতও বোধ করেছে। সে আর কথার উত্তর দিল না৷ এক ছুটে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা আটকে দিল। চোখে পানি চলে এসেছে তার। এই লোকটা সত্যি খুব খারাপ! অসহ্য!
***
তুলন রাতে ভয়াবহ সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্নে সে আর তার নতুন ক্রাশ ছেলেটা একসাথে পাহাড়ি ঝর্ণার পাশ দিয়ে হাঁটছে। পিচ্ছিল পথে বারবার তার পা হড়কে যাচ্ছে, ছেলেটা তাকে বারবার ধরে ফেলছে। এক পর্যায়ে তারা ঝর্ণার পানিতে পা ডুবিয়ে বসল। হাতে হাত রাখল।
স্বপ্নের শেষটা অবশ্য সুন্দর নয়। সে শেষে দেখল ছেলেটা তাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছে আর সে ডুবে যাচ্ছে। ভয়ে ঘুম ভেঙে গেছে তুলনের। অবশ্য সে নিজের কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছে এভাবে, ছেলেটা ওকে ধাক্কা দিয়ে নিজের ভালোবাসার জলে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করছে। ব্রেইন সিগন্যালটা ধরতে পারেনি বলে সে পড়েছে ঝর্ণার গর্তে!
যাহোক, এসব দেখতে দেখতে অনেক বেলা করে তুলন ঘুম থেকে উঠেছে। উঠে ঘর থেকে বের হতেই শুনতে পেল দুই ভাবির গলা। তার বাবার কারণে এরা জোরে কথা বলতে পারে না ঠিকই, তবে ভেতরে ভেতরে ঠিকই দুজনের চাপা ঝগড়া চলে। মাঝে তুলনের ব্যাপারটা নিয়ে ষড়যন্ত্র করায় দুই জা মিলেছিল ভালো, কিন্তু ওর ব্যাপারটা মিটে যেতেই দু’জনার আবার লেগেছে। এবারের বিষয়বস্তু হচ্ছে ছোট ভাবির পড়াশুনা নিয়ে। বড় ভাবি ইন্টার পাশ, তাই ছোট জায়ের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার ব্যাপারটা সহ্য করতে পারছে না কিছুতেই। ছোট ভাবিকে সে প্রতিবার পড়ার সময়গুলোতেই ডাকে। ডেকে এমন কাজ দেয় যেটা ঠিক এখুনি করা প্রয়েজনীয় নয়, তবু করতে হয় বড় জায়ের মুখের ওপর কথা বলতে পারে না বলে। পেছনে পেছনে ঠিকই ঝাল ঝাড়ে কাজকর্মে ইচ্ছাকৃত ভুল করে।
তুলনের বিরক্ত লাগে এসব। সে মাকে বলেওছে কয়েকবার, কিন্তু মা সবকিছুতেই কেমন নির্লিপ্ত। ঝামেলায় জড়াতে তার তেমন ইচ্ছে নেই। শাসন বারণ সব তুলনের জন্য তোলা। বাকিরা ভেসে যাক, আপত্তি নেই।
তুলনের ধারণা সংসার দ্রুত ভেঙে যাবে। বাবার ইনকাম বন্ধ হলেই ভাইয়েরা আলাদা হয়ে যাবে। মা বাবাকে নিয়ে তখন ঝামেলায় পড়বে দুই ভাই। কোনো বউই শ্বশুর-শাশড়ী নিয়ে ঘর করতে রাজি হবে না। তুলন চিন্তায় পড়ে গেল। নিজে কিছু করতে পারবে কি সে? সারাদিন তো পড়ে আছে অযথা ছেলেগুলোর দিকে চেয়ে। বহুদিন পর তার মন থেকে ক্রাশ সংক্রান্ত চিন্তাগুলো মুছে কিছু বাস্তবিক চিন্তা ভর করল।
