#বেলীফুল
পর্ব-২৩
খুব ভোরে ডোরবেলের শব্দে কানন ঝট করে উঠে বসল। আজ শুক্রবার, অফিস নেই বলে একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমাবে ঠিক করে রেখেছিল। চোখ ডলতে ডলতে উঠল সে। হঠাৎ মনে হলো, ইলা আসেনি তো? হয়তো মা বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আসার সুযোগ পেয়ে গেছে! সে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে একটা মোড়ার সাথে পা বেঁধে প্রায় পড়তে পড়তে দরজা খুলতে গেল।
পিপহোলে চোখ রেখে কানন দেখল বাইরে দাঁড়িয়ে ইলার বাবা। একদিকে আশার পানিতে এভাবে ছাই পড়তে দেখে ভীষণ হতাশা ছেকে ধরল, অন্যদিকে ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। লোকটা কি তাকে আল্টিমেটাম দিতে এলো? কী বলবে? ‘ইলার দিকে চোখ তুলে তাকালে চোখ তুলে ফেলব!’ নাকি ‘আমার মেয়ের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে খুনোখুনি হয়ে যাবে!’
ভাবতে ভাবতে ঢোক গিলল কানন। তখনই তৃতীয়বারের মতো বেল বাজল। সে যত দ্রুত সম্ভব একটা ভালো টিশার্ট পরে নিল। অসম্ভব অগোছালো ঘরটাকে মোটামুটি পরিপাটি করার চেষ্টা করল। তারপর দরজা খুলে দিল।
ইলার বাবা মুখে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কানন সালাম দিয়ে বলল, “আসুন ভেতরে।”
হাবিব ভেতরে ঢুকলেন। তাকে চারদিকে নজর বোলাতে দেখে কানন তাড়াতাড়ি বলল, “আসলে একা থাকি তো, ঘর গোছানোর সময় পাই না…”
হাবিব হো হো করে হেসে বললেন, “তোমার ঘর তো ভালোই। ব্যাচেলর থাকাকালীন আমার ঘর দেখলে মানুষ দৌড়ে পালাত।” বলে বোধহয় নিজের অতীতের স্মৃতিচারণ করে আরও খানিকটা হেসে নিলেন।
কাননের বুক ভার কমে গেল। সে একটু হেসে বলল, “আঙ্কেল আপনি বসুন, আমি চা বানিয়ে আনি।”
“আনো, একসাথে চা খেতে খেতে কথা বলি।”
কানন মনে মনে বিষ্ময় নিয়ে চা বানাতে গেল। রান্নাবান্না সে মোটামুটি পারে। চা-টা বলতে গেলে ভালোই হয়। দু’কাপ চায়ের সাথে দুই পিস কেক নিয়ে সে নিজের হলেও হতে পারে শ্বশুরকে আপ্যায়ন করল।
হাবিব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “ফার্স্টক্লাস! যখন ব্যাচেলর ছিলাম, চা খাওয়ার হলে দৌড় দিতাম টং দোকানে। কী আড্ডা! দিনের অর্ধেক সময় চায়ের দোকানে পার করতাম। তবু চা বানানো শেখা হয়নি। তুমি তো ভালো কাজের!”
কানন একটু লজ্জা পাওয়ার ভান করল।
হাবিব নিজের অতীত স্মৃতি নিয়ে রীতিমতো বকবকানি শুরু করে দিলেন। “জানো তো, ব্যাচেলরের ওই এক জিনিস শিখলেই হয়, ডিমভাজি। কিছু না পারি, ওটা পারলে চলে যায়। আমার রুমমেট আবার আরেকটা জিনিস ভালো পারত। কী শুনবে? শুটকি ভুনা। আমার ইউনিভার্সিটি জীবন পুরোটা কেটেছে ডিমভাজি আর শুটকি ভুনা খেয়ে। হা হা হা।”
এত হাসি কাননের কেন যেন বিপদসংকেত মনে হচ্ছে। সে আরেকবার ঢোক গিলে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল। হাবিব আরও কিছুক্ষণ বকবকানির পর বললেন, “ওই জীবনটাই ভালো ছিল বুঝলে! বিয়ে থা করার পর ভালো রান্না তো পাই, কিন্তু ওইযে অফুরন্ত আড্ডা, রাত জেগে তাস পেটানো, মনভরে সিগারেট খাওয়া ওসব আর হয় না বুঝলে! ইচ্ছে হয় আগের জীবনে ফিরে যেতে। কেন যে মানুষ বিয়ে করে!” উদাস গলায় কথাগুলো বলে তিনি চায়ের দিকে মনোযোগ দিলেন।
কাননের অস্বস্তি লাগল। বিয়ের প্রসঙ্গ চলে আসছে।
চায়ের কাপ রেখে গলা পরিষ্কার করে হাবিব বললেন, “বিয়ে! হ্যাঁ, বলো তুমি বিয়ে করতে চাও?”
