বেলীফুল পর্ব-১৭

0
1130

#বেলীফুল
পর্ব-১৭

কানন চোখ খুলে দেখতে পেল ওর দিকে ঝুঁকে উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে আছে ইলা। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। উঠে বসার শক্তি নেই। এখন কি দিন না রাত? ইলা কখন এসেছে এখানে? গতরাতে দরজা খুলে দেখেছিল ইলা এসেছে। সাথে ওর মা’ও ছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। সে অস্ফুট স্বরে বলল, “ইলা!”

“বলুন।”

ইলা তার কপালে নিজের ঠান্ডা হাত রাখল। ভীষণ আরাম বোধ হলো। ক্ষুধা রয়ে গেছে পেটে। পিপাসা পাচ্ছে। “পানি!” শব্দটা উচ্চারণ করল কানন।

ইলা ছুটে গেল পানি আনতে। কাননের চোখের ভেতরটা কেমন জ্বালা করছে। চোখ কয়েকবার পিটপিট করে সে দেখতে পেল তার ঘরে আরও একজন আছে। পাশেই বসে আছে, কিন্তু এতক্ষণ দেখতে পায়নি তাকে৷ মানুষটা সম্ভবত ইলার মা। কানন কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু শব্দ খুঁজে পেল না৷ ইলার মা কাননের মুখোমুখি বসে বললেন, “এখন ভালো লাগছে?”

কানন দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। এর মানে ভালো না খারাপ সে নিজেও জানে না।

একটু পরে একজন ডাক্তার এলেন। দেখে ঔষধ দিয়ে গেলেন। কাননকে ইলার মা খানিকটা ভাত খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে চলে গেলেন৷ বলে গেলেন একটু পর আবার এসে দেখে যাবেন। এখন যেন সে একটু বিশ্রাম নেয়। ইলাকে নিয়ে গেলেন নিজের সঙ্গে।

কানন আস্তে আস্তে শোওয়া থেকে উঠে বসল। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। কর্মব্যস্ত একটা দিন শুরু হয়েছে। ইলাকে আজ খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। ইলা কি মায়ের সামনে কোনো পাগলামি করে বসল? তারছেঁড়া মেয়ে একটা! তার মা কি এখন থেকে তাকে নজরবন্দি করে রাখবে? যদি রাখে তাহলে আর ইলাকে যখন তখন দেখা যাবে না। কেমন মন খারাপ হয়ে আসে কাননের।

দুর্বল লাগলে শুয়ে পড়ে সে। আকাশ পাতাল কত ভাবনা মাথায় আসে! আজ বহুদিন পর মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। ইলার মা কী যত্ন করে তাকে খাইয়ে দিল! কত বছর কেউ খাইয়ে দেয়নি! কাননের বারবার চোখে পানি চলে আসছিল, বহুকষ্টে আটকে রেখেছিল। এবার কেঁদে ফেলল।

গতকাল থেকেই অদ্ভূত ব্যাপারটা ঘটছে! তার বড্ড বেশি বাঁচতে ইচ্ছে করছে। ইলা একবার মজা করে বলছিল তাকে বিয়ে করে নিলে বাচ্চাকাচ্চা হবে, তখন তাদের সাথে আরও বহুকাল বাঁচতে ইচ্ছে করবে। কথাটা আসলেই সত্যি। কাননের ইচ্ছে হয় নতুন করে কিছু ভাবতে। কিন্তু নিজের ভাঙাচোরা জীবনটার জন্যই কিছু করতে ভয়টা হয়!