পড়ার টেবিলে বসে আনমনে কী ভাবতে ভাবতে আবারও ঘুমিয়ে পড়ল সে। এবারও খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখল। সেই স্বপ্নে তার একটা বিশাল বাংলো বাড়ি আছে। সেখানে বাবা মা আছে, আর আছে তার একটা ছোট্ট ছেলে। ছেলেটার চুল বড় বড় আর কোঁকড়ানো।
তুলন ঘুম থেকে উঠল মায়ের ডাকে। মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷ তুলন হঠাৎ মাসের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলল। মাঝেমধ্যে কাঁদার নির্দিষ্ট কারণ লাগে না। অদ্ভূত এক মন খারাপ আচ্ছন্ন করে রাখে পুরো সত্তা। তুলনের জীবনে প্রথমবার এমন অনুভূতি হলো।
***
ইলা ভেবেছিল বইগুলো র্যাপ করে কাননকে উপহার দেবে। রাতেই সুন্দর করে প্যাকিং করে রেখেছিল। এখন আর বদ ছেলেটাকে এসব দিতে ইচ্ছে করছে না৷ সারাদিন কাননের ব্যবহার মনে করে কষ্ট লেগেছে ইলার। নিজের কাজের জন্যও ভীষণ লজ্জা লাগছে। কোনোদিন কোনো ছেলের হাত পর্যন্ত ধরেনি সে। সেখানে এই ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরল কেমন করে? যদিও সে তেমন কিছু মনে করে জরিয়ে ধরেনি। অনেকদিনের পুরানো বান্ধবীকে দেখলে যেমন খুশিতে জড়িয়ে ধরে, এটাও তো তেমনই। তবু কানন একটা ছেলে! আর এমনি কোনো ছেলেও নয়, ইলার ভালোবাসার মানুষ!
দুপুরে খেয়েদেয়ে শুয়ে মোবাইলটা হাতে নিল সে। সাজিদের মেসেজ এসেছে, “আজকে আসবেন একটু? বাবা আপনার কথা বলছিল।”
গতকাল তুলনের কথা শুনে তারও আর সাজিদের প্রতি আগ্রহ ছিল না। তুলনেরই যখন ইচ্ছে নেই, তখন সে আর আগ বাড়িয়ে আলাপ জমিয়ে কী করবে! কিন্তু সাজিদের বাবার জন্য মায়া হচ্ছে। বুড়ো লোকটা একেবারে নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে। ইলা ঠিক করল বিকেলের দিকে হাসপাতালে যাবে।
***
কাননের আজ বারবার কাজ থেকে মন ছুটে যাচ্ছে। এমনিতে সে তেমন কিছু ভাবে না। কারো সাথে কথাবার্তাও খুব একটা বলে না। অফিসের পুরো সময়টা রোবটের মতো ঠাঁয় বসে নিজের কর্তব্যটুকু করে বিদায় হয়। না সে তেলবাজির মধ্যে আছে, না আছে কারো সাথে খাতিরে। তাই ফাঁকিবাজ গোত্রের না হলেও তার প্রমোশনের নামগন্ধও পাওয়া যায় না। উচ্চাকাঙ্খা সে হারিয়েছে বহু আগেই। একটা পেট চালাতে এই বেতনই তার জন্য ঢের। মাস শেষে ব্যাংকে ভালো পরিমান টাকা জমাও হচ্ছে।
তবে আজকের দিনটা অন্যরকম৷ কাননের জীবনে কখনো মেয়ে আসেনি তা নয়। ক্যাম্পাস জীবনে তার প্রেমিকা ছিল। মেয়েটার নাম আসমানী। ধবধবে সাদা ছিল গায়ের রঙ, ছোট ছোট চোখ, লম্বা চুল। প্রথম দেখাতেই সে প্রেমে পড়েছিল আসমানীর। মাস দুই পর প্রপোজ করেছিল। তাকে অবাক করে দিয়ে আসমানী সেদিন বলেছিল, “আমিও তোমাকে প্রথম থেকেই পছন্দ করি।”.
