বেলীফুল পর্ব-২২

0
993

#বেলীফুল
পর্ব-২২

মসজিদের সামনে বড় একটা মেহগনি গাছ। তার নিচে অনেকগুলো চেয়ার পাতা। তাতে বসে এলাকার মুরুব্বি গোছের কিছু লোক। থমথম করছে পরিবেশ। এই সকালবেলাতেও ঘাম হচ্ছে সাজিদের। খুবই অস্বস্তি লাগছে। এই যুগে এসেও কোনো মেয়েকে নিয়ে এরকম বিচার বসতে পারে তার ধারণাতেও ছিল না। ব্যাপারটা দেখতেই বাবার সাথে আসা। তার বাবাও একটা চেয়ারে বসেছেন।

এলাকাটা সাজিদের ইউনিভার্সিটির পেছনে। মফস্বলি ভাব থাকলেও অনেকটাই গ্রামের মতো। কাছেই একটা পুকুর আছে, পাশের বাঁকা নারকেল গাছের স্পষ্ট ছায়া পড়েছে স্থির পানিতে। সেদিকেই তাকিয়ে আছে মেয়েটা।

মেয়েটার নাম জানা গেল, মৌরি৷ ওড়নায় মাথা ঢাকা। ফর্সা চেহারা আর বড় বড় চোখের বেশ সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর ওপর থেকে তার সব ভালোবাসা উঠে গেছে, বাকি রয়েছে শুধু নির্লিপ্ততা। মেয়েটার পাশে মুখ কালো করে বসে প্রৌঢ় ভদ্রলোক, যার চেহারা দেখে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মনে হয়। যতদূর সাজিদ বাবার কাছে জেনেছে, এই ভদ্রলোকের পৈতৃক সম্পত্তি অনেক৷ নিজে ব্যবসা করেও প্রচুর টাকা কামিয়েছেন৷ এখন শহরের কোলাহল থেকে দূরে একটু নির্জন জায়গায় বাড়ি করে বাস করতে শুরু করেছেন। কিন্তু এখানে এসে এরকম বিপদে পড়বেন তা ভুলেও বুঝতে পারেননি। তিনি লোকগুলোকে আরও একবার বোঝানোর চেষ্টা করলেন, “আমার মেয়ের কী দোষ বলেন তো? সে তো ভিক্টিম। এই দেশে ভিক্টিম ব্লেমিং কবে শেষ হবে? জীবনে এরকম একটা দৃশ্য দেখতে হবে আমি কল্পনাও করিনি।”

ভদ্রলোকের কথা শুনে আরও জানা গেল, শহরের বাড়ি ভাড়া না দেয়া থাকলে তিনি সেখানে কবেই চলে যেতেন! এই এলাকায় থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও তার বাকি নেই। আগামী মাসেই তিনি চলে যাবেন, এই ক’দিন যেন সহ্য করা হয়।

তাকে অবশ্য বেশি কথা বলতে দেয়া হলো না৷ একটা খুব লম্বা লোক গলা খাকারি দিয়ে বললেন, “এত কথা বলে লাভ নাই ভাইসাহেব। আমরা যে কারনে এখানে বসছি সেটা পরিষ্কার করে বলতে চাই।”

সবচেয়ে বয়স্ক মুরুব্বি বললেন, “বলেন।”

“এই মেয়ে ছিল আমার মেয়ের বান্ধবী। মেয়ে কিছুদিন ধরে দেখতেছিলাম মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে সারাদিন। একদিন ধরলাম, দেখি এক ছেলের সাথে খুব কথা! চেপে ধরে আসল ঘটনা বের করলাম। ওই ছেলে এই মেয়ের বন্ধু। এর নাকি অনেক ছেলে বন্ধু। ওই ছেলের সাথেও সে লাইন করায় দিছে। মেয়েরে তো আমি সোজা করে দিছি, কিন্তু এই ডেঞ্জারাস মেয়ের কী করবেন করেন।”

কথাটা শুনে মৌরি চমকে তাকাল। সাজিদের মনে হলো ওর চোখ বলছে, সবগুলো মিথ্যে কথা! কিন্তু মৌরি মুখে একটা কথাও বলল না।

এবার আরেক ভদ্রলোক নিজের বক্তব্য রাখলেন। তার মেয়ে মৌরির কাছে মাঝে মাঝে ঘুরতে যেত। সে এমন বশ করেছে যে এখন শত নিষেধেও মেয়ে শোনে না। সময় পেলেই চলে যায় মৌরির কাছে। তাতে কী শিক্ষা পাচ্ছে তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত।