***

রইসুদ্দিনের আজ বেশ ভালো লাগছে। সকালে উঠে সে পুরো চার স্লাইস পাউরুটি খেয়েছে। একটু উঠে কেবিনের ভেতর হাঁটাহাঁটিও করেছে। আজ তাকে ছুটি দেয়া হবে। বাড়ি ফিরতে পারবে ভেবে বেশ একটা স্কুল ছুটির মতো আনন্দ হচ্ছে।

সাজিদের সকালে একটা ক্লাস আছে। সে ক্লাস সেরে এসে বাবাকে নিয়ে যাবে।

নার্স কেবিনে ঢুকে হাসিমুখে বললেন, “আজ আপনাকে একদম ইয়াং লাগছে স্যার।”

রইসুদ্দিন হেসে বললেন, “ঠিক। মনে হচ্ছে হেঁটেই বাড়ি যেতে পারব।”

নার্স সুন্দর করে হাসল। রইসুদ্দিনের মনে হলো এই মেয়েটা ছিল বলে সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছে। একটা মমতাময়ী মেয়ে আশেপাশে থাকলে জীবনটা অন্যরকম সুন্দর আর সহজ লাগে। আচ্ছা তার কি মেয়ে আছে? না তো! একটাই ছেলে, সাজিদ। একটা মেয়ে থাকলে কেমন হতো তার? ওইযে ইলা মেয়েটা তাকে দেখতে এসেছিল। ওর মতো একটা মেয়ে থাকলে মন্দ হতো না।

সাজিদ ঢুকল একটু পর। বাবার কাছে বসে খুব শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল, “বাবা, তুমি বাড়ি যেতে চাও?”

“হ্যাঁ, তো কোথায় যাব?”

“বাবা, আমার সাথে থাকতে চাও তুমি?”

“আর কার সাথে থাকব?”

“তুমি আমার কোয়ার্টারে যাবে তো?”

“হ্যাঁ। যেখানে খুশি নিয়ে চল। এই হসপিটাল থেকে শুধু মুক্তি চাই।”

সাজিদ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাবা পুরানো কথার বেশিরভাগই ভুলে গেছে। সাথে মুক্তি পেয়েছে অন্ধকারে কাটানো হতাশার জীবন থেকে। এই ভুলোমনা বাবাকে নিয়েই সে বাকি জীবন কাটাবে। এই একটা মানুষই তো আছে তার।

***

তুলন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে। আজ ভাবির পরীক্ষা। ভাইয়ার অফিস আছে, তাই সে যাবে ভাবির সাথে। ছেলেটা যদি ভাবির সাথে পড়ে থাকে তাহলে পরীক্ষাতেও একই কলেজে সিট পড়বে। সেখানে গেলে তার দেখা পাওয়া গেলেও যেতে পারে।

ভাবিকে বারবার তাড়া দিচ্ছে সে। “তাড়াতাড়ি করো তো! পরে দেখবে লেট হয়ে গেছে। লিখতেই পারবে না পুরোটা।”

নাজমিন সব গোছগাছ করে বের হলো হন্তদন্ত হয়ে। তার কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। বিয়ের পর এই প্রথম পরীক্ষা দেয়া। নার্ভাস লাগছে খুব৷ মনে হচ্ছে কিছু লিখতে পারবে না। ক’দিন ধরেই পরীক্ষা সম্পর্কিত দুঃস্বপ্ন তাকে একেবারে কাবু করে ফেলেছে। তার ওপর আবার কনসিভ করেছে। এ সময়টা মানসিক অস্থিরতা থাকেই।

শ্বাশুড়িকে সে প্রেগনেন্সির খবর জানায়নি। জানালে পরীক্ষা দিতে দিত কি না কে জানে! এরা যে পুরানা ধ্যানধারণার মানুষ! পুরো রাস্তা অস্থিরভাবে গেল নাজমিন। তার হাতের তালু ঘেমে যাচ্ছে বারবার। ভোরবেলায় উঠে পড়তে বসার সময় অবস্থা দেখে ওর স্বামী তানজিম আদর করে বলে দিয়েছে, “যা হয় হবে, এত টেনশন করো না। তোমার মনের জোর যতটা, রেজাল্ট ততটাই ভালো হবে।”

সেই কথাটাই বারবার মনে করার চেষ্টা করছে নাজমিন।

তার পাশে রিকশায় বসে অস্থির হয়ে আছে তুলনও। ক্যাম্পাসের গেটে নেমে দ্রুত তুলনের চোখদুটো ঘুরে বেড়াতে লাগল ভিড়ের মাঝে।

***

কানন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল ঘরে কারো উপস্থিতির শব্দে। একবার তাকিয়ে চোখ বুজে ফেলল সে। চোখে দিনের আলো কড়কড়ে লাগছে। কে এসেছে? ইলা? জানালাটা একটু বন্ধ করে দিতে পারে না?

