বেলীফুল পর্ব-২১

0
1137

#বেলীফুল
পর্ব-২১

কাননের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গিয়ে হাবিব ওর পুরানো অফিসের খবর পেলেন। সেখানে আবার তার এক পরিচিত লোক পেয়ে গেলেন। দেখা গেল লোকটি কাননকে ভালো করেই চেনেন। তার কাছে শুনতে পেলেন কাননের অতীত ইতিহাস। কীভাবে মিথ্যে অপবাদে ফেঁসে গিয়েছিল, কীভাবে সেটা থেকে ছাড়া পেল, ওর মা বাবার মৃত্যু, সবই লোকটা বিষদভাবে বর্ননা করল হাবিবকে। হাবিব তার থেকেই কাননের বোন আর দুলাভাই এর নাম্বার পেল। তারা থাকে টেক্সাসে। কাননের একমাত্র অভিভাবক তারাই, অতএব হাবিব ঠিক করলেন তাদের সাথে যোগাযোগ করবেন। তার আগে অবশ্য কাননের বক্তব্য পরিষ্কারভাবে শুনতে হবে। তার সাথে বলতে গেলে কথাই হয়নি।

তিনি কাননদের এলাকায় গিয়েও খবর নিলেন। ওরা সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা ছিল। তাই সবাই এক বাক্যেই চিনে ফেলল তাকে। ওদের বাড়িটাও দেখে এলেন। সেটা ওমনি পড়ে আছে। মা বাবা মারা যাওয়ার পর কানন ওখানে আর থাকেনি। ভাড়াটাড়াও দেয়নি। আর ক’দিন পর ভূতের বাড়িতে পরিণত হবে মনে হচ্ছে।

হাবিব একটা ব্যাপার বুঝতে পারলেন, কানন ভেসে আসা ছেলে নয়। ভালো পরিবারের ছেলে। সুখী একটা সংসার ছিল তাদের, যেটা দুর্ভাগ্যক্রমে ধ্বংস হয়ে গেছে। ছেলেটা বেঁচে আছে কোনোরকমে। ইলার জন্য যথেষ্ট যোগ্য সে। ভালো চাকরি করে, চরিত্রও ভালো। কিন্তু পরিবার ছাড়া ছেলে, ইলাকে সুখী করতে পারবে তো? হাবিবের চিন্তারা আর শেষ হয় না।

***

কানন মোবাইল হাতে ইতস্তত করছে, ফোন করবে কি না! ইলার নাম্বারটা স্ক্রিনের সামনে ভেসে আছে। একটা চাপ দিলেই কল চলে যাবে। এই ইলার পিছু ছাড়ানোর জন্য সে কী না বলেছে! কিন্তু আজ দৃশ্যপট উল্টো। সে নিজেই কাতর হয়ে আছে ওই একটি মানুষের কণ্ঠ একটুখানি শোনার জন্য। তার জীবনটাই যে বদলে দিল তার সাথে সত্যি তার এভাবে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে? বিশ্বাস হতে চায় না কাননের। অবশ্য তার ভাগ্যটাই কেমন গোলমেলে।

অবশেষে ফোনটা করেই ফেলল সে। উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল।

প্রথমবার বেজে শেষ হয়ে গেল। ইলা ফোন তুলল না। আবার ফোন করল কানন। এবারও ধরল না ইলা। তৃতীয়বারের বার যেন একটু বিরক্ত হয়েই ফোন ধরল ইলা।

“বলুন।”

“কেমন আছ?”

“ভালো। আপনি?”

“ভালো থাকার মতো অবস্থায় আছি কি?”

ইলা কান্না সংবরণ করে বলল, “কেন কী হয়েছে?”

“তুমি কি আর কখনো আমার ফ্ল্যাটে আসবে না ইলা?”

“না।”

“আচ্ছা ধরো আমি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আগেরবারের চেয়েও খারাপ অবস্থা, তখনও আসবে না?”

ইলা কঠিন স্বরে বলল, “এসব আজেবাজে কথা বললে আর জীবনেও আপনার ফোন ধরব না৷ আর আপনি অসুস্থ হবেন, হয়ে যান। সুস্থ হয়ে শুনবেন ইলা হারিয়ে গেছে চিরতরে।”

“তুমি বাচ্চা রয়ে গেছ ইলা।”

“আমার বয়স অল্প তাই বাচ্চা রয়ে গেছি। আপনি যে এত বড় হয়েও ছেলেমানুষী করেন তার কী হবে?”

“শোনো…”

“কী?”

“একটু দরজার সামনে দাঁড়াবে? কথা বলব না প্রমিজ। শুধু একবার দেখব। আমি অফিসের জন্য বের হচ্ছি। তোমাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। একটাবার আসো। তাতে মায়ের কথা অমান্য করা হবে না। ধরো তুমি এমনি বের হয়েছো, আমিও অফিসের জন্য বের হচ্ছি, দেখা তো হতেই পারে তাই না?”

