বেলীফুল পর্ব-২৯

0
921

#বেলীফুল
পর্ব-২৯

ছোটবেলায় গোয়েন্দা কাহিনী পড়ার সময় মনে হতো গোয়েন্দারাই কেন সব ঝামেলায় জড়ায়? বাস্তবে তো এসব অপরাধ পায়ে পায়ে ঘোরে না! এখন নিরবের মনে হয় আসলে অপরাধ এমন একটা জিনিস, যা সর্বত্র ঘটছে। দেখার মতো চোখ আছে বলেই গোয়েন্দাদের সেসব চোখে পড়ে যায়। আজ সে ঘটনাটার সাথে জড়িয়ে গেছে নিতান্তই কাকতালীয়ভাবে। যেন কোনো অদৃশ্য সুতো তাকে টেনে নিয়ে ফেলেছে সেখানটাতে।

সে সুপার মার্কেটে গিয়েছিল কেনাকাটা করতে। তখন সাজিদের ফোন পেয়ে কথা বলতে বলতে অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিল। এই ফাঁকে ধাক্কা খায় এক মেয়ের সাথে। মেয়েটার হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গিয়েছিল। সাথে ব্যাগ থেকে কয়েকটা কাগজপত্র আর টুকিটাকি। সেসব দ্রুত তুলে নিয়ে মেয়েটা যখন মার্কেট থেকে বেরিয়ে গেছে, তক্ষুনি নিরবের নজরে পড়েছে মেয়েটার ব্যাগ থেকে পড়ে যাওয়া একটা আইডি কার্ড, যেটা ভুলে ফেলে গেছে।

নিরব তক্ষুনি বের হয়ে দৌড়ে গেছে মেয়েটাকে খুঁজতে। শুধু একঝলক দেখেছে একটা গলিতে ঢুকতে। সেখান পর্যন্ত গিয়ে বেশ ঘোরাঘুরির পর একটা রাস্তার মোড়ে এসে যখন মেয়েটার দেখা পেয়েছে তখন ভয়ানক এক ঘটনা ঘটেছে! মেয়েটাকে জোর করে একটা মাইক্রোবাসে তুলে বাসটা এক ছুটে হাওয়া!

নিরব নিজের গাড়ি আনতে আনতে সেটা পালিয়ে গেছে। তার মস্তিষ্ক তখন কাজ করছে অতিদ্রুত। এরকম মাইক্রোবাস কাহিনী সে আজই মাত্র শুনেছে সাজিদের কাছে। এরা সব একই চক্র নয়তো? হওয়াটাই স্বাভাবিক।

সে তখন সাজিদের পাঠানো কয়েকটা ডায়েরির পাতার ছবি থেকে লেখাগুলো পড়ল। হ্যাঁ, এই ডিরেকশন অনুযায়ী গেলে পাওয়া যেতে পারে। মৌরিদের বাড়ি যেখানে, সেখান থেকে মাঝের একটা এলাকা পেরিয়ে দ্বিমুখী রাস্তা পড়ে। ডানের রাস্তা দিয়ে গেলে শহরে যাওয়া যায়, আর বামের পথটা চলে গেছে গ্রামের দিকে। সেখানটাতে কয়েকবার বিভিন্ন কাজে যেতে হয়েছে সাজিদের। ভূতের বাড়ি নামে খ্যাত বাড়িটাও সে দেখেছে বাইরে থেকে। সেটার কথাই কি মৌরি বলেছে? মনে হয় তাই-ই।

নিরব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছে ভূতের বাড়ির কাছাকাছি। বাইরে থেকে দেখেই বুঝেছে ভেতরে মানুষ আছে। লোকগুলো আলো জ্বালায়নি ঠিক, কিন্তু মানুষ থাকলে বাড়ির মধ্যে প্রাণের সাড়া জেগে ওঠে, বাড়ির নৈশব্দের ঘুম ভেঙে যায়।

মাইক্রোবাসটাও আবিষ্কার করে ফেলেছে নিরব। এখন শুধু ভেতরে কোনোভাবে দেখা যে হচ্ছেটা কী! মেয়েটাকে বাঁচাতেই হবে যে করে হোক। এক্ষুনি ওদের আক্রমণ করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু সে একা এতগুলো লোকের বিপক্ষে কিছুই করতে পারবে না, উল্টে বিপদ বাড়বে।

নিরব একটু দূরে গিয়ে দুটো ফোন করল। এক তার পুলিশ বন্ধুকে, যে তাকে বিশ্বাস করে অন্ধের মতো। আরেকটা ফোন করল সাজিদকে। মৌরি নামক মেয়েটাকে নিয়ে আসলে বোঝা যাবে তার সাথে যা হয়েছে, এখানেই হয়েছে কি না!