দেখা গেল আরও কিছু বক্তব্য এলো। সবই মৌরির সাথে মিশে মেয়ে খারাপ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কিংবা নমুনা। তাছাড়া একজনের মেয়েকে নাকি মৌরি জাুদটোনা করেছে, যার কারনে সেই মেয়ে মৌরির পক্ষ নিয়ে বাড়িতে রীতিমতো ঝগড়া শুরু করেছে। সেটা নিয়েও মেয়ের বাবার তীব্র ক্ষোভ।

সবশেষে বিষয়টা দাঁড়াল, একটা অশুচি হয়ে যাওয়া মেয়ে পুরো এলাকার জন্য হুমকিস্বরূপ। এই মেয়ে সত্যি কিডন্যাপ হয়েছিল নাকি ইচ্ছে করে গেছে তারও ঠিক নেই। ইচ্ছে করে যাওয়ার সম্ভবনাই বেশি। তাকে কিছুতেই এই এলাকায় রাখা যাবে না। রাখলেও একঘরে করে রাখতে হবে।

কিছু লোক অবশ্য বিপক্ষে মত দিল। তাদের সহানুভূতি আছে মৌরির বাবা আর মৌরির জন্য। দুই পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হলো।

সাজিদ দেখল মৌরির চোখে পানি জমে আছে। কিন্তু গড়িয়ে পড়ছে না। কী শক্ত ব্যক্তিত্বের মেয়ে! এর সাথে কেন এমন হচ্ছে! পৃথিবীটাকে এই মুহূর্তে সৌরজগতের নিষ্ঠুরতম গ্রহ বলে মনে হচ্ছে। মহাবিশ্বে যদি আর কোথাও প্রাণী থেকে থাকে, তারা নিশ্চিয়ই এত জঘন্য নয়?

সাজিদের কিছু বলা দরকার। একটা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হয়ে সে এরকম একটা দৃশ্য দেখতে পারে না৷ কী বলবে সেটাই প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারছিল না৷ এবার একটু সামনে এগিয়ে গেল। গলা খাকারি দিয়ে বলল, “সবাই একটু চুপ করবেন? আমার কিছু বলার আছে।”

“তোমারও বলার আছে? বলো বলো।” মাঝবয়সী এক লোক বললেন।

“আপনারা এই মেয়েটাকে কোন ভিত্তিতে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন?”

“শুনলেন না এতক্ষণ?” বলে উঠল কয়েকজন।

“হ্যাঁ। কিন্তু তার দোষটা কী?”

“সেটা নিয়েও অনেক কথা হয়েছে।”

“একতরফা শুনে কাউকে দোষ দেয়া যায় না।”

“তাহলে তাকে বলতে বলেন। এই মেয়ে, তুমি বলো!” বলল বয়ষ্ক লোকটি।

মৌরি কথা বলল না। মুখ গোজ করে দাঁড়িয়ে রইল।

সাজিদ বলল, “উনাকে বলতে হবে না। আপনারা এখন বলুন, উনার অপরাধটা কী? যেকোনো একজন বলুন।”

এক লোক বলল, “সে এলাকার মেয়েগুলারে নষ্ট করে দিতেছে।”

“আচ্ছা? প্রমাণ দেখান। কোন মেয়েটাকে নষ্ট করেছে সে?”

কয়েকজন বলল, “এইযে আমরা এতক্ষণ বললাম শোনেন নাই?”

সাজিদ বলল, “হ্যাঁ। কিন্তু প্রমাণ আছে কোনো? বিচার করতে সবার আগে প্রমাণ করতে হবে। আপনার মুখের কথা আমরা কেন বিশ্বাস করব?”

বয়ষ্ক লোকটি বলল, “এরা এলাকার মান্যিগন্যি লোক, এনারা মিথ্যা বলবেন কেন?”

সাজিদ বিরক্ত স্বরে বলল, “হোক না? তাতে কী? প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিচার করা যাবে না। তাছাড়া এখন তো গ্রাম্য বিচার শালিসের সময় পার হয়েছে। কোনো সমস্যা হলে মামলা করুন, কোর্টে যান, এসব কেন? এভাবে একটা মেয়েকে হেনস্তা কেন করছেন আপনারা?”

যে লোকটা প্রথমে অভিযোগ শুরু করেছিল সে এবার ত্যক্ত হয়ে বলল, “অনেক হইছে ভাই। এইটা ইউনিভার্সিটি না, লেকচার বন্ধ করেন।”

সাজিদ উনার দিকে তাকিয়ে বলল, “বেশ! আপনিই তো বলেছেন আপনার মেয়েকে প্রেম শিখিয়েছেন মৌরি। তাহলে আপনার মেয়েকে ডেকে আনুন, তার মুখে শোনা যাক।”

লোকটা অবাক হয়ে বলল, “না, তার কী দোষ? তারে এইসবের মধ্যে আনা যাবে না।”

“কেন যাবে না? আপনি যে এখানে দাঁড়িয়ে কোনো প্রকার প্রমাণ ছাড়াই আরেকজনের মেয়েকে সবার সামনে খারাপ বলে দোষারোপ করে যাচ্ছেন তাতে কিছু হচ্ছে না? আপনার সম্মান খুব বড়, আর উনার সম্মান?”