“আচ্ছা বের হন।”

ইলা দরজা খুলে দাঁড়াল। কানন তার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আগে সুযোগ পেলেও যে কথাগুলো বলা হয়নি, আজ বলার জন্য মন ছটফট করলেও সুযোগটা মিলিয়ে যাচ্ছে। দু’জন বহুকালের তৃষ্ণা নিয়ে দাঁড়িয়ে দুই প্রান্তে। কাননের চোখদুটো স্থির হয়ে আছে ইলার শান্ত মুখের পরে। সারাদিন তাকিয়ে থাকলেও চোখ ব্যথা হবে না। বেশ কিছুক্ষণ পর কানন দরজায় তালা দিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল। ইলার চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সেও ভেতরে ঢুকে পড়ল।

কেউ যদি ইলাকে প্রশ্ন করে, সুখ কী জিনিস তুমি জানো? ইলা উত্তর দিতে পারবে, প্রিয় মানুষটাকে প্রাণভরে দু’চোখে দেখতে পারাটা সুখ।

***

“তুলন, তুমি এখনো আমাকে আপনি করে ডাকছ।”

“সরি! হুট করে হয় না আসলে…”

“ঠিক আছে, এখন তুমি বলো।”

“বললাম। তুমি। হয়েছে?”

“হুম। চলো দেখা করি। কথা হচ্ছে, অথচ দেখাদেখি হচ্ছে না। তোমার সাথে সারাদিন গল্প করে নিজের মন হালকা করি, অথচ একটাবার চোখের দেখা হলো না। তোমার বাসার ঠিকানা বললে একবার কাছাকাছি গিয়ে দেখে আসতাম।”

তুলন ঢোক গিলল। এর আগে এক ছেলের সাথে বাড়ির সামনে দেখা করেছিল বলে জীবনে যে দুর্দশা নেমে এসেছিল সেই রেশ এখনো রয়ে গেছে। এমন ঝুঁকি সে আর জীবনে নেবে? বলল, “আমার বাড়ির লোক দেখে ফেললে সর্বনাশ। তারা ছেলেবন্ধু পছন্দ করে না। আমরা পরশু দেখা করি বোটানিক্যাল গাডেনে?”

“পরশু? আজ বা কাল কী দোষ করল?”

“আজ আর কাল বাবা বাসায় থাকবে। বের হওয়া অসম্ভব।”

আকাশ একটু মন খারাপ করে বলল, “আচ্ছা পরশু।”

“ডান!”

“তুমি শাড়ি পরে আসবে কিন্তু!”

“কেন?”

“শাড়িতেই নারীকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে।”

তুলন হেসে বলল, “আচ্ছা শাড়িই পরব।”

“আর আমি?”

“পাঞ্জাবি।”

“কী রঙের?”

“যেটা ভালো লাগে পরে এসো। দুজনের যদি ম্যাচ হয়ে যায় তাহলে কী দারুণ হবে ভাবো!”

“ঠিক বলেছ।”

“আচ্ছা রাখছি। আমাদের বাসায় এত লোক যে কোনো খালি জায়গা নেই কথা বলার।”

“ছাদে গেলে পারো।”

“পরেরবার ছাদে গিয়ে ফোন করব। এখন রাখি। টেক্সট করো।”

“ওকে!”

***

ইলা শেষ বিকেলের মিষ্টি লালচে আলোর দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তুলনের একবার ইলাকে বলতে ইচ্ছে হলো, তুই দিনদিন সুন্দর হচ্ছিস ইলা! কিন্তু ওর এই মন খারাপের সময়ে আর সেসব বলা হলো না।

তুলন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “শেষ পর্যন্ত হনুমানের জন্য তোর এমন দুর্দশা হবে জীবনে ভাবিনি!”

“আমিও ভাবিনি রে। জীবনটা অনেক কমপ্লেক্স। বেশি সহজভাবে নিয়েছিলাম বলে এত ভোগান্তি হচ্ছে।”

“সহজ কঠিন জানি না। তোর বাবা মা বাড়াবাড়ি করছে। কানন তো সোজা বিয়ের কথা বলেছে। প্রেম করতে তো বলেনি। বিয়ে দিতে আপত্তি কিসের?”

“আমি জানি না।”

“তুই বুঝিয়ে বল।”

“চেষ্টা করছি। সমস্যা হলো কিছু বলতে গেলেই কান্না চলে আসে। গুছিয়ে একটা কথাও আসে না।”

“তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না!”

“ঠিক বলেছিল।”

ইলার চোখে পানি চলে আসে। তুলন এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। “কাঁদিস না ইলা। মানুষের খারাপ সময় আসে, আবার ঠিকও হয়ে যায়।”

ইলা কিছু বলে না। তুলনকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।

***

সাজিদ কিছুদিন ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আজ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সে একটু দেরিতে ফিরেও দেখে বাবা এখনো খাননি। একসাথে খেতে বসে বাবার সাথে অনেক কথা হলো সাজিদের। শরীরের খবর থেকে শুরু করে আশেপাশের লোকজনের খবরাখবরও বাবার কাছে আছে। সাজিদের মজা লাগল। তার ছোটবেলায় দেখা বাবা এরকমই ছিলেন। কত গল্প, আড্ডা, বন্ধুবান্ধব নিয়ে মেতে থাকতেন!

শুতে যাওয়ার আগে রইসুদ্দিন বললেন, “ভোরে উঠতে না পারলে আমাকে ডেকে দিও তো।”

“এত জরুরি কেন?”

“কালকে একটা বিচার সভা বসবে।”

“তোমাকে নিয়ে?” সাজিদের মুখটা হা হয়ে গেল।

“আরে না গাধা। এলাকার যে মেয়েটা কয়েকদিন নিখোঁজ ছিল তাকে নিয়ে।”

“কেন, কী হয়েছে?”

“বিস্তারিত জানি না। বিচার হবে ফজরের পরে মসজিদের সামনে। গিয়ে দেখি কী ঘটনা।”

সাজিদ কী একটা ভেবে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here