***

মৌরি একটা ম্যাগাজিন হাতে চুপচাপ বসে আছে। পড়ছে না। তার মন পড়ে আছে যোজন দূরে কোনো এক নির্জন স্থানে, যেখানে কেউ তাকে চেনে না। একটা ছোট্ট কুটিরে সে একা বাস করে। নিজের মতো খুশি থাকে। তার চেহারা এতটা কুৎসিত যে কোনো পুরুষ মানুষ তার দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকায় না৷ হ্যাঁ, এই স্বপ্নটাই সে এখন বারবার দেখে। সে যদি পালিয়ে যায় এখান থেকে, তো কেমন হবে?

মোবাইলের ভাইব্রেশনের শব্দ তার কানে গেল একটু দেরিতেই। তখন দ্বিতীয়বারের কলটা কেটে গিয়ে তৃতীয়বারের মতো ভোঁ ভোঁ শব্দে মোবাইলটা জানান দিচ্ছে কেউ মৌরিকে স্বরণ করছে ব্যকুল হয়ে।

মৌরি দেখল সাজিদ। এই ছেলেটা খুব ভালো। মৌরির এত ভালো লেগেছে ওকে! মনে হয়েছে সব কথা এই মানুষটাকে বলে ফেলা যায়। মৌরির স্বভাবজাত গুণ হলো সে খুব দ্রুত বন্ধু বানিয়ে ফেলতে পারে, আর দোষ হলো, সেই বন্ধুত্ব টেকে না। সাজিদ বলেছে তাকে সাহায্য করবে। কতটা করতে পারবে কে জানে! ফোন ধরল মৌরি।

“হ্যালো।”

“মৌরি শুনুন, একটা জরুরি দরকার।”

“বলুন।”

“আপনি একটু বের হতে পারবেন? একটা ঝামেলা হয়েছে।”

“কোথায় যাব?”

“গেলেই দেখতে পাবেন। আপনি এলে খুব উপকার হয়। আপনারও আর আরেকজনেরও।

মৌরি ইতস্তত করতে থাকল। যত ভালোই হোক, সাজিদও একটা পুরুষ, যাকে সে ভালোমতো চেনে না এখনো। ডাকলেই চলে যাবে?

সাজিদ বোধহয় বুঝল ব্যাপারটা। সে খুব আন্তরিক গলায় বলল, “আমি আপনার চিন্তাটা ধরতে পারছি মৌরি। বাট….ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি। ইউ হ্যাভ নো এনাদার অপশন! ছেলেগুলোকে ধরতে হলে আপনাকে এক্ষুনি বের হতে হবে।

মৌরি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “বের হচ্ছি। আপনি কোথায়?”

“আপনার বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি।”

“আচ্ছা আমি কি বাবাকে নিয়ে যেতে পারি?”

“অবশ্যই!”

***

তুলন কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে হেঁচকি তুলছে। ভয়ে আতঙ্কে অসাড় হয়ে গেছে শরীর। জ্ঞান হারিয়েছে বার কয়েক। এখন জোর করে কী একটা পানীয় তাকে গিলিয়ে দেয়া হয়েছে, শরীর অসুস্থ লাগছে। গা গুলিয়ে বমি পাচ্ছে।

ছেলেগুলো পাশেই বসে মদ খাচ্ছে। আকাশের এই রূপ সে কোনোদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেনি! যে চেহারার প্রেমে পড়েছিল সেটা এখন দেখাচ্ছে রাক্ষসের মতো। ওরা বাতি জ্বালায়নি। পাছে গ্রামের লোক সন্দেহ করে এদিকটায় চলে আসে! যদিও জায়গাটা পরিত্যক্ত বলা যায়, তবু রিস্ক না নেয়াই ভালো।

বাইরে আজ বাঁধভাঙ্গা জোছনার আলো উপচে পড়ছে। সেই আলোতে পাঁচটা ছেলেকে নরক থেকে পালিয়ে আসা শয়তানের প্রতিচ্ছবি মনে হচ্ছে। একটু পর ওরা কী করবে ভেবে কেঁপে কেঁপে উঠছে তুলন। চোখের বাঁধন খুললেও তার মুখ বাঁধা। চিৎকার করার আপ্রাণ চেষ্টা করেও লাভ নেই।

একসময় উঠে দাঁড়াল আকাশ। নেশা ধরা গলায় বলল, “আমার জিনিস, আমি আগে যামু।”