সে ধীরে ধীরে চোখ খুলে ঘুরে তাকাল। ইলার মা এসেছে। টেবিলের ওপর ঔষধের বক্সটায় কী যেন দেখছেন৷ কাননের দিকে তাকালেন তিনি। হাসিমুখে বললেন, “ঘুম ভাঙল? কী খাবে বলো। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।”

কাননের একটু লজ্জা লাগল। “আপনি আবার কষ্ট করে..আমি কিছু একটা করে নেব..”

“কষ্ট কিসের? প্রতিবেশী অসুস্থ হলে দেখব না? চটপট বলো কী খাবে? ঝাল করে মুরগি রান্না করি? ঝাল খাবার মুখে রুচবে ভালো। পেটভরে খেলে দেখবে রাতের মধ্যে একদম ফিট হয়ে যাবে।”

কাননের মায়ের কথা মনে পড়ল। তার জ্বর হলে মা অস্থির হয়ে পড়তেন। মুখে রুচি থাকত না বলে এটা ওটা একটু পরপর করে এনে বলতেন, দেখ তো, এটা খেতে পারিস কি না।

কানন বলল, “আপনি যা রান্না করবেন সেটাই খাব।”

“লক্ষী ছেলে। এখন ওঠো একটু৷ হাতমুখ ভালো করে ধুয়ে এসো। জ্বর তো কম৷ বসে টিভি দেখো বা বইটই পড়ো। শুতে হবে না এখন৷ খেয়েদেয়ে একেবারে বিকেলে শুয়ে থেকো।”

কাননের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো ইলা কোথায়। কিন্তু করা হলো না।

“ওঠো। হাতমুখ ধোও। তারপর আমি যাই।”

কানন উঠে হাতমুখ ধুয়ে এলো। এখন হালকা লাগছে শরীরটা৷ তবে মুখের ভেতরটা তেঁতো হয়ে আছে। মাথায়ও যন্ত্রণা রয়ে গেছে।

ইশরাত বললেন, “শোনো কানন, আমি দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে গিয়েছিলাম তখন৷ এখনো তাই যাচ্ছি। দরকার হলে ফোন করো।”

কানন ঘাড় হেলিয়ে সায় দিল। এই মহিলার সামনে তার কেমন যেন লজ্জা লাগছে।

***

অবশেষে তুলন ছেলেটাকে দেখতে পেল। ভাগ্য এভাবে সহায় হবে কে জানত! ভাবি হলে ঢোকার মিনিট পাঁচেক পর ছেলেটাকে দেখা গেল। হন্তদন্ত হয়ে এসে পরীক্ষা দিতে ঢুকল। তার মানে ভাবির ব্যাচেরই। ইয়েস! হাততালি দিয়ে উঠল তুলন৷ আশেপাশের লোকজন অদ্ভূত চোখে তাকাল। সে পাত্তা দিল না।

সময় কাটাতে কলেজ প্রাঙ্গনের একধারে ফুচকাওয়ালার কাছ থেকে এক প্লেট ভয়ানক ঝাল দেয়া ফুচকা খেয়ে মিনিট ত্রিশেক ঝালের তীব্রতা থেকে বাঁচতে ছোটাছুটি করে কাঁদল। তারপর ফিরে এসে আরেক প্লেট খেয়ে আরেক দফা গাল ভাসাল।

অপেক্ষার মতো বিরক্তিকর বিষয়টাও তার এত ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে প্রজাপতির মতো উড়তে। “আজকের দিনটা ভীষণ সুন্দর।” ভাবল তুলন। ভাবিকে এখানে দিয়ে তার চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই চমৎকার ছেলেটিকে আরেকবার দেখার সুযোগ হারানোর কোনো মানেই হয় না!