তারপরই চুটিয়ে প্রেম টানা দুটো বছর। কত হাত ধরে ঘোরাঘুরি করেছে দু’জন, কতবার চুমু খেয়েছে! কিন্তু সেসব আজ অতীত। অতীতের চিন্তা কেন বারবার ফিরে ফিরে আসছে? আসলে কানন মনে করার চেষ্টা করছে আসমানীকে জড়িয়ে ধরতে তার ঠিক কেমন লাগত। মনে পড়ছে না একেবারেই।
আসমানীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল থার্ড ইয়ারে উঠে। তাকে কিছু না বলেই বিদেশফেরত এক ছেলেকে হুট করে বিয়ে করে নিয়েছিল মেয়েটা। বিয়ের দিন পনেরো পর একেবারে হানিমুন সেরে ক্লাসে এসেছিল আসমানী। কাননের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি দিয়ে বলেছিল, “বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল। কিছু করার ছিল না আমার। তুমি খুব ভালো মেয়ে পাবে দেখো! ভুলে যেও আমাকে।”
কানন বিশ্বাস করেছিল আসমানীর কথা। মনটা ভেঙে গেলেও শুভকামনা জানিয়েছিল ওর নতুন জীবনের। কিন্তু দিনকয়েকের মধ্যেই আসমানী যেভাবে সংসারে ডুবে গেল, আর ক্লাসে এসে বান্ধবীদের কাছে নিজের সংসার, স্বামী সম্পর্কে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠত তাতে কাননের সন্দেহ রয়নি মেয়েটা ইচ্ছে করেই গেছে। আসমানী হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে ছিল। আর্থির সুখের হাতছানি এড়াতে পারেনি, এড়িয়ে গেছে প্রেম। প্রথমবার বিচ্ছেদের সেই তীব্র যন্ত্রণাও কানন সয়ে গিয়েছিল কেমন করে সেকথাও আজ সে বিস্মৃত হয়েছে।
ইলা তাকে ছিটকে এসে যখন জড়িয়ে ধরল, তার মনে হয়েছিল পৃথিবীটা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওই বাচ্চা মেয়েটা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তার মন পেতে। কিন্তু মন যে কবে মরে ছাই হয়ে গেছে! কষ্ট পেতে পেতে অনুভূতির কোটর শূন্য।
কিন্তু আজ তাহলে অত ভালো লাগল কেন? ভালোলাগাটাও তো এক ধরণের অনুভূতি! কানন অনেক চেয়েও কাজে মনোযোগ দিতে পারল না৷ ছুটি নিয়ে চলে গেল বাইরে। গাড়িটাড়ি না ধরে এলোপাতাড়ি হাঁটতে থাকল পথ ধরে। অনেক আগে সে গল্পের বই পড়ত। হুমায়ূন আহমেদের সব বই ছিল প্রায় মুখস্থ। বহুদিন পর তার হিমুর কথা মনে পড়ল। নিজেকে হিমু ভাবতে ইচ্ছে হলো খুব।
কিন্তু হিমু হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঘোরে, হিমুর পায়ে জুতা থাকে না। এই মুহূর্তে রাস্তায় হলুদ পাঞ্জাবি পাওয়া না গেলেও সে শু জোড়া খুলে রাস্তার পাশে এক ভিক্ষুকের সামনে রেখে দিল। গলার টাই খুলে দিয়ে দিল এক পথশিশুকে।
***
ইলা হাসপাতালে গিয়েও রইসুদ্দিনের সাথে দেখা করতে পারল না। তিনি নাকি ঘুমাচ্ছেন। তার ছেলেও নেই। জিজ্ঞেস করে আসা উচিত ছিল! আজকের দিনটাই বোধহয় অলুক্ষণে! ইলা বেরিয়ে যাওয়ার আগে হাতে করে নিয়ে আসা বইটা সেখানকার নার্সকে দিয়ে গেল। দিয়ে বলল, “ওনাকে দিয়ে দেবেন।”
বইটা ঠিক কী বই ইলা জানে না। কয়েক রকমের বই এনেছিল কাননের জন্য। সবগুলো আলাদা করে প্যাক করেছিল৷ এটা কোনটা কে জানে! খালি হাতে আসতে কেমন লাগছিল বলে নিয়ে আসা!
নার্স যদিও তার কথা বোঝেনি। সে রোগীকে না, রোগীর ছেলেকে বইটা দিল।
***
বৃষ্টি নামল সন্ধ্যার দিকে। ইলা চা হাতে জানালার পাশে বসে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছিল। হঠাৎ নিচের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। কানন ঢুকছে। খালি পা, কাদায় মাখামাখি প্যান্ট। ভিজে চুপসে গেছে একেবারে। ঝোড়ো কাকের মতো বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে ছেলেটাকে!
(চলবে)