বলেই টলোমলো পায়ে এগিয়ে আসতে থাকল সে। তুলনের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে এমন সময় থামতে হলো তাকে। বলা ভালো, থামিয়ে দেয়া হলো। এই দলের সবচেয়ে ঠান্ডা যে ছেলেটা, ইতিমধ্যে ডাকাডাকিতে শুনেছে তুলন, ছেলেটার নাম অর্ক, কাঁধে হাত রেখে থামিয়ে দিয়েছে আকাশকে।

শীতল গলায় সে বলল, “আমি লিডার, আগে আমি। তারপর তোরা।”

আকাশ মুখ খারাপ করে গালি দিল, “শালা তোর…”

একটা প্রচন্ড চড়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিল অর্ক। লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল দূরে। অন্যরা এগিয়ে এসে টেনে ঘরের কোণে নিয়ে গেল আকাশকে। অতিরিক্ত নেশা করে আকাশের অবস্থা এমনিতেও খারাপ। চড় খেয়ে এখন বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে।

অর্ক ঘুরে আবার আকাশের কাছে চলে গেল। আরেকটা ভীষণ চড় দিয়ে বলল, “আরেকবার শব্দ করলে তোর…”

আকাশ চুপ হয়ে গেল। বোতলের টুংটাং আর ঝিঁঝির একঘেয়ে ডাক ছাড়া অন্য কোনো শব্দ রইল না। অর্ককে দেখে মনে হয় না সে নেশা করেছে। অথচ সে-ই সবার চেয়ে বেশি গিলেছে।

তুলনের কাছে এগিয়ে এসে সে মুখ নামাল। বিচ্ছিরি গন্ধে তুলনের পাকস্থলী উল্টে আসতে চাইল। ধীরেসুস্থে নিজের জামাকাপড় খুলে ফেলল অর্ক। তারপর এগিয়ে এলো তুলনের খুব কাছে। ওর গায়ে হাত রাখল। তুলনের শরীর তখন মৃগী রোগীদের মতো কাঁপছে। অর্ক যেন খুব মজা পেয়ে গেল তাতে। দাঁত বের করে পিশাচের মতো হাসল সে। তুলন জ্ঞান হারাল আবারও।

***

পুলিশ ফোর্স ভেবেছিল চারদিকে পজিশন ঠিক করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে বাড়ির কাছে। আক্রমণ করবে অতর্কিতে। কিন্তু পরিকল্পনা করতে করতেই শুনতে পেল ভেতর থেকে ধস্তাধস্তির আওয়াজ আসছে। মারামারি লেগেছে বোধহয়। পুলিশের দল হুড়মুড় করে তখন ঢুকে পড়ল ভেতরে। টর্চের আলোয় দেখা গেল পাঁচটা ছেলে জটলা বেঁধে হাতাহাতি করছে। তার মধ্যে একজনের গায়ে কোনো কাপড়চোপড় নেই। মূলত তার আর ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটার মধ্যে মারামারি হচ্ছে, বাকিরা থামানোর চেষ্টা করছে। একধারে একটা মেয়ে পড়ে আছে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায়। একজন মহিলা কনস্টেবল দ্রুত গিয়ে মেয়েটার গায়ে কাপড় জড়িয়ে দিল। ততক্ষণে অন্যরা ছেলেগুলোকে আলাদা করে ফেলতে পেরেছে।

আকাশ সমানে খিস্তিখেউড় করে যাচ্ছে। তার কিছুতেই সহ্য হয়নি তুলনকে আগে অন্য কেউ পেয়ে যাবে। নেশা না করলে সে অর্ককে কোনোদিন কিছু বলার সাহস পেত না। কিন্তু মদ খেয়ে মাথা এত বিগড়ে গেছে যে কে কী সেসব মাথায় নেই। অর্ককে তুলনের কাছে যেতে দেখে হিংস্র শ্বাপদ ভর করেছিল তার গায়ে। এক ছুটে গিয়ে মদের বোতল দিয়ে বাড়ি মেরেছিল অর্কর মাথায়। ওর মাথায় বোধহয় কেটে গেছে, রক্ত পড়ছে ঘাড় বেয়ে। অর্কও তখন আকশকে প্রাণপণে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। এক ঘুষিতে দুটো দাঁতও ফেলে দিয়েছে।

বিদ্ধস্ত ধর্ষক দলটাকে যখন পুলিশের দল বেঁধে ফেলেছে, তখন মৌরিরা এসে পৌঁছুল সেখানে। বাড়িটা চিনতে পারল মৌরি। এখানেই এনেছিল তাকে। আর ছেলেগুলোও এরাই ছিল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here