কানন মনে মনে বলল, আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই, অন্য কাউকে কোনোভাবেই নয়। মুখে বলল, “জি।”
“কেন?”
এই ‘কেন’র কী উত্তর হয়? কানন একটু ভেবেচিন্তে জবাব দিল, “বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। জীবন নিয়ে এতদিন কিছু ভাবিনি। কোনোমতে কাটাতে পারলে বাঁচতাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটা সুযোগ দেয়া উচিত নিজেকে। নতুন করে শুরু করা উচিত। আর সেজন্য একজন সঙ্গী ভীষণ প্রয়োজন।”
হাবিব বোধহয় উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন। বললেন, “আচ্ছা! এবার বলো, তুমি ইলাকে কেন বিয়ে করতে চাও?”
কানন ভাবল ঝেড়ে কেশে ফেলাই ভালো। ভণিতা না করে সে সোজাসুজি উত্তর দিল, “আমি আসলে ইলাকে নিয়ে সেভাবে ভাবতাম না। ও নিজেই আমাকে পছন্দ করত, আমার কাছে আসত। ওর একটা দৃঢ় প্রচেষ্টা ছিল আমাকে ডিপ্রেসড লাইফ থেকে বের করে আনার। সত্যি বলতে আমি যে একটা সুস্থ জীবনযাপন করছি, মরার কথা বলছি না বা ভাবছি না, জীবনটাকে নতুন করে গোছাতে চাচ্ছি, তার পুরো ক্রেডিট ইলার। ওর জন্য আমার অবশ্যই সফট কর্ণার আছে। একমাত্র ওকে বিয়ে করলেই আমি সুখী হতে পারব। তাই ইলাকে বিয়ে করতে চাই।”
“তুমি সুখী হতে পারবে বুঝলাম, ইলাকে সুখে রাখতে পারবে?”
কানন একটু থেমে বলল, “জানি না। নিজের ওপর ভরসা আমি অনেক আগেই হারিয়েছি। তবে আমার ধারণা ইলা সুখে থাকবে। আমি ওকে জ্ঞানত কষ্ট দেব না, ভালো রাখার চেষ্টা করব। আর ও যেহেতু আমাকে ভালোবাসে, ও আমার সাথে যথেষ্ট ভালো থাকবে। ইলাকে আমি যতদূর চিনেছি, আপনি যদি তাকে অন্যত্র বিয়ে দিতে চান তাহলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।”
হাবিব নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। ছেলেটা এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে তিনি জানতেন না। মুখচোরা একটা ছেলে গুছিয়ে কথা বলতে পারবে তাই তিনি ভাবেননি।
হাবিব এবার বললেন, “ঠিক আছে! তাহলে তুমি বলছ তুমি ইলার ব্যাপারে সিরিয়াস?”
“জি। এখন বাকিটা আপনাদের ইচ্ছে।”
“হুমম। তোমার তো আত্মীয় বলতে এক বোন? তার ফোন নম্বর আমি যোগাড় করেছি। তার সাথে সরাসরি কথা বলব? নাকি তোমার সাথেই সব কথা হবে?”
কানন একটু ভয় সহকারে বলল, “তার মানে কি আপনারা রাজি?”
“মিয়া বিবি রাজি তো আমরা আর বাঁধা দিয়ে কী করব বলো!” বলে আবারও হো হো করে হেসে নিলেন হাবিব। কাননের কেন যেন মনে হলো লোকটা হেসে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন। “তাহলে কী বলো?”