***

কাননকে অবাক করে দিয়ে খাবার নিয়ে এলো ইলা। সে ভেবেছিল ইলাকে বোধহয় তার মা আর আসতেই দেবে না। অবশ্য একটু পর ইশরাতও চলে আসলেন। তার আগেই ইলা নিচু গলায় কাননকে বলল, “মা সব জেনে গেছে বুঝলেন? আমাকে নজরে নজরে রাখছে। বাসা বদলে ফেললেও আশ্চর্য হব না। আর না হলেও আমি আপনার কাছে আর আসতে পারব না। মাকে কথা দিয়েছি। কিছু করার নেই আর।”

ইলার চোখদুটো ছলছল করে উঠল। সামলে নিয়ে বলল, “আপনাকে মা খুব পছন্দ করে। আপনি যদি মাকে একবার বলতেন আমার কথা…অবশ্য তা কেন বলবেন? আমি চলে গেলেই আপনার ভালো।”

আর কিছু বলার সুযোগ পেল না ইলা। ওর মা চলে এলো। ইশরাত বললেন, “তুমি খেয়ে নাওগে ইলা। অনেক কাজ করেছ।”

ইলা চুপচাপ চলে গেল।

কাননের মনটা ভার হয়ে গেল। আবার ইশরাতের হাতে খেতে খুব ভালোও লাগল। অনেকদিন পর মনে হলো তার কেউ নেই কথাটা ঠিক না।

***

নাজমিন পরীক্ষা শেষে বের হয়ে তুলনকে দেখে ভারি অবাক হয়ে গেলেন। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। “ওমা! তুমি এখনো আছো?”

“হ্যাঁ। পরীক্ষা কেমন হলো?” ভাবিকে কথাটা জিজ্ঞেস করলেও তার মন পড়ে আছে অন্য জায়গায়। চোখদুটো অস্থিরভাবে খুঁজছো একটা মানুষকে।

নাজমিন বললেন, “ভালোই হয়েছে। পাশ করে যাব মনে হচ্ছে। চলো এখন যাই।”

তুলন এতক্ষণের অপেক্ষা বৃথা যেতে দিতে মোটেও রাজি নয়। সে দ্রুত বলল, “ভাবি ওই ফুচকাটা এত্ত মজা জানো না! চলো একটু খাই।”

নাজমিনের এমনিতেই এখন টক খেতে ইচ্ছে করে। ফুচকার কথায় তৎক্ষনাৎ তার জিভে জল চলে এলো। তুলনের সাথে ছুটল ফুচকার দোকানে। ততক্ষণে জায়গাটা লোকজনে ভর্তি হয়ে গেছে। সিরিয়াল দিয়ে ফুচকা খেয়ে বের হতে হতে তাদের বেশ দেরি হয়ে গেল। ঝালে চোখে অন্ধকার দেখছে, তবু তুলনের চোখ সেই ছেলেটার খোঁজে। কিন্তু ভিড়ের মাঝে কোথা দিয়ে যেন সে বেরিয়ে গেছে।

একটু মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরল তুলন। ফিরতে ফিরতে অবশ্য সেই ছেলের কথা মনেও রইল না তার। প্রচন্ড পেটব্যথা শুরু হয়েছে। বাড়ি গিয়ে সোজা সে ঢুকল টয়লেটে। তিন প্লেট ঝাল ফুচকার প্রকোপ তাকে রাতের মধ্যেই পুরো কাবু করে দিল। রাত তিনটায় সে একত্রিশবারের মতো টয়লেট থেকে ফিরে বিছানায় নেতিয়ে পড়ে নিজের অজান্তেই গেয়ে উঠল, “প্রেমের মড়া জলে ডোবে না…”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here