লোকটা সমান তেজে জবাব দিল, “আমার মেয়ে ওর মতো পরপুরুষের সাথে দুই রাত কাটায় আসা মেয়ে না।”

সাজিদ অবাক হয়ে বলল, “কেউ ইচ্ছে করে এরকম যায়? সাধারণ বুদ্ধি থাকলেও মানুষ বুঝবে যে একটা মেয়ের খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে সে প্রাকাশ্য দিবালোকে গাড়িতে করে কারো সাথে পালিয়ে গিয়ে দু’দিন পর ফিরে আসবে না! আপনারা কেউ মেয়েটার পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। যেখানে সান্ত্বনা দেয়ার কথা, সেখানে দোষ দিয়ে বিচারসভা বসিয়েছেন। আজকে আপনার মেয়েকে কতগুলো ছেলে তুলে নিয়ে গেলে?”

লোকটা জবাব দিল না। সাজিদ বলল, “দেশের অবস্থা কেমন সবাই জানে। পথেঘাটে কারো নিরাপত্তা নেই। বিচার নেই। দোষীরা আইনের বড় বড় ফাঁকফোকর দিয়ে অনায়েসে বের হয়ে যাচ্ছে। কেউ কি গ্যারেন্টি দিতে পারে তার বাড়ির মেয়ের সাথে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে না? এমন অবস্থায় আমরাও যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকি, একে অপরের সাথে এমন আচরণ করি, তাহলে কী করে হবে? আজকে মৌরির বাবাকে এলাকা ছাড়া করবেন, কাল আপনার মেয়ের সাথে কিছু হলে এলাকার বাকি লোকেরা আপনাকে এলাকা ছাড়া করার আগে ভাববে?”

কেউই আর কথা বলল না। পরিস্থিতি উল্টে গেছে। সাজিদ বলে চলল, “আপনাদের যদি মনে হয়, এই মেয়ে খারাপ তাহলে নিজেদের মেয়েদের ওর কাছে আসতে দেবেন না, আটকে রাখবেন। এটাই একমাত্র সমাধান। তবে আপনার কাউকে খারাপ মনে হলেই সে যে খারাপ হবে, তাকে যে সবার সামনে অপদস্ত করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। স্বাধীন দেশে সবার সমান অধিকার।”

সাজিদের মাথা দপদপ করছে ব্যথায়। পুরো ব্যাপারটা তাকে যথেষ্ট যন্ত্রণা দিয়েছে। সে আর কিছু না বলে বাবার কাছে গিয়ে বলল, “চলো বাবা।”

রইসুদ্দিন মুগ্ধ বিস্ময়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তার অপূর্ব সুন্দর দেখতে ছেলেটার মন যে এত সুন্দর তিনি কোনোদিন খবর রাখেননি। ইচ্ছে হলো ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগায় কাজটা করতে পারলেন না। উঠে সাজিদের হাত ধরে এগিয়ে গেলেন।

অনেকেই তার সাথে উঠে পড়ল। সাজিদ যাওয়ার সময় দেখল মৌরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ভেজা, তাতে অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা ফুটে আছে। সাজিদ একবার মাথা নাড়ল। তারপর ফিরে চলল। কিছুদূর যাওয়ার পর কার একটা ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকাল। দেখল মৌরির বাবা দৌড়ে আসছেন।

কাছে এসে সাজিদের হাত ধরে বললেন, “তোমার জন্য আজকে এই ছোটলোকদের হাতে আপমান হওয়া থেকে বেঁচে গেলাম বাবা। তুমি আমার মান বাঁচালে। তোমার জন্য কী করি বলো তো?”

সাজিদ একটু হেসে বলল, “দোয়া করবেন।”

মৌরির বাবা অশ্রুসজল চোখে বললেন, “তুমি আজ বিকেলে একবার আমার বাড়িতে এসে এক কাপ চা খেয়ে যাবে।” রইসুদ্দিন এর দিকে চেয়ে বললেন, “আপনিও অবশ্যই আসবেন। কত গর্বিত বাবা আপনি!”

রইসুদ্দিন হাসলেন। সাজিদ বলল, “আমি তো ব্যস্ত থাকি, সময় পেলে যাব।”

“সময়ের কথা জানি না বাবা, তুমি অবশ্যই আসবে। একটা বাবার অনুরোধ এটা।”

সাজিদ মাথা ঝাঁকাল শুধু।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here