“আপাকে কিছু বলতে হবে না। সে দেশে আসে না বললেই চলে। আমিও তেমন একটা যোগাযোগ করি না। যা বলার আমার সাথেই বলুন।”
“ঠিক আছে। সময় হোক, বাকি আলাপ করা যাবে। আজ উঠি।”
কানন দরজা পর্যন্ত হাবিবকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আবার আসবেন। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগল।”
“এখন তো আসাই হবে। দু’পা বাড়ালেই তোমার ঘর। আসতে যেতে আবার ইনভিটেশন লাগে নাকি? হা হা হা।”
হাবিব ওপাশের দরজার কলিংবেল বাজাল। দরজা খুলে দিলেন ইশরাত। কানন সালাম দিল। কুশল জিজ্ঞেস করল। তারপর হতাশ হয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ইলাও তো দরজাটা খুলতে পারত! তিনদিন দেখা হয় না! কিন্তু বুকের মাঝে কী অদ্ভুত প্রশান্তি! এতদিন যে যন্ত্রণা নিয়ে সে ঘুরছিল, তার বোধহয় অবসান ঘটতে চলেছে! ইলা তার হতে যাচ্ছে!
কানন প্রথমে কথাটা ঠিকভাবে বুঝে উঠতেই একটা লাফ দিয়ে উঠল। পরমুহূতেই তিরিংবিরিং করে গিয়ে ঠিক ছোটবেলার মতো বিছানায় উঠে এলোপাথাড়ি লাফালাফি, নাচানাচি করে নিল। তারপর নিজেই হেসে গড়াগড়ি খেল। মা বাবা মারা যাওয়ার পর আজ এতটা বছর পর তার এত আনন্দ হচ্ছে!
***
তুলন কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরল। লাল ব্লাউজ, ম্যাচিং চুড়ি, ছোট্ট লাল টিপ পরে নিল। গলায় কণ্ঠার সাথে লেপ্টে থাকা একসারি পাথরের সেট আর কানে ছোটো সাইজের ঝুমকা। তাকে দেখতে সত্যি সত্যি ভীষণ সুন্দর লাগছে। ছোটো ভাবি দেখে বললেন, “ওমা তুলন! তোমাকে একেবারে নতুন বউয়ের মতো লাগছে! যাচ্ছো কোথায়?”
তুলন আগেই মাকে বলে রেখেছিল বান্ধবীর জন্মদিন, সেখানে যাবে। ভাবিকেও সেটাই বলল। জন্মদিন ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য সে একটা গিফটের প্যাকেটও র্যাপিং করে রেখেছে। বলেছে ওটাতে কসমেটিকস আছে। আসলে ভেতরে আছে আকাশের জন্য কেনা পারফিউম।
সে খানিকক্ষণ পর বেরিয়ে পড়ল। রিকশা নিয়ে সোজা চলে গেল বোটানিক্যাল গার্ডেন। আকাশ দাঁড়িয়ে ছিল। তুলন রিকশা থেকে নামতেই এগিয়ে এসে ভাড়া মিটিয়ে দিল। তারপর হঠাৎ ওর হাতের কব্জি ধরে হ্যাচকা টানে সরিয়ে নিল। তুলন ভীষণ অবাক হলেও পরমুহূর্তেই দেখতে গেল একটা দ্রুতগামী প্রাইভেট কারের সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে আকাশ।
দু’জন কথা বলতে বলতে এগিয়ে যেতে থাকল। আকাশ চোরা চোখে বারবার তাকাচ্ছে তুলনের দিকে। তুলন চোখ নাচিয়ে বলল, “কী দেখো এভাবে?”
“তোমাকে দেখতে আগুনের মতো লাগছে। তুমি এত সুন্দর হবে কে জানত!”
“তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“তুমিও অনেক সুন্দর!”
তুলন একটু ভালো করে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “আরে! তোমার পাঞ্জাবির সাথে আমার শাড়ির কালার প্রায় ম্যাচিং!”
আকাশ লেমন কালারের পাঞ্জাবি পরেছে। হাতা গুটিয়ে কনুইয়ের কাছাকাছি নিয়েছে। গলায় ঝোলানো বেশ দামী একটা সানগ্লাস। ঝাঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো, তবে সুন্দর।
আকাশ হেসে বলল, “মনের মিল থাকলে এমনই হয়।”
তুলন মুচকি হাসল। আজকের আবহাওয়া ভালো। কড়া রোদ ওঠেনি। সুন্দর বাতাস দিচ্ছে। তুলনের ইচ্ছে হলো আকাশের হাত ধরে হাঁটতে। ঠিক তখনই আকাশ আলতো করে তার হাত ধরল। তুলন লজ্জা পেয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, ছেলেটা কি তার মন পড়তে পারে নাকি?
- (চলবে)